#তোমার_আমার_চিরকাল🌸
|| পর্ব – ৫০ ||
#লেখনীতে_বিবি_জোহরা_ঊর্মি
শীতের শেষ। বসন্তের আগমন ঘটল। নানান রকম ফুলের সুভাষ ছড়াচ্ছে। প্রকৃতিতে তাই লেগেছে রংয়ের ছোঁয়া। দক্ষিণা দুয়ারে বইছে ফাগুনের হাওয়া। কোকিলের কণ্ঠে আজ বসন্তের আগমনী গান। শীতকালে ঝরে পড়া পাতার ফাঁকা জায়গা পূরণ করতে গাছে গাছে আবার নতুন পাতা গজায়। গাছগুলো সবুজ পাতায় ছেয়ে যায়, ফুলে ফুলে ভ্রমরও করছে খেলা। গাছে গাছে পলাশ আর শিমুলের মেলা। সব কিছুই জানান দিচ্ছে বসন্ত এসে গেছে।
আজ প্রায় পাঁচ দিনের মতো হলো। আহান আর মীরার দেখা হয়না। মীরাকে দুইদিন আগেই বাসায় আনা হয়েছে। মীরার এখন একটা সমস্যা দেখা দিয়েছে। আর তা হলো শ্বাসকষ্ট। মীরার এখন নিঃশ্বাস নিতে গেলে কষ্ট হয়। মীরার চোখ সবসময় আহানকে খুঁজে বেড়ায়, কিন্তু আহানের দেখা নেই। কেউ তার রুমে আসলে তার মনে এই বোধহয় আহান এসেছে, কিন্তু তাকিয়ে সে আহানকে দেখতে পায়না। মীরা কাঁদে। নিজের ভুলের জন্য, আহানকে না দেখার কষ্টে সে প্রতিদিন কাঁদে। রাতে ঘুম আসেনা। বিছানার একপাশ খালি থাকে। ছটপট করতে থাকে সে। একবার আহানকে দেখার তিব্র ইচ্ছা জাগে। কিন্তু আহান তার সাথে দেখা করছে না। তাকে দেখতে আসছে না এসব মীরাকে খুব কষ্ট দেয়। নিজেও উঠে কোথাও যেতে পারছেনা। সারাক্ষণ রুমে শুয়ে বসে থাকতে থাকতে বিরক্তি হয়ে গেছে। শেষ রাতে একটু ঘুম আসে তার। কিন্তু রাতের বেশিরভাগ সময়ই নির্ঘুমে কাটে।
অন্যদিকে আহান মীরার কাছ থেকে নিজেকে আড়ালে রেখেছে। রোজ রাতে মীরা ঘুমিয়ে যাওয়ার পর আহান আসে। মীরার কাছে কিছুক্ষণ বসে ঘুমন্ত মীরাকে দেখে যায়। কতটা কষ্ট চেপে রেখেছে বুকে তা শুধু আহানই জানে। মীরার থেকে দূরে থাকা তার পক্ষে সম্ভব হচ্ছেনা। মীরার কাছে এসে তার মাথায় হাত ছোঁয়ায়। চুমু খায় কপালে, গালে। দু’ফোটা জলও মীরার গালে ফেলে যায়। তিব্র যন্ত্রণায় পুঁড়ে ছাঁই হয়ে যায় বক্ষঃস্থল। আহানের উপস্থিত মীরা কি টের পায়না? আহান সাবধানে আসে, সাবধানে পা ফেলে চলে যায়।
রাত প্রায় একটা। ঘুমিয়ে আছে মীরা। আজও আহান চুপচাপ মীরাকে দেখতে এসেছে। মীরার রুমের দরজা সারাক্ষণ খোলাই থাকে। আহান আসলো। মীরার পাশে বসে তার মাথায় হাত বুলালো। কপালে চুমু খেল। একটু একটু জ্বর আছে মীরার শরীরে। মীরার হাত ধরে মীরার দিকে তাকিয়ে রইলো অনিমেষ। মেয়েটার মুখটা কেমন যেন শুকিয়ে গেছে। চোখের নিচে কালো দাগ পড়েছে। তাকানো যাচ্ছে না। কিছুক্ষণ মীরার কাছে বসলো সে। আহান