দুই দুয়ারী
শেষ পর্ব (প্রথম অংশ)
মিলিদের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছি আমি। বিয়ের কোন আমেজ নেই এখানে, আত্মীয় স্বজনের ভিড় নেই, বাড়তি কোন সাজসজ্জার বালাই নেই। থাকার মধ্যে অল্প একটু সুগন্ধের আভাস আছে, প্রতিদিনকার চেয়ে ভালো রান্না হয়েছে সেটুকু বোঝা যাচ্ছে। সেই ঘ্রানে আমার ভেতরে ক্ষুধা চনমন করে উঠলো, কিন্তু খাবার কথা ভাবার সময় নেই এখন ।
কিছুখন দাঁড়িয়ে থেকে যখন কারো সাড়া পেলাম না, দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে গলা তুললাম, ” মিলি, এই মিলি, একটু বাইরে আসবে? ”
মিলি না, ওর মা বের হয়ে এলেন, আর পেছনে তার বাবাও।
” আপনি এত তাড়াতাড়ি এখানে কেন? ” বাবা বললেন। আমি খেয়াল করলাম, উনি আমাকে আপনি করে বলছেন আজ, মেয়ের জামাইকে আপনি করে বলার চল আছে, আমি আমার ভবিষ্যতের জীবনেও সেটা দেখেছি। আমার একটু শিহরণ হলো, আমি মেয়ের জামাই, ভেবে।
আমি বললাম, ” ইমাম সাহেবকে কি খবর দেয়া যায়? আমি ভাবছিলাম যদি এখনই… ”
তিনি হাতের ইশারায় আমাকে বসতে বললেন, ” কোন সমস্যা হইছে? নাকি ভাবতেসেন দেরি করলে আপনার মন পাল্টায় যাবে? ”
” আমার মন এই জীবনে পাল্টাবেনা ” লজ্জার মাথা খেয়ে বলে বসি, ” আমার খুব মন খারাপ। মিলি আমার কাছে… মানে যদি মিলির কাছে বসি… আমার মন ভালো হবে”।
মা দ্রুত ঘরে ঢুকে গেলেন, লজ্জা পেয়েছেন। বাবা হাসতে গিয়েও মুখ গম্ভীর করে ফেলে বললেন, ” দেখি জালালরে পাঠাই মসজিদে ”
জালাল দ্রুতগতিতে ছুটে গেল, আমি বসে রইলাম। আমার ভীষণ তৃষ্ণা পেয়েছে, রীতিমতো বুক ফেটে যাচ্ছে তৃষ্ণায়, কিন্তু সেটা পানির জন্য নয়। দুই একবার উঁকি ঝুকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করলাম, কাউকে দেখতে পেলাম না, কেউ বের হয়েও এলোনা।
জালাল যেভাবে গিয়েছিলো, সেভাবে দৌড়ে ফিরেও এলো, জানা গেল ইমাম সাহেব মসজিদে বা বাড়িতে কোথাও নেই। আমার ইচ্ছে হলো বলি, আপনি বিয়ে করাতে পারেন না? তিনবার কবুল বলতে হয় শুনেছি, আমি না হয় দশবার বললাম, চলবে না?
মা আবার বের হয়ে এসেছেন, ” বাবার মনে হয় খাওয়া হয়নাই সারাদিন, একটু সেমাই খান, ইমাম সাহেব চলে আসবে ”
উনি খুব সুন্দর করে বাবা বলেন, অনেকটা আমার মায়ের মত করে, আমার মন দ্রবীভূত হয়ে যায়। আমি ফিসফিস করে বললাম, ” আমি এখানে বসে থাকলে আপনাদের সমস্যা হবে? আমার কোথাও যেতে ইচ্ছে করছেনা। ”
” সমস্যা আর কি? যেই না বিয়ার আয়োজন। কিন্তু বাবা ঘরে আসতে বলতে পারবোনা এখনই। এইটুক তো করতে দেন মাইয়াটার জন্য “।
রোদ উঠেছে আজকে, বেশ গরম। এর মধ্যে মাথার উপর কোনরকম ছাউনি ছাড়া বসে থাকা একটু কষ্টই, তবু রাজি হয়ে গেলাম। হতচ্ছাড়া মিলিটা ঘরের ভেতর ঘাপটি মেরে বসে কি করছে জানিনা, একটাবার বাইরে আসলে কি হয়?
