#শেষটা_সুন্দর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
২১।
অফিসের ভেতরে রাবীর প্রবেশ করতেই সবাই তাকে চিনে যায়। কাজ ফেলে সবাই উঠে দাঁড়ায়। রাবীর বলে,
‘আপনারা বসুন। আর কাইন্ডলি আপনাদের অফিসের হেডকে একটু ডেকে দিন। আমার উনার সাথে একটু কথা আছে।’
একজন লোক তখন বেরিয়ে এসে বলল,
‘স্যার, আপনি আমার সাথে আসুন। আমি আপনাকে বসের রুমে নিয়ে যাচ্ছি।’
রাবীর মেহুলের দিকে চেয়ে বলল,
‘চলুন, মেহুল।’
মেহুলও তার পেছন পেছন যায়। একটা রুমের সামনে এসে সেই লোকটা দরজায় নক করে বলে,
‘বস, রাবীর স্যার এসেছেন। আপনার সাথে নাকি কথা বলতে চান।’
বস ভেতর থেকে বলেন,
‘উনাকে নিয়ে ভেতরে আসুন।’
রাবীর আর মেহুল ভেতরে ঢুকতেই অফিসের বস উঠে দাঁড়ান। হেসে বলেন,
‘ভালো আছেন?’
‘জি। আপনি কি এখন ফ্রি আছেন? আপনার সাথে আমি একটু কথা চাই?’
‘জি জি, অবশ্যই। বসুন না।’
তারপর লোকটি তার পি.এ কে বলল,
‘যাও, উনাদের জন্য শরবত নিয়ে এসো।’
‘তারপর বলুন রাবীর খান, কোন সৌভাগ্যে আপনার পদচিহ্ন আমার অফিসে পড়েছে?’
‘হু, তা তো বলবোই। তার আগে পরিচয় করিয়ে দেই। উনি আমার ওয়াইফ, মিসেস মেহুল খান।’
লোকটি চমকে বলল,
‘ওমা, ম্যাডামকে নিয়ে এসেছেন। আসসালামু আলাইকুম ম্যাডাম, ভালো আছেন?’
মেহুল ইতস্তত স্বরে বলল,
‘জি, ভালো।’
‘আমি আপনাদের কী সাহায্য করতে পারি বলুন?’
রাবীর তখন একটা খবরের কাগজ লোকটার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
‘এটা তো আপনাদের অফিসেরই নিউজ পেপার, তাই না?’
লোকটি ভালোভাবে দেখে বলল,
‘হ্যাঁ। কেন, কোনো সমস্যা হয়েছে?’
‘আচ্ছা, বলছি। তার আগে আপনি এটা বলুন, আপনার নিউজ অফিস থেকে কোনো খবর ছাপানোর আগে যাকে নিয়ে খবর ছাপান তার অনুমতি নেন?’
‘উমম, আসলে অনুমতি নেওয়ার তো কিছু নেই। আমরা সাধারণত প্রতিদিনের ঘটনাগুলোই এখানে তুলে ধরি। আর প্রতিবেদন যা আছে, সেটা ব্যক্তির মতামত নিয়েই করা হয়।’
‘বেশ বুঝলাম। আমাকে তাহলে আরেকটা জিনিস বুঝান। এই যে এই বিনোদনের অংশে, কালকে এটা খবর ছাপানো হয়েছে, একটা মেয়েকে নিয়ে। যে তার বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা প্রোগ্রামে গান গেয়েছিল। এবং তার এই গানের কথা উল্লেখ করে আপনার পত্রিকাতে বেশ হাইলাইট করে একটা শিরোনাম প্রকাশ করা হয়েছে। কিন্তু, এই শিরোনামের ব্যাপারে ঐ মেয়েটা কিছুই জানে না। মানে সে জানেও না তাকে নিয়ে যে প্রতিবেদন লেখা হচ্ছে। এখন আবার কথা হচ্ছে, আপনাদের অফিসের কোনো সাংবাদিক বা প্রকাশক সেই প্রোগ্রামেও উপস্থিত ছিলেন না। তারমানে নিশ্চয়ই, কেউ আপনাদের অফিসে এসে এই প্রতিবেদনটা লিখতে বলে গিয়েছেন। আর আমরা এখন সেই ব্যক্তিটার নামই জানতে চাই।’
লোকটি চিন্তায় পড়ে। খবরের কাগজটা ভালো করে দেখে। বলে,
‘আপনার ওয়াইফকে নিয়ে প্রতিবেদন লেখা হয়েছে?’
