#বিবর্ণ_বসন্ত
৯ম_পর্ব
~মিহি
-‘খাবার বেড়েছি। খেতে এসো।’
-‘তুমি খেয়েছো?’
সোহরাবের প্রশ্নে অবাক হলো অনামিকা। আজ প্রথম সোহরাব অনামিকার খাওয়ার খোঁজ নিচ্ছে। অনামিকা মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইল। সোহরাব টাই খুলতে খুলতে আবারো প্রশ্ন করলো,’কী হলো? খেতে যাবে না? বসো যাও, আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।’ অনামিকা মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো। সোহরাবের কর্মকাণ্ডে অনামিকা সাজিয়ার কথার প্রতিচ্ছবি দেখতে পেল। সংসার আয়নারই মতো। সোহরাব ফ্রেশ হয়ে খাবার টেবিলে গেল। রাহেলা বানুর কোমড় ব্যথা বেড়েছে। সে বাহানায় তিনি এখন দিনরাত বিছানায় শুয়ে থাকেন। খাবার-দাবারও বিছানায়। তন্বীর শরীর আগের চেয়ে ভালো তবে নাদিমের সাথে তার কথা হচ্ছে না সে দুঃখেই তন্বী মৃতপ্রায়। রাহেলা বানুও তার সাথে কথা বলছেন না। বলতে গেলে তন্বী আবারো একা হয়ে পড়েছে। খাবারটা সেও নিজের ঘরেই খায়। সুমি আগেই খেয়ে নিয়েছে। খাবার টেবিলে অনামিকা, সোহরাব আর সাজিয়া শেখ। সাজিয়া অল্প একটু খেয়েই ঘরে চলে গেলেন। সোহরাব আর অনামিকা মুখোমুখি বসে অথচ দুজনের মুখে কোনো কথা নেই। সোহরাবের কেন যেন অনামিকার কাছে ক্ষমা চাইতে ইচ্ছে করছে কিন্তু কোথাও একটা অদৃশ্য দেয়াল কাজ করছে। অনামিকাই কথা শুরু করলো।
-‘রাইসা আপু সুস্থ আছেন এখন?’
-‘হুম। এনআইডিটা ওর বাড়িতে ফেলে এসেছিলাম আগেরদিন। ও আজকেই চলে যাচ্ছিল তাই ওটা ফেরত দিতে ডেকেছিল।’
-‘কৈফিয়ত দিচ্ছেন?’
চমকাল সোহরাব। আসলেই তো সে কৈফিয়ত দিতে শুরু করেছে কিন্তু অনামিকা তো কোনো প্রশ্ন করেনি। অনামিকার কথাটা এড়িয়ে গেল সোহরাব।
-‘তোমার পরীক্ষা কবে শুরু?’
-‘টেস্ট পরীক্ষা দুই-একদিনের মধ্যেই শুরু হবে।’
-‘তুমি তো আর্টসে পড়ছো তাই না? বই সব আছে?’
-‘আর্টসে না, সায়েন্সেই পড়ি।’
-‘সে কী! তাহলে পড়াশোনা বাদ দিয়ে দিছো কেন? প্রাইভেট পড়তেও তো দেখিনা, কভার করবে কিভাবে? কাল থেকেই প্রাইভেট শুরু করো।’
-‘শুরুর দিকে পড়েছিলাম, এখন নিজে নিজে পড়লেই হবে।’
-‘আচ্ছা হেল্প লাগলে বলিও আমাকে। তোমার হাজবেন্ড কিন্তু ম্যাথ ভালোই পারে যদিও বলেনি কখনো। নিজের ঢোল নিজে পেটাতে ভালো লাগেনা আর কী!’
কথাটা বলেই চুলে হাত চালালো সোহরাব। অনামিকা ঠোঁট টিপে হাসলো। সোহরাবের মনে হলো এত সুন্দর হাসি সে আগে কখনো দেখেনি। অবশ্য অনামিকা বোধহয় এত সুন্দর করে এই প্রথম হাসলো।
খাবার শেষ করে সোহরাব প্লেট ধুয়ে রান্নাঘরে রেখে দিল। অনামিকা সোহরাবের পরিবর্তনটা খেয়াল করছে। সচরাচর সোহরাব প্লেটে পানি ঢেলে ওভাবেই ফেলে যেত।
-‘অনামিকা, ফুফু আর আম্মা ওষুধ খেয়েছে কিনা একটু খোঁজ নিও তো।’
-‘আচ্ছা আপনি ঘরে যান।’
সোহরাব মাথা নাড়িয়ে ঘরের দিকে এগোলো। অনামিকা প্লেট রেখে প্রথমে সাজিয়া শেখের রুমের দিকে গেল। সাজিয়া মাত্র ওষুধ খেয়ে বসেছেন। অনামিকা পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো তাকে।
-‘বাব্বাহ! আজ এই মায়ের প্রতি এত ভালোবাসা!
