#তোমার_আমার_চিরকাল🌸
|| পর্ব – ২৭ ||
#লেখনীতে_বিবি_জোহরা_ঊর্মি
চোখের কোণে জমেছে ধুঁলো,
আঁধারে কাটে বারোমাস।
প্রণয়িনীর আগমনে,
হয়েছে আমার সর্বনাশ!
নিদারুণ শব্দগুচ্ছ দিয়ে লেখা সুন্দর চারটি লাইন দেখে বিশ্মিত হয় মীরা। বাবার বাসা থেকে আসার পর জামা কাপড়গুলো আলমারিতে রাখছিল সে। তখনই একটা ডায়েরি চোখের সামনে দেখল। ডায়েরিটা হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ নেড়ে চেড়ে ভাবলো এটা খুলবে কিনা। ভেবে চিন্তে অবশেষে খুলেই ফেললো। অতঃপর ডায়েরির প্রথম পাতায় এই চারটি লাইন দেখতে পেয় সে। আহানের ডায়েরিও লেখে? পুলিশ মানুষ এতো সময় পায় কিভাবে? পরের পৃষ্টা উল্টিয়ে আরও কিছু লেখা পায় সে। চুপচাপ কাজ ফেলে ডায়েরি নিয়ে বসে পড়ে বিছানায়। পরের পৃষ্টায় যা লেখা আছে তা পড়তে থাকে।
“তাকে আমি ভালোবেসেছি প্রকাশ্যের আড়ালে, গোপনতার ভিড়ে। যে ভালোবাসায় কোনো খাঁদ নেই। সে আমার অপূর্ণতায় পূর্ণতা। যে ভালোবাসা কখনো পুরাবার নয়। সে আমার আত্মতৃপ্তিতে পরিশুদ্ধি। দিন শেষে সে আমার এক চিলতে দীর্ঘঃশ্বাস। তবুও সে আমার মানসিক শান্তি। এক টুকরো ভালো লাগা।”
মীরা স্তব্ধ। আহানের হাতের লেখা বেশ সুন্দর। কাকে নিয়ে এসব লিখলো সে? তাকে নিয়ে? সত্যি!
তাকে নিয়ে এতো সুন্দর অনুভূতি ছিল আহানের মনে? গোপনেও এতো ভালোবাসা যায়? মীরার চোখের কার্ণিশে জল এলো। আহান তাকে এতো ভালোবাসে। অথচ প্রকাশ করেনি কখনো। এখনও বলেওনি সে মীরাকে ভালোবাসে। শুধু বলেছে পছন্দ করে। মীরা ডায়েরিটা বন্ধ করে আলমারিতে রেখে দিল। বাকি যে জামা কাপড়গুলো ছিল, সেগুলো ভাজ করে আলমারিতে রেখে দিল। নিজেকে গুছিয়ে নিচে চলে গেল।
আয়ানের মা রান্না করছিলেন। অনেক সুন্দর ঘ্রাণ বেরিয়েছে। মীরা মুচকি হেসে তার কাছে গেল বলল, “আমায় রান্না শেখাবেন মা?”
কিংকর্তব্যবিমূঢ় আয়ানের মা! আজ প্রায় এক মাসের মতো হয়ে গেল আহানের বিয়ের। এই মেয়েকে কখনো রুম থেকে বেরোতেই দেখেনি সে। হঠাৎ আজ ঘটা করে মা বলে রান্না শিখতে এসেছে? আশ্চর্য! উনি বললেন, “আমি যা’কে তা’কে রান্না শেখাই না।”
“যা’কে তা’কে কেন বলছেন মা? আমি আপনার ছেলের বউ।”
“আমার ছেলে একটাই, আর তার এখনো বিয়ে হয়নি।”
মীরা খানিকটা হাসলো। আয়ানের মা মীরার হাসি দেখে বোকা বনে গেল। এই মেয়ে কি পাগল? এভাবে হাসছে কেন?
মীরা বলল, “আপনি ভুল করছেন মা। আপনার দুই ছেলে। বড়োটার নাম আহান ও ছোটটার নাম আয়ান।”
“আহান আমার ছেলে নয়।”
“দেখুন মা, আজ বাদে কাল যদি মরে যান। তাহলে আপনার খাটিয়া শুধু এক ছেলেই ধরবে। যদি আপনি মন থেকে আপনার অন্য ছেলেকে মেনে নেন তাহলে দুজনেই আপনার খাটিয়া ধরবে। লোকে আপনাকে দেখে শিখবে। কে বলতে পারে, হয়তো দুই ছেলেকে কাছে টানায় আপনি হয়ে উঠবেন আদর্শ মা।”
“এসব জ্ঞান আমাকে দিবে না।”
“জ্ঞান নয় মা। সত্যি কথা। আপনি নিজেই ভাবুন। সে কি দোষ করেছে? আপনি যখন এখানে এসেছেন সে তখন একটা ছোট বাচ্চা ছেলে ছিল। আপনি কেন তাকে মেনে নেন না? একটা ছোট বাচ্চাকে দেখলে তো সবাই আদর করে। এগিয়ে আসে। তাহলে আপনি কেন পিছনে গিয়েছেন?”