‘জি। সেটা আমার ওয়াইফ জানতো না। তাহলে এটা কে করেছে। তার ডিটেইলস আমাকে দিন।’
লোকটা আমতা আমতা করে বলল,
‘আসলে, আমি সবকিছুর হেড হলেও এই নিউজ পেপারে কী কী ছাপবে না ছাপবে তা সব আমার পি.এ ঠিক করে থাকে। আপনারা ওর কাছ থেকে সবকিছু জানতে পারবেন।’
‘তাহলে ডাকুন উনাকে।’
‘ঐ তো চলে এসেছে।’
পি.এ দুটো শরবতের গ্লাস নিয়ে ভেতরে ঢুকে। রাবীরের সামনে একটা গ্লাস দেয় অন্যটা মেহুলের সামনে। রাবীর তাকে পরখ করে বলে,
‘আপনি এখানে বসুন। আপনার সাথে আমার কথা আছে।
‘
পি.এ খানিকটা ঘাবড়ে গেল। সে জোরপূর্বক হেসে বলল,
‘আমার সাথে?’
‘জি, বসুন।’
লোকটা ঢোক গিলে বসে। রাবীর তার দিকে ঘুরে বসে। খবরের কাগজটা তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,
‘এই নিউজটা আপনি তৈরী করেছেন?’
লোকটা ভালো মতো দেখে বলল,
‘নির্দিষ্ট করে তো বলা যায় না। তবে বিনোদনের অংশটা আরেকজন দেখাশোনা করেন।’
রাবীর এবার নাক ফুলিয়ে নিঃশ্বাস ফেলে। কিছুটা রাগ দেখিয়ে বলে,
‘কে দেখাশোনা করেন, তাকে ডাকুন।’
‘আচ্ছা, স্যার। আমি উনাকে ডেকে আনছি।’
‘গো ফাস্ট।’
পি.এ দ্রুত সেই কক্ষ থেকে বেরিয়ে গেল। অফিসের বস বলল,
‘চিন্তা করবেন না, আপনারা সঠিক তথ্য পাবেন।’
রাবীর ভ্রু কুঁচকে বলল,
‘আপনারা অনুমতি ছাড়া প্রতিবেদন কেন প্রকাশ করেন? এই নিয়ম কোথায় লেখা আছে? আপনাদের নিউজের জন্য যে অন্য মানুষকে সমস্যায় পড়তে হয়, সেটা কেন খেয়াল রাখেন না?’
বস জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলে,
‘মি. খান, আপনি শান্ত হোন। আমরা নিজেরাও জানতাম না এই ব্যাপারটা। আমাদের যা বলা হয়, আমরা কাগজের পাতায় তাই লিখি। এখানে আমাদের কোনো হাত নেই।’
‘হ্যাঁ, তাই তো। যে এসে যা বলবে আপনারা তাই লিখবেন।।সেটার সত্য মিথ্যা বা প্রাইভেসির কথা চিন্তা করবেন না? এত বড়ো নিউজ অফিসের এই অবস্থা।’
রাবীরকে কিছু বুঝিয়ে বলার আগেই পি.এ এসে আবার সেখানে হাজির হয়। সে মাথা নুইয়ে বিনীত সুরে বলে,
‘স্যার, উনি আজ আসেননি। দু’দিনের ছুটিতে গিয়েছেন।’
রাবীর এবার আরো বেশি গর্জে উঠে। সে কপট রাগ দেখিয়ে বলে,
‘বাহ, এবার উনিও নেই। মানে এখন কোনোভাবেই কোনো তথ্য পাওয়া যাবে না, তাই তো?’
বস বলেন,
‘না না, কেন পাওয়া যাবে না? উনি দু’দিনের ছুটিতে গিয়েছেন। দু’দিন পর তো চলে আসবেন। উনি আসলেই আমি আপনাকে কল করে জানাব। আপনি চিন্তা করবেন না।’
রাবীর চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। তারপর টেবিলের উপর দুহাত চাপড় মেরে ধরে বলে,
‘আমি যদি সহজে ঐ লোকটার ডিটেইলস না পাই, তবে কিন্তু আমি থানায় এই নিউজ অফিসের বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করব। কথাটা যেন মাথায় থাকে।’
এই বলে সে মেহুলকে নিয়ে সেখান থেকে বেরিয়ে যায়।
_______
গাড়িতে চুপচাপ দুজন বসে আছে। মেহুল রাবীরের এতটা রাগ আগে দেখেনি। আজ এই একটু দেখেই রাবীরকে ভয় পাচ্ছে সে। তাই কিছু বলতে চেয়েও বলতে পারছে না। এক পর্যায়ে রাবীর’ই প্রথমে বলে উঠল,
‘আপনি চিন্তা করবেন না, আমি যেকোনো মূল্যে ঐ লোকটাকে খুঁজে বের করব।’
মেহুল মৃদু সুরে মিনমিনিয়ে বলল,
‘আপনি আমার উপর রেগে আছেন, তাই না?’
