দুই দুয়ারী
পর্ব ২
আগের পর্ব
https://m.facebook.com/groups/Anyaprokash/permalink/1667123710469316/?mibextid=Nif5oz
ভদ্রলোক আমার কাঁধে হাত রাখলেন, ” চলেন আপনাকে একটু আগায় দেই “।
আমি উনার সাথে সাথে হাঁটতে লাগলাম, উনি কথা বলছেন না দেখে আমিই বললাম, ” কালকে রাতে কি হয়েছিলো বলেন তো? ”
উনি সঠিক জবাব না দিয়ে অন্য কথা বললেন, ” অতীত কোনোদিন হারাইয়া যায়না। বর্তমানের মধ্যে অতীত লুকায় থাকে। অতীত আপনাকে টানতেসে। আর অতীতে যা হবার তাতো হইয়াই গেসে একবার। ওইটা বদলাবেন কিভাবে? ”
ওনার শিক্ষাগত যোগ্যতা সম্পর্কে আমার ধারণা নেই, ধরেই নিয়েছি খুব বেশি হবেনা, তাই তার গুরুগম্ভীর কথায় আমি একটু হাসি চাপলাম, ” কি বিষয়ে কথা বলছেন বুঝতে পারিনি। আবার বলবেন? ”
” আমরা খুলনা শহরে ছিলাম, ভালোই ছিলাম, কয়েক বছর আগে আম্মা প্যানপ্যাঁনানী শুরু করলো। এই কোটচাঁদপুরে আসতেই হবে আমাদের। কোন কথা শুনেনা, রাতদিন কান্নাকাটি। জিগ্যেস করলে বলে, অতীত টানতেসে। কথা বুজছেন কিছু? ”
আমি বুঝিনি, মাথা নেড়ে সেটা জানালাম, তিনি আবার বললেন, ” আমি বললাম, আম্মা, কি বলেন, যাইতে চাইতেসেন ভালো কথা, হয়তো ভাবসেন ঐখানে ভবিষ্যত ভালো, অতীত অতীত করেন কেন? ”
আমি আবারো অন্যমনস্ক হয়ে গেছি, কি যেন একটা মনে পড়ার কথা, ধরতে চাচ্ছি, কিন্তু নাগালের বাইরে থেকে যাচ্ছে। জালাল সাহেব হেসে উঠলেন, ” কি? মনে পড়েনা তো? যেটা এখনো হয়নাই মনে পড়বে কেমনে? ”
এবার একটু রাগ হয়ে গেলো, ” আপনি কি আমাকে কিছু বলতে চান? পরিষ্কার করে বলুন। আর আপনি আপনি করছেন কেন? আমিতো আমার দাদা নই, আমাকে সম্মান দেখানোর কিছু নেই ”
উনি থমকে দাঁড়ালেন। একটা স্কুল বিল্ডিং এর পাশে এসে দাঁড়িয়েছি ততক্ষনে আমরা। ঈদের ছুটি, স্কুল বন্ধ, স্বাভাবিকভাবেই ভেতরটা খা খা করছে, একটা রিকশা টুং টুং শব্দে ঘন্টি বাজিয়ে আমাদের পাশ দিয়ে চলে গেলো।
” আমার এতো জ্ঞান নাই। আম্মা বলেছেন আপনাকে এখানে পৌঁছে দিতে, দিলাম। বাকিটা আপনি বুঝবেন ”
