মুঠোভরা_চোরাবালি #আলিশা_আঞ্জুম #সূচনা_পর্ব

0
1300

মুদ্রার আজও মনে পরে বিয়ের পনেরো দিন পরের ঘটনা। ক্লাস নাইনে পড়াকালীন সময়ে তার বিয়ে হয়ে যায়। অর্থ তখন ভার্সিটি শেষ করে বাবার ব্যাবসায় বসেছে। তাদের বয়সের তফাৎটা ছিল প্রায় দশ বারো বছরের। অর্থের তো খুবই অপছন্দ ছিল মুদ্রাকে। এতো ছোট বউ তার? মানা যায়? সে মুদ্রাকে দেখলে পিঁপড়া ভেবে অবজ্ঞা করতো, এড়িয়ে যাওয়াই তার দৈনন্দিন জীবনের অভ্যাস হিসেবে পরিণত হলো। একজনের মনে তরতাজা ভয় অপরদিকে অন্যজনের মনে অবজ্ঞা। এরই মাঝে মুদ্রার কানে কান পড়া দিলো অর্থর দাদি। সে বহু কথা। অনেক কিছু বোঝানো হলো মুদ্রাকে। তার মধ্যে মুখ্য একটা বিষয় ছিলো,

” জামাইরে আঁচলে বাইন্ধা রাখো নাতিবউ। নইলে দেহো না সিরিয়ালে কি হয়? ফুড়ুৎ করে উইড়া যাবো। যদিও আমার নাতি ওমন না। কিন্তু সাবধানের তো মাইর নাই”

ব্যাস, আর কি চাই। কিশোরী মনে সেদিন প্রথম ভাবনা উদয় হলো। জামাইকে বেঁধে রাখার ভাবনা। মুদ্রা ভীষণ মনোযোগ দিয়ে তখন সিরিয়াল দেখতে লাগলো। এ বাবা! সত্যিই তো! নায়ক কে অন্য মেয়ে নিয়ে নেয়। দেবী চৌধুরানী’র বর তো একাধিক বিয়ে করলো। অর্থও যদি করে? এমন ভাবনা মনে উদয় হতেই মস্তিষ্ক তীব্র নিন্দা জানিয়ে বলল, ” ছিহ, মুদ্রা। এমন হলে একটুও ভালো হবে না। বেঁধে রাখ স্বামীকে। যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব! ”

মুদ্রা ভাবনার অন্ত ঘটিয়ে আঁটসাঁট সিদ্ধান্ত নিলো। সিরিয়ালের নায়িকাদের মতো মনে মনে জপ করলো, ” অর্থ শুধুই আমার” তারপর আরো কিছু বিদঘুটে দৃশ্য চোখে ভেসে উঠলো, অর্থ অফিসের সুন্দরী পিএ-এর সাথে খুব সুন্দর করে কথা বলে। মুখে কোনো বিরক্তি থাকে না তার। আর মুদ্রার সাথে? সেই তো, শুধু ধমকের সুরে। নয়তো কথাই বলে না। তাকায়ই না মুদ্রার দিকে। ভাবতে গিয়ে মুদ্রার কোমল হৃদয়টায় ফাটল ধরলো। হুহু করলো বুকের ভেতরটা। অতিরিক্ত এক ভয় মনে বাসা বাধলো।

তারপর, সেদিন সন্ধ্যা বেলাতেই মুদ্রা পড়তে বসলো টেবিলে। সালোয়ার, ওয়ান পিস, থ্রিপিস পাল্টে সে পরলো সাড়ি। সাথে পড়ার টেবিলের নিচে রাখলো একটা রশি। এবার শুধু অর্থর অফিস থেকে ফেরার পালা। বহু অপেক্ষা, পড়ালেখা তুঙ্গে তুলে দিয়ে মুদ্রার মাটিতে বসে অপেক্ষা। অতঃপর অবশেষে অর্থ আসে ক্লান্ত হয়ে। কিন্তু কি হতাশার বিষয়? সেদিন মুদ্রা দ্রুত ঘুমিয়ে যায়। ফলাফল অর্থ সেদিন রশির বাঁধনে বদ্ধ হয় না। বড্ড ভালো ভাগ্য ছিলো তার।

