#অনুরাগের_প্রহর
#মৌপ্রিয়া_ইসলাম_মিহি
#পর্ব_০৯
_________________
-“দেখুন মিস্টার হামিদ!আমি আপনার সাথে এখন কথা বলার মুডে নেই।সো প্লিজ এখান থেকে চলে যান।”
-“আমার মনের কথা না জানিয়ে আজ আমি এখান থেকে যাবো না।”
-“কি মনের কথা?”
হামিদ মুনিয়ার দিকে এক তোড়া গোলাপ এগিয়ে দিয়ে বললো,
-“মুনিয়া….তোমাকে আমি যেদিন প্রথম দেখি সেদিন তোমার উপর আমার প্রচন্ড রাগ হয়।তবে সেদিন যখন তোমাকে তোমাদের বাড়িতে দিয়ে আসতে যাই বিশ্বাস করো তোমার প্রেমে পড়ে গেছি।তোমার খোলা চুলগুলো যখন উড়ছিল আর আমি তা মুগ্ধ হয়ে দেখছিলাম বেশ লাগছিল ব্যাপারটা!অন্যরকম ভালো লাগা কাজ করছিল।এই ভালো লাগা আমি হারাতে চাই না।”
মুনিয়া হামিদের কথাগুলো শুনে কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,
-“আপনি কি কোনো নাটক বা সিনেমাতে কাজ করেছেন?না মানে এতো সুন্দর ডায়লগ ডেলিভারি তো আমি আগে কাউকে করতে দেখিনি!”
মুনিয়ার কথায় হামিদের কপাল কুঁচকে গেল।সে আকাশের দিকে তাকিয়ে বললো,
-“আল্লাহ!এ আমি কোন পাগলির প্রেমে পড়লাম?”
হামিদের কথায় বেশ চ*টে যায় মুনিয়া।কোমরে হাত দিয়ে বললো,
-“এই আপনি কাকে পাগলি বললেন?আপনার সাহস তো কম না!”
হামিদ আর কিছু না বলে মুনিয়ার হাতে গোলাপের তোড়াটা ধরিয়ে দিয়ে সেখান থেকে চলে গেল!মুনিয়া ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বললো,
-“আসছে প্রেম করতে!দেখা গেলো দুদিন প্রেম করে আরেক মেয়েকে বিয়ে করে বসে থাকবে।তারপরে আমার সন্ন্যাসী হয়ে হিমালয়ে যাওয়া লাগবে।”
মুনিয়া ফুলের তোড়াটা ফেলতে গিয়ে ফেললো না।তারপরে সেটা দুলাতে দুলাতে ক্যান্টিনের দিকে চলে গেল।
_________________
-“রাজের ছাড়া পাওয়ার কোনো চান্স নেই তো?”
রিয়াদ মৃদু হেসে বললো,
-“তুই কোনো চিন্তা করিস না শেহরেয়ার।রাজ এতো সহজে ছাড়া পাবে না।”
-“আর যদি ছাড়া পায়ও আমার হাত থেকে পাবে না।”
-“প্লিজ আর এইসব করিস না।এমনিই তো এর জন্য কতকিছু ঘটে গেল।”
শেহরেয়ার কিছু না বলে কফির কাপে চুমুক দিল।
–
–
–
মেহরিন রায়ানকে নিয়ে ‘মির্জা বাড়ি’তে ঢুকে দেখলো হেনা সাহেবা বসে পান চিবাচ্ছেন।উনাকে দেখে মৃদু হেসে মেহরিন বললো,
-“মা…..এতো পান খাওয়া শরীরের জন্য ক্ষতিকর।”
মেহরিনের কথায় তার দিকে তাকালেন হেনা সাহেবা।রূঢ় কণ্ঠে বললেন,
-“তুমি আমাকে মা বলে ডেকো না।”
মেহরিন রায়ানকে রুমে পাঠিয়ে দিয়ে হেনা সাহে্বার পাশে গিয়ে বসে বললেন,
-“এটা অন্তত নিষেধ করবেন না।অনেক ছোটবেলায় মাকে হারিয়েছি।বাবা কখনো মায়ের অভাব বুঝতে দেয়নি ঠিকই তবে মা তো মা-ই।মায়ের বিকল্প তো কেউ হতে পারে না।তবে আপনি চাইলে হতে পারেন।বেশি কিছু না একটু ভালোবাসবেন আমাকে।তাহলেই চলবে!”
