#তোমার_আমার_চিরকাল🌸
|| পর্ব – ৭ ||
#লেখনীতে_বিবি_জোহরা_ঊর্মি
নিজের রুমে বসে ফেসবুক স্ক্রল করছিল মীরা। হঠাৎ তার সামনে একটা আইডি চলে এলো। আইডিটা আহানের। প্রোফাইলে আহানের সুন্দর একটা ছবি দেওয়া আছে। আইডির নাম আব্রাহাম মাহমুদ আহান। মীরা সাত পাঁচ না ভাবেই আহানের আইডিতে ঢুকে। তেমন কোনো পোস্ট বা পিক নেই ওর আইডিতে। মীরা আহানের প্রোফাইল পিক টা জুম করলো। আহানকে দারুণ লাগছে পুলিশের পোশাকে৷ মীরা মুচকি হাসলো। দুইহাতের দুটো বৃদ্ধা আঙুলের সাথে আঙুল ঘষতে ঘষতে ভাবছে, রিকুয়েষ্ট পাঠাবে কিনা। চোখ বন্ধ করে রিকুয়েষ্টও পাঠিয়ে দিল। তারপর ডাটা অফ করেই ফোনটা বিছানায় ছুঁড়ে ফেললো।
মীরা এখনো চোখ বন্ধ করে আছে। ও আহানকে নিয়ে কেন এতো ভাবছে?
.
রাতের খাবার খাচ্ছিল মীরারা সবাই মিলে। ডাইনিং টেবিলে বসে আছে মীরা, মীরার বাবা, দাদি ও মিরাজ। খাবার সার্ভ করছে মীরার মা ও ভাবি। মীরার মা খাবার সার্ভ করতে করতে বললেন, “মা ফোন করেছিল। বলেছে মিরাজ যেন তার বউকে নিয়ে কাল গ্রামের বাড়িতে যায়। উনি মিরাজের বউকে দেখতে চেয়েছেন। অসুস্থতার জন্য তো বিয়েতে আসতে পারেননি। তাছাড়া মীরার মামারাও কল করে ওদের যেতে বলেছেন। মীরাকেও নিয়ে যেতে বলেছেন।”
খাবার টেবিলে নিরবতা। কিছুক্ষণ পর মীরার বাবা বললেন, “কাল শুক্রবার। ব্যাংক বন্ধ। মিরাজ, তুমি মীরাকে আর বৌমাকে নিয়ে কাল সকালেই রওনা দিও। অসুস্থ মানুষ, দেখতে চেয়েছেন যখন যেও।”
মিরাজ আর কিছু বলে না। সবাই খাওয়ায় মনোযোগ দেয়। খাওয়া শেষ করে মীরা তার রুমে চলে আসে।
রুমে আসার পর মীরা নিজের ফোনটা হাতে নিতেই দেখে তুর্য ওকে অনেকগুলো কল দিয়েছে। আর একটা মেসেজ করে বলেছে অনলাইন হতে। মীরা ডাটা অন করে। সাথে সাথেই তুর্যর কল আসে। ভিডিও কল! মীরা কলটা রিসিভ করে। তুর্য ওপাশ থেকে বলে, “কই থাকিস রে?”
“বাসায় থাকি।”
“বাসায় থাকলে কল ধরিস না কেন? কতোগুলো কল দিলাম।”
মীরা বিছানায় বসতে বসতে বলে, “খাবার খেতে গিয়েছিলাম।”
“কেমন আছিস? একটা কলও দিস না কেন তুই?”
“তুর্য ভাই! স্যরি। আমার তোমার খোঁজ নেওয়া উচিৎ ছিল।”
“হইছে, এখন বল কেমন আছিস?”
“আলহামদুলিল্লাহ, ভালোই। তুমি?”
“আলহামদুলিল্লাহ। মোটামুটি আছি।”
“কি করো?”
“কাজ করছি রে। বাসায় বসেও কাজের শেষ নেই।”
“ক্লান্ত হয়ে গেলে নাকি?”
“হুম। কেন যে চাকরি করতে নিলাম।”
“চাকরি না করলে খাবে কি আর তোমার বউকে খাওয়াবে কি?”
