#তোমার_আমার_চিরকাল🌸
|| পর্ব ২৫ ||
#লেখনীতে_বিবি_জোহরা_ঊর্মি
আহানকে হসপিটাল থেকে রিলিজ করে দেওয়া হলো। মীরা আহানকে নিয়ে কেবিন থেকে সবে বের হলো। কেবিনের বাহিরে আসতেই আহান দেখে, কাল রাতের ছোট মেয়েটা ও তার মা এসেছে। ছোট মেয়েটা মীরার আঁচল ধরে টানছিল। আহান ভ্রু কুচকালো। এরা এখানে কি করছে সেটাই প্রশ্ন আহানের। তখন মেয়েটির মা মীরার এক হাত ধরে বলল, “তোমাকে আবারও ধন্যবাদ জানাতে এলাম বোন। তুমি না থাকলে হয়তো আমার মেয়েটাকে হারিয়ে ফেলতাম। অসংখ্য ধন্যবাদ বোন।”
মীরা বলল, “আরে, কি বলছেন, আমার জায়গায় অন্য কেউ হলেও একি কাজ করতো। ধন্যবাদ দেওয়ার কিছু নেই।”
আহান মহিলাটিকে জিগ্যেস করল, “কি হয়েছে? আপনি মীরাকে ধন্যবাদ দিচ্ছেন কেন?”
মহিলাটি তখন বলল, “আসলে আমার মেয়েটা কথা বলতে পারেনা। রাতের বেলায় হাটতে হাটতে এখানে চলে আসে। আমি তাকে অনেক খুঁজেছিলাম, কিন্তু পাচ্ছিলাম না। বিশ্বাস করবেন না আমি অনেক ভয় পেয়েছিলাম যে ওকে হারিয়ে ফেলেছি বোধয়। কিন্তু উনি আমার মেয়েকে আমার কাছে নিয়ে আসেন। মেয়েকে দেখার পর আমার জানে পানি এলো।”
আহান এসব শুনে মীরার দিকে তাকালো। মীরা চোখ নামিয়ে ফেলে। আহানের এখন খারাপ লাগছে, না জেনে মীরাকে কত কথাই না বলে ফেলল সে। অথচ মীরার কথা একবার শোনার চেষ্টাও করেনি। মীরা ছোট মেয়েটিকে আদর করে দিল। আহান তার পকেট থেকে কিছু টাকা বের করে মেয়েটির হাতে দিয়ে বলল, “কিছু খেয়ে নিও।”
মেয়েটি খুব খুশি হয়ে গেল। আহান মহিলাটিকে বলল, “ওর নাম কি?”
“মিষ্টি।”
“মাশআল্লাহ! ও দেখতেও খুব মিষ্টি।”
“আপনারা কি স্বামী স্ত্রী?”
“হ্যাঁ।”
“ভালো থাকবেন, আসি।”
“আপনারাও।”
ওনারা চলে যাওয়ার পর আহান চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। মীরা আহানকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলে, “যাবেন না? দাঁড়িয়ে পড়লেন যে!”
আহান অনুতপ্ত সুরে বলল, “স্যরি মীরা।”
মীরা কিছু বলল না। তাড়া দিল। “দেরি হচ্ছে। চলুন।”
মীরা চলে যেতে লাগলে আহান পিছন থেকে বলে, “অভিমান করেছ? স্যরি বললাম তো।”
মীরা আহানের দিকে ফিরে তাকায়। বলে, “যখন জানেনই, তখন আবার প্রশ্ন করেন কেন?”
“অভিমান ভাঙাতে কি করতে হবে আমায়?”
“আপাতত বাসায় চলুন।”
“আগে বলো কি করতে হবে?”
“আমায় একটা কেক এনে দিবেন? আমি আমাদের বাসায় যেতে চাই।”
“হঠাৎ কেক কেন?”
“দরকার আছে। আপনি যাবেন আমার সাথে?”