মেহরিনের চোখগুলো ছলছল করছে।যা দেখে হেনা সাহেবার কিছুটা খারাপ লাগলো।তিনি নিজেকে সামলে বললেন,
-“তোমাকে আমি নিজের মেয়েই বানাতে চেয়েছিলাম।কিন্তু…..”
এটুকু বলে থামলেন হেনা সাহেবা।মেহরিন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
-“কিন্তু সমস্যাটা হলো আমার একটা ছেলে আছে।”
হেনা সাহেবা আর কিছু বললেন না।মেহরিন’ হেনা সাহেবার এক হাত ধরে বললো,
-“মা আপনি যা ভাবেন আমাকে নিয়ে তা হয়তো ঠিক নাও হতে পারে।আমরা মানুষকে নিয়ে যা ভাবি সবসময় তা কিন্তু ঠিক হয় না।”
কথাগুলো বলে মেহরিন তার রুমের দিকে চলে গেল।হেনা সাহেবা তার যাওয়ার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন,
-“তোমাকে তো আমি নিজেই পছন্দ করেছিলাম।কিন্তু এটা ভাবলেই আমার খারাপ লাগে যে তোমার একটা বাচ্চা আছে।আর যার বাবার কোনো পরিচয় নেই।”
কথাগুলো বলে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন হেনা সাহেবা।
________________________
-“আজকে আসতে এতো লেট হলো কেনো?”
শেহরেয়ার রুমে এসে ফ্রেশ হতে ওয়াশরুমে যাওয়ার সময় তার দিকে উপরোক্ত প্রশ্ন ছুড়লো মেহরিন।মেহরিনের পা থেকে মাথা পর্যন্ত চোখ বুলিয়ে শেহরেয়ার বললো,
-“বাহ্!বউদের মতো কথা বলা শুরু করেছেন।”
মেহরিন ভ্রু কুঁচকে বললো,
-“তা বউ হয়ে বউদের মতো কথা না বলে কি বান্ধবীদের মতো কথা বলবো?”
মেহরিনের কথায় নিঃশব্দে হাসলো শেহরেয়ার।তারপরে মেহরিনের কিছুটা কাছে এগিয়ে গিয়ে বললো,
-“খালি বউদের মতো কথা বললে তো হবে না কাজও করতে হবে!স্বামীর যে স্ত্রীর উপর অধিকার আছে সেটাও তো দিতে হবে।তাই-না?”
শেহরেয়ারের কথায় মুচকি হেসে তার বুকে আলতো করে কিল মারলো মেহরিন।পরক্ষনেই কিছু মনে পড়তে হাসি মিলিয়ে গেল তার মুখ থেকে।ভ্রু কুঁচকে বললো,
-“আপনি আমার প্রশ্ন এড়ানোর চেষ্টা করছেন।”
-“মোটেও না।আজকে অফিস থেকে বের হয়ে একটু রিয়াদের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম।”
-“সত্যি তো?”
-“বিশ্বাস না হলে রিয়াদকে কল করে জিজ্ঞেস করে নেন।”
-“তার প্রয়োজন নেই।আপনার মুখের কথাই আমার বিশ্বাস হয়েছে।”
-“এতোবার প্রশ্ন করে বলছেন মুখের কথা বিশ্বাস হয়েছে?”
