#বৃষ্টিভেজা_আলাপন (২৬)
ছোঁয়া হয়ত এই সময় তার প্রিয়তমের বুকে মাথা রেখে সুখ গুনে চলেছে। সময়টা মধ্য রাত কি না। দিনটা যতটা স্বস্তিতে গত হয় রাত ততই হয় বেদনার। রাতের এই সময়টায় এসে ঈশানের খুব করে মনে হয় নিজের একটা মানুষ প্রয়োজন। কিন্তু সেই মানুষের জায়গাটায় ছোঁয়া ছাড়া আর কাউকেই কল্পনা করতে পারে না সে। অথচ এটা ভীষণ অনুচিত। তীব্র বেদনা নিয়ে নিকোটিনে বুক পো ড়া য় সে। তার দু চোখে ঘুম না হওয়ার ছাপ যেন অন্যরকম সুর তুলেছে। শরীরের গঠন ভেঙে গিয়েছে এ কদিনেই। মনে হচ্ছে কত দিন ধরে যত্ন নেওয়া হয় না! বেসিং এর আয়নায় নিজের মুখশ্রী দেখতে দেখতে চোখে মুখে পানি দিচ্ছিল ঈশান। রাতের আঁধারে ঝিঝি পোকার দল শব্দ করছে। রাতের আকাশে নিশ্চয়ই মেঘ জমেছে। সন্ধ্যা থেকেই তো বৃষ্টি হলো। বড়ো অধৈর্য হয়ে ঘরে এল ঈশান। ক্লোজেট ঘেটে ঘুমের ঔষধ বের করল। প্রতি রাতে ঘুমের জন্য ঔষধ ব্যবহার করতে হয়। তবু কখনো কখনো দু চোখে ঘুম নামে না। নিষ্ঠুর হয়ে উঠেছে তার বেঁচে থাকা। কান্নারা হানা দিচ্ছে দু চোখে। মেঝেতে ধপ করে বসে পড়ল সে। এত কষ্ট কেন হয় তার?
উষশী ঘুম ভাঙতেই লাবণ্যকে পাশে পেল না। তাকে পাওয়া গেলে বারান্দায়। গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে অদূরের ফুল গাছ গুলো দেখছে সে। তার চুল গুলো এলোমেলো। গায়ে রাতের পোশাক। যা ভিজে পুনরায় শুকিয়েছে।
“আপু, তুমি কি গত রাতে ঘুমাতে আসো নি?”
কথা নেই লাবণ্য’র মুখে। সে হাল্কা হাতে মেয়েটির বাহু ছুঁতেই সর্বাঙ্গে উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ল।
“তোমার জ্বর এসেছে! আপু, আপু কি হয়েছে তোমার?”
ব্যগ্র হয়ে উঠেছে উষশী’র কণ্ঠ। লাবণ্য’র সাড়া না পেয়ে পাগলের মতো ছুটে বেরিয়ে পড়ল। পথিমধ্যে মালতির সাথে দেখা হলো।
“উষশী, এভাবে দৌড়াচ্ছ কেন?”
“লাবণ্যপু, লাবণ্যপু’র যেন কি হয়েছে।”
কথা জড়িয়ে আসছে মেয়েটির। মালতি সময় নষ্ট না করে সোজা লাবণ্য’র ঘরে এল। লাবণ্য তখন মেঝেতে বসে পড়েছে। শরীরে ভীষণ উত্তাপ।
“হায় আল্লাহ! জ্বরে শরীর পুড়ে যাচ্ছে। কাউকে ডাকিস নি কেন?”
