#শেষটা_সুন্দর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
২০।
মেহুল কাঁপাকাঁপা স্বরে বলল,
‘মা, এসবের আমি কিছু জানি না।’
রামিনা বেগম গর্জে উঠে বললেন,
‘তোমাকে নিয়ে খবরের কাগজের হেডলাইন হয়েছে, আর তুমিই সেটা জানো না? আমাকে কি বোকা পেয়েছ? তোমার শাশুড়ি ফোন দিয়ে কত কথা বলেছেন, জানো? তোমার জন্য আজ আমি এত অপমানিত হয়েছি।’
মেহুল মাথা নুইয়ে ভেজা গলায় বলে,
‘আমি এসবের সত্যিই কিছু জানতাম না, মা। আর সবচেয়ে বড়ো কথা হলো, আমাদের ভার্সিটিতে কালকে কোনো সাংবাদিক যাননি। এটা একটা ভার্সিটি প্রোগ্রাম। আমি তো এর আগেও গান গেয়েছি। কিন্তু, কালকের গানের ব্যাপারটা এত হাইলাইট হলো কী করে?’
‘নিশ্চয়ই কেউ হাইলাইট করেছে। এমনি এমনিই তো খবরের কাগজে চলে আসেনি, নিশ্চয়ই কেউ ছাপাতে বলেছে। তুমি না করলে তোমার বন্ধুদের মাঝে কেউ করেছে। যাও এখন গিয়ে খোঁজ নাও কে এসব করেছে।’
রামিনা বেগমের রাগ বিন্দুমাত্র ও কমেনি। ঘনঘন নিশ্বাস ফেলছেন তিনি। মেহুল অসহায় চোখে বাবার দিকে তাকায়। বাবাও উদাস চোখে তার দিকেই চেয়ে আছেন। মেহুল ঢোক গিলে জিজ্ঞেস করে,
‘ঐ মহিলা তোমাকে কী কী বলেছেন, মা?’
রামিনা বেগম কটমট করে তাকালেন। ক্ষিপ্ত স্বরে বললেন,
‘ঐ মহিলা তোমার কি হয়? কোন সাহসে তুমি উনাকে “ঐ মহেলা” বলে সম্বোধন করছো?’
মেহুল নিচের দিকে চেয়ে বলে,
‘আমার শাশুড়ি মা তোমাকে কী বলেছেন?’
‘কী বলবেন? তুমি কি আর কিছু বাকি রেখেছো বলার? বলেছেন, আমরা নাকি ওয়াদা দিয়ে ওয়াদা রাখতে পারিনা। বিয়ের আগে ওয়াদা দিয়েছি মেয়ে গান গাইবে না। অথচ বিয়ের পর আমাদের মেয়ে ঠিকই গান গেয়েছে। আর এখন তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ চারদিক। উনার অসম্মানে লেগেছে ব্যাপারটা। আশেপাশের মানুষ নাকি উনাকে এসে বলেছেন, ছেলের বউ দেখি খবরের কাগজে উঠে এসেছে। কার এসব শুনতে ভালো লাগে? উনি তোমার উপর রেগে আছেন। এখন তুমিই ভাবো কী করবে?’