এরপর আরো একটা কাহিনী। সেদিন অর্থ বিছানায় ঘুমোতে যায়। যাওয়ার পর তার নাকে তীব্র মিষ্টি গন্ধ আসে। ভীষণ অবাক হয় অর্থ। তড়াক করে বিছানা থেকে উঠে বসে সে। গন্ধর উৎস ধরে এগোতে গিয়েই সে মুদ্রার কাছে চলে যায়। তারপরই সেদিন তার চোখ মুখ লাল হয়ে ওঠে। রাগে দাঁতে দাঁত লেগে যায়। সে মুদ্রা কে হাত ধরে টেনে বিছানা থেকে তুলে বলে

— তোমার চুল এমন গন্ধ কেন?

মুদ্রা একটু লজ্জা পেয়ে বসে । অর্থ তখন নিজের সন্দেহের সত্যতা যাচাই করতে মুদ্রার চুলের অতি নিকটে মুখ নিয়ে ঘ্রাণ অনুভব করতে ব্যাস্ত হয়। কুঁচকানো মুখ তার। মুদ্রা তখন কাচুমাচু হয়ে একটু দূরে গিয়ে বসে। অর্থ সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকায়। মুদ্রা বহুক্ষণ মুখ টিপে লাজুক হাসে। অতঃপর বলে

— আমি চুলে আপনার পারফিউম দিয়েছি। যেন চুলে সুগন্ধ হয়। আমি গল্পে পড়েছিলাম, একটা নায়ক নায়িকার চুলের গন্ধে মাতাল হয়েছিলো। আপনিও যেন আমার চুলের গন্ধে মাতাল হন তাই আমি চুলে পারফিউম দিয়েছি।

অর্থ সেদিন একথা শুনে শুধুই অবাকে স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে ছিলো। যেন সে বুঝে উঠতে পারেনি তার প্রতিক্রিয়া কমেডিরর হওয়া উচিত নাকি ট্রাজেডি হওয়া জরুরি।

ফেলে আসা তিনটা বছরের আজ একটু স্মৃতিচারণ হলো। মুদ্রা দু’হাতে চোখ মুছে নিলো। কান্নারা এসে ভীর জমিয়েছে চোখে। আজ সেই মানুষটাকে ছেড়ে চলে যেতে হবে। চলে যেতে বাধ্য সে। যার কোলে কখনো সে একটা সন্তান তুলে দিতে পারবে না তার কছে তার থাকার অধিকার নেই একথা স্পষ্ট করে বলে দিয়েছে মুদ্রার শাশুড়ি। গত ছয়মাস হলো প্রচেষ্টা চলছে অর্থকে নতুন বিয়ে কোরানোর। কিন্তু সে কানেই নেয় না সেকথা। ঘুণাক্ষরেও মানে না। মুদ্রার সামনে ডিভোর্স পেপার রাখা। এতিম একটা মেয়ে সে। কোথায় যাবে? শাশুড়ি বলেছে মুদ্রাকে বহু দূরে সুন্দর একটা ঘর বানিয়ে দেবে। আজীবনের খরচাপাতি সব দেবে অর্থের মা। কিন্তু সম্পত্তির লোভ তো মুদ্রার নেই। তার লোভ অর্থ নামক মানুষটার প্রতি। সে তো অর্থ নামের মানুষটা ছাড়া আর কাউকে চায় না। কিন্তু সে হয়তো এখন আর মুদ্রা কে তেমন ভালোবাসে না। বা প্রকাশ করে না। সারাদিন ব্যাস্ততায় পার করে। আগের মতো মুদ্রার হাত ধরে রজনির প্রহর কাটায় না। হুটহাট এনে দেয় না একমুঠো চুড়ি। অফিস শেষে মাঝে মধ্যে আনা বেলি বা জারবেরা ফুলগুলোও আর তার হাতে ওঠে না। মুদ্রার অপরাধ বোধ হয়। সে-ই কি তবে অর্থর মন খারাপের কারণ হয়ে যাচ্ছে? গম্ভীর হলেও সে সতেজ ছিলো পূর্বে। ইদানীং নিশ্চুপ, নিস্তেজ। মুদ্রা দু চোখের দু ফোটা পানি উন্মুক্ত করতে দ্বিধা করলো না। শাশুড়ি আর তার মাঝে দূরত্ব তৈরি করা টেবিলের ওপর হতে হাতে তুলে নিলো কলম। হাত কাঁপছে। এই মনে হচ্ছে কলম টুপ করে পরে যাবে হাত থেকে। সাইন করার জায়গায় কলম নিয়ে গিয়ে আবার হুট করেই মুদ্রা কলম তুলে ফেলল। চোখ বন্ধ করে শাশুড়ির উদ্দেশ্যে বলল

