দুই দুয়ারী পর্ব ৯

0
109

দুই দুয়ারী

পর্ব ৯

দুইদিন না, আমরা ফিরলাম তিনদিন কাটিয়ে। ভালো লাগছে ভেবে যে আমার পকেটে কিছু অর্থ আছে যা আমার একান্ত নিজের কিন্তু শরীর জুড়ে ক্লান্তি। সঙ্গী দুজনের যাবার জায়গা আছে, আমার নেই, এই ভাবনায় ভালো লাগাটা বিষন্নতায় পরিণত হচ্ছে বারবার।

ওরা চলে গেছে বিদায় নিয়ে, আমি দাঁড়িয়ে আছি একা। খুব ইচ্ছে করছে মিলিদের বাড়ি যাই, কিন্তু তা কি করে হয়? খেয়াল করলাম, একয়দিনের শারীরিক পরিশ্রম আমাকে কঠিন পুরুষ বানিয়ে দিতে পারেনি। আমার একটু একটু কান্না পাচ্ছে।

অবশেষে পা বাড়ালাম ইমাম সাহেবের বাড়ির দিকে, নিরাশ্রয়কে আশ্রয় দিয়ে আজ রাতে উনাকে আরেকটু সওয়াব কামাবার সুযোগ করে দেয়া যাক। উনি বিরক্ত হবেন, জানি, তবু এই মুহূর্তে আমি লজ্জাহীন, নিরুপায়। যখন পৌঁছলাম, আমার মধ্যে শক্তি আর বিশেষ অবশিষ্ট নেই, লৌকিকতার কাছে দিয়েও গেলাম না। বাপ্ ছেলের অবাক দৃষ্টির সামনে মেঝেতে সটান হয়ে শুয়ে পরলাম।

***

গভীর রাতে ঘুম ভেঙে গেলো আমার। ইমাম সাহেবের হালকা নাসিকাধ্বনি শুনতে পাচ্ছি।কয়টা বাজে জানার উপায় নেই, খুব উচিত ছিল যেভাবে পারি একটা হাত ঘড়ি কিনে আনা, তখন মনেই পড়েনি। অবশ্য কটা বাজে তাতে কিছুই আসে যায়না। আমি জানি সময়টা আমার অভিসারের।

সুতরাং আমি উঠলাম। ঘুমিয়ে শরীরটা ঝরঝরে লাগছে, পেট জানান দিচ্ছে সে ক্ষুধার্ত। তবে মন জানান দিচ্ছে আরো বেশি, সেও বড় ক্ষুধার্ত। সেই বাঁশবাগান, সেই পুকুর পাড়। মিলিকে দেখে আমি শব্দ করে হেসে ফেললাম আনন্দে। আমি জানতাম ও আমাকে নিরাশ করবেনা।

” বলছিলেন দুই দিন ” আষাঢ়ের সব মেঘ ওর চোখে।

” বৈশাখ আগে না আষাঢ়? ” আমি বললাম।

” ফালতু কথা বলতে আসছেন এখন? ”

আমি আবার হাসলাম, কি আশ্চর্য! প্রেমে পড়লে শহরের মেয়েরা যেভাবে কথা বলে, গ্রামের মেয়েরাও সেভাবে বলে? পঞ্চাশ বছর আগে যেভাবে বলে পঞ্চাশ বছর পরেও সেইভাবে বলে?