‘আপনার উপর কেন রেগে থাকব?’
রাবীরের কন্ঠ স্বাভাবিক। মেহুল বলল,
‘আমার জন্য আপনার মা আপনার উপর রেগে আছেন। ভুল তো আমি করেছি। আমারই গান গাওয়া উচিত হয়নি।’
মেহুল এই বলে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। রাবীর একবার তাকায় তার দিকে। চোখের একপাশ থেকেও বোঝা যাচ্ছে যেন চোখের কোণে বিষাদ জমেছে তার। রাবীর মেহুলের হাতটা আলতো করে মুঠোয় নেয়। নরম গলায় বলে,
‘মা আর আপনার মাঝে আমি কারো কষ্টই সহ্য করতে পারিনা। কিন্তু, আবার এই দুদিক সামলাতেও পারছি না। মা মানতে নারাজ। তার উপর আপনার কষ্ট, আপনার স্বপ্ন। কীভাবে আপনাকে মুখের উপর বারণ করি, আবার কীভাবেই বা মা’র বিরুদ্ধে যাই? দুইটার কোনটাই আমার পক্ষে সম্ভব হয়ে উঠছে না। আমি যে বড্ড অসহায়, মেহুল।’
মেহুল তার দিকে আবার ফিরে তাকায়। লোকটার জন্য তার খুব মায়া হয়। ইশ, মাথার ভেতর এমনিতেই তার কত দুশ্চিন্তা। তার উপর সেও এখন বাড়তি চাপ সৃষ্টি করছে। মেহুল তাই নাক টেনে নিজেকে শান্ত করে। বলে,
‘থাক, আমার জন্য আপনি মা’কে কষ্ট দিয়েন না। আমি চাইনা আমার জন্য আপনাদের সম্পর্ক খারাপ হোক। মা যা বলবেন আমি তাতেই রাজি।’
রাবীর উদাস চোখে মেহুলের দিকে তাকায়। মেয়েটা মুখে যা’ই বলুক না কেন, তার চোখ তো অন্য কথা বলছে। চোখের সামনে তো তার বিষন্নতা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। রাবীর কী করে এই মেয়েটার প্রতি এত কঠোর হবে? সে বলে,
‘আপনি জানেন, আপনার চোখও কথা বলে? আর আপনার এই মুখের কথার সাথে আমি আপনার চোখের কথার কোনো মিল পাচ্ছি না, মেহুল। আপনি কষ্ট পাচ্ছেন। মায়ের সাথে আমি কথা বলব। আমি বুঝিয়ে বলব সব। দেখবেন, মা অবশ্যই রাজি হবেন।’
‘আর যদি না হোন?’
মেহুলের এই প্রশ্নের আর কোনো জবাব দেয়না রাবীর। কেবল গাড়ি চালানোতে নজর দেয়। মেহুল তখন নিজ থেকেই বলে,
‘মা রাজি না হলে আমিও আর গান গাইব না। অনার্সটা কোনোরকমে শেষ করব। তারপর আপনি আমাকে আপনার বাড়িতে নিয়ে যাবেন। সেখানে আমি আর পাঁচটা মেয়ের মতোই একটা ছোট্ট সংসার শুরু করব। আর তারপর আমাদের বাচ্চা কাচ্চা হবে। মা নাতি নাতনিদের নিয়ে খুশিতে সময় কাটাবেন। আমিও আমার মতো সংসার করে যাব। ভালো না আইডিয়াটা?’
রাবীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে। বলে,
‘আমি শুনেছি মেয়েরা নাকি সব পারে। আজ মনে হচ্ছে, আসলেই মেয়েরা সব পারে। খুব নিখুঁত ভাবে তার স্বপ্নকে পা মাড়িয়ে দিয়ে সেখানে বাস্তবতার পাহাড় গড়ে তুলতে পারে। অথচ সেই পাহাড়ের নিচে চাপা পড়েই যে আজীবন তাকে কাতরাতে হয়, সেটা একটা মেয়ে কোনোভাবেই বুঝতে পারে না। আর আপনার সাথে আমি তেমনটা হতে দিব না, মেহুল। আপনি যতদিন পর্যন্ত না সবকিছু খুশি মনে মেনে নিচ্ছেন ততদিন পর্যন্ত এসবের কিছুই হবে না।’
চলবে…