আমি বুঝবো? কি বুঝতে হবে তাই তো জানিনা… কিন্তু না, আমি হঠাৎ করেই ওনাকে পিছনে রেখে স্কুল বিল্ডিংটার দিকে হাঁটা শুরু করলাম। হাঁটতে হাঁটতে একবার পিছনে তাকালাম, জালাল সাহেবও তাকিয়ে আছেন আমার দিকে।
স্কুলের মাঠে বিশাল একটা বট গাছ, শাখা প্রশাখা বিস্তৃত করে অনেক খানি জায়গা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। লোকমুখে শুনেছি, এর বয়স একশো বিশ বা তার কিছু বেশি। আমরা এর নাম দিয়েছিলাম অচিন বৃক্ষ, ঠিক গল্পের মত, আমরা বলতাম এই গাছেরও হয়তো ইচ্ছে পূরণের ক্ষমতা আছে।
অন্যমনস্কভাবেই আমি গাছের শাখায় হাত রেখে দাঁড়িয়েছি, মাটি আর গাছের পাতা মিলে একটা সোদা গন্ধ আমার নাকে আঘাত করছে। আমি চোখ বন্ধ করে গন্ধটা উপভোগ করছিলাম। ঠিক সেই মুহূর্তে কোথাও যে একটা কিছু পরিবর্তন হয়ে গেলো, চোখ না খুলেও আমি স্পষ্ট অনুভব করতে পারলাম।
দীর্ঘ কিছু মুহূর্ত কাটলো সেভাবে, জানিনা কতক্ষন। একটা ঘোরের মধ্যে চলে গেলাম আবার। অনেকটা সময় পর আমি চোখ খুললাম। সূর্য ডুববে এখনি, পশ্চিমাকাশ লাল হয়ে আছে। কি আশ্চর্য! একটু আগেই প্রখর রোদে জালাল সাহেবের সাথে হেঁটে আসছিলাম। আমি কি তাহলে ঘুমিয়ে পরেছিলাম? কিন্তু দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে? সে যাই হোক, এ ছাড়া আর কোন ব্যাখ্যাও নেই। ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম।
ইস। বাড়িতে নিশ্চই হই চই লেগে গেছে। মা চিন্তা করছে, দাদা হয়তো লোক লাগিয়ে দিয়েছেন এতখনে। কি করে এখানে এতটা সময় পার করলাম, সে রহস্যর সমাধান হবে পরে , আপাতত বাড়ি যাওয়া দরকার। পকেটে হাত ঢোকালাম অভ্যাসবশত, মোবাইল ফোনটার জন্য, মনে পরল পাঞ্জাবির পকেট থেকে বারবার পরে যায় বলে আজ ওটাকে বাসায় রেখে বের হয়েছি। যেইনা ভেবেছি পা চালাবো, স্কুল বিল্ডিংটার দিকে চোখ পরল আমার ।
কিন্তু কোথায় বিল্ডিং? ছাদের জায়গায় খড়ের ছাউনি দেখতে পাচ্ছি অন্ধকারেও, ইটের গাথুনি নেই, সস্তার সাদা রঙের আড়ালে মাটিতে গড়া দেয়াল। আমি ঘুমন্ত থাকা অবস্থায় কেউ কি আমাকে তুলে এনে অন্য কোথাও রেখে গেছে? কেউ কেন এটা করবে? কার কি স্বার্থ থাকতে পারে এর পিছনে? আর তার চেয়েও বড় কথা, কোথায় আমি? এটা কোন জায়গা?
