#মুঠোভরা_চোরাবালি
#আলিশা_আঞ্জুম
#পর্ব_২
( নাম পাল্টে দিলাম। যেহেতু কারোরই পছন্দ হচ্ছিলো না। ফাইজা আর তাসরিফ দিলাম)
খুব ভোরে ঘুম ভেঙে গুড়িয়ে গেলো এই যুগলের। তাদের অবস্থানটা ছিলো একে অপরের মাথার সাথে মাথার সন্ধি। এই মাথায় মাথায় সন্ধি না হলে ঘুম হয় না তাসরিফের। তাদের মনে মনে অভিমানের আকাশ ছোঁয়া পাহাড় গড়ে উঠলেও তাসরিফ ফাইজার মাথার সাথে মাথা লাগিয়ে ঘুমোবে। একই অভ্যাস ফাইজাও পেয়ে বসেছে। গতরাতে তাসরিফ নয় বরং ঘুমের মাঝে ফাইজা চলে গিয়েছে তাসরিফের নিকট। আজ ঘুম ভাঙার সাথে সাথেই দ্রুত যেন ছিটকে দূরে সরে এলো ফাইজা। তাসরিফ দৃষ্টিতে অবাক ভাব ফুটে উঠলেও তা যেন সামান্য। ফাইজা পাশ ফিরে শুয়ে রইলো। এরই মাঝে আজানের সুর ভেসে এলো অদূর হতে। তাসরিফ বিছানা ছেড়ে উঠে পরলো। ফাইজা বন্ধ চোখে শুয়ে রইলো ক্ষণকাল। একটুপর দরজা খোলার শব্দ কানে এসে ধাক্কা খেলে ফাইজা উঠে বসলো বিছানায়৷ মসজিদে চলে গেছে সে। ফাইজা দু হাটু মুড়িয়ে নিয়ে ক্ষণকাল বসে রইলো। ভোর হওয়া মানে সময় ফুরিয়ে আসা। প্রিয় মানুষটার থেকে দূরে সরার তাড়া। আজও তাসরিফের মা ফাইজার সাথে জেড ধরবে। কি করবে ফাইজা? কাল বলেছিল ছেড়ে চলে যাবে। যাওয়াটা কি সত্যিই সহজ? ভাবনার মাঝে ছটফটিয়ে উঠলো ফাইজার মন। আরো কিছুসময় অতিবাহিত হলো টানাপোড়েনে। কি করা উচিত তার?
.
ভোর ছেড়ে সকাল হলো। সূর্যের কিরণের উঁকি জানালার ফাঁক দিয়ে। নামাজ আদায় করে ফাইজা চলে গেলো রান্নাঘরে। এ বাড়ির একমাত্র ছেলের একমাত্র বউ হওয়ার সুবাদে সকল খানে শুধু তারই বিচরণ। শাশুড়ি রান্নার ধারধারে আসেন না কিছুমাস জাবাদ। একবছর হবে ফাইজা বাচ্চা হওয়ার নারিতে অস্তিত্ব পেতে বসা টিউমার অপারেশন করেছে। আর তিনমাস হবে তাসলিমা খাতুন রান্নাঘরে ফাইজার পাশাপাশি দাড়িয়ে একই সাথে রান্নার কাজ করেন না। ফাইজাকে রান্না করতে হয় সালমা নামের এক মেয়ের সাথে। ফাইজা-তাসরিফের বিয়ের পূর্ব পর্ব টানলে উঠে আসবে তসলিমা খাতুনের হেয় পর্ব। বেশ খানিকটা অমত ছিলো ফাইজার সাথে তাসরিফের বিয়ের সম্বন্ধ পাকাপোক্ত করা নিয়ে। কেবল মাত্র শাশুড়ির কারণে অর্থাৎ তাসরিফের দাদির পছন্দে ফাইজা এবাড়ির বউ। সৎ মায়ের নরকময় সংসার থেকে তুলে এনেছিল ফাইজাকে বৃদ্ধ মানুষটা। এনে দিয়ে দুবছরের মাথায় সে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে পরপারে পারি জমিয়েছেন। দিনগুলো সোনালী ছিলো। আর কেউ না থাকলেও ফাইজার সঙ্গী ছিলো বৃদ্ধ মানুষটা।
— হায়! হায়! ভাবি চিনি দেন ক্যান? নুনের জায়গায় চিনি?