-“তা তো মজা করে করেছি।এখন বেশি কথা না বলে ফ্রেশ হতে যান।কত বেলা হয়ে গেছে!এখনো না খেয়ে বসে আসি।”
শেহরেয়ার কাঁদো কাঁদো সুরে বললো,
-“আহা!স্বামীর প্রতি স্ত্রীর ভালোবাসা দেখে চোখ দিয়ে পানি চলে আসছে।”
মেহরিন এবার চোখ রাঙিয়ে শেহরেয়ারের দিকে তাকালো।শেহরেয়ার হাসি দিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল।শেহরেয়ার যেতে মেহরিন নিঃশব্দে হেসে দিল।
-“এই লোক যে এতোটা দুষ্টু আগে ভাবিনি।”
_______________________
সন্ধ্যার সময় শেহরেয়ার বাড়ি থেকে বের হতে যাবে এমন সময় হেনা সাহেবা বললেন,
-“শেহরেয়ার তোর সাথে আমার কিছু জরুরি কথা আছে।”
শেহরেয়ার দাঁড়িয়ে পড়লো।তারপরে হেনা সাহেবার কাছে গিয়ে বললো,
-“কি বলবে বলো!”
-“তুই যা জানিস সেটা ভুল জানিস।”
শেহরেয়ার অবাক হয়ে বললো,
-“কিসের কথা বলছো তুমি?”
-“আমার ধারণা তোকে হয়তো কেউ বলেছে রাজ আমার…..”থেমে গেলেন হেনা সাহেবা।হেনা সাহেবার না বলা কথা বুঝতে পারলো শেহরেয়ার।সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
-“মা এই বিষয়ে আমি কিছু শুনতে চাই না।”
-“আমিও চাই না তুই কোনো ভুল ধারণা নিজের মনে পুষিয়ে রাখিস।”
শেহরেয়ার কিছুটা উচ্চস্বরে বললো,
-“তাহলে সত্যিটা কি?এখন তুমি কি বানিয়ে বানিয়ে কতোগুলো কথা বলবে?”
-“শেহরেয়ার!আমি তোর মা।মায়ের বিষয়ে যা বলবি ভেবেচিন্তে বলবি।আমি সেদিনই তোকে সবটা বলতাম।তবে আমি জানি তুই আমার মুখের কথা বিশ্বাস করবি না।তাই আমার সাথে এখন বাগানে চল।ওখানে তোর জন্য অপেক্ষা করছে সমস্ত সত্য!”
-“আমি একা যাবো কেনো?বাড়ির বাকিদেরও সমস্ত সত্যিটা জানতে হবে।বিশেষ করে বাবার।বাবা কোথায়?”
-“তোর বাবা আর দিদুন দুজনই বাগানে আছেন।”
-“আচ্ছা।তাহলে মেহরিনকেও ডাকি।ও তো এই বাড়িরই সদস্য।”
হেনা সাহেবা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন,
-“আচ্ছা ডাক।”
শেহরেয়ার উচ্চস্বরে দুইবার মেহরিনের নাম নিতেই সে নিচে নামলো।তারপরে শেহরেয়ার আর মেহরিন’ হেনা সাহেবার সাথে বাগানে গিয়ে দেখলো একজন মহিলা বসে শেহমীর মির্জা আর সেতারা বেগমের সাথে কথা বলছেন।উনাকে দেখে মনে হচ্ছে উনি হেনা সাহেবার বয়সীই হবেন।হেনা বেগম মহিলাটির উদ্দেশ্যে বললেন,
-“রোজি এই আমার ছেলে শেহরেয়ার।”
রোজি বেগম শেহরেয়ারকে দেখে মৃদু হেসে তার দিকে এগিয়ে এসে বললেন,
-“ওই শিকদার খানের কথা শুনে নিজের মাকে ভুল বুঝেছো বাবা?”
রোজি বেগমের প্রশ্নে বেশ অবাক হলো শেহরেয়ার।সে কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,
-“শিকদার খানকে আপনি কিভাবে চিনেন?”
-“কথাটা বলতে ঘৃণা হলেও বলতে হবে।ওই লোক আমার স্বামী।”
শেহরেয়ার চমকে গিয়ে বললো,
-“মানে?”