***
একটি তরুণী মেয়ে আর দশ এগারো বছরের এক বালককে দেখা গেল সেই ঘরের ভিতর থেকে বের হয়ে আসতে। আশা করছিলাম না বলেই আমি প্রচন্ড ভাবে চমকে উঠলাম, ওরাও চমকেছে, দাঁড়িয়ে গেছে আমাকে দেখে।
আমার কোন উপায় ছিলোনা, নিজেকে ধাতস্থ করে একটু এগিয়ে গেলাম, ” এটা কোন জায়গা? ”
মেয়েটি আঁচল মুখে চাপা দিয়ে খিলখিল করে হেসে ফেলল এই কথায়, ” আপনি যেই জায়গায় আসছেন, সেই জায়গা”।
হাসির শব্দটা এমন রিনিঝিনি ধরণের ছিল যে আমিও সব ভুলে হাসতে বাধ্য হলাম, তারপর বললাম, ” কোথায় এসেছি আমি? ”
বালক তখন মেয়েটার হাত ধরেছে, ” ও মিলিবু, চলো বাসায় চলো। লোকটা মনে হয় ঢাকা থেকে আসছে। ঢাকার লোকদের আমার ভয় করে ”
আমার বয়স নিতান্তই কম, লোক বলে সম্বোধনটা একটু গায়ে লাগলেও এড়িয়ে গেলাম, ” আমি আসলেই ঢাকা থেকে এসেছি, পথ হারিয়ে ফেলেছি এখন। আমাকে ভয় পাবার কিছু নেই। শুধু যদি বলতেন আমি কোথায়, খুব উপকার হত ”
ছেলেটার অনবরত হাত ধরে টানাটানিকে উপেক্ষা করে মেয়েটা এবার বলল, ” এটা চিত্রাপুর গ্রাম। এতে কোন লাভ হবে? ”
আমাদের মফস্বল শহরটার নাম আগে চিত্রাপুর ছিলো, চিত্রা নামের ছোট একটা নদী কোটচাঁদপুরের পাশ দিয়ে বয়ে যেত একসময়, তার নামে জায়গাটার নাম হয়েছিলো শুনেছি। পরে নদীটা শুকিয়ে গেছে, তখন বাজারের নামে জায়গার নাম হয়ে গেছে কোটচাঁদপুর। একটু ভরসা পেলাম, খুব দূরে হয়তো আমাকে ফেলে যায়নি তাহলে , চিত্রাপুর নাম যেহেতু, কাছাকাছিই কোথাও আছি।
মেয়েটা আমাকে ফেলে সহসা চলে যেতে একটু দ্বিধা বোধ করছে, একটু ইতস্তত করে বলেই ফেলল, ” আমাদের সাথে আসবেন?”
আমি অবাক হয়েছি, খুব সহজ সাবলীলভাবে কথা বলছে মেয়েটি, তাও কম বয়সী একটা ছেলের সাথে, সাধারণতো গ্রামের মেয়েরা এমন হয়না। আবছা অন্ধকারে তার মুখ স্পষ্ট করে দেখা যাচ্ছেনা, কিন্তু শাড়ি পড়ার কারণেই কিনা জানিনা, তাকে বেশ রহস্যময়ী মনে হচ্ছে। প্রথম দেখায় অজান্তেই তরুণী ভেবে নিয়েছিলাম, এখন তার পেছন পেছন হাঁটতে হাঁটতে বারবার তাকিয়েও পরিষ্কার করে কিছু বুঝতে পারছিনা।
ছেলেটা বলল, ” বাবা মারবে আজকে। সত্যিই মারবে। ”
মেয়েটা তার মাথার চুলে হাত বুলিয়ে বলল, ” তাইলে আসিস কেন আমার পিছে খালি খালি। না করসি না? ”
আমার একটু গল্প করার শখ হলো, পা চালিয়ে ওদের পাশাপাশি হেঁটে বললাম, ” এই সন্ধ্যায় এখানে কি করছিলেন আপনারা? ”
মেয়েটা চকিতে তাকালো, ” বিকালে আমাকে দেখতে ছেলে পক্ষের আসার কথা ছিল। সেই তখন থেকে ইস্কুল ঘরে পালায় আছি ” তারপর আবার কিছুক্ষন রিনঝিন শব্দে হেসে নিয়ে বললো, ” আর এই জালাইল্যা ছাড়া কেউ আমার লুকানোর জায়গা চিনেনা, সেও পিছে পিছে আইসা আমার সাথে বসে থাইকলো। ”
ঠিক কি কারণে জানিনা, ছেলেটার দিকে ভালো করে তাকানোর চেষ্টা করলাম আমি, ” তোমার নাম জালাল? ”
ওর হয়ে মেয়েটা উত্তর করল আবার, ” হ্যাঁ। ও আমাদের মসজিদের ইমাম সাহেবের ছেলে। বেচারার মা মরে গেছে কয়দিন হল। আর ইমাম সাহেব তার রাগ ঝাড়ে এই বেচারার উপর। রাত নাই দিন নাই, মাইর ”
একটু পরে একটা বাড়ির সামনে থেমে গেল ওরা, ” এটা আমাদের বাড়ি। এখন ভিতরে গিয়া আব্বা আম্মার বকা খাবো” মেয়েটা এমনভাবে বললো যেন বকা খাওয়া খুব মজার একটা ব্যাপার, ” আপনি কোথায় যাবেন? ”
” নজরুল সাহেবের বাড়িটা কতদূর বলতে পারবেন? এলাকার চেয়ারম্যান ছিলেন একসময়, চেনেন? ”
” নজরুল সাহেব? চেয়ারম্যান? নাম শুনিনাই কখনো”
আমি এতক্ষনে চিন্তিত বোধ করতে শুরু করলাম, ” আচ্ছা একটা রিকশা কোথায় পাওয়া যাবে বলতে পারেন? ”
“রিকশা? ” আবার হাসি, ” আমাদের এখানে রিকশা নাই আপনাদের ঢাকার মত। ”
” রিকশা নেই? ” আমি অবাক। কোথায় আছি আমি? কোন প্রত্যন্ত অঞ্চলে?