সাড়া নেই লাবণ্য’র। ওর চোখ দুটো ঘোলাটে হয়ে এসেছে। উষশী’র কণ্ঠ পেয়ে ইতোমধ্যেই অভিরাজ চলে এসেছে। মিনিটের মধ্যেই চলে এল বাড়ির বাকি সদস্য। লাবণ্য শেষ বারের মতো দেখছে সবাইকে। তার চোখ দুটো বিষাদে মাখা। সে নিরলস ভাবে তাকিয়ে রইল অভি’র পানে। তারপরই ফুরিয়ে এল তার শক্তি। অসাঢ় হয়ে গেল সর্বাঙ্গ। ক্ষণিকেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলল মেয়েটি।
অসুস্থ লাবণ্য। তার শারীরিক স্বাস্থ্যের উন্নতি হলো দুদিন পর। অভিরাজ এই দুদিন অনেক বেশি যত্ন করেছে তার। সেই থেকেই সকলের মাঝে একটা গুঞ্জন চলছে। সবাই ভাবছে তাদের মধ্যে কোনো সম্পর্ক তৈরি হয়েছে কিংবা হবে। ছোট বেলা থেকে বন্ধু আর কাজিন হওয়াতে এই সম্পর্কের নাম দিতে অস্বস্তি হচ্ছে ওদের। এমন সব ভাবনাই চলছে সকলের মাঝে। দুদিনে একটিবার কথা হয় নি উষশী’র সাথে। মেয়েটিও আসে নি সময় নিয়ে। সে রত্নার সাথে ঘুমিয়েছে। ঘর থেকেও খুব একটা বের হয় নি। লাবণ্য একটু সুস্থ অনুভব করতেই উষশীকে খুঁজতে লাগল অভিরাজ। পেয়েও গেল। মেয়েটি বাড়ির পেছনের বাগানে বসে আছে। সেখানে একটা পুকুর রয়েছে। সেই পুকুরের জলে ছোট ছোট হাঁসের বাচ্চা ঘুরে বেড়াচ্ছে। সেগুলোই মুগ্ধ নয়নে দেখছে সে।
“ভোর বেলা একা একা এখানে কি করছো?”
না ঘুরেই উষশী বলল,”হাঁসের বাচ্চা দেখতে এসেছি। রত্না আপু বলেছিল দুই সপ্তাহ আগে বাচ্চা গুলো হয়েছে।”
“তাই বলে একা আসবে?”
“একা এলে কি হবে?”
“অনেক সমস্যা আছে। তুমি এই পরিবেশের সাথে পরিচিত নও উষশী।”
মেয়েটির পাশে বসল অভিরাজ। উষশী কোনো কথা না বাড়িয়ে ফের পুকুরের জলে দৃষ্টি ফেলল। মাথার উপর আম গাছ। সেখানে একটা পাখির বাসাও রয়েছে। পাখির বাচ্চা গুলো চি চি শব্দে ডেকে তুলেছে। কেমন একটা ভালো লাগা কাজ করছে। কিশোরীর ঘনিষ্ঠ হলো অভি। কণ্ঠে একরাশ মায়া ডুবিয়ে ডাকল।
“রেইন,রাগ হয়েছে আমার উপর?”
উষশী বুঝতে পারছে না। সে রাগ করেছে কি না জানে না। তবে একটা কষ্ট,অভিমান ঠিক ই জড়ো হয়েছে।
“জানি রাগ হওয়াটা স্বাভাবিক। লাবণ্য’র যত্ন নিতে গিয়ে তোমার খোঁজ রাখা হয় নি।”
এবার ও উত্তর নেই উষশী’র। অভি’র খারাপ লাগছে। কিশোরীকে নিজের দিকে ফেরাল সে।
“তুমি তো চালাক বাচ্চা। সব বুঝতে পারো। আসলে আমি ভুল করে ফেলেছি। একদমই উচিৎ হয় নি। সরি রেইন।”
ওর কথা বলার ভঙ্গিতে হেসে উঠল উষশী। বুকে হাত রেখে বলল,”এখানটায় সব সময় রাখলেই হবে। শারীরিক দূরত্ব আমার কাছে ম্যাটার করে না। তুমি শুধু ভালোবেসে যেও। কখনো ঘৃণা কোরো না। তোমার ভালোবাসার আন্দোলন সহ্য করে নিলেও ঘৃণা’র উত্তাপ সহ্য হবে না অভিরাজ।”