***
আমি বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, অথবা ঝিমুনি এসেছিলো, ইমাম সাহেবের উপস্থিতি ঘুম ভাঙালো আমার।
” খবর তো শুনছো মনে হয়, সেইজন্যই ছুঁইটা আসছো, তাই না? ” উনি বললেন।
আমি মাথা নিচু করে রইলাম। যদিও আমি জানি, এনারা কেউ আমার পরিচয় জানেন না, তারা জানেন না, আমি ওই ঘৃনিত নিষ্ঠুর চরিত্রহীন নজরুলের খুব আপন, রক্তের সম্পর্কের লোক, তবু লজ্জায় মাথা হেট্ হয়ে থাকে, তুলতে পারিনা।
” মেয়েটা খুব অসুস্থ হয়া গেসে” বলে উনি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন ” বাঁচবো কিনা সন্দেহ “।
আমি চমকে উঠলাম, প্রচন্ডভাবে।
” কলিমের বাড়ির সামনে ফালায় রাইখা গেসে। হুশ ছিলোনা। ”
আমি দাঁড়িয়ে গেলাম এবার, চিৎকার করে বললাম, ” পুলিশ? পুলিশ নাই এখানে? আপনারা নজরুলকে ধরিয়ে দিচ্ছেন না কেন? ”
” সেইটা নিয়াই কথা হইতেছিলো এতক্ষন। নিজামুদ্দিন সাহেবের ওইখেন থেকে আসলাম। কলিম পুলিশে জানাইতে চায়না ”
আমি অবাক হয়ে গেলাম। সোবহান , তার মেয়ে শেফালী আর তার স্বামীর কথা মনে পড়লো। কলিম ভাই ও কি তাদের মত জমিজমা আর দুটো গরুর বদলে এই অপমান ভুলে যাবে? এ কোথায় এসে পড়লাম আমি? আবার গলা চড়ালাম, ” মিলি, এই মিলি, বাইরে আসো। আমরা এখুনি চলে যাবো। ”
” যাইও ” ইমাম সাহেব বললেন, ” তাড়াতাড়িই যাইও। আজকে ঝামেলা হবে। এইখানে না থাকাই ভালো। বসো। বিয়াটা পড়ায় দেই, বেশি সময় লাগবেনা… ”
বসতে গিয়েও হঠাৎ বলি, ” ঝামেলা মানে? কেমন ঝামেলা? ”
” কলিম” উনি বললেন, ” নিজামুদ্দিন সাহেবের ওইখানে বসা এখনো। মানুষ মারার অস্ত্র খুজতাসে। সে বলছে, চেয়ারম্যান সাহেবের বংশ শেষ হইবো আজকে। নজরুল, হের পোয়াতি বৌ, নাইমুল কেউরে ছাড়বেনা। এই বংশ বাড়লেই আরো মাইয়াদের ক্ষতি, এই পরিবারে আর কোন পুরুষ মানুষ সে রাখবোনা “।
আমার মাথা ঝিমঝিম করতে লাগলো। কলিম ভাই কেন একথা বলতে বা ভাবতে পারে, আমি সেটা সমস্ত মন দিয়ে অনুধাবন করতে পারি। আর মনে হচ্ছে, খুব একটা অন্যায় ভাবনাও না সেটা… কিন্তু, তাহলে আমার বাবা? উনি জন্মাবেন না? আর যদি উনি না থাকেন তাহলে আমি? আমি যদি না থাকি তাহলে মিলিকে পাবো কি করে? আমার মাথা ঘুরতে লাগলো।
” আর আপনারা সেটা মেনে নিলেন? ”
” আমি মানা না মানার কে? তবে নিজামুদ্দিন সাহেব না করেন নাই। বলসেন, কাজ শেষ হোক, তারপরে পুলিশের ব্যাপার উনি দেখবেন”।
