#বিবর্ণ_বসন্ত
৫ম_পর্ব
~মিহি
‘এমন করে ফাঁকি না দিলেও পারতে প্রতিবেশী!’ অনামিকার ফোনে টেক্সটটা দেখামাত্র সোহরাবের কপালের রগ ফুলে উঠে। সকালবেলা ঐ পলাশ নামের ছেলেটার আদিখ্যেতা মনে পড়ে। তলে তলে তবে এতকিছু! অনামিকাকে সে ভালো ভেবেছিল অথচ সে কিনা পরপুরুষকে মনে বসিয়ে সংসার করছে। সোহরাব অফিস থেকে ছুটি নিয়ে বাড়িতে আসলো। সোহরাবের রাগী চেহারা প্রথম চোখে পড়লো তন্বীর। সে বুঝে গেল তার ধ্বংস বোধহয় আজই হবে। সোহরাবের রাগ সম্পর্কে সে অবগত। তাড়াতাড়ি সে ছাদের চিলেকোঠায় লুকিয়ে পড়লো যাতে কেউ তাকে খুঁজে না পায়। সোহরাব চেঁচিয়ে অনামিকাকে ডাকতে লাগল। সোহরাবের চেঁচামেচি শুনে অনামিকা ঘর থেকে বেরোলো। আফিফের সাথে কথা হওয়ার পর থেকে সে এমনিতেই মানসিকভাবে কিছুটা ভেঙে পড়েছে। এমতাবস্থায় সোহরাবের এ হেন চেঁচামেচি তার কাছে বিরক্তিকর ঠেকছে। অনামিকা সোহরাবের সামনে দাঁড়াতেই সোহরাব সজোরে অনামিকার গালে থাপ্পড় বসিয়ে দিল। অনামিকা হতবুদ্ধির মতো দাঁড়িয়ে রইল। অনামিকাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সোহরাব অনামিকার চুলের মুঠি ধরে তাকে উঠোনে ফেলল। ব্যথায় কঁকিয়ে উঠলো অনামিকা। পাশের ঘর থেকে ছুটে এলেন সাজিয়া। রাহেলাও উৎসুক দর্শকের মতো ডাগর চোখ মেলে দাঁড়াল।
-‘বাড়ির বউয়ের গায়ে হাত তোলার স্পর্ধা তোর কী করে হলো সোহরাব?’
-‘তোমার বাড়ির বউ পরকীয়ায় মত্ত আম্মা। এমন দুশ্চরিত্র বউকে এভাবেই মারা উচিত।’
-‘কী যা তা বলছিস!’
-‘যা তা না মা। তোমার বউমার প্রেমিক, ঐ যে পলাশ না কী নাম, সকালে এসেছিল, তিনি তোমার বউমাকে মেসেজ করেছেন। নির্ঘাত দুজনের মধ্যে প্রেম ছিল।’
অনামিকার কান গরম হয়ে উঠলো। পলাশ ভাইকে সে মায়ের পেটের ভাইয়ের মতো দেখে তবুও কোনোদিন একান্তে বসে তার সাথে কথাটুকুও বলেনি। অথচ আজ তার নামের সাথেই অনামিকার নাম এমন বিশ্রিভাবে জড়ানো হচ্ছে। সাজিয়া সোহরাবকে আটকালেন। অনামিকা কিয়ৎক্ষণ চুপ থাকলো। অতঃপর উঠে দাঁড়ালো।
-‘ফোনটা দিন আমাকে।’
-‘তোমার মধ্যে লাজ লেহাজ কিছু নাই মাইয়্যা! এত রঙঢঙ কইরা আবার ফোন চাও!’
-‘আমি আপনার সাথে কথা বলছিনা ফুফু। সোহরাব ফোন দিন। অপবাদ যখন দিয়েছেন তখন সেটা প্রমাণও করুন।’
সোহরাবের মাথায় রক্ত চড়ে গেল। অনামিকাকে অশ্রাব্য গালি দিয়ে সে ফোনটা বের করে মেসেজটা দেখালো। অনামিকা দেখলো আননোন নম্বর থেকে মেসেজ এসেছে। অনামিকা নম্বরটা চেনেনা। সে ঐ নম্বরে কল দিতেই সোহরাব ফোন কেড়ে নিয়ে লাউড স্পিকারে দিল। কল রিসিভ হলো।
-‘এত দেরী করলে কল করতে? অপেক্ষা করছিলাম তো সোনা।’
-‘কে আপনি? আমার নম্বরে উল্টোপাল্টা টেক্সট কেন করেছেন?’