“তুমি আমাকে রাগাচ্ছ কিন্তু।”
“আমি চাই আপনি রাগুন। কারণ আমি যা বলছি সব আপনার ভালোর জন্যই বলছি। তাকে কেন আপনি দূরে দূরে রাখেন? সে আপনার ছেলে নয় বলে? একটা অনাথকেও তো মানুষ দত্তক নিয়ে নিজের সন্তানের মতো লালন পালন করে। তাহলে আপনি কেন এতো অবহেলা করলেন তাকে?”
আয়ানের মা চুপ করে রইলো। চুলোর আগুন নিভিয়ে দ্রুত নিজের ঘরে চলে গেল। মীরা তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, “একদিন আপনি ঠিক বুঝবেন মা। সেদিন আপনি নিজে থেকে ওনাকে কাছে টেনে নিবেন।”
–
টুংটাং গিটারের শব্দ মীরার কানে বাজছে। এই দুপুরবেলা হঠাৎ কার মাথায় ভুত চাপলো গিটার বাজানোর! মীরা আওয়াজ অনুসরণ করে রুম থেকে বের হলো। দোতলার বারান্দা দিয়ে ড্রয়িংরুমে চোখ বুলিয়ে দেখে এখন কেউই নেই সেখানে। আওয়াজটা আসছে দোতলা থেকে। আহান তো এখনো আসেনি। তাহলে নিশ্চয়ই এটা আয়ান হবে। মীরা চুপিচুপি আয়ানের রুমের দিকে পা বাড়ালো। দরজাটা চাপানো ছিল, মীরা আস্তে করে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে। আয়ান বিছানায় বসে অন্যদিকে মুখ করে মনের আনন্দে গিটার বাজাচ্ছে। আয়ানের পিছনের দিক মীরার দিকে। আর সামনের দিক আয়ানের বারান্দা বরাবর। মীরা পা টিপে টিপে আয়ানের কাছে গেল। পিছন থেকে জোরে আয়ানকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করলো। “ভাউউউ।””
আয়ান এক লাফ দিয়ে উঠল। “আ…আম্মুউউউ!!”
মীরা খিলখিলিয়ে হেসে উঠে। আয়ান পিছনে তাকাতেই মীরাকে লক্ষ্য করে। এটা মীরা ছিল। আয়ান মীরার হাসি দেখে দাঁতে দাঁত চেপে বলে, “তুমি এখানে? তুমি আমাকে ভয় দেখাচ্ছ?”
মীরা হাসতে হাসতে বলে, “তুমি কি বাচ্চা যে ভয় পাচ্ছ। আর এই দুপুর বেলা কেউ গিটার বাজায়? খেয়েছ তুমি?”
“এতো প্রশ্ন কেউ একসাথে করে!”
“একসাথে করলাম, একসাথেই উত্তর দাও।”
“আমার ইচ্ছে হয়েছে তাই বাজাচ্ছি। তোমার সমস্যা? বাচ্চা নই আমি। যথেষ্ট বুদ্ধি আমার আছে। আমি কি তোমার মতো মাথামোটা নাকি।”
মীরা কিঞ্চিৎ রেগে গেল। “অ্যাঁই! কি বললে? আমি মাথামোটা?”
“হ্যাঁ, তাই। কেন যে আমার ভাই তোমায় বিয়ে করলো। ইশ! আমার ভাইয়ের জন্য আমার খুউউব আফসোস লাগছে।”
মীরা রাগে ফোসফাস করছে। আর তা দেখে আয়ান মিটিমিটি হাসছে। “তোমার কপালে আমার থেকেও খারাপ মেয়ে জুটবে দেখো। অ্যাঁহ! আসছে। আমাকে বিয়ে করে নাকি তার ভাই গঙ্গার জলে ভেসে যাচ্ছে একেবারে।”
“তুমি অভিশাপও দিতে জানো! অবশ্য তোমার অভিশাপ লেগেও যেতে পারে। রাক্ষসীদের অভিশাপ দ্রুত লেগে যায় শুনেছি।”
মীরা আয়ানের কথায় দাঁতে দাঁত চেপে ধরে। চোখগুলো রক্তচন্দ্রিমার মতো হয়ে আছে। ফোসফাস করতে থাকে। আয়ান তখন বলল, “এভাবে সাপের মতো ফোসফাস করছ কেন? ছোবল দিবে নাকি? দাও তো দেখি। আমিও কিন্তু সাপের রাজা হতে পারি। তুমি আমায় কি ছোবল দিবে, তার দশগুণ তোমায় ফেরত দিব। আমার শক্তির সাথে তুমি পারবে?”