” রিকশা কি বু? ”
” আরে আমরা দেখলাম না ছবিতে? মনে নাই রংবাজ সিনামায়? ”
রংবাজ? রংবাজ কোন সিনেমা? আমি মোটামুটি বাংলা চলচ্চিত্রের খবর রাখি, এমন কোন সিনেমার নাম ইদানিং শুনিনি। হয়তো মফস্বলের সিনেমাঘরে দেখানো তৃতীয় শ্রেণীর কোন ছবি, তাই আমার জানা নেই।
” আমি আপনার বাড়িতে একটু যেতে পারি? ” নিরুপায় হয়ে বললাম, ” হয়তো আপনার বাবা সাহায্য করতে পারবেন আমাকে? ”
” তাহলে এখানে একটু অপেক্ষা করে পরে আসেন।” বলেই ওরা আমাকে একা রেখে ভিতরে চলে গেল।
আমি একা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নিজেকেই গাল দিচ্ছিলাম। আমার নিজের দেশের বাড়ি, জন্ম থেকে আসা যাওয়া, আরেকটু জেনে শুনে রাখলে কি ক্ষতি হত? আমি রীতিমতো যুবক, ভয়ের কিছু নেই হয়তো, কিন্তু হঠাৎ করে অন্ধকারে কোন দিকে হাঁটা শুরু করবো? আমি নিশ্চিত দাদার কোন শত্রু এই কাজটা করেছে। আমাকে কোনোভাবে গভীর ঘুম পাড়িয়েছে, তারপর বহু দূরে কোথাও ফেলে রেখে গেছে। এটা কি ধরণের ফাজলামো? একবার বাগে পেলে…
হারিকেন হাতে একজন কেউ বের হয়ে এলেন, কতকাল পরে হারিকেন দেখলাম! এই অজপাড়া গায়ে সময় কি থমকে আছে? কে হারিকেন ব্যবহার করে এই যুগে?
” তুমি পথ হারায় ফেলসো শুনলাম ” ভদ্রলোক মধ্যবয়স্ক, পরনে লুঙ্গি, আমার মুখের কাছে আলোটা ধরে বললেন, ” ভিতরে আসো। ঢাকা থেকে আসছো? বেড়াইতে? ”
আমার পরণে ঈদের পাঞ্জাবী, মোবাইল সাথে নেই, পকেটে খুব বেশি হলে তিন থেকে চারশো টাকা, এই অবস্থায় ঢাকা থেকে এসে পথ হারিয়ে ফেলা কোন কাজের কথা নয়। আমার একটু লজ্জা লজ্জা করতে লাগল। পাঞ্জাবীর দিকে দৃষ্টি যেতেই আরেকটা কথা মনে হল আমার, ঈদের দিন আবার কোন ছেলেপক্ষ মেয়ে দেখতে আসে?