বর্তমান
অভি পারে নি মেয়েটিকে ঘৃণা করতে। আজ এত বছর হয়ে গেল যোগাযোগ নেই দুজনের। তবু একবিন্দু ভালোবাসা কমে নি অভিরাজের। সে সবটুকু দিয়ে একই ভাবে উষশীকে ভালোবেসে যাচ্ছে। অথচ মেয়েটি তার সাথে ছলনা করেছে। চোখের কার্নিশে জমে থাকা জলটুকু বুড়ো আঙুলে মুছে নিয়ে বাসা থেকে বের হলো সে। এক অজানা পথে।
ব্যবসায়িক নানা ঝামেলা নিতে নিতে আসাদ প্রায় অসুস্থ। ঈশান ভবঘুরে হয়ে ঘুরে বেড়ায়। তার দ্বারা এসব কখনোই হবে না সকলেই জানে। সে একটা ভালো পজিশনে জব করছে। ছোঁয়া’র বিয়ের পর একেবারেই ভেঙে বসেছিল। কোনো মতে গ্রাজুয়েশন শেষ করল। তারপরের একটা বছর একেবারেই ঘরকুনো হয়ে বসেছিল। এ পর্যন্ত আসতে বেশ ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে। এখন নিজের মতো ঠিকানা খুঁজে নিয়েছে। তাকে কেউ জোর করে না। বাড়ির দুই ছেলেই যদি এভাবে ব্যবসা থেকে হাত গুটিয়ে নেয় তবে ভবিষ্যৎ যে খুবই খারাপ হবে তা বেশ ভালোই বুঝেন আসাদ। পরিবারে ভাঙন ধরেছিল। সবাই আলাদা অবস্থান করছে দুইটা বছর। এখন আবার সবাই এক হয়েছে। ওনারা দুই ভাই ও আজকাল তেমন কাজ করতে পারে না। সকলেরই বয়স হচ্ছে। বিদেশের ডিল গুলো একটার পর একটা ক্যানসেল হচ্ছে। চিন্তায় আরো বেশি অসুস্থ হয়ে পড়লেন তিনি। ওনার এই অসুস্থ শরীর দেখেই হয়ত অভিরাজের মায়া হলো। সে নিজ থেকেই বলল ব্যবসায় জয়েন করবে। এই সময়টা পরিবারের প্রতিটা মানুষ বিস্মিত হয়ে রইল। অভিরাজ যে আগের মতো হবে সেই আশা বহু আগেই বাদ দিয়েছিল সকলে।
আমিনা আর আসাদ নিজ ঘরে বসে আছেন। লাবণ্য নক করে রুমে এল। হুট করেই বিশেষ দরকারে ডাকা হয়েছে তাকে।
“বড়ো আব্বু,কি বলতে চাইছিলে?”
“অভি’র বদল চোখে পড়ার মতো। আমার বিশ্বাস ও খুব দ্রুত ঠিক হয়ে যাবে।”
“আমার ও তেমনটাই মনে হচ্ছে।”
“লাবণ্য মা, আমার ছেলের জন্য অনেক করেছিস তুই। বিনিময়ে কিছুই পেলি না। এখনো একই ভাবে করে যাচ্ছিস। তোকে যে কি বলব বুঝতে পারছি না।”
“এভাবে বলো কেন বড়ো আম্মু? আমি কি তোমাদের মেয়ে নই?”
“সেই জন্যেই তো আরেকটা আবদার করব মা।”
লাবণ্য আমিনার বাহু জড়িয়ে ধরল। ওনার সাথে ছোট থেকেই আদুরে সম্পর্ক ওর।
“কি বলবে?”
আমিনা স্বামীর পানে তাকালেন। ওনার রুগ্ন চেহারাটা আজ আরো বেশি মলিন দেখাচ্ছে।
“চাচ্ছিলাম অভি’র সাথে বিজনেসে তুই ও জয়েন কর।”
“হসপিটালের কি হবে বড়ো আব্বু?”