-‘কী যে বলো না মা। তোমাকে কি আমি কম ভালোবাসি?’
-‘তা বুঝলাম কিন্তু এত খুশি খুশি লাগছে যে? দুপুর অবধি তো মুখটা গোমড়া করে রেখেছিলি।’
-‘এমনি।’
-‘বুঝি বুঝি। যা ঘরে যা।’
-‘ওষুধ খেয়েছো?’
-‘হ্যাঁ। যা এখন, তোর খুশির কারণ অপেক্ষা করছে।’
অনামিকা লজ্জা পেয়ে সেখান থেকে চলে এলো। রাহেলা বানুর কাছে ওষুধের কথা জিজ্ঞাসা করতেই উনি কর্কশ কণ্ঠে অনামিকাকে ঘর থেকে বেরোনোর আদেশ দিলেন। অনামিকা কিছু না বলে চলে আসতে নিল। ঘরে ঢোকার পূর্বমুহূর্তে অনামিকার চোখ গেল সিঁড়ির দিকে। তন্বী সতর্ক পায়ে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠছে। অনামিকার বিষয়টা খটকা লাগল। সে তন্বীর পিছু নিল।
তন্বী দ্রুত পায়ে ছাদের এককোণে দাঁড়ালো। চিলেকোঠায় যাওয়ার সাহস আর তার নেই। হাতে লুকিয়ে রাখা মায়ের ফোনটা বের করলো তন্বী। ডায়াল করলো নাদিমের নম্বরে। প্রথমবার রিং হতেই ওপাশ থেকে কেটে দেওয়া হলো। তন্বী আবারো কল দিল, আবারো কেটে গেল। প্রায় চারবারের মাথায় কল রিসিভ করলো নাদিম। ফোন কানে ধরেই কেঁদে উঠলো তন্বী।
-‘নাদিম, তুমি এভাবে অবহেলা করছো আমায়?’
-‘তোমার মায়ের আচরণ কি যথেষ্ট কারণ নয় এটার? উনি কখনো আমাকে মেনে নেবেন না। তাই অযথা এ সম্পর্ক কন্টিনিউ করে কী লাভ?’
-‘নাদিম, তুমি এভাবে বলো না প্লিজ। আমি অনেক ভালোবাসি তোমায়।’
-‘তোমার পরিবারের অনিচ্ছায় আমি তোমায় বিয়ে করতে পারবোনা।’
-‘প্রেম করার সময় মনে ছিল না এটা?’
নাদিম কিছুক্ষণ চুপ থেকে কলটা কেটে দিল। তন্বী আবারো ডায়াল করলো। নম্বর ব্যস্ত বলছে। নাদিম তবে ব্লক করে দিয়েছে তাকে! সব ভালোবাসা কি তবে উবে গেল? ধপ করে সেখানেই বসে পড়লো তন্বী। চোখ থেকে নোনা জল নামছে বাঁধ ভেঙে। অনামিকা এতক্ষণ দূরে দাঁড়িয়ে সবটাই দেখছিল কিন্তু নাদিম কী বলেছে তা সে শোনেনি। তন্বীকে এখন সামলানো দরকার। অনামিকা তন্বীর কাঁধে হাত দিয়ে তাকে উঠালো। কোমল হাতের স্পর্শ পেয়ে তন্বী উপরে তাকালো। অনামিকাকে দেখে তাকে জড়িয়েই কাঁদতে শুরু করলো। অনামিকা কী করবে বুঝে উঠতে পারলো না। তন্বীকে কী বলে সান্ত্বনা দিলে সে বুঝবে!
