শেষ_বিকেলে_তুমি_আমি #আলিশা #পর্ব_২৫

0
304

#শেষ_বিকেলে_তুমি_আমি
#আলিশা
#পর্ব_২৫

বিষন্ন মন নিয়ে রোজা খুলল সকলে। স্মরণের কাছে যাওয়ার কারণে বেশ খানিকটা রক্ত আমার শাড়িতে জায়গা নিয়েছিল। সেই রক্তমাখা শাড়ি পাল্টে আমি নতুন একটা শাড়ি পরে নিলাম। যেটা এনে দিলো অঙ্কন। অনিচ্ছা সত্বেও নিতে হয়েছে। আমরা মেয়ে ক’জন বাদে সকলে মসজিদে চলে গেছে। ওটির দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে সময় পার করছি আমি। অঙ্কন রোজা খোলার পর কোথাও একটা নামাজ আদায় করে নিয়ে রক্ত দেওয়ার জন্য চলে গেলো নির্দিষ্ট রুমে। সাথে ব্যাবস্থা করে দিয়ে গেলো আমাদের নামাজের ঘরের। প্রিয়ার সাথে টুকটাক কথা বলে সব ঠিকঠাক করছে। দৌড়াদৌড়ি তার কম হচ্ছে না। আমি তাকে রক্ত দিতে মানা করলাম একবার। সারাদিন রোজার পর দুই ব্যাগ রক্ত দেবে। পরদিন আবারও রোজা রাখবে। বললাম অন্য একটা ব্যাবস্থা করা যায় না? অঙ্কন জবাব দিলো ঈষৎ হেসে

— ও পজিটিভ রক্ত। পাওয়া টাফ। হবে না ওরকম।

এরপর হঠাৎ একটা দম নিয়ে বলল

— সরি টু সে বাট ইটস ট্রু, কিছু মানুষের চোখের পানি সহ্য করা যায় না। স্মরণ আমার বন্ধু বলে এমনিতেও আমি আমার সবটুকু দিয়ে চেষ্টা করছি তারপরও একটা মানুষের চোখের পানি সহ্য করতে পারছি না। ভুল করে ভালোবাসলেও, ভালোবাসা তো ভালোবাসাই তাই না? আমি আমার বেস্টটা দিয়ে চেষ্টা করবো।

চমকে উঠলাম আমি অঙ্কনের কথা শুনে। মুখ তুলে তার দিকে তাকাতেই সে চলতে শুরু করলো। যেন আমার চোখে চোখ না রাখার ইচ্ছে, মনের কথা ব্যাক্ত করার পর আমার মুখোমুখি না হওয়ার ইচ্ছে তার।

.
আশপাশের কোনো এক মসজিদ হতে এশার আজান কানে এলো। স্মরণের ওটির ট্রিটমেন্ট আপাতত সমাপ্ত। সে এখন জ্ঞানশূন্য! না জানি কখন তার জ্ঞান ফিরবে। ডাক্তারা অনেক কিছুই বলে যাচ্ছে। হতে পারে স্মরণ স্মৃতি হারবে, হতে পারে কারো ডাকে সারা দেবে না। হতে পারে দু একটা নার্ভ অকেজো। আমি মনে ছটফট ভাব নিয়ে বসে আছি। এসবের একটাও যেন না হয়৷ সে যেন আগের মতো পুরোপুরি সুস্থ হয়ে যায় বলে দোয়া করে যাচ্ছিলাম। প্রিয়া আমার পাশে বসে ঝিমোচ্ছিলো। প্রচন্ড গরমে সেই সাথে ঘেমে অসুস্থ প্রায়। ওর মাথাটা আমার কাঁধে রেখে দিয়ে বললাম

— ঘুমা। আর তুই না হয় বাসায় চলে যা। ছোঁয়ার নানা নানিকে বলছি ওনারাও চলে যাক।

প্রিয়া কড়া দৃষ্টিতে চাইলো আমার দিকে। মাথাটা আমার কাঁধ থেকে তুলে রেগে পেছনে ভালোভাবে ঠেস দিয়ে বসলো। আমি কথা বাড়ালাম না। মিনিট দুয়েক যেতেই মেয়েটা ঘুমে ঢুলে পরলো আমার ওপর। আমি নড়চড় না করে বসে রইলাম। এভাবে ঠিক কতক্ষণ বসে ছিলাম তা জানি না। তবে আমরও হয়তো চোখ লেগে এসেছিল। স্মরণের কথা ভাবতে ভাবতে আচমকাই ক্লান্ত শরীর নিয়ে ঘুমিয়ে পরেছিলাম।