“সেই জন্যে তো আমরা আছিই। আর তুই তো তোর প্র্যাকটিস চালিয়ে যাবি। অভি সব থেকে বেশি তোর সান্নিধ্য পছন্দ করে। তুই যদি এত গুলো বছর আগলে না রাখতি তাহলে ছেলেটা ম রে ই যেত।”
লাবণ্য মাথা নত করে ফেলল। ওর দু চোখ নিশ্চয়ই ভিজে উঠেছে। আমিনা মেয়েটির মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন।
“ছোঁয়া আর ইরা তো পুরো দমে সংসারী হয়ে উঠেছে। ঈশান ভবঘুরে। পারিবারিক ব্যবসায় ভীষণ অনীহা। তুই ই ভরসা মা। ব্যবসার সাথে সাথে অভি’র খেয়াল একমাত্র তুই ই রাখতে পারবি।”
পরের সপ্তাহে অভিরাজের সাথে লাবণ্য ও ব্যবসায় জয়েন করল। দুজনের এক সাথে কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে। একটা সময় হসপিটালের সমস্ত দায়িত্ব তো ওদের উপর ই ছিল। দুজনে ব্যবসায় ও ভালো করবে এই নিয়ে সন্দেহ নেই। প্রথম সপ্তাহেই বেশ ব্যস্ত হয়ে পড়ল ওরা। পুরো কাজ বুঝে নিয়ে একটা সুন্দর প্ল্যান ও করে ফেলল। গত ছয় মাসে ডেনমার্কের সাথে চারটে ডিল ক্যানসেল হয়েছে। এতে করে কোম্পানি’র হিউজ পরিমাণে লস হয়েছে। সেই লসের পরিমাণ গিয়ে ঠেকেছে শত কোটি টাকায়! তাদের কোম্পানি কখনো এত লসের মুখোমুখি হয় নি। অভিরাজ একটা অপরাধ বোধে ভুগছে। ছেলে হিসেবে নিজেকে অযোগ্য বলে মনে হচ্ছে। এই সময়ে লাবণ্য তাকে সান্ত্বনা দিল। আশ্বাস দিল সব ঠিক হয়ে যাবে বলে।
চলবে….
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি#বৃষ্টিভেজা_আলাপন (২৬)
ছোঁয়া হয়ত এই সময় তার প্রিয়তমের বুকে মাথা রেখে সুখ গুনে চলেছে। সময়টা মধ্য রাত কি না। দিনটা যতটা স্বস্তিতে গত হয় রাত ততই হয় বেদনার। রাতের এই সময়টায় এসে ঈশানের খুব করে মনে হয় নিজের একটা মানুষ প্রয়োজন। কিন্তু সেই মানুষের জায়গাটায় ছোঁয়া ছাড়া আর কাউকেই কল্পনা করতে পারে না সে। অথচ এটা ভীষণ অনুচিত। তীব্র বেদনা নিয়ে নিকোটিনে বুক পো ড়া য় সে। তার দু চোখে ঘুম না হওয়ার ছাপ যেন অন্যরকম সুর তুলেছে। শরীরের গঠন ভেঙে গিয়েছে এ কদিনেই। মনে হচ্ছে কত দিন ধরে যত্ন নেওয়া হয় না! বেসিং এর আয়নায় নিজের মুখশ্রী দেখতে দেখতে চোখে মুখে পানি দিচ্ছিল ঈশান। রাতের আঁধারে ঝিঝি পোকার দল শব্দ করছে। রাতের আকাশে নিশ্চয়ই মেঘ জমেছে। সন্ধ্যা থেকেই তো বৃষ্টি হলো। বড়ো অধৈর্য হয়ে ঘরে এল ঈশান। ক্লোজেট ঘেটে ঘুমের ঔষধ বের করল। প্রতি রাতে ঘুমের জন্য ঔষধ ব্যবহার করতে হয়। তবু কখনো কখনো দু চোখে ঘুম নামে না। নিষ্ঠুর হয়ে উঠেছে তার বেঁচে থাকা। কান্নারা হানা দিচ্ছে দু চোখে। মেঝেতে ধপ করে বসে পড়ল সে। এত কষ্ট কেন হয় তার?
