তুমি_হৃদয়ে_লুকানো_প্রেম #তাহিরাহ্_ইরাজ #পর্ব_৪১

0
435

#তুমি_হৃদয়ে_লুকানো_প্রেম
#তাহিরাহ্_ইরাজ
#পর্ব_৪১

” তূর্ণ! ”

ক্রন্দনে লিপ্ত বাড়ির রমণীবৃন্দ। তাসলিমাকে আগলে রাখা হয়ে ওঠেছে মুশকিল। তাহমিদা বড় বোনকে সযতনে আগলে রেখেছে। বারবার শান্ত করার চেষ্টা করছে। কিন্তু ফলাফল শূন্য। তাসলিমা কেঁদেই চলেছে। হসপিটাল লবি দিয়ে চলাচলরত কিছু নার্স, ওয়ার্ড বয় তা দেখে আফসোস করলো। আবারো কারো আপনজন বিপদে। দুঃসময়ে দিশেহারা পরিবারের সদস্যরা। তারা সেথা হতে চলে গেল। এ যে তাদের দৈনন্দিন চিত্র। দুঃখ বিরহে কাতর দুয়া বসে স্টিলের আসনে। আর’ক্ত আভা ছড়িয়ে মুখশ্রীতে। নোনাজলে পূর্ণ অক্ষি। একদম শান্ত স্থির হয়ে বসে মেয়েটি। কোনো নড়চড় নেই। নেই কোনো আহাজারি। তবে তার হৃদ গহীনে চলমান তা.ণ্ডব বাহির হতে অনুধাবন করা অতটাও দুষ্কর নয়। পরিবারের সদস্যরা ঠিক বুঝতে পারছে মেয়েটির ভেতরে কি ঝড় ই না উঠেছে। তার অর্ধেক অংশ-অর্ধাঙ্গ যে শয্যাশায়ী। যন্ত্রণা সয়ে চলেছে শুভ্র চাদরের বুকে। র ক্তে র|ঞ্জিত তার গৌর কায়া। অসহনীয় যাতনা শরীরের আনাচে কানাচে। দুয়া’র কপোল ছুঁয়ে অশ্রু কণা গড়িয়ে পড়লো।

বেশ কিছুক্ষণ বাদে বেরিয়ে এলো চিকিৎসক। তৎক্ষণাৎ ছুটে গেলেন নিজাম সাহেব, রিশাদ এবং তৃষা।

” ডক্টর? আমার ছেলে..? ও-ও কেমন আছে? ঠিক আছে তো? ”

” পেশেন্ট এর অবস্থা ভালো নয়। মাথায় এবং পায়ে আঘাত পেয়েছে। বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে মাথা। ব্লাড লস হচ্ছে খুব। আমরা আপাতত র`ক্তপাত বন্ধ করার চেষ্টা করছি। সিটি স্ক্যান করে দেখতে হবে আর কোনো ক্ষতি হয়েছে কিনা। ”

প্রস্থান করলেন চিকিৎসক। তাসলিমা ছোট বোনকে জড়িয়ে আরো কেঁদে উঠলেন। স্তব্ধ দুয়া অনুধাবন করতে পারলো তার বাঁ কাঁধে তানজিনা’র ভরসার হাতখানি।
°

র.ক্তনালীর দেয়ালে চাপ পড়লে তা ফেটে যায়। পালাক্রমে মস্তিষ্কের টিস্যুতে র.ক্ত প্রবাহিত হতে পারে যাকে বলা হয় ইন্ট্রাসেরিব্রাল হেমোরেজ। বা এটি মস্তিষ্কের চারপাশে অবস্থিত স্থানের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে পারে যাকে সাবরাচনয়েড হেমোরেজ বলা হয়। গাড়ির স্টিয়ারিং হুইলে মারাত্মক আঘাত পেয়ে তূর্ণ’র মস্তিষ্কের টিস্যুতে র.ক্তক্ষরণ হচ্ছে। দ্রুত সার্জারি করতে হবে। সংবাদটি জানতে পেরে চেতনা হারালেন তাসলিমা। দিশেহারা পরিবারের সদস্যবর্গ। ভারসাম্য হারিয়ে আসনে বসে পড়লো দুয়া। ভোঁ ভোঁ শব্দ সৃষ্টি হচ্ছে মস্তিষ্কে। কম্পিত অন্তঃস্থল।