” না ভাবছিলাম তোমার চোখে আষাঢ় আমার বুকে কালবৈশাখী ঝড় তাই”।

এতখনে হারিকেনের আলোয় মাটির পাত্রটা দেখলাম, এগিয়ে দিয়ে বলল, ” কুমড়া ফুলের বড়া। খাইয়া চুপ থাকেন। কি বলেন কিছুই বুঝিনা “।

আমি নীরবে খেলাম কথা না বাড়িয়ে। পরে হাত মুঠি করে বাড়িয়ে দিলাম ওর দিকে, ” এই নাও। আমার প্রথম কামাই। মাকে দিতাম, তাতো পারছিনা, বৌকে অর্ধেক দিলাম, বাকিটা দাদির”।

মিলি কাঁদছে। অদ্ভুত একটা মেয়ে। কান্নাহাসির কোন ঠিক ঠিকানা নেই।

” তোমাকে কিছু কথা বলবো। পাগল ভাববে নাতো আমাকে? ”

” আপনেতো পাগলই। তবু বলেন, শুনি ”

” আমি এখানকার মানুষ নই ”

” সেতো জানি ”

” আচ্ছা সহজ করে বলি। এখন ১৩৭৯ না? আমার জন্ম ১৪০৭ সালে। ”

মিলি হাসছে, আমি পাত্তা দিলাম না, ” নজরুল আমার দাদা। ওর যে ছেলে, লুৎফর, আমার বড় চাচা, আর যে সন্তানটা আসবে, সে আমার বাবা ”

” আপনি পাগল জানতাম, এত বড় পাগল তা বুঝিনাই। কি বললেন, একটা কথাও বুঝলাম না, হারাম!”

” মিলি, মিলি ” আমি ওর কাঁধ স্পর্শ করে একটু ঝাঁকাই, ” হাসি বন্ধ করে শোন। যদি কেউ বুঝতে পারে, সে একমাত্র তুমি। ”

” আমার বুঝার ইচ্ছা নাই। বিয়া করবেন না তাই এসব বলতেসেন, বুঝছি। খাওয়া হইসে? আমার বাটি দেন। আর এই নেন আপনের টাকা… ”

আমি হাল ছেড়ে দিলাম। এখন সে চলে গেলে আমার চলবেনা। ক্ষুধা মিটে গেছে, আমি এখন তৃষ্ণার্ত। আমি পুরোপুরি হার মেনে নিয়ে বললাম, ” আচ্ছা। আচ্ছা আর বলবোনা। আরেকটু বসো। ”

একটু পরে আমি আবার বলছিলাম, ” আমার দাদার বাবার দুই ছেলে, দাদার তিন ছেলে, তাদের তিনজনের একজন করে ছেলে, আমাদের বংশে মেয়ে নেই। আমার একটা মেয়ের শখ হচ্ছে খুব জানো? ”

” এমন কথা জীবনে শুনিনাই। মেয়ের ও শখ হয় মানুষে র?” এটুকু বলে ও থেমে গেল, এরপর মুখ লাল করে উঠে দাঁড়ালো, ” এগুলি বলতে একটুও লজ্জা করেনা আপনার ? ”

আমি বুঝলাম না মেয়ের শখ করার মধ্যে লজ্জার কি আছে। কি পাগল মেয়েরে বাবা!

***

সকালে কোলাহল আমার ঘুম ভাঙালো। বাড়িতে কেউ নেই, জালাল আর তার বাবা কখন চলে গেছে কোথায়, কে জানে। আমি ঘর থেকে বের হয়ে অবাক হয়ে গেলাম। চেয়ারম্যান সাহেব দাঁড়িয়ে আছেন, সবসময়ের মত সাথে আছে কলিম ভাই আর একজন লোক। আর উনার পিছে নিজেকে প্রায় লুকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আমার ছাত্র, নাইমুল।

” বাবা ” উনি আমাকে জড়িয়ে ধরলেন, পানের মন কেমন করা একটা গন্ধ পেলাম সাথে সাথে, ” তুমি বাড়ি যাওনা, আমার বৌমা আর তোমার এই ছাত্র দুইজন খাওয়া দাওয়া ছাড়সে। আর আমিতো বুড়া মানুষ। আমার কথা বাদই দিলাম। ”