উষশী ঘুম ভাঙতেই লাবণ্যকে পাশে পেল না। তাকে পাওয়া গেলে বারান্দায়। গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে অদূরের ফুল গাছ গুলো দেখছে সে। তার চুল গুলো এলোমেলো। গায়ে রাতের পোশাক। যা ভিজে পুনরায় শুকিয়েছে।
“আপু, তুমি কি গত রাতে ঘুমাতে আসো নি?”
কথা নেই লাবণ্য’র মুখে। সে হাল্কা হাতে মেয়েটির বাহু ছুঁতেই সর্বাঙ্গে উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ল।
“তোমার জ্বর এসেছে! আপু, আপু কি হয়েছে তোমার?”
ব্যগ্র হয়ে উঠেছে উষশী’র কণ্ঠ। লাবণ্য’র সাড়া না পেয়ে পাগলের মতো ছুটে বেরিয়ে পড়ল। পথিমধ্যে মালতির সাথে দেখা হলো।
“উষশী, এভাবে দৌড়াচ্ছ কেন?”
“লাবণ্যপু, লাবণ্যপু’র যেন কি হয়েছে।”
কথা জড়িয়ে আসছে মেয়েটির। মালতি সময় নষ্ট না করে সোজা লাবণ্য’র ঘরে এল। লাবণ্য তখন মেঝেতে বসে পড়েছে। শরীরে ভীষণ উত্তাপ।
“হায় আল্লাহ! জ্বরে শরীর পুড়ে যাচ্ছে। কাউকে ডাকিস নি কেন?”
সাড়া নেই লাবণ্য’র। ওর চোখ দুটো ঘোলাটে হয়ে এসেছে। উষশী’র কণ্ঠ পেয়ে ইতোমধ্যেই অভিরাজ চলে এসেছে। মিনিটের মধ্যেই চলে এল বাড়ির বাকি সদস্য। লাবণ্য শেষ বারের মতো দেখছে সবাইকে। তার চোখ দুটো বিষাদে মাখা। সে নিরলস ভাবে তাকিয়ে রইল অভি’র পানে। তারপরই ফুরিয়ে এল তার শক্তি। অসাঢ় হয়ে গেল সর্বাঙ্গ। ক্ষণিকেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলল মেয়েটি।
অসুস্থ লাবণ্য। তার শারীরিক স্বাস্থ্যের উন্নতি হলো দুদিন পর। অভিরাজ এই দুদিন অনেক বেশি যত্ন করেছে তার। সেই থেকেই সকলের মাঝে একটা গুঞ্জন চলছে। সবাই ভাবছে তাদের মধ্যে কোনো সম্পর্ক তৈরি হয়েছে কিংবা হবে। ছোট বেলা থেকে বন্ধু আর কাজিন হওয়াতে এই সম্পর্কের নাম দিতে অস্বস্তি হচ্ছে ওদের। এমন সব ভাবনাই চলছে সকলের মাঝে। দুদিনে একটিবার কথা হয় নি উষশী’র সাথে। মেয়েটিও আসে নি সময় নিয়ে। সে রত্নার সাথে ঘুমিয়েছে। ঘর থেকেও খুব একটা বের হয় নি। লাবণ্য একটু সুস্থ অনুভব করতেই উষশীকে খুঁজতে লাগল অভিরাজ। পেয়েও গেল। মেয়েটি বাড়ির পেছনের বাগানে বসে আছে। সেখানে একটা পুকুর রয়েছে। সেই পুকুরের জলে ছোট ছোট হাঁসের বাচ্চা ঘুরে বেড়াচ্ছে। সেগুলোই মুগ্ধ নয়নে দেখছে সে।
“ভোর বেলা একা একা এখানে কি করছো?”
না ঘুরেই উষশী বলল,”হাঁসের বাচ্চা দেখতে এসেছি। রত্না আপু বলেছিল দুই সপ্তাহ আগে বাচ্চা গুলো হয়েছে।”
“তাই বলে একা আসবে?”
“একা এলে কি হবে?”