মীরা আয়ানের হাত থেকে গিটারটা নিয়ে স্ব জোড়ে ফ্লোরে ফেলে দেয়। আয়ান হতবিহ্বল চাহনিতে গিটারের দিকে তাকিয়ে আছে। গিটারের দুটো তার ছিঁড়ে গেছে। আয়ান দুঃখী দুঃখী মুখ করে বলে, “এটা কি করলে তুমি? আমার এতো শখের গিটার তুমি ভেঙে দিলে?”
“বেশ করেছি। আর রাগাবে আমায়? তুমি আমার রাগের মাত্রা ছাড়িয়ে গেছ। আমি আর তোমায় আর সাহায্য করব না।”
মীরা চলে যেতে নিলেই আয়ান মীরার সামনে এসে বলে, “আরে, আরে। কোথায় যাচ্ছ। প্লিজ এমন করো না। এই দেখো আমি কান ধরলাম।”
আয়ান মীরার সামনে কান ধরে উঠ বস করে। মীরার ভ্রুক্ষেপ নেই তাকে। সে অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। আয়ান কিছুক্ষণ উঠ বস করার পর বলে, “কি গো! স্যরি তো। আর তোমায় রাগাবো না। তুমি প্লিজ আমায় সাহায্য করো।”
“সামনে থেকে সরো।”
“স্যরি তো। প্রমিস আর তোমায় রাগাবো না। আমিতো মজা করছিলাম তোমার সাথে। কিন্তু কে জানতো তোমার এতো রাগ! বাপরে। আমার গিটারটা কত জোড়ে ফেললে। নষ্ট হয়ে গেছে। এখন আমি কিভাবে সুর তুলবো বলো।”
“আরো রাগাও আমাকে। পথ ছাড়ো, আমি যাচ্ছি। তোমার ভাইয়া আসবে এক্ষুণি।”
মীরা হনহন করে ওখান থেকে বেরিয়ে যায়। আর আয়ান অসহায় দৃষ্টিতে তার গিটারটার দিকে তাকিয়ে থাকে।
_
দুপুরের শেষে আয়ান আসলো বাসায়। মীরা বিছানায় বসে পা দুলিয়ে এসির হাওয়া খাচ্ছে। দরজায় চোখ পড়তে আহানকে দেখে সে। গায়ে পুলিশের পোশাক। চোখে কালো সানগ্লাস। মীরা কিছুক্ষণ অপলক দৃষ্টিতে আহানের দিকে তাকিয়ে রইলো। মীরার চোখে আহানকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুদর্শন পুরুষ মনে হচ্ছে। এই সুদর্শন পুরুষটা তার ব্যক্তিগত সম্পত্তি। আহান নিজের জুতোগুলো খুলতে লাগলো। চোখ থেকে চশমাটা খুলে টেবিলের উপর রাখলো। পুলিশের শার্টটা খুলতে যাবে, এই সময় মীরা এসে তাকে জড়িয়ে ধরে। আহান স্তম্ভিত। মীরার হঠাৎ কি হলো। সে মীরাকে প্রশ্ন করে। “কি হয়েছে তোমার? মন খারাপ?”
“উঁহু।”
“তাহলে! এভাবে জড়িয়ে ধরলে যে? কিছু হয়েছে? কেউ কিছু বলেছে তোমায়? নাকি বাসার কথা মনে পড়ছে।”
“ওসব কিছুনা।”
“তাহলে হয়েছে টা কি?”
“কিছু হয়নি তো। আমার ইচ্ছে হয়েছে তাই এমন করেছি। আপনার কোনো সমস্যা?”
“দেখি ছাড়ো। আমার গায়ে ঘামের গন্ধ। তোমার ভালো লাগবে না।”
“আপনার সবকিছুই আমার ভালো লাগে।”
“আজ হঠাৎ এতো ভালোবাসা? কি ব্যপার!”
“আপনি আমায় খুব ভালোবাসেন না? বলেননি কেন আমাকে?”
“এসব কথা এখন উঠছে কেন? আমি ফ্রেশ হবো।”
“কোথাও যাবেন না আপনি। প্লিজ আর একটু এভাবে থাকি না। আমার ভিষণ ভালো লাগছে।”
“তোমার যে হঠাৎ আজ কি হলো।”
আহান চুপ। মীরা আহানের বুকে মাথা রেখে প্রশান্তির হাসি দিচ্ছে। আহানের যে খারাপ লাগছে তাও না। আহানের আরও দ্বিগুণ ভালো লাগছে।
চলবে…