নিজাম সাহেব দ্রুত হসপিটালে টাকা জমা দিলেন। সার্জারির ব্যবস্থা শুরু করলো চিকিৎসকরা। অপারেশন টেবিলে শুয়ে চেতনাহীন তূর্ণ। চিকিৎসকরা সার্জারি শুরু করলো। বাহিরে অপেক্ষারত সকলে। দুয়া, তৃষা নামাজের কক্ষে নফল ইবাদতে মশগুল। তাসলিমা দ্বিতীয়বারের মতো হুঁশ হারিয়েছেন। নিজাম সাহেবের ঘাম ছুটে গেছে। উনি নিস্তব্ধতায় আচ্ছাদিত হয়ে বসে। তূর্ণ’র বন্ধুমহল খবর পেয়ে খানিক পূর্বেই ছুটে এসেছে। সময় তখন ফজরের আগ মুহূর্ত। ঘন্টাব্যাপী সার্জারি চললো। অবশেষে সমাপ্ত হলো ব্রেন সার্জারি। অপারেশন থিয়েটার হতে বেরিয়ে এলেন চিকিৎসক। মনিকা, রাজীব ছুটে গেল। মনিকা থেমে থেমে জিজ্ঞেস করলো,

” ডক্টর! তূর্ণ? ”

চিকিৎসক ওকে দেখে কিঞ্চিৎ অবাক হলো!

” ডক্টর হক! আপনি এখানে? ”

” জ্বি। পেশেন্ট তূর্ণ আমার ফ্রেন্ড। ও ঠিক আছে তো? ”

” জ্বি অপারেশন সাকসেসফুল। ফেটে যাওয়া র.ক্তনালী রিকোভার করা হয়েছে। ইনশাআল্লাহ্ সকালের মধ্যে পেশেন্টের জ্ঞান ফিরবে। ”

শুকরিয়া আদায় করলো সকলে। এক পশলা স্বস্তির বৃষ্টি নেমে এলো সেথায়। মনিকা খুব করে চিকিৎসকের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলো। কৃতজ্ঞতা গ্রহণ করে সেথা হতে প্রস্থান করলেন চিকিৎসক।

ভানু’র কিরণে আলোকিত বসুন্ধরা। আস্তে আস্তে করে হসপিটাল হতে পরিবারের সদস্যরা ভিড় কমালো। বলেকয়ে অধিকাংশ সদস্যকে বাড়ি পাঠানো হয়েছে। তবে তাসলিমা এবং দুয়া কিছুতেই গেল না। রয়ে গেল সেথায়। ঘড়ির কাঁটা ধরে সময় অতিবাহিত হতে লাগলো। তূর্ণ অচেতন প্রায় পাঁচ ঘন্টা। এখনো চেতনা ফেরেনি। এজন্য চিন্তিত সকলে। তবে ডক্টর আশ্বস্ত করেছে চিন্তার কারণ নেই। এতবড় আঘাতের পর শরীর জাগ্রত হতে একটু সময় লাগবে।

ভেজানো দ্বার উন্মোচন করে প্রবেশ করলো দুয়া। ফুলো র.ক্তিম দৃষ্টি নিবদ্ধ হলো শয্যাশায়ী মানবের পানে। চেতনাহীন শুয়ে সে। মাথায় মোড়ানো সফেদ ব্যান্ডেজ। বাঁ পায়েও ব্যান্ডেজ। দেহে জড়ানো পাতলা কাঁথা। কাঁথার অন্তরাল হতে বেরিয়ে দুই পায়ের একাংশ। গুমড়ে উঠলো মেয়েটি। বুকের মধ্যিখানে খা ম চে ধরলো দা.নবীয় কোনো হস্ত। তোলপাড়ে বি ধ্ব স্ত অন্তঃস্থল। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কদম ফেলে অগ্রসর হতে লাগলো মেয়েটি। প্রতিটি কদমে ভেতরকার যাতনা আরো জাগ্রত হতে লাগলো। ক্রন্দনে দিশেহারা হতে চাইছে নেত্র জোড়া। বিছানার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো দুয়া। আলতো ছোঁয়ায় পায়ের ওপর কাঁথা জড়িয়ে দিলো। বসে পড়লো পদযুগল সংলগ্ন। সুস্থ ডান পা’টি আঁকড়ে ধরলো। কপোল ছুঁয়ে গড়িয়ে পড়লো নোনাজল। অস্ফুট স্বরে ডেকে উঠলো,

” শুনছো? ”

ওপাশ হতে সাড়া মিললো না। ভেজা কণ্ঠে একাকী বলতে লাগলো,

” অনেক তো ঘুমালে। আর কত? এবার ওঠো না। সবাই তোমার অপেক্ষায় রয়েছে। মামণি, বাবা, তৃষা। সব্বাই। ত্ তোমার বন্ধুরাও এসেছে। সবাই কষ্ট পাচ্ছে তো। তুমি কি তা বুঝতে পারছো না? কেন আমাদের জেনেশুনে ক্ষ.তবিক্ষত করছো? এবার ওঠো না। চোখ মেলে একবার তাকাও। আমাদের। আমাদের সাথে দু দন্ড কথা বলো। বলো না। ”