“আমার যে বউ হবে না, সে আমাকেই ভালোবাসবে। আমার চাকরি দেখে নয়।”
“বাবার পয়সায় কি আর সারাজীবন চলা যায়?”
“এই, তুই আমাকে এতো জ্ঞান দিচ্ছিস কেন? আমি কিন্তু তোর বড়ো।”
“এমন বড়ো হও যে, সামান্য বোধবুদ্ধিও নেই। শুধু কথার প্যাঁচ জানো।”
তু্র্য রেগে আগুন। “আমায় এভাবে বললি তুই?”
মীরা খিলখিল করে হেসে উঠে৷ মীরার হাসি দেখে তুর্যর রাগ উড়ে যায়৷ সেও বাঁকা হাসে৷ তুর্য বলে, “এই হাসিটা সারাজীবন ঠোঁটের কোণে জড়িয়ে রাখিস মীরু৷ কখনো হারাতে দিস না।”
মীরা অবাক হয়ে তুর্যর দিকে তাকায়৷ খুব সুন্দর কথা বলে তো তুর্য। মীরা বলে, “রাখতে চাই। যদি ভালো কিছু আমার জীবনে থেকে থাকে, তো আমার এই হাসি সারাজীবন থাকবে।”
“ইন-শা-আল্লাহ। দেখিস তুই একদিন অনেক সুখি হবি।”
“আচ্ছা বুঝলাম। খেয়েছো তুমি?”
“হ্যাঁ, খেয়েছি। তোর সাথে সারাদিন কথা বলতে ইচ্ছে করে, বাট কাজের চাপ এতো বেশি যে আম্মুকেও ফোন দিতে পারিনা।”
“কাজে মন দাও। এতো ফোন দিতে হবে না।”
“আমার ফোনে কি তুই বিরক্ত হোস?”
“তা কেন হবে? উল্টো বুঝো তুমি।”
“আচ্ছা। তাহলে ঘুমিয়ে পড়।”
“কাল নানুর বাড়ির যাচ্ছি।”
“আমাদের গ্রামের বাড়ি! কেন?”
“নানু বলেছে। আমি ভাইয়া আর ভাবি যাচ্ছি।”
“আচ্ছা, গিয়েই কিন্তু আমাকে কল দিবি হ্যাঁ?”
“আচ্ছা দিবনে।”
“বায়।”
মীরা কলটা কেটে দিল৷ বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। তারপর আবার ফোনটা হাতে নিল। অনলাইনে যখন আছেই তখন মীরা চেক করে দেখে আহান তার রিকুয়েষ্ট অ্যাকসেপ্ট করেছে কিনা। কিন্তু আহান মীরার রিকুয়েষ্ট অ্যাকসেপ্ট করেনি। নীরা রেগে গিয়ে বলে, “দেখে তো ভালোই মনে হতো। আপনার এতো অ্যাটিটিউড মিস্টার আহান? ঠিকাছে। আমিও মীরা। দেখি আপনি কিভাবে এই অ্যাটিটিউড নিয়ে থাকেন।”
মীরা এসব বলছিল আর তখনই মীরার রুমে মিরাজ চলে আসে। মিরাজ মীরাকে বলে, “কি বলছিস রে?”
পিছন থেকে মিরাজের কন্ঠ শুনতে পেয়ে মীরা ভয়ে ফোনটা বিছানায় ছুড়ে ফেলে। তারপর মিরাজের দিকে ফিরে এক ঢোক গিলে বলে, “কিছুনা ভাইয়া।”
মিরাজ মীরাকে কিছুই জিগ্যেস করে না। মিরাকে বিছানায় বসতে বলে। মীরা বসে। পাশে মিরাজও বসে। মিরাজ বলে, “কাল আমাদের সাথে আহানও যাবে।”
মীরা হুট করেই রেগে যায়। আহান? “কেন ভাইয়া? কি দরকার ওনাকে সাথে নেওয়া? তাছাড়া তোর বন্ধুর কি সময় আছে আমাদের সাথে যাওয়ার? পুলিশ মানুষ!”