-‘কে মানে? ফাজলামি করতেছো? তুমিই তো আগে মেসেজ দিলা।’
-‘আমি চিনিই না আপনাকে, টেক্সট করবো কেন?’
কলটা কেটে গেল। রাহেলা মুখে আঁচল গুঁজে বিড়বিড় করতে লাগল।
-‘ছিঃ ছিঃ! আমি তো আগেই বলছিলাম এই মেয়ের চরিত্রের দোষ আছে। তোমরা তো শুনলা না।’
-‘আহ ছোটো! চুপ কর। অনামিকা তো বলছে ও চেনেনা।’
-‘ও না চিনলে ওর নম্বর ছেলেটা কিভাবে পেল আম্মা?’
সাজিয়া চুপ হয়ে গেলেন। অনামিকা চুপ হলো না। নিজের চরিত্রে এমন কালি সে সহ্য করবে না। ফোনটা নিয়ে ট্রুকলারে নম্বরটা সার্চ দিল। সেখানে নাদিম নাম লেখা উঠলো ছবিসহ। সোহরাব ছেলেটাকে দেখে কিছুটা বিভ্রান্ত হলো। ছেলেটাকে সে কোথাও দেখেছে কিন্তু ঠিক কোথায় দেখেছে তা মনে করতে পারলো না। সাজিয়া শেখ ছবি দেখে চিনতে পারলেন। এ ছেলেকে তিনি রাহেলার এলাকায় দেখেছেন, পাশাপাশি বাড়ি। বেশ মিশুক ও ভদ্র ছেলে। রাহেলা দেখে কিছু বললেন না। বিষয়টা কেমন যেন ঘোলাটে হয়ে এলো।
-‘ফুফু, আপনি ছেলেটাকে ডাকুন। সামনাসামনিই সব কথা বলে নিব আমরা।’
-‘পিরিত করার সময় বলছিলা আমারে? এখন ক্যান লাগতেছে?’
রাহেলার কথায় বিরক্তি বাড়লো অনামিকার। শেষে সাজিয়াই নাদিমের বাড়িতে কল করে ওকে ডেকে পাঠালেন। নাদিম সরল মনে হ্যাঁ বললো।
রোদের উত্তাপে চিলেকোঠায় থাকতে পারছে না তন্বী। একটু বের হয়ে ছাদের রেলিংয়ে হেলান দিল। নিচে অতি পরিচিত মুখ দেখে তার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠলো। একছুটে সে আবারো চিলেকোঠায় লুকিয়ে পড়লো। নাদিম এসে সোফায় বসতেই সোহরাব রাগী দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। অনামিকাও পাশেই রয়েছে। সাজিয়াই প্রথম প্রশ্ন করলেন।
-‘নাদিম, তুমি কি অনামিকাকে চেনো?’
-‘না তো খালা। ওনাকে তো ঠিক চিনলাম না।’
রাহেলা নাদিমের কথায় ভেংচি কাটলেন।
-‘এখন তো চিনবাই না। রাশলীলা করার সময় ঠিকই চিনতা।’
-‘আহ ছোটো চুপ কর তো। নাদিম, তুমি সকালে অনামিকার ফোনে মেসেজ করেছো। কল করার পরও প্রেমিকের মতোই ব্যবহার করছিলে। এসবের মানে কী?’
-‘আমি? না মানে..এটা ভুল বোঝাবুঝি খালা। সকালে আমার প্রেমিকা একটা নম্বর থেকে মেসেজ করেছিল। আমি তো ওর সাথেই কথা বলেছিলাম। সেটা অনামিকা ভাবীর নম্বর কী করে হলো বুঝছি না।’
-‘দেখো তো এ নম্বর কিনা!’
-‘হ্যাঁ এটাই ছিল। কিন্তু আমি ভাবীকে উদ্দেশ্য করে মেসেজ করিনি।’
-‘তোমার প্রেমিকা অনামিকার ফোন কী করে পেল? কে সেই প্রেমিকা?’