আমি আবার ডাকলাম, ” মিলি, এই মিলি, একটু বাইরে এসো। একবার। ”
এবার ভেতর থেকে মার গলা শুনি, ” নামাজে দাড়াইসে বাবা। একটুখানি সহ্য নাই, এইটা কেমন কথা? ”
আমার মাথার ভেতর প্রতিটা শিরা উপশিরা নিজেদের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে, আমাকে কলিম ভাইয়ের আগে সেখানে পৌঁছুতে হবে। নজরুল যত খারাপই হোক না কেন, ওকে আমার, আমার বাবার, আমাদের প্রয়োজন। সেই সাথে আমার দাদি, উফ, বাচ্চা একটা মেয়ে, যার গর্ভে পালিত আমার বাবা, পৃথিবীর আলো দেখার জন্য মুখিয়ে আছেন।
” আমি আসছি মিলি ” জোরে বললাম, ” একটু অপেক্ষা করো। আমি আসছি ”
ইচ্ছে ছিল, বিয়ে করে মিলিকে নিয়ে গরুর গাড়িতে উঠবো। আমার তো ওকে নিয়ে যাবার জায়গা নেই, অন্তত বিদায়ের নাটক করবো দুজন মিলে। তারপর চালকের চোখ এড়িয়ে অথবা চালক দেখে ফেললে নির্লজ্জের মতোই ওকে একটু ভালোবাসবো। সেইজন্য গাড়িটাকে আসতে বলা। ভাগ্য ভালো, আমার মতোই আমার গরুর গাড়িও সময়ের আগেই এসে উপস্থিত। অবশ্যই আমি কলিম ভাইয়ের আগে পৌঁছে যাবো।
***
যখন পৌঁছালাম, তখন প্রায় বিকেল হয়ে এসেছে, অন্তত মাথার উপরের তীব্র সুর্যটা আর নেই। কোন কিছুর পরোয়া না করে ঘরে ঢুকে গিয়েছি, অবাক হয়ে দেখলাম, নজরুল কাঁথা গায়ে ঘুমুচ্ছে। কি সাহস! কত বড় আস্পর্ধা! কি পরিমান আত্মবিশ্বাস!
আমার ওকে হাত দিয়ে স্পর্শ করতে ঘৃণা করে, আজন্ম যাকে সম্মান করে এসেছি, সেই দাদা নজরুল, তাকে আমি আমার বহুল ব্যবহৃত স্যান্ডেলের আগা দিয়ে লাথি মেরে ঘুম থেকে তুলি, ” এই শুওরের বাচ্চা। ওঠ। এখুনি ওঠ”।
চেয়ারম্যান সাহেবের স্ত্রী আর আমার দাদি দুজন এসে উপস্থিত হয়েছে তখন, আমি বললাম, ” আপনার ছেলেকে দেখতে বলেছিলেন না? এই দেখেন দেখতে এসেছি “।
দাদি চূড়ান্ত বিস্ময় নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন, নজরুল নিজেও তাই। অদ্ভূতভাবে সে আজকে কিছুই বললোনা, বরং উঠে দাঁড়াতেই আমি আমার সব শক্তি একত্রিত করে ওকে চড় মারলাম।
” কি হইতেসে এসব? ” চেয়ারম্যান সাহেবের কণ্ঠ। আজ আমি স্নেহ বোধ করিনা, যে বাবা এতকিছুর পরে ছেলেকে ঘরে প্রবেশ করতে দিয়েছেন, আবার হয়তো রাতের ক্লান্তি দুর করার জন্য তাকে দিনের বেলায় ঘুমাতে দিচ্ছেন, তাকে ধিক্কার করতে ইচ্ছে করে।