কিছুটা অভিমানী কণ্ঠে বলে মীরা। মিরাজ বলে, “আহানের সাথে কথা হয়েছে, ও বলেছে কাল সকালে থানায় একবার যাবে, কিছু কাজ আছে সেড়ে তারপর আমাদের সাথে যাবে। তারপর বিকেলের দিকে আমি আর আহান আবার চলে আসব।”
মীরা কাচুমাচু হয়ে মিরাজকে বলে, “ভাইয়া! একটা কথা জানতে চাইবো।”
“বল।”
“সেদিন উনি তোকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছিলেন? কি হয়েছিল ওনার?”
মিরাজ কিছুক্ষণ চুপ থাকে। মীরা উত্তর পাওয়ার অপেক্ষায় মিরাজের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। মিরাজ কিছু বলছে না। তবে সে বেশ গম্ভীর হয়ে চিন্তায় মগ্ন আছে। মীরা মিরাজকে আবারও বলে, “ভাইয়া? বল।”
“আসলে মীরা, আহান খুব আপসেড।”
“কেন?”
“আহানের নিজের মা নেই। ওর বাবা ওর মা মারা যাওয়ার পর আবার বিয়ে করে। কিন্তু সে আহানকে মোটেও সহ্য করতে পারেনা। আহান মা মা বলে ছোটবেলায় কতো ডাকতো। কাছে যেতে চাইতো। কিন্তু উনি দূর দূর করে ওকে তাড়িয়ে দিতেন। ওনার একটা ছেলে হওয়ার পর সারাক্ষণ তাকে নিয়েই থাকতেন। আহান তখন একা রুমে বসে কাঁদতো।”
মীরা স্তব্ধ হয়ে রইলো। আহানের জীবনে এতো কষ্ট? মীরা জিগ্যেস করলো, “ওনার বাবা কিছু বলতেন না?”
“বললেও বা কি হবে। সব ওনার হাতের বাহিরে চলে গেছে। বলেও লাভ হয়না। ওর সৎ মা ওকে নানা ধরনের কথা বলে অপমান করে। ওর মাকে নিয়ে কুটুক্তি করে। এসব আহান সহ্য করতে পারে না। আহান এসব শুধু আমার সাথেই শেয়ার করতো। ও নিজেকে সব সময় কাজের মধ্যে ব্যস্ত রাখতো যাতে এসব থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারে। সেদিনও এর সৎ মা ওর মা’কে নিয়ে বাজে কথা বলেছেন। তাই ও কেঁদেছে। আমার কাছে চলে এসেছে। আহানের সাথে আমার বন্ধুত্ব হয় ক্লাস সিক্স থেকে। অনেক সহজ এবং সরল মনের ছেলে আহান। আমাদের বাসার দুটো বাসা পরেই ওদের বাসাটা। তুই ওকে দেখিসনি কারণ ও ছবি তোলা খুব একটা পছন্দ করেনা। এতোদিন ও চট্রগ্রামে ছিল। এখন এখানে বদলি হয়ে এসেছে।”
মীরা চুপচাপ তার ভাইয়ের কথা শুনছিল। একটা মানুষের ভিতরে এতো কষ্ট লুকিয়ে আছে? কিভাবে কাটে তার সময়গুলো? মিরাজ বলে, “আচ্ছা যাই। ঘুমা তুই।”
মিরাজ চলে গেলো। কিন্তু মীরা এখনো আহানের কথাই ভাবছে। আহানের মা নেই?
মীরার ঘোর কাটে ফেসবুক নোটিফিকেশন এর আওয়াজে। মীরা ফোনটা হাতে নিয়ে দেখে আহান তার রিকুয়েষ্ট অ্যাকসেপ্ট করেছে। মীরা মুচকি হাসে। যাক! যতটা অ্যাটিটিউট আছে ভেবেছিল ততটাও নেই। হয়তো অনলাইন না হওয়ায় মীরার রিকুয়েষ্ট পাঠানো টা আহান দেখতে পায়নি। মীরা উঠে রুমের দরজা বন্ধ করে দেয়। তারপর নিজের বিছানায় শুয়ে পড়ে। আর মনে মনে বলে, “কাল দেখা হচ্ছে ইনিস্পেক্টর সাহেব। তৈরি থাকুন৷ মীরা আপনাকে কথার জালে ফাঁসাবে।”
চলবে…