মীরার হাত ছেড়ে আস্তে করে উঠে দাঁড়াল। বেশিক্ষণ থাকা যাবে না। মীরার ঘুম ভেঙে গেলে ও আটকে যাবে। আহান চলে যেতে নিল। কিন্তু কথায় আছে, যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যে হয়। আহানের হাত ধরে ফেলল মীরা। আহান চমকে পিছনে ফিরে তাকাল। মীরা আস্তে করে চোখ খুলল। দু’জনে চোখাচোখি হলো। আহানের হাত ধরে শীতল চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে মীরা। আহান ঘাঁমছে, গলা শুকিয়ে আসছে তার। মীরা শোয়া থেকে উঠে দাঁড়িয়ে গেল। অশ্রুসিক্ত নয়ন নিয়ে আহানকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। আহানের শার্টের উপরের দুটো বোতাম খোলা। যার ফলে তার বুকের কিছু অংশ উন্মুক্ত হয়ে আছে। মীরা তার মধ্যেই নিজের মাথাটা রাখল। আহান সোজা হয়েই দাঁড়িয়ে রইলো। না পারছে মীরাকে কিছু বলতে, আর না পারছে মীরার কাছ থেকে সরে যেতে। হুট করেই মীরার হাত আহানের থেকে আলগা হয়ে গেল! আহান প্রথমে স্বাভাবিকভাবে নিলেও পরে দেখে মীরা ধীরে ধীরে ফ্লোরে পড়ে যাচ্ছে৷ আহান দ্রুত মীরাকে ধরে নিল। মীরা সেন্সলেস হয়ে গেছে। আহান চিন্তিত হয়ে মীরা ডাকতে লাগলো। কিন্তু মীরা আর সজাগ হলো না। আহান দেখলো মীরার শরীর জ্বরে পুঁড়ে যাচ্ছে। ভয় পেয়ে যায় সে। মীরাকে দ্রুত কোলে নিয়ে বিছানায় শোয়ায়। মীরার রুমে খুঁজে খুঁজে একটা ছোট বোল পায় সে। ওয়াশরুম থেকে টেপ ছেড়ে পানি নিয়ে আসে। একটা রুমাল ভিজিয়ে পানি সরিয়ে তা মীরার কপালে রাখে। একটু পানি হাতে নিয়ে মীরার চোখে ছিটিয়ে দেয়। অস্থির হয়ে পড়েছে আহান। কি করবে বুঝে উঠতে পারছেনা। কয়েকবার পানি ছেটানোর পর মীরার চোখের পাতা নড়ে উঠে। আহান ভরসা পায়। মীরাকে ডাকতে থাকে। “মীরা! চোখ খোলো না। এই দেখ আমি এসেছি। আমি কোথাও যাব না মীরা। প্লিজ তুমি চোখ খোলো।”
কিন্তু মীরা কিছুতেই চোখ খুলছে না। কাঁপছে সে। আহান মীরাকে জল পট্টি দিতে থাকে। মীরা খুব ছোট শব্দে বিড়বিড় করতে থাকে। আহান মীরার মুখের কাছে কান দিয়ে শোনার চেষ্টা করছে। মীরা বলছে, “আমায় ছেড়ে যাবেন না। আমি মরে যাব, আমি মরে যাব।” মীরার কথাগুলো আহানের বুকে গিয়ে বিঁধল। আহান মীরার মাথায় হাত দিয়ে বলে, “আমি তোমায় ছেড়ে কোথাও যাব না মীরা। তুমি প্লিজ চোখটা খোলো।”
আহান মীরার সমস্ত মুখে চুমু দিয়ে ভরিয়ে ফেলে। কাঁদতে থাকে সে। কেঁদে কেঁদে বলে, “আমি তোমায় আর কষ্ট দিব না মীরা। সুস্থ হয়ে যাও মীরা। তোমার কাছাকাছি থাকব।”
.