আমি ওনার পিছে পিছে ঢুকলাম, দারিদ্রতা খুব প্রকট না হলেও কি যেন একটা অদ্ভুত কিছু আছে বাড়িটায়, ভীষণ রকম আটপৌরে আর পুরোনো। গ্রামের মানুষের জীবন সম্পর্কে আমার যে কোন ধারণা নেই, সেটা খুব পরিষ্কার করে বুঝতে পারলাম।
বাড়ির বাইরে উঠানের মত আছে, সেখানে বেশ কয়েকটা চেয়ার পাতা। ভাবলাম, মেয়ে দেখতে এসে এইখানে হয়তো বসেছিল ছেলে আর তার অভিভাবকরা। তারপর মেয়ে পালিয়ে গেছে শুনে রাগ করে চলে গেছে। মেয়েটার রিনিঝিনি হাসির শব্দ মনে পরল, বেশ হয়েছে পালিয়েছে! ভেবে আমারো হাসি পেল একটু।
আমাকে সেই চেয়ারগুলোর একটায় বসিয়ে ভদ্রলোক উধাও হলেন , খুধাও টের পাচ্ছি এখন। সকালে ভরপেট খেয়ে বের হইনি, সামান্য সেমাই মুখে দিয়ে নামাজে চলে গিয়েছিলাম। ওদিকে আমাদের বাড়ি রান্নার সুগন্ধে ম ম করছে আর এখানে এমন এক জায়গায় বসে আছি, যারা ঈদের দিনেও কিছু খেতে বলছেনা।
” নাম কি? কি করেন? কেন আসছিলেন গ্রামে? একাই? পথ হারাইলেন কিভাবে?” এক বাটি ফিরনির বদলে এতো প্রশ্ন শুনে আমার রাগ হয়ে গেল।
” একটু রাস্তা পর্যন্ত এগিয়ে দিন। আমি চলে যাব। আমি নজরুল সাহেবের নাতি। নাম শুনেছেন? ” একটু উদ্ধত হয়ে বললাম।
” নজরুল সাহেব? না। চিনিনা ” আরেক ভদ্রলোকের আগমনের শব্দে তার দিকে তাকিয়ে বললেন, ” ইমাম? তুমি শুনছো নজরুল সাহেবের নাম? ”
” না ” ইমাম রাগে ফুসছেন মনে হলো, ” কই সে হারামজাদা জালাল ? বের হতে বলেন। ”
” কোন রাস্তার কথা বলো তুমি বলতে পারিনা। আর আজকে সারাদিন পরিশ্রম ও কম যায়নাই আমার। তার ওপর ধামড়ি মেয়ে, আঠারো বছর বয়স, সে নাকি বিয়ে শাদী করবেনা, পড়াশোনা করবে। আমার মুখে চুনকালী মাখাইলো আজকে। আমি এখন এতদূর যাইতে পারবোনা ”
আমি ততক্ষনে সিদ্ধান্ত নিয়েছি, একাই হাঁটতে শুরু করবো, এক সময় না এক সময় তো অন্য কারো দেখা পাবো!
” আজকের রাত আমার ওখানে থাকো। এটাতো তোমার ঢাকা শহর না, বিদ্যুৎ নাই এখানে বুঝছ? ” ইমাম সাহেব বললেন, ” ঘুটঘুটে অন্ধকারে যাবা কই? সকালে আমি ব্যবস্থা করে দিব? ”
বিদ্যুত নেই? আমার দাদার বাড়ির আশেপাশে এমন জায়গাও আছে? তবে উনার কথায় যুক্তি আছে, বিদ্যুৎ যদি না ই থাকে আর যদি অন্ধকার এত তীব্র হয়, আমি হয়তো সত্যি সত্যিই পথ হারিয়ে ফেলবো।
” আচ্ছা ” আমি বললাম, ” আপনার কষ্ট না হলে। জায়গা হবে তো আমার? ”
” আমি আর জালাল মাটিতে ঘুমাবো আজকে ” উনি হাসিমুখে বললেন, ” কিরে ব্যাটা? পারবিনা? ”