“ডিউটি আছে যে।”
“শেষ হলেই বাসায় চলে যাবেন।”
“আর কেক?”
“আসার সময় নিয়ে আসবেন।”
“আচ্ছা। চলো।”
আহান মীরাকে নিয়ে হসপিটাল থেকে বেরিয়ে গেল। মীরাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে সে থানায় চলে গেল।
_
প্রথমবার শ্বশুর বাড়ি থেকে বাবার বাসায় যাবে মীরা। আহানের সাথে না গেলে খারাপ দেখায়। তাই সে আর তার বাসায় যায়নি। আহান আসলে এরপর তাকে নিয়েই যাবে। ইউটিউব দেখে কয়েকটি রান্না শিখেছে সে। বাসায় এসে ওগুলোই করল। খুব একটা ভালো না হলেও খাওয়া চলে। দুপুরে ওগুলো দিয়েই খেল। পিয়াওমির সাথে অনেক্ক্ষণ সময় কাটালো মীরা। পিয়াওমির মীরাকে ছাড়া এখন কিছু বোঝে না। খুব ভালো বন্ধু হয়ে গেল তারা। মীরা বা আহান না থাকলে পিয়াওমির দেখাশোনা আয়ান করে।
আহান আসে বিকেলের দিকে৷ মীরাকে এখনো বাসায় দেখে সে অবাক হয়। কারণ জিগ্যেস করলেই মীরা বলে, “প্রথমবার বাবার বাসায় একা যেতে নেই।”
আহান খুশি হলো। মীরা যে তার জন্য অপেক্ষা করেছে এটাই আহানের ভালো লেগেছে। আহান ফ্রেশ হয়ে রেড়ি হলো। সাথে মীরাও। আহান সাথে করে একটা কেক নিয়ে এসেছিল। মীরাকে তা দেখালে মীরার খুব পছন্দ হয়৷ বাসা থেকে বেরিয়ে আহান মীরাকে দাড় করায়। তাদের বাসার সামনেই অহরহ মিষ্টির দোকান। আহান ওখান থেকে পনেরো কেজি মিষ্টি নিল আহান। সাথে নিল ফল আর পান সুপারি। আহানদের নিজস্ব গাড়ি আছে। সেই গাড়িতে উঠে মীরাকে নিয়ে আহান মীরাদের বাসায় গেল। পাঁচ মিনিটের রাস্তা, তাই তারা দ্রুত মীরাদের বাসায় চলে আসে।
মিরাজ বাসার বাহিরে দাঁড়িয়ে ছিল। মীরাদের গাড়ি থেকে নামতে দেখে দৌড়ে আগে আহানকে জড়িয়ে ধরে। এরপর মীরাকে জিজ্ঞেস করে। “কেমন আছিস?”
মীরা মুচকি হেসে জবাবে বলে, “আলহামদুলিল্লাহ, ভালো। তুই ভালো?”
“আমিসহ বাসার সবাই আলহামদুলিল্লাহ ভালো।”
গাড়ি থেকে ড্রাইভার এক এক করে সব জিনিস নিয়ে ভেতরে ঢোকে। মিরাজও তাকে সাহায্য করে। আহান ও মীরা বাসার ভিতরে চলে যায়। মীরাদের ড্রয়িংরুমে বসে ছিল সবাই। আহান ও মীরাকে একসাথে দেখে সবাই উঠে যায়। হাসি মুখ নিয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে থাকে। দুজনে একসাথে সবাইকে সালাম করে কুশল বিনিময় করে। মীরার মা মীরাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেই ফেলে। মীরা ব্যাগ নিয়ে উপরে তার রুমে চলে যায়। আহান সবার সাথে বসে কথা বলতে থাকে।
কিছুক্ষণ পর মিরাজ এসে আহানের পাশে বসে। আহানের সামনে বিভিন্ন নাশতা, ফল মিষ্টি দিয়ে টেবিল সাজিয়ে রাখা হয়েছে। মিরাজ আসার মীরার বাবা ওখান থেকে উঠে যান। এতক্ষণ ধরে উনি আহানের সাথে গল্প করছিলেন। মীরার মা ও ভাবি রান্নাঘরে। মীরার মা কাজ করছেন ও মীরার ভাবি টুকটাক এগিয়ে দিচ্ছে। আহান মিরাজের কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বলে, “আজ কি কারো জন্মদিন?