মেহুল নিজেকে ধাতস্ত করে বলে,
‘ছোট্ট একটা ব্যাপারকে উনি টেনেটুনে এত বড়ো কেন করছেন? আর আপাতদৃষ্টিতে দেখতে গেলে উনার তো উল্টো আরো খুশি হওয়ার কথা, উনার ছেলের বউয়ের গানের এত প্রশংসা, তার নামে খবরে কাগজে শিরোনাম এসেছে। উনি খুশি না হয়ে উল্টো কথা শুনিয়েছেন? আর তুমিও কিছু বলতে পারলে না।’
‘হে, আমি কী বলব? উনার সাথে ঝগড়া বলব। বলব যে, আমার মেয়ে যা করেছে বেশ করেছে। এটাই বলা উচিত ছিল আমার? এই শিক্ষা তোমাকে আমি দিয়েছি? শুনো মেহুল, তোমার এখন বিয়ে হয়ে গিয়েছে। এখন তুমি না চাইলেও তোমার শাশুড়ি আর স্বামীর কথামতোই তোমাকে চলতে হবে। উনারা যখন তোমাকে গান গাইতে বারণ করেছেন, তার মানে তুমি গান গাইবে না। এই নিয়ে যেন আর কোনো কথা না হয়।’
মেহুলের চোখে কোণে পানি জমে। সে দ্বিতীয় কোনো কথা না বলে নিজের রুমে ছুটে যায়। রুমে গিয়ে দেখে তার ফোন বাজছে। হাতে নিয়ে দেখে রাবীর কল করছে। ইচ্ছে করে সে কলটা কেটে দেয়। মেহুলের ভীষণ রকম কান্না পাচ্ছে। কষ্ট হচ্ছে তার। চারদিকে অপরিচিত মানুষরা তার আজ এত প্রশংসা করছে অথচ তার কাছের মানুষরাই তাকে কোনো দাম দিচ্ছে না। তার স্বপ্নের কথা কেউ ভাবছেই না।
রাবীর ক্রমাগত তাকে কল দিতেই থাকে। মেহুল এক পর্যায়ে বিরক্ত হয়ে কল রিসিভ করে। কানে ফোন ধরে চুপচাপ বসে থাকে। রাবীর ঠান্ডা গলায় বলে,
‘আমি জানি আপনার মন ভালো নেই। বিশ্বাস করুন, আমি মা’কে অনেক ভাবে বোঝানোর চেষ্টা করেছি। তবে মা বোঝেননি। তিনি কোনোভাবেই আপনার গান গাওয়াটাকে মেনে নিতে পারছেন না। তারউপর আজকে খবরের কাগজ দেখে আরো বেশি মন মেজাজ খারাপ হয়ে আছে উনার। আমার উপরও রেগে আছেন, আপনাকে অনুমতি দিয়েছি তাই। আমি সবটুকু দিয়ে মা’কে বোঝানোর চেষ্টা করেছি, মেহুল। তবে মা’কে কোনোভাবেই রাজি করাতে পারিনি। আর মা রাজি না হলে আমার পক্ষেও আপনাকে সাপোর্ট করা সম্ভব না। আপনি আমাকে ক্ষমা করবেন।’
রাবীরের বলা শেষ হলেও মেহুল কিছু বলে না। রাবীর তার নিশ্বাসের শব্দগুলো ঠিকই শুনতে পারছে। মেয়েটা যে খুব কষ্ট পাচ্ছে সেটাও সে বুঝতে পারছে। রাবীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
‘এই নিউজটা বের না হলে হয়তো মা’কে আমি পরে সবটা সুন্দর করে গুছিয়ে বলতে পারতাম। কিন্তু, সকাল হতেই চোখের সামনে এই নিউজ দেখে উনার মেজাজ বিগড়ে গিয়েছে। এখন আমি হাজার বোঝালেও উনি বোঝবেন না। কী দরকার ছিল, এই প্রতিবেদন দেওয়ার?’
মেহুল এবার মুখ খুলে। বলে,
‘আমি এই প্রতিবেদন দেইনি। কে দিয়েছে সেটাও জানি না। আমি নিজেই তো সকালে মায়ের মুখে সব শুনে অবাক।’
রাবীর অবাক হয়ে বলে,
‘আপনি কিছু জানতেন না? আপনার অনুমতি ছাড়াই আপনার নামে প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে?’
‘জি।’
‘কে করেছে এসব? আপনার কোনো ফ্রেন্ড?’