এবার নাদিমকে ঘামতে দেখা গেল। প্রেমিকার নাম কী করে বলবে সে! রাহেলা শুধু সুযোগ খুঁজছে অনামিকাকে ফাঁসানোর। নাদিমের মৌনতার সদ্ব্যবহার করতে চাইল সে।
-‘এই ছেলে অনামিকার সাথেই প্রেম করছে। নাহলে প্রেমিকার নাম বলতে পারেনা ক্যান! নষ্টা মেয়ে প্রেমিকরে শ্বশুরবাড়িতে টেনে আনলো। ছিঃ ছিঃ!’
-‘না রাহেলা আন্টি। ভুল হচ্ছে আমার। আমার প্রেমিকা ভাবী কেন হতে যাবে?’
-‘তো বলো তোমার প্রেমিকা কে! বলছো না কেন? ভাবী তোমার ছেলের বউ একটা দুশ্চরিত্রা…’
-‘আমার প্রেমিকা ত..তন্বী! অনামিকা ভাবীকে অযথা দোষারোপ করবেন না।’
নাদিমের কথা শুনে রাহেলা বানুর চোখ অক্ষিকোটর থেকে বের হবার উপক্রম হলো। এ কী বলছে এই ছেলে!
-‘এই ছেলে! ঐ অনামিকার দোষ ঢাকতে আমার মেয়ের নাম নিচ্ছো! এত বড় স্পর্ধা তোমার! আমার মেয়ে ফুলের মতো পবিত্র। ও তো এখনো প্রেম ভালোবাসা কী তাই বোঝেনা। যে মেয়ে প্রেমের ছবি দেখেনা, আমার সেই মেয়ের নামে অপবাদ দাও কোন সাহসে?’
নাদিমের এবার বিরক্ত লাগছে। তন্বীর মা আসলেই আজব ক্যারেক্টার। এ মুহূর্তে রাগটাও সমান তালে বাড়ছে তার। বিরক্ত হয়ে ফোন বের করে গ্যালারিভর্তি তন্বীর শ’খানেক ছবি দেখাল সে।
-‘এবার বলুন আন্টি, আপনার মেয়ের এসব ছবি আমি আপনার বাড়িতে ঢুকে তুলেছি? ঐ দিয়েছে এসব। ও ভালোবাসে আমাকে।’
-‘আমার মেয়ের ফোনই নাই। তুমি মিথ্যে বলছো। এসব নিশ্চয়ই নকল।’
-‘আপনার মেয়ে আপনার ফোন চালায় লুকিয়ে লুকিয়ে। আপনি তো অন্যের সংসার নিয়ে ব্যস্ত তাই নিজের মেয়ের খোঁজ নেওয়ার সময় নাই আপনার। একবার মেয়ের সাথে বসে একটু কথা বলছেন কোনদিন? জিজ্ঞাসা করছেন ও কী চায়? আরে মেয়েটাকে তো বন্ধুও বানাতে দেন নাই। দম বন্ধ হয়ে মরে যেতো। মা যখন হয়েছেন, দায়িত্ব পালন করতে অবহেলা কেন করলেন?’
-‘দুদিনের ছেলে আমাকে দায়িত্ব শেখাও? অভদ্র ইতর কোথাকার! আমার মেয়ে কোনদিন তোমাকে ভালোবাসতে পারেনা।’
-‘ডাকুন তন্বীকে। আজ এসপার নয়তো ওসপার হয়েই যাক।’
রাহেলা সুমিকে পাঠালেন তন্বীকে খুঁজতে। সুমি অনেকক্ষণ খুঁজেও কোথাও পেল না তাকে। এত খোঁজাখুঁজির পরও তন্বীকে না পেয়ে সবার চিন্তা বাড়তে লাগল। রাহেলা বানুর গলার জোর তখনো কমেনি। দিব্যি বলে যাচ্ছেন,’সত্যি ফাঁস হওয়ার ভয়ে আমার মেয়েকে গুম করে দিল। সব তোমার বৌমা আর ওর প্রেমিকের ষড়যন্ত্র ভাবী!’ অনামিকার ইচ্ছে করছে কষিয়ে একটা চড় লাগাতে কিন্তু বয়সের কারণে পারছে না। ‘তন্বীইই!’ আচমকা সুমির চিৎকার শুনে সকলে চিলেকোঠার দিকে দৌড় দেয়।
চলবে…