সালমার ছোট খাটো চিৎকার। ফাইজা চমকে উঠলো, কেঁপে উঠলো। অগোছালো দৃষ্টিতে চাইলো সালমা নামক মেয়েটার দিকে। মন যেন ঘুরে ফিরে গত দিনের বিষাক্ত প্রহরেই বন্দি আছে।
— সরেন। আপনের মন নাই কামে। সরেন সরেন।
ফাইজা সরে দাঁড়ালো। পা বাড়ালো বাইরে। রান্নাঘর ছেড়ে ড্রয়িং রুমে পৌছাতেই চোখ পরলো তাসরিফের দিকে। একহাত মাথায় রেখে সে ঝিমোচ্ছে। মুখখানি বড্ড শুকনো দেখাচ্ছে। ফাইজার বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠলো। না চাইতে, ইচ্ছে অনিচ্ছার পাল্লার পরিমাপ পর্যবেক্ষণ না করে সে মনের টানে ছুটে গেলো তাসরিফের নিকট। প্রায় ঢলেই পরছিলো তাসরিফ। একটু হলেই সেগুন কাঠের সোফার সাথে মাথার সংঘর্ষ হবে। এমন সময়ই পাশ থেকে একটা কুশন নিয়ে মাথার নিচে দিয়ে দিলো ফাইজা। তাড়াক করে চোখ মেলল তাসরিফ। ফাইজা তখন মিহি কন্ঠে বলল
— রুমে গিয়ে শুয়ে থাকো।
সামনের দেয়াল ঘড়িতে দৃষ্টি রেখে কপালের অগোছালো একমুঠো অবাধ্য চুল সরিয়ে তাসরিফ জবাব দিলো
— না। আটটায় মিটিং আছে। বেরোতে হবে। নাস্তা কি হয়ে গেছে?
— না। আর কিছুক্ষণ।
কথাটা বলেই ফাইজা আবারও উদভ্রান্তের মতো ছুটতে যাচ্ছিলো। ঠিক এমন সময়ই তাসরিফ পিছু ডেকে বলে উঠলো
— গতরাতে কি না খেয়ে ঘুমাইছিলা?
দূরন্ত পথ মন্থর হলো। মনের আবেগ, আর্তনাদ জেগে উঠলো বেশ করে। ফাইজা তাসরিফের দিকে পুনরায় ঘুরে দাড়িয়ে বলল
— হুম। তুমি খেয়েছিলে?
জবাব পাওয়া গেলো না। শুধু নীরব কথন জেগে উঠলো। মুখাবয়বে লাল আভা নিয়ে উঠে দাড়িয়ে চলে গেলো তাসরিফ। ফাইজা পিছু নিয়ে ঘর অব্দি যাওয়ার সাহস করে উঠতে পারলো না। সে চলে গেলো রান্নাঘরে। গতরাতে তাসরিফও কি ডিনার করেনি? ভাবতেই ফাইজার মনে উঁকি দিচ্ছে এক টুকরো আশা। গলে যাচ্ছে মোমের ন্যায় ঢিপি করে রাখা কিছু কিছু অভিমান, অভিযোগ। ফাইজা তড়িঘড়ি করে রান্না শেষ করলো। সালমার সহায়তায় টেবিলে খাবার পরিবেশ করে তাসরিফেকে ডাকার জন্য পা বাড়িয়েছিল সে। সৌভাগ্য ক্রমে তাসরিফই এসে হাজির। ফাইজা ধপ করে একটা চেয়ারে বসে যায়। এরই মাঝে হাজির হয় তাসরিফের মা-বাবা। একবার চোখাচোখি হয়ে যায় ফাইজায় সাথে তাসলিমা খাতুনের। ফাইজা চোখ সরিয়ে নেয় বেশ সাবলীল ভঙ্গিতে। তাসরিফের প্লেটে ভাত দিয়ে শশুরের প্লেটে এক চামচ ভাত রাখে। মাংসও দিয়ে দেয় ফাইজা। তাসলিমা খাতুন ক্ষুদ্ধ হয়ে দেখলেন। মুখে কিছু বললেন না ফাইজাকে। তবে অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে হঠাৎ তাসরিফের উদ্দেশ্যে বললেন
— দেখো তাসরিফ। হেয়ালি জিনিসটা আমি করতে পারবো না। একটা কথা বলি। এই বয়সে আমাদের একটা নাতি নাতনির অভাব বোধ হয়। সকলেই তার নাতি নাতনির সাথে সময় কাটায়। আমাদেরও তো ইচ্ছে হয় তাই না?