আমি তবু শক্ত মুখে দাঁড়িয়ে আছি, নজরুলের কথা ভুলতে পারছিনা। উনি আবার বললেন, ” নজরুলকে আমি বলসি। ভাই ভাই হইয়া থাকবা। চলো রাগ কইরা থাইকোনা। চলো। ”

রক্তের বোধহয় একটা অন্যরকম আকর্ষণ থাকেই। আমি ইমাম সাহেবের করুনার চেয়ে আমার নিজ বংশের করুনাকে প্রাধান্য দেব কিনা ভেবে দেখতে শুরু করলাম। তখন কলিম ভাই বললো, ” ছোট ভাই, আজ বাদে কালকে আমার বিয়া। আগেই বলছি আপনি তাদের বিশেষ মেহমান। যাবেন না? ”

” আপনার বিয়েতে তো যাবোই।” বললাম, দাদির সাথেও দেখা করা দরকার। কি করবো বুঝতে পারছিনা। নজরুলের বলা কথাগুলিও ভুলে যাবার মত নয়, ” চাচা আপনি যান। আমি কিছু কাজ সেরে যাবো একবার আপনার বাড়ি।” এর বেশি কিছু বলতে পারলাম না।

নাইমুল হাত ধরলো আমার, ” স্যার। চলেন না? ”

আমি নিজের ভিতরে অপত্য স্নেহ টের পেলাম,
“আসবো ভাই। নিশ্চই আসবো।”

ভেবেছিলাম এত ক্লান্ত আমি, ঘুমিয়েই কাটিয়ে দিতে পারবো সারাটা দিন। কিন্তু আমার হঠাৎ করেই ভীষণ অস্থির লাগতে শুরু করলো। কেন যেন মনে হচ্ছে, যা করতে চাই তা খুব দ্রুতই করতে হবে। খুব দ্রুত। আমি যতটা পারলাম ভদ্রস্থ হলাম। পায়ের দিকে চোখ পড়তে থমকে যাই, সেই ঈদের পাঞ্জাবির সাথে শখ করে কেনা চামড়ার স্যান্ডেল জোড়া বহু ব্যবহারে ক্ষয়ে এসেছে। এক জোড়া নতুন জুতো যৌতুক হিসেবে চাইবো নাকি?

হ্যাঁ, আমি নিজেই আমার বিয়ের আলোচনা করতে যাচ্ছি এখন। আমাকে এক্ষুনি যেতে হবে। জানি চেয়ারম্যান সাহেবকে বললে হয়তো আমার জন্যও দুটো নাহলেও একটা খাসির ব্যবস্থা করে ফেলবেন। সেসব আমার দরকার নেই। আমার শুভ দিনে আমি থাকবো আর মিলি থাকবে। হ্যাঁ, ইমাম সাহেব থাকতে পারেন । বিয়ে পড়ানোর জন্য তাকে দরকার আছে।

তাড়াহুড়ো করছি? হয়তো। কিন্তু কেন জানিনা অস্থিরতা বেড়ে চলেছে ক্রমশঃ। দেরি করলে হয়তো মিলিকে হারিয়ে ফেলবো আমি! মিলি কি করছে এখন? কাল রাতেই এই বুকে ওকে ধরে রেখেছিলাম অনেকক্ষন, ওকে ছাড়া আমার চলবেই না আর।

***

” আমার বড় ছেলে” মিলির বাবা বললেন, ” খুলনায় থাকে। ওরে ছাড়া বিয়া কেমনে হয়? ”

ওদিকে মিলির মা আর মিলি দুইজন একটু দূরে দাঁড়িয়ে আঁচল মুখে চেপে ধরে কেঁদে যাচ্ছে। আমি বসেছি ওদের উঠানে, মোড়ার উপর। বাকি সবাই দাঁড়িয়ে আছে বলে আমার একটু অস্বস্তি হচ্ছে, তাই মাথা নিচু করে রেখেছি।

” তোমার বাপ্ মা পরিবার কোথায়, তেঁনারা কারা কিছু জানিনা… ”