‘না, আমার তো তা মনে হয় না। কিছু করার আগে ওরা অবশ্যই আমাকে জানাতো।’
‘আপনি এক্ষুনি ওদের সাথে কথা বলে সিউর হোন। তারপর আমাকে জানান। আর মায়ের কথায় কষ্ট পাবেন না। আমি মা’কে আবার বোঝাব।’
‘ঠিক আছে।’
রাবীর কল কাটার পর মেহুল রিতাকে কল দেয়। রিতার কল রিসিভ করে “হ্যালো” বলতেই মেহুল বলে,
‘তুই ঘুমাচ্ছিস?’
‘হ্যাঁ, বন্ধের দিনে ঘুমাব না তো জেগে থাকব?’
‘খবরের কাগজ দেখেছিস?’
‘ঘুমের মধ্যে খবরের কাগজ কেন দেখতে যাব, পাগল হয়েছিস নাকি?’
‘ঘুম থেকে উঠে খবরের কাগজটা আগে দেখ, তারপর আমাকে আবার কল দিস।’
এই বলে মেহুল কল কেটে দেয়। রিতা তার কথার আগা মাথা কিছু বুঝতে পারে না। তাই সে উঠে বসে। ফ্রেশ হয়ে তাদের বসার রুমে যায়। সেখানে তার বাবা খবরের কাগজ পড়ছিলেন। রিতাকে দেখে তিনি হেসে বললেন,
‘দেখ রিতা, মেহুলকে নিয়ে খবরের কাগজে শিরোনাম হয়েছে।’
রিতা চমকে খবরের কাগজটা হাতে নিয়ে দেখে। প্রতিটা লাইন পড়ে অবাকের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে যায় সে। দৌড়ে আবার রুমে গিয়ে মেহুলকে কল দেয়। মেহুল ফোন হাতে নিয়েই তার অপেক্ষা করছিল। কলটা তাই সাথে সাথেই রিসিভ করে। রিতা তখন বিস্ময়ে বলে উঠে,
‘তুই তো এক রাতেই বিশাল গায়িকা হয়ে গেছিস, মেহুল। এগুলো কে করেছে? নিশ্চয়ই ভাইয়া?’
‘ভাইয়া? মানে রাবীরের কথা বলছিস?’
‘হ্যাঁ, তা নয়তো আর কে?’
মেহুল নিশ্বাস নিয়ে বলে,
‘রাবীর এসব করেনি, রিতা। কে করেছে আমি সেটাই বুঝতে পারছি না। তুই কি জানিস কিছু?’
‘না, আমি মাত্র জানলাম। ভাইয়া না করলে, কে করবে এসব?’
‘আমাদের বন্ধুদের মাঝে কেউ?’
‘একদমই না। ওরা কেউ করবে না। আর করলেও তোকে বলে করতো। এটা অন্য কেউ করেছে, আমি ডেম সিউর।’
‘কিন্তু, সে কে? আমি কী করে তাকে খুঁজে বের করব?’
‘আরে এটা তো সিম্পল ব্যাপার। জাস্ট এই নিউজ পেপারের অফিসে গিয়ে জিজ্ঞেস করবি, এই নিউজটা কে পাবলিশ করতে বলেছে। উনাদের কাছে নিশ্চয়ই সব ইনফরমেশন রয়েছে। তুই ভাইয়াকে নিয়ে গেলেই দেখবি, ইজিলি সবকিছু বের করে ফেলতে পারছিস।’
মেহুলেরও তাই মনে হয়। নিউজ পেপারের অফিসটাতে গেলেই সে সব তথ্য পাবে। আর তারউপর তার কেন যেন মন বলছে, এটাও সেই অচেনা মানুষটাই যে তাকে ঐ চিরকুট আর ফুল দিয়েছিল। এইসব কিছু একজনই করছে। কিন্তু, সেটা কে?
চলবে ….
(আপনাদের কী মনে হয়, কে সেটা? পরের পর্বে কি জানার ইচ্ছে আছে?)