মিরাজ ভ্রু কুচকে নেয়। আহানের দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। বলে, ” হঠাৎ এই কথা।”
“তোর বোনকে দেখলাম একটা কেক নিয়ে আসতে। অবশ্য সে আমাকে নিয়ে আসার জন্য বলেছিল, কিন্তু কারণ বলেনি। জন্মদিন বা কোনো অনুষ্ঠান আছে কি?”
মিরাজ ভাবতে থাকে৷ ভাবনার মাঝেই মিরাজ জানতে পারে আজ কি। ছোট করে আহানকে বলে, “আজ তুর্যর জন্মদিন।”
ইমোশনাল হয়ে যায় মিরাজ। আহানও চুপ হয়ে যায়। মিরাজের চোখে পানি চিকচিক করছে। তুর্যর কথা খুব মনে পড়ছে তার। মিরাজ ইমোশনাল হয়ে বলে, “তুর্য আমাদের ছেড়ে কেন চলে গেল বলতো?”
“ওনার চলে যাওয়ায় আমারও খুব খারাপ লাগছে। এমনটা না হলেও হতো। কিন্তু ভাগ্যের কাছে আমরা সবাই অসহায়।”
–
রাতের দিকে মীরা কেকে সুন্দর করে তুর্যর নাম লিখে, “Happy Brithday Turjo Bhai”. কেকটা নিয়ে সে রেড়ি হয়ে ড্রয়িংরুমে এলো। মিরাজ আর আহান ওখানেই ছিল। মীরা মিরাজকে জিগ্যেস করে। “ভাইয়া, আমার সাথে যাবি?”
“তুর্যদের বাসায়?”
“হ্যাঁ।”
“আচ্ছা, চল।”
ভাই বোন এগিয়ে যেতে লাগলে আহান বলে, “আমায় নিবে না? দুজনের কেউ সাধলেও না।”
মীরা উৎসাহিত কণ্ঠে বলল, “আপনি যাবেন?”
“নিয়ে গেলে কেন যাব না? অবশ্যই যাব।”
“চলুন তাহলে।”
ওরা তিনজন মিলে বাসায় বাহিরে বের হলো। মিরাজ একটা সিএনজি ঠিক করলো। আহান ও মীরা পিছনে বসলো আর মিরাজ সামনে। দশ মিনিটের মতো সময় নিয়ে তারা পৌঁছালো তুর্যদের বাসায়। মীরা কলিংবেল চাপতেই তুর্যর মা এসে দরজা খুলে দিল। মীরাকে দেখেই তুর্যর মায়ের মুখে হাদির রেখা ফুটে উঠল। পিছনে মিরাজ ও আহানকে দেখে আরও ভালো লাগলো তার। মীরা সোজা ভেতরে ঢুকে গেল। মামা মামিকে সালাম করলো তারা সবাই। তুর্যর মা বলল, “তোরা এখন! হঠাৎ এলি!”
মীরা হাতে থাকা কেকটা টেবিলের উপর রেখে বলল, “আজকের দিনটা কি করে ভুলে যাই বলো?”
তুর্যর বাবা কেক দেখে বললেন, “যে নেই, তার জন্মদিন পালন করে কি হবে?”