অবশ্য আমিও কম কিছু নই, রক্তের টানে এখানে ছুটে এসেছি এই নরপিশাচকে উদ্ধার করতে, ওনার সাথে আমার খুব একটা পার্থক্য নেই বোধহয়।
” এখুনি পালাতে হবে তোদের ” তুই ছাড়া কিছু বের হলোনা মুখ দিয়ে, ” যেমনে আছিস সেভাবে, এক মুহূর্ত সময় নেই ”
” কি হইসে? ” চেয়ারম্যান সাহেব বললেন।
” আপনি জানেন না কি হইসে? কলিম আসছে ওকে মারতে। হয়তো চলেও এসেছে। এখুনি বের হন আপনারা। দাদি, লুৎফর, নাইমুল সব সহ। আমার সাথে গরুর গাড়িটা আছে। পিছনের জঙ্গলের পথ দিয়ে বের হতে হবে। আর একবারও না থামিয়ে যতদূর যাওয়া যায় চলে যেতে হবে। ”
আমি ইমাম সাহেবের কাছে শোনা কথাটা ওদের জানালাম। চেয়ারম্যান সাহেব বোকার মত হাসছেন, ” কলিম? ও মারবে আমাদের? হাহাহাহা। ওর রক্ত পর্যন্ত আমার কিনা। তারপরেও যাইতে হইলে এরা যাক, কলিমের সামনে আজকে না পড়ুক। আমি থাকি। গাড়িতেও ধরবোনা এত লোক।”
নজরুল একটা শব্দও বললোনা মুখ দিয়ে, শুধু লুঙ্গি বদলে পাজামা পরে নিলো নীরবে। দাদি খুন খুন করে কাঁদছেন বিরামহীন, চেয়ারম্যান সাহেব আর তার স্ত্রী নিস্তব্ধ। নাইমুল বাবার জামা ধরে দাঁড়িয়ে রইলো, সে কিছুতেই যাবেনা। তার তো কোন দোষ নেই, তাই।
তাদের বাড়ির পেছনে জঙ্গলটা, সেদিক দিয়ে বের হয়ে গেলো গরুর গাড়িটা। এক কাপড়ে আর সামান্য কিছু অর্থ নিয়ে ওরা যাচ্ছে।
আমি বড় করে নিঃশ্বাস ফেলে তাকিয়ে রইলাম সেই কুয়াটার দিকে, এই পর্যন্ত তিনবার বাবাকে বাঁচিয়ে দিলাম। অথচ সেই কবে আমি দুষ্টুমি করতে গিয়ে বিদ্যুতের তারে আটকে গেছিলাম আর বাবা বুদ্ধি করে আমাকে স্পর্শ না করে রাবারের সেন্ডেল দিয়ে লাথি মেরে আমাকে সরিয়ে এনেছিলেন, এই কথা যেকোন সুযোগে শুনিয়ে দিতে ভুলেননা।
আমার একটু হাসিও পেলো। বাবার কাছে থেকে পুরোটা সুদে আসলে উসুল করব এবার বাড়ি গেলে। কিন্তু না, সেই সম্ভাবনা তো নেই আর, আমি আর সেখানে যাচ্ছিনা। আমি এখন মিলির কাছে যাবো। আর সেখানেই থাকবো।
আমি ঘুরে বাড়ির সামনে এলাম, বাদ আসর আমার বিয়ের কথা ছিল, অথচ ঝুপ করে আধার নেমে গেছে। মিলি হয়তো রাগ করছে, অসুবিধা নেই, আমি ওর সব রাগ শুষে খেয়ে ফেলবো।
চমকে উঠলাম। উঠোনে একজন কেউ দাঁড়িয়ে আছে। এই গরমে তার পরনে কালো রঙের শাল। কলিম ভাই।
আগের পর্ব
https://m.facebook.com/groups/Anyaprokash/permalink/1688599324988421/?mibextid=Nif5oz