এই ঘুম ভাঙলো আনুমানিক বিশ মিনিট পর। চাচি আম্মা এসে ডেকে বললেন, সকলকে অঙ্কন বাইরে যেতে বলছে। হসপিটালের পাশের হোটেল থেকে ডিনার করতে বলছে। আমার ক্ষুধা বা খাওয়ার ইচ্ছে কোনোটাই নেই। তাই আমি চাচি আম্মাকে বলে দিলাম সকলকে নিয়ে ডিনার করে আসতে। আমার ক্ষুধা নেই। আমি যাবো না। চাচি আম্মা বেশ জোরাজোরি করলেন। অতঃপর তাকে হার মানতে হলো। চলে গেলেন। প্রিয়াকে ঘুম থেকে জাগিয়ে ডিনারের জন্য পাঠিয়ে দিলাম। ইতিমধ্যেই অঙ্কন এসেছিল। হয়তো প্রিয়াকেই নিতে এসেছিল। আমার সাথে কোনো কথা বিনিময় করার ইচ্ছে হয়তো তার ছিল না। আমার যে খুব ইচ্ছে ছিলো তাও না। তবুও ঘটনাচক্রে তাকে শুধাতে হল, রক্তের ব্যাবস্থা হয়ে গেছে? জবাবে সে মাথা ঝাকিয়ে মুখে ছোট করে “হুম” বলে প্রস্থান করেছে।

.
ডিনার না করার ইচ্ছেটা আমার হলেও ‘করতেই হবে তোকে’ বলে জোরাজোরি করে কয়েক লোকমা ভাত প্রিয়া আমাকে খাইয়ে দিয়েছে। প্রথমে অঙ্কন খাবার শেষ করে ওপরে এসেছে অতঃপর প্রিয়া আমাকে নিচে নিয়ে গিয়ে ধরে বেধে খাওয়ালো। রাত ততক্ষণে দশটা। খাওয়ার পাঠ চুকিয়ে যখন ওপরে এলাম তখন চোখে পরলো দূর্বল চিত্তের অঙ্কনকে। গা এলিয়ে দিয়ে একটা বসার আসনে বসে ছিলো। প্রিয়ার দিকে তাকিয়ে দেখি ওর মুখটা আঁধারে ছেয়ে গেছে। আমার বড্ড খারাপ লাগলো। রক্ত দিয়ে অঙ্কন শারীরিক ভাবে বেশ ঝিমিয়ে গেছে। একা সব দিকে দেখতে হচ্ছে । অনেক বেশিই কষ্ট হয়ে গেছে তার। প্রিয়াকে ঠেলে পাঠিয়ে দিলাম অঙ্কনের কাছে। আমি গিয়ে বসলাম তাদের থেকে দূরে একটা চেয়ারে। আড়ষ্টতায় জড়িয়ে যাওয়া প্রিয়া অঙ্কনের পাশের চেয়ারে বসে হয়তো ছোট করে ডাক দিয়েছিল। অঙ্কন তড়বড় করে মাথা তোলে। যেন চমকে উঠেছে। তারপর নিজেই কিছু জিজ্ঞেস করে প্রিয়াকে। প্রিয়া জবাব দেয়। আবার গম্ভীর মুখে অঙ্কন কিছু বলে। প্রিয়ার মন খারাপ হয়। এমন করেই তাদের আলাপ এগিয়ে যাচ্ছিল। আমি দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলাম। ভালোই থাকবে ওরা। অন্যরকম ভালো। আমি কখনো দেখিনি অঙ্কন প্রিয়ার সাথে রুক্ষ, উগ্র আচরণ করেছে। বরং দেখেছি কখনো দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ায়নি।

.
প্রহরটা মাঝরাতের হলেও গরমটা মোটেও মাঝামাঝিতে ছিলো না। উত্তাপের গ্রাফ যেন সরল রেখায় চলছিল। বেশ গরম। মাথার ওপর যদিও ফ্যান ছিলো তবুও সকলে চিন্তাগ্রস্ত মন নিয়ে গরমে নাজেহাল দশা পার করছে। একে একে ঘন্টা পেরোলো আরো দুইটা। রাত বারোটা বাজতে চলল। আমি বন্ধ চোখ নিয়ে মাথার সমস্ত ভার ডান হাতে রেখে বসেছিলাম। বাবা অধীর আগ্রহে বসে ছিলেন স্মরণের জ্ঞান ফেরার মুহূর্তের জন্য। তেমনি করে সকলেই প্রহর গুণছিল৷ কখন স্মরণ চোখ খুলবে। অবশেষে এই কাঙ্খিত মুহূর্ত এসে পরলো। একজন নার্স এসে অঙ্কনের উদ্দেশ্যে বলল

— স্যার, আপনার পেশেন্ট রেসপন্স করছে। কিন্তু এসপেকসিয়া হচ্ছে মনে হয়।

অঙ্কন তড়িৎ গতিতে বসা থেকে উঠে পরলো। নার্সের উদ্দেশ্যে বলল

— ওকে। আমি যাচ্ছি।

খবরটা আমার কানে পৌঁছাতেই বুক ধ্বক করে উঠেছে আমার। বাবাসহ সকলে’ আলহামদুলিল্লাহ ‘ বলে উঠলো। আমার চোখে অশ্রু জমলো। একটা ভয় কেটে গেলো। তবে আরেকটা ভয় বুকে বাসা বাঁধলো শক্ত করে। সে আগের মতো সুস্থ হবে তো? কোনোরূপ খারাপ কিছু হবে না তো? ভাবনার মাঝে পা চালিয়ে দ্রুত এগিয়ে যেতে চাইলাম। ঠিক তখনই অঙ্কন সকলের উদ্দেশ্যে বলল

— আমি আগে দেখে আসি। কিছু কাজ আছে। তারপর না হয় আপনারা….