তখন মীরা বলল, “কে বলল তুর্য ভাই নেই? তুর্য ভাই আছে তো। এই যে তোমাদের এই ঘরটা দেখছ, এর প্রতিটি কোণায় তুর্য ভাই আছে। তুর্য ভাই মরে যায়নি। ও আমাদের সবার মাঝেই বেঁচে আছে।”
মীরা তার মামা মামিকে পাশে নিয়ে কেকটা কাটলো। মিরাজ আর আহান মিলে হাত তালি দিয়ে তুর্যকে উইশ করতে লাগলো। তুর্যর মা বাবা কেক কাটার সময়ই কেঁদে দিলেন। তাদের সামলানো যাচ্ছে না
তাদের কাঁদতে দেখে মীরার ও চোখের পানি অনবরত পড়তে লাগলো। মীরা বলল, “তোমরা কি ভাবছ মামা মামি? শুধু তোমাদের একার কষ্ট হচ্ছে? আমার হচ্ছে না? তুর্য ভাই আমার বেস্ট ফ্রেন্ড ছিল। আমি তাকে খুব সম্মান করি। আমার ভাইয়েরও কষ্ট হচ্ছে। তুর্য ভাই আমার ভাইয়ের প্রাণ ছিল। তোমরা জানো, হসপিটালে যখন আমাকে নিয়ে যাওয়া হলো। জ্ঞান ফেরার পর এক কোণে ভাইয়াকে তুর্য ভাইয়ের নাম নিয়ে কাঁদতে দেখেছি। বন্ধুর জন্য বন্ধু এমনও করে আমি জানতাম না। আই মিস তুর্য ভাই।”
আহান সবাইকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে, “প্লিজ সবাই থামুন। এভাবে কাঁন্নাকাটি করলে তুর্য আরও কষ্ট পাবে। তার জন্য দো’য়া করুন।” এরপর ওরা সবাই মিলে তুর্যর কবরে যায়। তুর্যর জন্য মন থেকে দোয়া করে। মীরা কাঁদতে কাঁদতে বিড়বিড় করে বলে, “ক্ষমা করে দিও তুর্য ভাই। আমি তোমায় ভালোবাসতে পারলাম না। তুমি আমার চেয়ে ভালো কাউকে ডিজার্ভ করো। কিন্তু তোমার সব ইচ্ছেই অপূর্ণ রয়ে গেল৷ তার জন্য বোধয় আমিই দায়ী।”
আহান মীরার এই কথাগুলো শুনে নেয়। সে মীরার কাঁধে হাত রেখে বলে, “কাঁদবে না প্লিজ। তুর্য আমাদের সাথেই আছে৷ উনি একজন সফল প্রেমিক। যে নিজের জীবনের পরোয়া না করেও তার ভালোবাসার মানুষটির কথা ভেবেছে। তাকে সুখি দেখার জন্য হাসিমুখে নিজের যন্ত্রণা মেনে নিয়েছে। আমি তাকে সেলুট করি।”
মীরা অবাক হলো আহানের কথায়। তুর্যকে নিয়ে আহানের মনে কত সুন্দর অনুভূতি রয়েছে। আহানের জায়গায় অন্য কেউ হলে বোধহয় তুর্যকে মীরার জীবনে সহ্যই করতে পারত না। কিন্তু আহানের চিন্তাভাবনা অন্যরকম। এজন্যই বোধয় আহানকে মীরার ভালো লেগেছিল। এইজন্যই বোধয় আহানকে মনে জায়গায় দিয়েছে মীরা। মাঝে মাঝে উন্মাদ প্রেমিকের চেয়ে নিরব প্রেমিক ই শ্রেষ্ঠ হয়। তাদের মধ্যে উন্মাদনা না থাকলেও ভালোবাসার কমতি থাকে না।
রাত গভীর হতে দেখে তারা সবাই চলে যায় মীরাদের বাসায়। মীরা কিছুদিন তার বাবার বাসায় থাকবে বলে এসেছে। আহান ডিউটি শেষে তাকে দেখতে আসবে বলে জানিয়েছে। মীরার এবারের পরিকল্পনা রান্না শেখা। তাকে তার মায়ের মতো রান্না শিখতে হবে। নিজেদের জন্য এইটুকু করতেই হবে।
চলবে…