“অনেক সমস্যা আছে। তুমি এই পরিবেশের সাথে পরিচিত নও উষশী।”
মেয়েটির পাশে বসল অভিরাজ। উষশী কোনো কথা না বাড়িয়ে ফের পুকুরের জলে দৃষ্টি ফেলল। মাথার উপর আম গাছ। সেখানে একটা পাখির বাসাও রয়েছে। পাখির বাচ্চা গুলো চি চি শব্দে ডেকে তুলেছে। কেমন একটা ভালো লাগা কাজ করছে। কিশোরীর ঘনিষ্ঠ হলো অভি। কণ্ঠে একরাশ মায়া ডুবিয়ে ডাকল।
“রেইন,রাগ হয়েছে আমার উপর?”
উষশী বুঝতে পারছে না। সে রাগ করেছে কি না জানে না। তবে একটা কষ্ট,অভিমান ঠিক ই জড়ো হয়েছে।
“জানি রাগ হওয়াটা স্বাভাবিক। লাবণ্য’র যত্ন নিতে গিয়ে তোমার খোঁজ রাখা হয় নি।”
এবার ও উত্তর নেই উষশী’র। অভি’র খারাপ লাগছে। কিশোরীকে নিজের দিকে ফেরাল সে।
“তুমি তো চালাক বাচ্চা। সব বুঝতে পারো। আসলে আমি ভুল করে ফেলেছি। একদমই উচিৎ হয় নি। সরি রেইন।”
ওর কথা বলার ভঙ্গিতে হেসে উঠল উষশী। বুকে হাত রেখে বলল,”এখানটায় সব সময় রাখলেই হবে। শারীরিক দূরত্ব আমার কাছে ম্যাটার করে না। তুমি শুধু ভালোবেসে যেও। কখনো ঘৃণা কোরো না। তোমার ভালোবাসার আন্দোলন সহ্য করে নিলেও ঘৃণা’র উত্তাপ সহ্য হবে না অভিরাজ।”
বর্তমান
অভি পারে নি মেয়েটিকে ঘৃণা করতে। আজ এত বছর হয়ে গেল যোগাযোগ নেই দুজনের। তবু একবিন্দু ভালোবাসা কমে নি অভিরাজের। সে সবটুকু দিয়ে একই ভাবে উষশীকে ভালোবেসে যাচ্ছে। অথচ মেয়েটি তার সাথে ছলনা করেছে। চোখের কার্নিশে জমে থাকা জলটুকু বুড়ো আঙুলে মুছে নিয়ে বাসা থেকে বের হলো সে। এক অজানা পথে।
ব্যবসায়িক নানা ঝামেলা নিতে নিতে আসাদ প্রায় অসুস্থ। ঈশান ভবঘুরে হয়ে ঘুরে বেড়ায়। তার দ্বারা এসব কখনোই হবে না সকলেই জানে। সে একটা ভালো পজিশনে জব করছে। ছোঁয়া’র বিয়ের পর একেবারেই ভেঙে বসেছিল। কোনো মতে গ্রাজুয়েশন শেষ করল। তারপরের একটা বছর একেবারেই ঘরকুনো হয়ে বসেছিল। এ পর্যন্ত আসতে বেশ ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে। এখন নিজের মতো ঠিকানা খুঁজে নিয়েছে। তাকে কেউ জোর করে না। বাড়ির দুই ছেলেই যদি এভাবে ব্যবসা থেকে হাত গুটিয়ে নেয় তবে ভবিষ্যৎ যে খুবই খারাপ হবে তা বেশ ভালোই বুঝেন আসাদ। পরিবারে ভাঙন ধরেছিল। সবাই আলাদা অবস্থান করছে দুইটা বছর। এখন আবার সবাই এক হয়েছে। ওনারা দুই ভাই ও আজকাল তেমন কাজ করতে পারে না। সকলেরই বয়স হচ্ছে। বিদেশের ডিল গুলো একটার পর একটা ক্যানসেল হচ্ছে। চিন্তায় আরো বেশি অসুস্থ হয়ে পড়লেন তিনি। ওনার এই অসুস্থ শরীর দেখেই হয়ত অভিরাজের মায়া হলো। সে নিজ থেকেই বলল ব্যবসায় জয়েন করবে। এই সময়টা পরিবারের প্রতিটা মানুষ বিস্মিত হয়ে রইল। অভিরাজ যে আগের মতো হবে সেই আশা বহু আগেই বাদ দিয়েছিল সকলে।
আমিনা আর আসাদ নিজ ঘরে বসে আছেন। লাবণ্য নক করে রুমে এল। হুট করেই বিশেষ দরকারে ডাকা হয়েছে তাকে।
“বড়ো আব্বু,কি বলতে চাইছিলে?”