কিচ্ছুটি বললো না নি`ষ্ঠুর মানব। শুয়ে রইলো একরোখা রূপে। দুয়া’র সুডৌল নাকের ডগায় যেন র ক্ত জমেছে। এতটাই র.ক্তিম! মেয়েটি আস্তে ধীরে বিছানা ত্যাগ করলো। দাঁড়ালো সোজা হয়ে। এগিয়ে গিয়ে জায়গা করে নিলো শিয়রে। মাথায় মোড়ানো সফেদ ব্যান্ডেজ ছুঁয়ে দেখতে গিয়েও হাত ফিরিয়ে নিলো। কেঁপে উঠল কোমল হাতটি। নিম্ন অধর কা`মড়ে নিজেকে সামাল দেবার প্রয়াস চালিয়ে গেল।

” ওঠো না। ত্ তুমি না তোমার মাইরা’র চোখে অশ্রুবিন্দু সইতে পারো না? আজ যে তোমার মাইরা কাঁদছে। তোমার বিরহে ক্লিষ্ট তার হৃদয়। তুমি কি তা অনুধাবন করতে পারছো না? অ্যাই। ওঠো না। দয়া করে আমাকে আর যন্ত্রণা দিয়ো না। ওঠো। একবার চোখ মেলে তাকাও না। অ্যাই.. ”

উঠলো না তূর্ণ। দিলো না তার মাইরা’র ডাকে সাড়া। অচেতন মানুষটির হাত আঁকড়ে ধরলো দুয়া। আস্তে ধীরে বসে পড়লো বেডের দেহ ঘেঁষে। পুরুষালি শক্তপোক্ত হাতে মাথা ঠেকিয়ে কাঁদতে লাগলো দুয়া। চার দেয়ালের মাঝে চাপা পড়লো সে যন্ত্রণা, ক্রন্দন ধ্বনি।

ওয়েটিং জোনে বসে তৃষা। থমথমে মুখশ্রী। কপোলে অশ্রুর শুকনো ছাপ। ঠিক তখনই পাশে এসে বসলো কেউ। কারোর উপস্থিতি অনুভব করে বায়ে তাকালো তৃষা। নিশাদ বসে। কোনোরূপ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলো না মেয়েটি। আস্তে করে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। নিশাদ সবটাই বুঝলো। অনুধাবন করতে পারলো। আপনজনের বিপদে কি যে যন্ত্রণা! সে তো অবগত। বছর ছয় পূর্বে এর থেকেও করুণ, ভ.য়ঙ্কর মুহূর্ত সে অতিবাহিত করেছে। হারিয়েছে জন্মদাতা পিতাকে। চিরতরে চলে গেল জন্মদাতা, সবচেয়ে বড় আশ্রয়স্থল। ভরসাযোগ্য মানুষটি। সেখানে তৃষা তো ভাইয়ের দুর্ঘটনায় কাতর। ছোট কোমলমতি হৃদয়ের অধিকারিণী মেয়েটার মানসিক অবস্থা সম্পর্কে সে অবগত। জানে কতটা যন্ত্রণা হচ্ছে। তবে এখন স্রষ্টা ছাড়া কোনো কূলকিনারা নেই। একমাত্র তিনিই ভরসা। মহান স্রষ্টা তিনি, বিপদে রক্ষাকর্তা। বান্দার একমাত্র সাহারা।

” দুঃখে জর্জরিত হোস না তৃষা। আল্লাহ্’কে স্মরণ কর। উনি নিশ্চয়ই মুখ তুলে তাকাবেন। ইনশাআল্লাহ্ সব ঠিক হয়ে যাবে। তূর্ণ আবার.. ”

বাক্য অসম্পূর্ণ রয়ে গেল। ক্রন্দনে লিপ্ত ললনা ছুটে সেথা হতে প্রস্থান করলো। নিশাদ ব্যথিত চাহনিতে সে পথে তাকিয়ে রইল। ইশ্! বুকের মধ্যিখানে চিনচিনে ব্যথা অনুভূত হচ্ছে। কেমন যন্ত্রণা হচ্ছে রন্ধ্রে রন্ধ্রে।

” পেশেন্টের জ্ঞান ফিরেছে। ”