অঙ্কনের কথা মেনে নিলেও মনের আস্কারায় তার পিছু পিছু হেঁটে আই.সি.ইউ এর দরজা পর্যন্ত পৌছালাম। অঙ্কন প্রবেশ করলো। আমাকে একটুপর দূরে পাঠিয়ে দিলো একজন নার্স। এক পলকের দেখায় শুধু স্মরণের হাশফাশ করা মুখটা দেখেছি। শ্বাসকষ্টের দরুন ছটফট করা বুক দেখেছি। নিজেকে ঠিক রাখা দ্বায় হয়ে পরলো। বুক ভেঙে কান্না চলে এলো আমার।

.
রাত বারোটায় জ্ঞান ফিরলেও আই.সি.ইউ থেকে স্মরণকে বের করা হলো রাত দু’টোর নাগাদ। একটা রুমে সিপ্ট করা হলো। প্রথমেই অঙ্কন বাবাকে নিয়ে গেলেন দেখা করানোর জন্য। অতঃপর একে একে সকলকে। শুনলাম সে কোনোরকম সুস্থ। চিনতে পারছে সকলকে। কথা বলতে পারে অক্সিজেন মাস্ক খুলে দিলে। অঙ্কন বেশ খুশি। আমার চাইতে যেন শতগুণ বেশি আনন্দিত সে। প্রফুল্ল চিত্তে বাবাকে বলল

— আলহামদুলিল্লাহ। যে ভয়টা পাচ্ছিলাম ওটা হয়নি। ট্রমাটিক ব্রেইন ইনজুরি ওর ক্ষেত্রে তেমন প্রভাব ফেলেনি। দু দিন পর শুধু একবার টেস্ট করে দেখবো। যদিও ভয়ের কিছু নেই। তারপরও হালকা যদি সমস্যা হয়ে থাকে ট্রিটমেন্ট করতে হবে। আর পায়ের ইনজুরি…. হ্যা এটা এক্সরে করে দেখতে হবে আবার। অপারেশনের পর একটু ভয় আছে। হাঁটা চলা নিয়ে সমস্যা… বাট কিছু হবে না। চিন্তা করবেন না।

বাবা কিছুটা স্বস্তি পেলেন। সেই সাথে আমিও। ছোঁয়ার নানা নানিকে চট্টগ্রাম পাঠানোর ব্যাবস্থা করা হলো। আমিই জাহিনকে বলে দিলাম ওনাদের নিয়ে বাসায় ফিরে যেতে। সাথে চাচি আম্মা, ছোট আব্বুকেও পাঠিয়ে দিলাম। শুধু থেকে গেলো ছোঁয়া আর বাবা।

এতো কিছুর মাঝে আমার এখনো দেখা করা হয়নি স্মরণের সাথে। মনটা আকুপাকু করছিল। তবে কেন যেন এক পা তুললে দু’পা পিছিয়ে আসছিলাম। কেমন ভয় হচ্ছিলো, অজানা কারণে বুকের হৃদপিণ্ড দ্রুত গতিতে বিট করছিল। অঙ্কন স্মরণকে কাছে বসে ছিলো। আমি দাড়িয়ে ছিলাম রুমের বাইরে। একটা সময় অঙ্কন বেরিয়ে এলো রুম থেকে। আমাকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার কালে অনাকাঙ্খিত ভাবে বলল

— দেখা করে আসুন। কিছুক্ষণ পর ঘুমিয়ে পরবে।

আমি চমকে উঠলাম। অঙ্কন চলে গেলো। আমি বুকে সাহস সঞ্চয় করে অবশেষে রুমে প্রবেশ করলাম। স্মরণের অক্সিজেন মাস্ক খুলে দেওয়া হয়েছে। মাথায় সাদা ব্যান্ডেজ। পায়ে ব্যান্ডেজ তার। দৃষ্টি অজানা দিকে। ধীর পায়ে অগ্রসর হয়ে তার মাথার নিকট গিয়ে থেমে গেলাম। পাশে থাকা চেয়ারে বসতেই সে ফিরে চাইলো আমার দিকে। বুকটা কেঁপে উঠলো আমার। চোখে অশ্রু জমলো। ঘিরে ধরলো বোবা কান্না আর নীরবতা। দ্রুত অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে চোখের জল মুছে নিলাম। স্বাভাবিক হওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা চালানোর পর একটু আধটু সফল হয়ে স্মরণের দিকে ঘুরে বসে বললাম

— এরকম করে কষ্ট না দিলেও পারতেন।

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here