একথায় মিলির মা আরো শব্দ করে কেঁদে উঠলেন। একেক কান্নার সম্ভবত একেক রকমের অর্থ, আমি মনোযোগ দিয়ে সেই অর্থ উদ্ধার করার চেষ্টা করছি।

” আর হুট্ কইরা তোমার সাথে মেয়ে শহরে দিয়া দিব, যদি নিয়া মাইরা ফালাও? ”

আমি এবারে মাথা তুললাম, এত অবাক হয়েছি বলার নয়। হতচকিত হয়ে বললাম, ” শুধু শুধু শহরে নিয়ে মেরে ফেলতে যাবো কেন? ”

খিলখিল হাসি শুনতে পেলাম, কান্না থামিয়ে হেসে উঠেছে মিলি। একসময় হাসি থামাতে না পেরে দৌড়ে ঘরে ঢুকে গেলো। ওর মা কথা বললেন তখন, ” ও এখানে থাক, তুমি যাওয়া আসা করো যদি…

ওনাকে থামিয়ে বাবা বললেন, ” হ। তোমার যা বুদ্ধি। যাক আর ফিরা না আসুক, তাই না?”

আমি উঠে দাঁড়ালাম, ” শহরে যেতে চাই ওখানে কলেজে ভর্তি হবে ও তাই। মেরে ফেলার ইচ্ছে নেই। আচ্ছা আপনারা ভাবেন। বেশি সময় নিয়েন না। কালকে পরশুর মধ্যে হলে আরো ভালো। ”

হঠাৎ মা নড়ে উঠলেন, ” একটু দাঁড়াও ” বলে মাটির পাতিলের ঢাকনা তুলে কি যেন তুলে আনলেন, ” পুলি পিঠা। মিষ্টি কিছু নাই। এইটাই মিষ্টি ভাইবা খাইয়া নেও”।

আমি খাচ্ছি, উনি আমার মুখে হাত বুলিয়ে দিলেন, ” এত সুন্দর চেহারা তোমার, শহরের ছেলে, শিক্ষিত মনে হয় দেখলে। আমার মেয়ে গ্রামের, তার উপর তারে নস্ট করসে পাকসেনায়, কেন তারে বিয়া করতে চাও, বলো তো? ”

” আমার ভালো লাগে। আর এমনিতেও ও ছাড়া আর কেউ নেই আমার”।

***

আমার জন্য নির্ধারিত ছোট ঘরটায় প্রবেশ করে আমার মন কেমন করে উঠলো। মায়া বড় খারাপ জিনিস,কখন কিসের উপর মায়া জন্মাবে কেউ বলতে পারেনা। এই অল্প সময়ের মধ্যে ঘরটার উপর মায়া জন্মে গিয়েছিলো।

ছোট লুৎফরের হাত ধরে আমার দাদি এসে দাঁড়ালেন একটু পরে, ক্ষিণ স্বরে বললেন, ” কয়দিনে কেমন শুকায় গেছেন।”

হতে পারে, চারদিন সকাল সন্ধ্যা মাটি কেটেছি। এ কথায় মনে পড়ল, ঢোলা পাজামার পকেটে করে সামান্য কিছু টাকা এনেছি, ” দাদি, এই নিন। কয়েকটা টাকা। আপনার জন্য আমার প্রথম উপার্জন। দুয়া করবেন আমার জন্য। ”

উনিও মিলির মতোই কাঁদতে শুরু করলেন, নাক টেনে টেনে বললেন, ” কি খাবেন? ”

আমি দুষ্টুমি করে বললাম, ” খাবার নিয়ে ভাববেন না। খাবার ব্যবস্থা হয়ে গেছে। কাউকে বলবেন না, আমি বিয়ে করবো। ”

” সত্যিই? ”

” হ্যাঁ। একদম সত্যি। আচ্ছা দাদি আমার পাঞ্জাবীটা কোথায়? আর আমার পাজামা? সেই যে একদিন ধুতে নিলেন, আর দেখিনি ওগুলোকে ”

” হারায় নাই। আছে। কলিম ভাইয়ের বিয়াতে পরবেন?”