***
সত্যি সত্যি আমাকে তাদের একমাত্র চৌকিতে শুতে দিয়ে বাপ্ ছেলে মাটিতে শুয়ে পরল, আর একটু পরে আমাকে অবাক করে দিয়ে ঘুমিয়েও পরল। আমি জেগে রইলাম, একটু চিন্তা হচ্ছে ঠিক, কিন্তু মজাও পাচ্ছি এখন। বিশাল একটা অভিযান হচ্ছে, বাড়িতে ফিরে প্রথম কাজ হবে সামাজিক মাধ্যমে বড়সড় একটা গল্প লিখে ফেলা।
” এখানে ঈদের আনন্দ নেই, এখানে ঝলমলে আলো নেই… ”
রাত কত হয়েছে জানিনা, মোবাইলে এমন অভ্যাস হয়েছে, হাত ঘড়ি পরা হয়ে উঠেনা। কয়টা বাজে জানার উপায় নেই কোন। একটা হারিকেন ঘরের কোনায় টিমটিম করে জ্বলছে। সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই হঠাৎ আমার মনে হল ঘরের বাইরে কেউ আছে। আমি পরিস্কার পায়ের শব্দ টের পেলাম, এমনকি কাপড়ের খসখস ও।
বিছানায় উঠে বসে নিচে মেঝেতে শুয়ে থাকা জালাল আর ওর বাবার দিকে তাকালাম, পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে আরাম করে ঘুমাচ্ছে। ইচ্ছে হলোনা ওদের ডাকি, আমি একাই বাইরে যাওয়া মনস্থির করলাম, হয়তো আমাকে কেউ নিতে এসেছে।
ঘরের বাইরে দাওয়ার উপর হারিকেন জেলে একটা মেয়ে বসে আছে, সেই অদ্ভূত আলোয় মেয়েটির মুখ দেখে আমি অবাক বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলাম। এতো সুন্দর কোন মানুষ হয়? কি আশ্চর্য! বাইশ বছরের জীবনে প্রথমবার আমার বুঁকের মধ্যে একটা ঝড় জাতীয় কিছুর অস্তিত্ব টের পেলাম।
আমার শব্দ পেয়ে মেয়েটি তাকালো এবার, আমি এতো রাতেও তার চোখে কাজল স্পষ্ট দেখতে পেলাম। পরনের সেই শাড়িটি এখনো পাল্টায়নি, নীল রঙের শাড়িতে বড় বড় ফুলের ছবিটা। সে হাসল। আমি টের পেলাম এবার আমার বুক ব্যাথা করছে।
” বসেন ” সে বললো, ” সকাল থেকে আমি নিজের হাতে রান্না করলাম, আর আমার বাবা একটা ক্ষুধার্ত মানুষকে এমনে পাঠায় দিলো। ঘুমাইতেই পারলাম না ”
অন্ধকার রাত, শুধু একটু পিদিমের আলো, সেই আলোয় রহস্যময়ী তরুণী, ক্ষুধার্ত যুবকের জন্য খাবার নিয়ে এসেছে। আমি প্রচন্ডরকম আপ্লুত হয়ে পড়লাম, কথা না বলে বসেছি তার পাশে, একটু দূরে।
” ঠান্ডা ” সে বললো, ” কিন্তু কি করবেন, এভাবেই খেয়ে নেন ”
” আপনার ভয় করলোনা? এতো রাতে অন্ধকারে একা একা আসলেন? ”
রিনিঝিনি হাসি, ” এই দুইটা বাড়ি পরেই তো। ভয়ের কি? আমি এমনিও মাঝে মাঝে রাতে চাঁদ দেখতে বাইর হই। আমার খুব ভালো লাগে ”
আমার কল্পনা ততক্ষনে রেসের ঘোড়ার মত তীব্র বেগে ছুটছে, চাঁদের আলোয় এই অদ্ভূত অসামান্যা তরুণীকে নিয়ে আরো অনেক কিছু ভাবতে ইচ্ছে করছে। নিজেকে রুখতে ভাত মুখে দিলাম। ঠান্ডা সত্যিই, কিন্তু অমৃতের চেয়ে কম স্বাদ না।
” পাঙ্গাস মাছ ” সে বলল, ” অনেক কাঁচা ঝাল দিয়ে রানতে হয়, আমি অনেক ভালো পারি এটা। ”
চলবে