তিন শব্দের এক ইতিবাচক বাক্য। স্বস্তির ছোঁয়ায় আবেশিত হলো পরিবারের সদস্যরা। খুশিতে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়লো রমণীবৃন্দ। পুরুষরা কেউ কেউ ফোন করে স্বজনদের সুসংবাদ দিচ্ছে। কেউ কেউ খুশিতে আপ্লুত। সে এক চক্ষু জুড়ানো মুহূর্ত! জাবির শুধু অবলোকন করলো সবটা। দুয়া’র চোখে অশ্রু ঠোঁটে হাসির রেখা। স্বামীর জন্য অনবরত ইবাদত বন্দেগী করা, নফল রোজা মানত করা – সবটার সাক্ষী সে রইলো। অনুধাবন করতে পারলো তার হৃদয়ে লুকানো অনুভূতি আজ স্বামীর সনে কতটা খুশি! তারা একে অপরকে কতটা ভালোবাসে! সে আবছা নয়নে তাকিয়ে প্রার্থনা করলো ‘ স্রষ্টার রহমতে ভালো থাকুক এই ভালোবাসা যুগল ‘. দৃষ্টি সরিয়ে মামীর কাছে এগিয়ে গেল জাবির। তাহমিদা আবেগতাড়িত হয়ে ওর বুকে মাথা এলিয়ে দিলো।
.

সফেদ বিছানায় শুয়ে দীর্ঘকায় মানুষটি। নিমীলিত তার অক্ষি জোড়া। হঠাৎ কর্ণ কুহরে পৌঁছালো কারো ফোঁপানি ধ্বনি। আস্তে ধীরে তাকালো তূর্ণ। ক্ষ`তস্থানে চিনচিন ব্যথা অনুভূত হলো। কিঞ্চিৎ বিকৃত হলো মুখমণ্ডল। তা লক্ষ্য করে ছুটে এলো জন্মদাত্রী মা।

” আস্তে আস্তে। খুব লেগেছে? ডাক্তার ডাকবো? ”

অস্থির হয়ে পড়লেন তাসলিমা। মা’কে শান্ত করতে অস্ফুট স্বরে ডেকে উঠলো তূর্ণ,

” আ ম্মু। ”

নাড়িছেঁড়া ধন পুত্রের ডাক শুনে শীতল হলো মাতৃহৃদয়। ওড়নার একাংশে মুখ লুকিয়ে কেঁদে উঠলেন উনি। যন্ত্রণায় চোখ বুজে নিলো মানুষটি। শুকনো ঢোক গিলে ক্ষীণ স্বরে বললো,

” কেঁ-দো না। ”

পুত্রের নিষেধাজ্ঞা মান্য করে জোরপূর্বক থেমে গেলেন তাসলিমা। হাতের উল্টো পিঠে অশ্রু কণা মুছে নিলেন। পুত্রের শিয়রে দাঁড়িয়ে বুকে হাত বুলাতে বুলাতে স্নেহাতুর স্বরে প্রশ্ন করলেন,

” ঠিক আছো আব্বা? ”

চোখ মেলে তাকালো তূর্ণ। আস্তে করে চোখের পলক ঝাপটে সম্মতি জানালো। যদিওবা তা পুরোপুরি সত্য নয়। এখনো বড্ড ব্যথা। তবে তা মা’কে বললো না। মাতৃহৃদয় তো? আরো ব্যাকুল হয়ে উঠতো। আস্তে করে থেমে থেমে তূর্ণ বললো,

” আব্বু কোথায়? ”

” বাইরে। ডাকবো? মানুষটা ভেতরে আসতেই চাইছে না। আবেগী হয়ে পড়ছে। ”

তূর্ণ কিছু বললো না। শুধু তাকিয়ে রইল দরজায়। তার তৃষ্ণার্ত-পীড়িত হৃদয় যে কারোর দর্শনের অপেক্ষায়! মা ঠিক বুঝতে পারলো।

” তুমি বিশ্রাম নাও আব্বা। ঠিক আছে? আমি আসছি। ”

বেরিয়ে গেলেন তাসলিমা। তূর্ণ কিছু বলতে গিয়েও ব্যর্থ হলো। তার যাতনায় পিষ্ট অক্ষি গড়িয়ে পড়লো তপ্ত জল।
.

নামাজ কক্ষে স্রষ্টার শুকরিয়া আদায়ে মশগুল দুয়া। হঠাৎ কর্ণ গহ্বরে পৌঁছালো মামণির কণ্ঠস্বর।

” দুয়া! ”

আবেগী হয়ে পড়লো মেয়েটা। অনুধাবন করতে পারলো এ ডাকের মর্ম। আস্তে করে বাঁ পার্শ্বে দরজায় তাকালো। তাসলিমা শুধু বললেন,

” তূর্ণ তোকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। ওর কাছে যা মা। ”

চলবে.

[ দু লাইন মন্তব্য আশা করছি তূর্ণ’র তরে। ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here