— মা, আমি পারবো না। অসম্ভব। আমি সাইন করবো না।

মুদ্রার শাশুড়ি চমকে উঠলো। মুখটা শুকিয়ে চুপসান হয়ে গেলো। সে বলে উঠলো

— সাইন করো মুদ্রা।

মুদ্রা হাতের কলম টেবিলে রেখে কান্নারত কন্ঠে বলল

— আমি কথা দিচ্ছি মা, আমি আপনার ছেলেকে ছেড়ে বহুদূরে চলে যাবো। আর আসবো না। কিন্তু প্লিজ মা আমাকে ডিভোর্স দিতে বলবেন না। আমি তার স্ত্রী হয়ে থাকতে চাই। পরপারে তার হাত ধরে সুখে থাকতে চাই। ডিভোর্স দিয়ে এতো বড় সুযোগ আমি হারাবো না।

অর্থর মা স্তব্ধ হয়ে গেলেন। তিনি কিছুটা মিইয়ে পরলেন। মুদ্রা চোখের পানি মুছে নিয়ে এক দৌড়ে ওপরে চলে গেলো। আয়েশা বেগম ডাকতে গিয়ে থমকে গেলেন। তার সাহস হলো না মুদ্রা কে ডাকার।রুমে এসে কান্নায় ভেঙে পরলো মুদ্রা। বড্ড অসহায় লাগছে নিজেকে। একটা সন্তান পৃথিবীতে আসতে পারতো। মাত্র সতেরো বছর বয়সে তার প্রাণঘাতী একটা অসুখ নাও হতে পারতো। হতে পারতো তার পরিবর্তে তাদের পরিবারে অঢেল সুখ। মিছিল নামতে পারতো আনন্দের। ঘরে দুঃখের আনাগোনা না থেকে হাটি হাঁটি পায়ে হাঁটতে পারতো একটা ছোট কেউ। মুদ্রার ভাবনা গুলো অতলস্পর্শী। কিছু প্রশ্ন বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। অর্থর পরিবর্তন ভাবাচ্ছে তাকে।

.
কান্নার মাঝে চোখে ঘুম নেমে গেছে মুদ্রার। ঘুমে ঘুমে সে এখন মাঝরাতের প্রহরে অর্থর পাশে শুয়ে আছে একথা সে জানে না। সে আজ বিষাক্ত গোধূলির পর ঘরে এসে কান্নার মাঝে সিধান্ত নিয়েছিল অর্থর মুখোমুখি হবে। অর্থ কি চায় তা একটিবার জানবে। দেখবে অর্থর চোখের ভাষা। কিন্তু হায়! বেচারি পূর্বের ন্যায় আজও ঘুমের জালে জড়িয়ে গেছে। সেদিন না হয় মুদ্রা অর্থ কে বাঁধতে পারেনি রশি দিয়ে। তবে বেধেছিল মায়া দিয়ে। আচ্ছা এই মায়ার বাঁধন কি অর্থ ছিন্ন করবে? পারবে প্রতিনিয়ত বলে বেড়ানো “খামখেয়ালির রাণী বড্ড বেশি ভালোবাসি” মুদ্রার থেকে দূরে সরে যেতে?

চলবে….

#মুঠোভরা_চোরাবালি
#আলিশা_আঞ্জুম
#সূচনা_পর্ব

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here