সকাল সাতটা। পিটপিট করে চোখ খোলে মীরা। ঘুম ভেঙেছে তার। গায়ের উপর কারো হাতের অস্তিত্ব অনুভব করছে সে। কে ধরে রেখেছে তাকে? পাশ ফিরে চমকে যায় মীরা। আহান! আহান কবে এলো? মীরা আহানের হাতটি সরিয়ে উঠে বসে। ট্রি টেবিলের উপর পানিভর্তি বোল আর ভেঁজা রুমাল দেখতে পায় সে। কেউ কি জল পট্টি দিয়েছে? কার কি হয়েছিল? মীরার কিছু মনে পড়ছে না। আহান এলোই বা কখন? ঘুমিয়ে আছে যেহেতু রাতেই এসেছে। মীরা আহানকে ভালো করে দেখতে থাকে। এই মানুষটাকে এতদিন না দেখায় কেমন ছটপট করেছিল সে। মীরা আস্তে করে আহানের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে। আহান কিন্তু জেগে যায়। মীরা হকচকিয়ে উঠে। আহান শোয়া থেকে লাফ দিয়ে উঠে। দুহাত আলতো করে মীরার গালে রাখে। অস্থির কণ্ঠে বলে, “এখন ঠিকাছ তুমি? জ্বর কমেছে?”
মীরা ভ্রু কুচকায়। জ্বর কি তবে তার ছিল? আহান মীরার কপালে ও গলায় হাত দিয়ে জ্বর চেক করতে থাকে। গা গরম নেই। একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে সে। আহান মীরার একটা হাত নিজের বুকের কাছে নিয়ে বলে, “আমাকে ক্ষমা করো মীরা। আর তোমার কাছ থেকে দূরে থাকব না। আমার দম বন্ধ হয়ে আসে তুমিহীনা। তোমাকে আমি আজই বাসায় নিয়ে যাব।”
মীরা চুপচাপ নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। আহান মীরার মুখ উপরে তুলে বলে, “তাকাও না। কষ্ট হয়েছে না খুব?”
মীরা নিঃশব্দে চোখের পানি ফেলে। বলে, “আপনাকে দেখার তৃষ্ণায় আমার চোখ ক্ষতবিক্ষত হয়েছে রোজ। আমি ভুল করেছিলাম আহান। যার শাস্তি আমি পেয়ে গেছি। আপনাকে রাগ দেখিয়ে কষ্ট দিয়েছি খুব। আমায় ক্ষমা করুন আহান।”
“এভাবে বলো না মীরা। তোমার এই অবস্থার জন্য আমি দ্বায়ী। আমার সাথে চলো প্লিজ।”
“আপনি ডাকলে আমি না গিয়ে কি করে থাকব। আপনাকে ছাড়া যে আমার এক মুহুর্তও চলে না। আপনি ভাবেন, আপনি রোজ রাতে এসে আমায় দেখে যান অথচ আমি টের পাইনা। আমি সবটাই টের পাই আহান। কিন্তু কিছু বলার ক্ষমতা আমার ছিল না।”
“তুমি জানতে?”
“হ্যাঁ, তবে কাল রাতের কথা আমার মনে নেই।”
“কাল তোমার খুব জ্বর উঠেছিল মীরা।”
“আপনি বুঝি সারারাত জেগে আমার মাথায় জল পট্টি দিয়েছেন?”
“আমার স্ত্রীর অবস্থা খারাপ হলে আমাকে তো দেখতেই হবে। আমি এতো নিষ্ঠুর কিভাবে হবো। যদি নিষ্ঠুরই হতাম তাহলে তোমাকে দেখতে আসতামই বা কেন।”
মীরা আহানকে জড়িয়ে ধরে। বলে, “আহান আমাকে ক্ষমা করুন।”
“বাদ দাও না মীরা। এখন এসব আমি আলোচনা করতে চাইনা। তুমি সুস্থ আছো এটাই আমার কাছে অনেক।”
“আপনি অতিরিক্ত ভালো আহান।”
“ভালো নই আমি। স্ত্রীকে কষ্ট দিয়েছি। ভালো থাকি কিভাবে।”
“আপনি আমার চোখে সেরা আহান।”
“খুব ভালোবাসি মীরা।”
“আমিও ভালোবাসি আহান। ভালোবাসি, ভালোবাসি, ভালোবাসি।”
চলবে…