তাসলিমা বেগমের কথার সুর সমাপ্ত হয়নি। সে আরো কথা বাড়াবে৷ আরো কিছু সাজিয়ে বলবে। কিন্তু আচমকা তাসরিফ বাঁধা দিয়ে বসলো। জোরালো, শক্ত, বা কড়া করে জবাব দিয়ে বাঁধা দিলো না। মায়ের এ প্রসঙ্গে একটা বাক্য রচিত হতেই সে ভাতের প্লেটে পানি ঢেলে হাত ধুয়ে সারা। অতঃপর বেশ নম্র সুরে সে বলছে
— আমি আসছি। পৌঁনে আটটা বাজে। আমার মিটিং আছে।
এরপর আর এক সেকেন্ডও ব্যায় নয়। যেন চাইলো সে তড়িৎ গতিতে চলতে। ফাইজার বুকের মাঝে সুক্ষ ব্যাথার উদয় হলো। সে কিছুটা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে দেখলো তাসরিফ কে। গুণে গুণে যেন দু লোকমা ভাতই মুখে দুয়েছিল মানুষটা। গত রাতেও দানাপানি মুখে নেয়নি। এখনও নেওয়া হলো না তার। তাসরিফের বাবা ক্ষুদ্ধ হলেন স্ত্রীর প্রতি। বেশ চাপা স্বরে বললেন
— তোমার স্বভাব কি পাল্টাবে না? খাওয়ার সময় কথাগুলো না বললেই কি নয়?
তাসলিমা বেগমের ক্ষোভ হলো। স্বামীর ওপর রাগ ফলাতে না পরলেও ফুঁসে উঠলেন ফাইজার ওপর। তাসরিফের বাবাও অর্ধ খাওয়া ভাতের প্লেট রেখে প্রস্থান করলেন। ফাঁকা হলো খাবারের টেবিল। ফাইজা শশুর কে দু একবার ডেকে উঠলেও রহমান সাহেবের পক্ষ হতে কোনো সাড়া মিলল না।
— অশান্তি করার জন্য কি পরেই থাকবে? আমার সংসারের সুখটাই নষ্ট করে দিলে তুমি। তোমাকে বলিনি আমি, তোমাকে সব দেবো তুমি আমার ছেলেকে ডিভোর্স দিয়ে চলে যাও। বলিনি? তবুও বেহায়ার মতো পরে আছো কেন? আচ্ছা মানলাম তুমি ডিভোর্স দেবে না। কিন্তু তোমার তো চলে যাওয়ার কথা ছিলো তাই না?
বেশ উচ্চকন্ঠে পৌঁছে গেছেন তাসলিমা। ফাইজা ভেতর থেকে কেঁপে উঠলো। আবারও দ্বিধাদ্বন্দ্ব। আবারও ভয়ে বুক কাঁপতে শুরু করলো তার। অসহ্য যন্ত্রণা হয় তাসরিফ হীনা জীবন কাটানোর কথা কর্ণকুহরে পৌঁছালে। চোখে ভাসে অন্য নারীর অবয়ব। পাশে তাসরিফ। ফাইজা জানে না মরণ যন্ত্রণা কেমন। কতটা ভয়ঙ্কর। তবে মনে হয় যেন তাসরিফের পাশে অন্য কাউকে দেখার যন্ত্রণা মরণ যন্ত্রণারই প্রতিরূপ।
— আপনি পারবেন মা, বাবা কে ছেড়ে চলে যেতে?
তাসলিমা বেগম থমকে গেলেন। ঠিক থমকানো বলে না হয়তো তার অভিব্যাক্তিকে। তার এই স্ফূর্তিকে বলা যায় হতবিহ্বল হয়ে যাওয়া।
— তুমি সত্যিই যাবে না? তুমি বোঝো না তাসরিফও চায় একটা সুন্দর জীবন?
কড়া কথা সরিয়ে মধুমাখা মুখে তাসলিমা ফাইজাকে বলল। ফাইজা তর্ক করলো না। যুক্তি নিয়ে বলল
— আপনার ছেলে তো যেতে বলেনি। সে যদি এমন কিছু চায় তবে আমি চলে যাবো। সে যখন বলবে তার সুন্দর জীবনের জন্য আমার চলে যাওয়ার দরকার তাহলে আমি যাবো।
ফাইজার গলা ধরে আসতে চাইলো শেষোক্ত কথায়। তাসলিমা খাতুন আর কথা বাড়াতে পারলেন না। তিনি হার মেনে উপচে পরা রাগ নিয়ে গটগট করে হেঁটে চলে গেলেন নিজের ঘরে। ফাইজা তাসরিফের অবলীলায় পানি দিয়ে পূর্ণ করে রেখে যাওয়া খাবারের প্লেটের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে রাখলো। সত্যিই সে চলে যাবে। যেদিন তাসরিফ বলবে ‘ চলে যাও’। তবে ফাইজার অঢেল বিশ্বাস, সমুদ্রসম আশ্বাস তাসরিফ এমন কিছু কখনোই বলবে না।
চলবে……