-‘তন্বী, ভালোবাসা শব্দটা ভুল মানুষের জন্য নয়। এখন তোমার বয়স অল্প। তুমি কি এখন নিজের জন্য বেস্ট জামাটা কিনতে পারো নাকি ফুফু কিনে দেয়? অবশ্যই বড় কেউ তোমার জন্য সেরাটা বাছতে পারে এখন। কিন্তু আর কয়েক বছর পর তুমি ম্যাচিউর হবে, তখন তুমি নিজেই নিজের জন্য সেরাটা বাছাই করতে পারবে।’
-‘ভাবী, নাদিম কিভাবে করতে পারলো এটা?’
-‘ভুল মানুষের কাছে ঠিকটা আশা করোনা। মন দিয়ে পড়াশোনা করো। তখন দেখবে সবার নজর তোমাতে আবদ্ধ থাকবে।’
-‘বুঝেছি ভাবী।’
-‘নিচে গিয়ে হাতমুখ ধুয়ে শুয়ে পড়ো।’
তন্বী মাথা নাড়িয়ে চলে গেল। অনামিকাও নিজের ঘরে ফিরল। ঘরে ঢুকতেই দেখল সোহরাব ঘুমিয়ে পড়েছে, লাইটটাও অন। অনামিকা বুঝতে পারলো সোহরাব তার অপেক্ষা করতে করতে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। লাইটটা অফ করে সেও পাশে শুয়ে পড়লো।
______________________
পরবর্তী দিনগুলো স্বাভাবিকই কাটলো। সোহরাব-অনামিকার সম্পর্কের যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে। রাহেলা বানুর কূটকৌশল কোনো কাজে লাগেনি। আজ তিনি শ্বশুরবাড়িতে ফিরবেন। বিপত্তি বাঁধলো রাহেলার যাওয়ার বেলায়। রাহেলা স্পষ্ট গলায় জানালেন তিনি তন্বীকে নিয়ে যাবেন না। রেজাল্ট বের হলে তন্বীকেও সুমির সাথে এখানকার কলেজেই ভর্তি করে দিয়ে হোস্টেলে রাখবেন। তার ধারণা বাড়িতে গেলেই তন্বী আবার নাদিমের সাথে যোগাযোগ করবে। তাকে কোনোভাবেই কিছু বোঝানো গেল না। শেষমেশ সাজিয়া তার প্রস্তাব মানলেন। তন্বীকে এখানেই ভর্তি করানো হবে তবে সে হোস্টেলে না, এ বাড়িতেই থাকবে। রাহেলা আপত্তি করলেন না। তন্বীর তাতে কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। সে এমনিতেও নাদিমের মুখোমুখি হতে চায় না। নাদিমও তার মূল্য বুঝতে শিখুক। রেজাল্ট বের হলো তার ঠিক দশদিন পর। সুমি ও তন্বী দুজনেই জিপিএ ফাইভ পেয়েছে। সুমির মার্কস ভালো আসায় সহজেই স্থানীয় কলেজে ভর্তি হতে পারলো কিন্তু তন্বীকে ভর্তি করার জন্য সোহরাব প্রধান শিক্ষকের সাথে কথা বলল। একই কলেজে সোহরাবও পড়েছে তাই প্রধান শিক্ষক তার কথা রাখলেন। একই কলেজে দুজনকেই ভর্তি করানো হলো। দুজনেই আর্টসের স্টুডেন্ট। সোহরাব তাদের জন্য টিউটরও ঠিক করলো। অনামিকার তখন পরীক্ষা চলছে। সংসারের কাজকর্ম সামলে পড়তে গিয়ে সে হিমশিম খাচ্ছে। টেস্ট শেষ করে কয়দিন পর এইচএসসি। সব মিলিয়ে অনামিকার উপর দিয়ে ঝড় বয়ে যাচ্ছে। সোহরাব অবশ্য সবসময় অনামিকার পরিশ্রম কমানোর চেষ্টায় নিয়োজিত। মাঝেমধ্যে রাতের খাবারটাও সে অফিস থেকে তাড়াতাড়ি এসে রান্না করে। অনামিকা এসব দেখে আর আলহামদুলিল্লাহ বলে। আল্লাহর কাছে সে অভিযোগ করেছিল একদিন অথচ মহান আল্লাহ তার ভাগ্যে যে কত সুখ লিখে রেখেছিলেন তা তো সে জানতো না। এ সুখ কি স্থায়ী হবে নাকি আবারো কোনো অশান্তি এসে এ সুখটাকে বিনষ্ট করে ফেলবে?
চলবে…