” না। আমার বিয়েতে” বলে আমি খুব হাসতে লাগলাম, ” আমি এক দুইদিনের মধ্যে আসবো দাদি। আমার জামা তৈরী রাখবেন। আমার বিয়ের সাজ আপনার হাতে হবে। পারবেন না?”

” আচ্ছা ” সব সংকোচ ঝেড়ে এবার বিছানায় বসলেন তিনি, ” কিন্তু বিয়ার আগে মাইয়ার এত কাছে থাকা ঠিক কিনা? দুইদিন এইখানে থাকলে হয়না? ”

” আপনি জানেন কাকে বিয়ে করবো? ”

” সবাই জানে। আল্লাহ আপনার ভালো করবেন দেইখেন “।

আমার ছাত্রের সাথেও দেখা হলো, আমি ওকে বললাম, ” আমার এখানে আসতে হবে কেন? তুমি বাইরে বের হও না কেন? গিয়ে আমার সাথে দেখা করে আসবে কেমন?”

” বাইরে যাইতে আমার লজ্জা করে” সে মিনমিন করে বললো, ” সবাই ভাইজানরে ঘিন্না করে, আমারেও তার মত ভাবে।” তারপর আমাকে অবাক করে দিয়ে বললো, ” আমি তো ছোট মানুষ, না পারতে এখানে থাকি। আপনি কেন থাকবেন? আর আসতে বলবোনা। আগের কাজ গুলা শেষ করলে আমি গিয়া আপনার কাছে নতুন বাড়ির কাজ নিয়া আসবো। ”

সুতরাং এখানে আমার কোন বন্ধন রইলোনা আর। বাইরে উঠানে উদোম শরীরে চেয়ারম্যান সাহেব বসে আছেন, কলিম ভাই সব শক্তি দিয়ে হাত পাখা নাড়ছে।

” বাবা, বিদায় নিতে আসতে বলিনাই ” উনি বললেন, ” তারপরেও গেলে আর কি করবো। একটু দাঁড়াও। ” এই বলে গলা উঁচু করে নিজের স্ত্রীকে ডাকলেন তিনি, ” কি জানি বলবা বলছিলা, বলো, যাইতেসে এখন “।

এই মহিলার সাথে আমার সখ্য হয়নি খুব একটা, দুর থেকে কয়েকবার হেসেছেন শুধু । এতদিনে ভালো করে তাকালাম, ওর চেহারায় মা ভাব প্রবল। উনি আমার খুব কাছে এসে দাঁড়ালেন, অন্য কেউ শুনতে না পায়, এমন ভাবে ফিসফিস করে বললেন, ” তোমারে ঠিক ঠিক চিনছি, আমার স্বপ্নে আসছিলা একদিন। এইটাই বলতে চাইসিলাম, স্বপ্নের পাথথর”।

বলেই সরে গেলেন। আমি ভীষণ চমকে উঠলাম। আমরা বন্ধুরা মিলে একটা ব্যান্ড গানের দল বানিয়েছিলাম, নাম দিয়েছিলাম ড্রিমিং রক। মহিলা কি কোনভাবে সেকথাই বলতে চাইলেন? হয়তো ওনার কোনরকম ক্ষমতা আছে স্বপ্ন দেখার।

” আর কিছু বলতে পারবেন? ভালো আছে সবাই? ” আমি মরিয়া হয়ে প্রশ্ন করলাম।

” এতো জানিনা বাবা। শুধু তুমি আমার ছেলেটারে দেখবা । কথা দাও, দেখবা তো?”

চেয়ারম্যান সাহেব হেসে উঠলেন, ” হের একটু মাথা খারাপ আছে। কি কয় না কয়।”

***

আমি মাথা উঁচু করে বের হয়ে এলাম ঠিক ই, কিন্তু দাদি আমাকে একটু চিন্তায় ফেলে দিয়েছেন। হয়তো নিতান্ত মেয়েলি ভাবনা অথবা কোন সংস্কার, তবু মিলির খুব কাছাকাছি থাকার ব্যাপারটা আমাকে ভাবাচ্ছে। আমি যাবোই বা কোথায়?

দিনের বাকিটা সময় গ্রামটা চষে বেড়ালাম। এক বাড়িতে সন্তানের জন্ম হলো, বাইরে দাঁড়িয়ে তার কান্না শুনলাম। আরেক বাড়ির উঠোনে এক মহিলাকে খুব মারছিলেন এক লোক, বোঝা যাচ্ছিলো মহিলা তার স্ত্রী, আমি হুট্ করে লোকটাকে ধাক্কা দিয়ে কাদায় ফেলে দিয়ে এগিয়ে গেলাম, পিছনে ফিরে দেখলাম না পরে কি হলো। চোদ্দ পনের বছরের বেশ কয়েকটা মেয়ে আমাকে দেখে হাসতে হাসতে এ ওর গায়ে ভেঙে পড়ছিলো, আমিও হেসে ওদের একটু উস্কে দিলাম।

স্কুলঘরের সামনে বাচ্চারা খেলাধুলা করছিলো, অনেক সময় নিয়ে তাদের খেলা দেখলাম। একবার গেলাম কাওসারের কাছে, কবে আবার ওরা কাজ করতে যাবে জেনে নিলাম।

ক্লান্ত শরীর নিয়ে বাঁশবাগান পার হয়ে পুকুরের ধারে এসে বসেছি তারপর। আজকে অনেক দিন পরে আমার ড্রিমিং রকের কথা মনে পড়েছে, আহা কতদিন গান গাইনা!

হারিকেন হাতে জালালকে দেখতে পেলাম, এসেই বললো, ” বাড়ি চলেন। মিলিবু আসবেনা বলতে বলছে আপনারে “।

” আসবেনা কেন? ”

” চিঠি লেখসে আপনারে। এই দেখেন ”

আমি কাঁপা হাতে কাগজটা নিলাম, এটা আমার জীবনের প্রথম প্রেমপত্র হতে পারে অথবা প্রথম প্রত্যাখ্যানের বার্তা। আমার তর সইছেনা। স্বল্প আলোয় আমি ওর হাতের লেখা দেখলাম প্রথমে, কি সুন্দর!

” বাবা বলছে যেদিন বলবেন সেদিন বিয়া হবে। কিন্তু তারপরে আমাদের বাড়িতে থাকতে হবে আপনারে। ঘর জামাই…. এটুকু পড়ে মিলির খিলখিল হাসি কল্পনা করে নিলাম, ” মা বলছে বিয়ার কনে রাতবিরাতে ঘরের বাইরে যাওয়া নিষেধ। খারাপ বাতাস লাগবো… আমার আর কি খারাপ বাতাস বাকি আছে বলতে পারেন….

আমি সন্তর্পনে চোখ মুছলাম, জালাল বদটা হা করে তাকিয়ে আছে আমার মুখের দিকে…. ” বিয়া করতে হইলে কিন্তু দাঁড়ি গোঁফ কামাইবেন। আর ইমাম সাহেবরে বাসায় পাঠাইবেন জানাইতে কবে আসবেন…. ইতি, খায়রুন্নেসা মিলি। ”

গলা খাকারি দিয়ে অনেকদিন পরে গান ধরলাম তখন

” আমার মনের নোঙ্গর পইড়া রইছে হায়রে সারেঙ বাড়ির ঘরে…. ”

আগের পর্ব

https://m.facebook.com/groups/Anyaprokash/permalink/1683571102157910/?mibextid=Nif5oz

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here