রোজি বেগম কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলতে শুরু করলেন,
-“তোমার মা আর আমি ছোটবেলা থেকে ভালো বান্ধবী।আমরা যখন একাদশ শ্রেণিতে পড়ুয়া তখন থেকে শিকদার তোমার মায়ের পিছনে লাগে।ও তোমার মাকে পছন্দ করতো।কিন্তু তোমার মা তাকে কখনোই পাত্তা দেয় না।আর ওমন গু*ন্ডাকে কে-ই বা পাত্তা দেয়!তারপরে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার পরে তোমার বাবার সাথে তোমার মায়ের বিয়ে দেওয়া হয়।আর আমার বাবা কিছু টাকার লোভে শিকদারের সাথে আমার বিয়ে দেয়।বিশ্বাস করো ও আমার জীবনটা নরক করে তুলেছিল।আমাদের একটা ছেলে হয়।আর সে হলো রাজ।তার কিছুদিন পরে আমাদের ডিভোর্স হয়ে যায়।তবে ও তাও আমার পিছু ছাড়ে না।আমাকে একদিন আটকে রেখেছিল একটা গোডাউনে নিয়ে।অনেক কষ্টে সেখান থেকে আমার ছেলেকে নিয়ে পালাই ও-কে ছুড়ি দিয়ে আঘাত করে।কিন্তু ও তো মরলো না।আমার ছেলেটাকে তোমার মায়ের হাতে তুলে দেই।কারণ আমি আমার ছেলেটাকে একটা ভালো জীবন দিতে চেয়েছিলাম।আমার পিছনে পুলিশ লাগিয়ে দেয় ওই শিকদার।আমিও ভয়ে পালিয়ে আমার নানাবাড়ি ইন্ডিয়াতে চলে যাই।সেখানে গিয়ে ফিরে আসার চেষ্টা করেছিলাম আমার ছেলের জন্য।কিন্তু আমার মামী আমাকে আসতে দেয়নি।তার ছেলের বউ মারা যাওয়ায় সে আমাকে তার ছেলের সাথে বিয়ে করিয়ে দেয়।তবে আমি তারপরে একটা ভালো জীবন পেয়েছি।কিন্তু এতো বছরেও ওর পরিবর্তন ঘটেনি।তোমার কাছে এধরনের বাজে কথা বলে তোমার মায়ের প্রতি তোমাকে বিষিয়ে দিয়েছে।তোমার মায়ের প্রতি ওর রাগ এভাবে মিটাতে চেয়েছে।তোমার মায়ের সাথে যোগাযোগ আমার সবসময়ই ছিল।তোমার মা আমাকে সবটা জানালে আমি এখানে আসি।ছেলেটাও বাপের মতোই হয়েছে।”
শেহরেয়ারের চোখ ছলছল করছে।সে হেনা সাহেবার সামনে দাঁড়িয়ে বললো,
-“মা আমাকে ক্ষমা করে দেও।”
-“তোর তো দোষ নেই বাবা।আমারই উচিত ছিল সবটা তোদের আগে জানানো।”
শেহমীর মির্জা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
-“এতোকিছু আমার অজানা ছিল!”
রোজি বেগম হালকা কেশে বললেন,
-“ভাই আমার উচিত ছিল আপনাকে সবটা জানানো।ক্ষমা করবেন।”
সেতারা বেগম’ হেনা সাহেবার কাছে গিয়ে বললেন,
-“তুমি তো সবডা আগেই জানাইতে পারতা!”
-“ভয়ে কিছু জানাইনি মা।”
-“তুমি আবার এতো ভয় পাও!”
হেনা সাহেবা চোখ রাঙিয়ে সেতারা বেগমের দিকে তাকালেন।রোজি বেগম শেহরেয়ারের কাঁধে হাত রাখলেন।শেহরেয়ার চোয়াল শক্ত করে বললো,
-“ওই শিকদার খানকে তো আমি দেখছি।আর মা তুমি ভেবো না যে এই সত্যিটা জেনেছি বলে আমার মন থেকে তোমার প্রতি সব ক্ষোভ চলে গিয়েছে।সেটা কিন্তু ভুল।কারণ আমি ছোটবেলা থেকে দেখে এসেছি তুমি দিদুনকে কেমন করে ট্রিট করেছো!আর আমার স্ত্রীর সাথে কি ধরনের আচরণ করছো বর্তমানে তাও আমি দেখতেছি!এইসব বাদ না দেওয়া পর্যন্ত তোমার প্রতি আমার এক প্রকার অসন্তুষ্টতা থেকেই যাবে।”
#চলবে____
[ভূল-ভ্রান্তি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।]