“অভি’র বদল চোখে পড়ার মতো। আমার বিশ্বাস ও খুব দ্রুত ঠিক হয়ে যাবে।”
“আমার ও তেমনটাই মনে হচ্ছে।”
“লাবণ্য মা, আমার ছেলের জন্য অনেক করেছিস তুই। বিনিময়ে কিছুই পেলি না। এখনো একই ভাবে করে যাচ্ছিস। তোকে যে কি বলব বুঝতে পারছি না।”
“এভাবে বলো কেন বড়ো আম্মু? আমি কি তোমাদের মেয়ে নই?”
“সেই জন্যেই তো আরেকটা আবদার করব মা।”
লাবণ্য আমিনার বাহু জড়িয়ে ধরল। ওনার সাথে ছোট থেকেই আদুরে সম্পর্ক ওর।
“কি বলবে?”
আমিনা স্বামীর পানে তাকালেন। ওনার রুগ্ন চেহারাটা আজ আরো বেশি মলিন দেখাচ্ছে।
“চাচ্ছিলাম অভি’র সাথে বিজনেসে তুই ও জয়েন কর।”
“হসপিটালের কি হবে বড়ো আব্বু?”
“সেই জন্যে তো আমরা আছিই। আর তুই তো তোর প্র্যাকটিস চালিয়ে যাবি। অভি সব থেকে বেশি তোর সান্নিধ্য পছন্দ করে। তুই যদি এত গুলো বছর আগলে না রাখতি তাহলে ছেলেটা ম রে ই যেত।”
লাবণ্য মাথা নত করে ফেলল। ওর দু চোখ নিশ্চয়ই ভিজে উঠেছে। আমিনা মেয়েটির মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন।
“ছোঁয়া আর ইরা তো পুরো দমে সংসারী হয়ে উঠেছে। ঈশান ভবঘুরে। পারিবারিক ব্যবসায় ভীষণ অনীহা। তুই ই ভরসা মা। ব্যবসার সাথে সাথে অভি’র খেয়াল একমাত্র তুই ই রাখতে পারবি।”
পরের সপ্তাহে অভিরাজের সাথে লাবণ্য ও ব্যবসায় জয়েন করল। দুজনের এক সাথে কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে। একটা সময় হসপিটালের সমস্ত দায়িত্ব তো ওদের উপর ই ছিল। দুজনে ব্যবসায় ও ভালো করবে এই নিয়ে সন্দেহ নেই। প্রথম সপ্তাহেই বেশ ব্যস্ত হয়ে পড়ল ওরা। পুরো কাজ বুঝে নিয়ে একটা সুন্দর প্ল্যান ও করে ফেলল। গত ছয় মাসে ডেনমার্কের সাথে চারটে ডিল ক্যানসেল হয়েছে। এতে করে কোম্পানি’র হিউজ পরিমাণে লস হয়েছে। সেই লসের পরিমাণ গিয়ে ঠেকেছে শত কোটি টাকায়! তাদের কোম্পানি কখনো এত লসের মুখোমুখি হয় নি। অভিরাজ একটা অপরাধ বোধে ভুগছে। ছেলে হিসেবে নিজেকে অযোগ্য বলে মনে হচ্ছে। এই সময়ে লাবণ্য তাকে সান্ত্বনা দিল। আশ্বাস দিল সব ঠিক হয়ে যাবে বলে।
চলবে….
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি