#শেষ_বিকেলে_তুমি_আমি
#আলিশা
#পর্ব_১৫
বিবস মন নিয়ে মিনিট দুয়েক অকারণে সময় নিলাম স্মরণের দরজায় টোকা দিতে। রাত বেশ গভীর। মধ্যরাত পেরিয়ে শেষ দু প্রহরের অন্তপ্রান্তে রাতের সীমা। কিছুটা ভাবনা, কিছুটা দুঃখ আর এই৷ অল্প একটু অভিমান ললাটের প্রতি। এসব জড়ো করে অবশেষে দরজায় করাঘাত করলাম। ওপাশ হতে কেউ বলল সেকেন্ড দুয়েকের মাঝে
— দরজা খোলা আছে। ভেতরে আসুন।
আমার বুকটা ঢিপঢিপ ছন্দ তুলল। সে কি জানতো আমি আসবো? ধীর পায়ে এগিয়ে গেলাম। স্মরণ বিছানায় বসে আছে। বিশৃঙ্খল বাসার ধরণ। একহাঁটু ভাজ করা অপর পা সোজা রাখা। ডান হাতের আঙ্গুল গুলো বিচরণ করছে তার চোখ ও কপালে। আমি হুট করে কিছু বলে ওঠার প্রস্তুতি নিতেই সে আচমকা আগ বাড়িয়ে বলল
— দুদিন আগে বাসা ঠিক করেছেন, কাল টাকা দিতে যাবেন আর দু’দিন পর চলে যাবেন। এটাই তো?
আমি চমকে না উঠলেও তার আচমকা বলা কথায় অবাক হলাম। সে ততক্ষণে মাথা তুলে চাইলো। পুনরায় বলল
— এটাই তো বলবেন তাই না?
হিম কন্ঠ। আমি আজ মনকে শক্তপোক্ত করে বেড়ি দিলাম। ভয়ের যে এক সুপ্ত দলা বুকে লুকিয়ে থাকে তাকে আজ বন্দি করলাম খাঁচায়। কোনো রূপ জড়তা ভীরুতাকে প্রশ্রয় না দিয়ে বললাম
— হ্যা এটাই। আর একটা কথা। সরি। আপনাদের ঘরে এতোদিন বোঝা হয়ে থাকার জন্য। আপনাকে বিরক্ত করার জন্য। অথৈয়ের শাড়ি অধিকার না থাকা সত্ত্বেও পরার জন্য, ঐ দিন আপনার পিছু নেওয়ার জন্য। সরি ফর এভ্রিথিং। এক্সকিউজ মি ইফ পসিবল।
আমার এতোগুলা কথার কবলে পরে স্মরণ যেন দিশা হারিয়ে ফেলল। কিছুসময় অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। অতঃপর যেন আমি দেখলাম তার চোখে অসহায়ত্ব।
— আসছি। দোয়া করি মেয়েকে নিয়ে অনেক ভালো থাকুন।
স্মরণ নিশ্চুপ রইলো। আমার বুকের ভেতরটা হুহু করে উঠলো। সে বিদায় মুহূর্তেও নির্লিপ্ত। এতো নিষ্ঠুর কেন সে? এতো কেন পাথুরে হৃদয় তার! বেপরোয়া চোখে অশ্রু চলে এলো। হুড়মুড় করে বেড়িয়ে আসতে চাইলাম তার ঘর থেকে। ঠিক করে নিলাম এই মুহূর্তে, শুধু রাতের আঁধার পেরিয়ে সূর্যের উঁকি দেওয়ার অপেক্ষা। অতঃপর খুব ভোরে, পাখিদের প্রভাত কলরবের পূর্বেই এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাবো আমি। অশ্রুভেজা ঘোলাটে দৃষ্টি নিয়ে হাটাছিলাম এমন ভাবনা মনে চেপে। হঠাৎ হোটচ খেলাম যেন। খেই হারিয়ে সম্মুখের আলমারির কোণাতে পা লাগলো। প্রায় পরছিলাম। তৎক্ষনাৎ সামনের দরজা ধরে সমলে নিলাম নিজেকে। পেছন থেকে ভীতু গলার আওয়াজ এলো
— আস্তে…
স্মরণ হুটোপুটি খেয়ে নেমে পরলো বিছানা থেকে। কয়েক কদম ব্যাস্ততার সাথে হেঁটে এসে আমাকে শুধালো
— ঠিক আছেন তো?
— এর চেয়ে বড় বড় ধাক্কায় ঠিক ছিলাম, ঠিক আছি। আর এটাতো সামান্য। আমি ঠিকঠাক।
বুকের যখন এক চিলতে শুকনো হাসিতে লুকিয়ে বলে দিলাম কথাটা। স্মরণ প্রতিত্তোরে করলো না। আমিও তার উত্তরের অপেক্ষায় ছিলাম না। সাধ্য মতো দ্রুত গতিতে প্রস্থান করলাম তার সম্মুখ হতে।
.
জীবনের সব হিসাব নিকাশ আজ ধামাচাপা দিলাম। কি পেয়েছি আর কি পাইনি এসব আজ মাথায় না এনে রাতের শেষ তিনঘণ্টা ঘুমিয়ে কাটালাম। ঘুম ভাঙলো সকাল সাতটায়। খুব আফসোস হলো। ফজরের নামাজ কাযা হয়ে গেলো। চটজলদি বিছানা থেকে নেমে ফ্রেশ হয়ে ছুটলাম রান্না ঘরের পানে। সাড়ে আটটায় স্কুল। রান্নাঘরে জয়নব খালা রুটি বেলছিলেন। ছেঁকে নিলাম গোটা সাতেক। ইতিমধ্যে খাবার টেবিল হতে নিয়ম মাফিক ডাক পরলো আমার। কেউ ভীষণ মিষ্টি করে ডাক দিলো
— মাআআ? মাআআআ?
ভালোই ছিলাম এই ডাক শ্রবণ করার আগে। কিন্তু এখন হঠাৎ মনে বাসা বেধে নিলো আবেগ। ছোঁয়ার ডাকের সাড়া দিতে গিয়ে অনুভব করলাম আমি স্বাভাবিক নেই। গলা দিয়ে কথা আসতে নারাজ। চোখ টলোমলো। এখনই যদি আমি ডাকে সাড়া দেই তবে তা কান্না হয়ে প্রকাশ পাবে। ইশ! এই ডাকটা আর দু’দিন পর কেউ নিয়ম করে ডাকবে না। আর কেউ রোজ রাতে আমার নিকট এসে বুকের মাঝে গুটিসুটি হয়ে অবস্থান করবে না।
— তুমি কানতেছো বউ?
অণুক্ষণের চিন্তায় সব ছেড়ে ভাবনা জগতে পারি দিয়েছিলাম যেন। খালার ডাকে হুঁশ হলো। তড়িৎ গতিতে চিকচিক করা চোখ মুছে নিলাম। থতমত ভাবটা কাটাতে পারলাম না। আড়ষ্টতা নিয়ে খালাকে বললাম
— কই৷ না তো? কাঁদিনি।
— কি ইইছে বউ? স্মরণ কিছু কইছে? জামাই বউয়ের মধ্যে টুকটাক কথা কাটাকাটি হয়ই। এই নিয়ে মান করতে নাই, মা।
আমি মুচকি হাসলাম খালার কথাতে। তার ঘরে এখন অব্দি এক রাতও অতিবাহিত করতে পারিনি। কথা-কাটাকাটি, আবার এ নিয়ে মান করা তো অনেক অনেক দূরের কথা।
— আমি দুই দিন পর চলে যাচ্ছি খালা। ছোঁয়ার খেয়াল রাখবেন। নিজেও সাবধানে চলবেন।
— ও কি কথা? কই যাবা?
— বেশি দূর যাওয়ার সামর্থ্য আমার নেই খালা। শুধু চোখের আড়াল পর্যন্ত দূরে যাচ্ছি।
আমার কথার পিঠে খালা কিছু ব্যাক্ত করতে উদ্দ্যত হলো। কিন্তু সে সুযোগ আমি দিতে বড্ড কৃপাণতা করলাম। প্লেটে দু’টো রুটি আর ডিম ভাজি নিয়ে দ্রুত রান্নাঘর থেকে প্রস্থান পথ ধরলাম। মুখে বললাম
— ছোঁয়া বোধ হয় খাবার চাচ্ছে। আমি দিয়ে আসি।
.
দ্রুত ব্যাগপত্র গুছিয়ে নিয়ে নিলাম। যদিও কাল রাতে মনস্থির করেছিলাম খুব দ্রুত চলে যাবো এবাড়ি ছেড়ে কিন্তু তা হয়ে উঠলো না অধিক বেলা পর্যন্ত ঘুমানোর অপরাধে।
আজ হয়তোবা ভাড়া নেওয়া বাসায় ঠাঁই হবে না। চিন্তা নেই। দু’টো রাত প্রিয়ায় বাসায় কাটিয়ে দেওয়া যাবে অনায়াসে। দিনে স্কুল আর ভার্সিটি আছে। শুধু চিন্তা ছোঁয়ার জন্য। তাকে কি বলে বিদায় জানাবো? বাচ্চা মেয়েটা অনেকখানি আমার মায়ায় বাঁধা পরেছে। আমি হয়তোবা ওর অভ্যাসের কিছু জায়গা জুড়ে আছি।
— ছোঁয়ার জন্য থেকে যেতে পারিস না?
বাবার কন্ঠ। আমি পেছন ফিরে চাইলাম। একটা লাঠি হাতে বাবা ভর করে চলে এসেছেন আমার ঘরে। ওনার ফিজিওথেরাপি চলছে। ক্রমে ক্রমে উনি সুস্থ হয়ে উঠছেন।
— আমি ছোঁয়ার সাথে দেখা করবো বাবা। ও মাঝে মাঝে আমার কাছে গিয়ে থেকে আসবে।
— আমার কিছু বলার নেই।
— দূরে গেলে ভালোবাসা বাড়ে। ছোঁয়া হুট করে একদিন আমার কাছে যাবে। ও ভীষণ খুশি থাকবে তখন।
বাবা আমার যুক্তিতে কেবল অসহায় দৃষ্টিতে চাইলেন। মুখে কিছু বললেন না তিনি। আমার দৃষ্টি অধোগামী হয়ে গেলো। বুকে সুক্ষ্ম ব্যাথার জোয়ার উঠলো। মিনিট তিনেক পেরোতেই বাবা আমার ঘর ছেড়ে চলে গেলেন। আমি উদাসীন হয়ে বসে রইলাম। অপেক্ষায় রইলাম ছোঁয়ার স্কুলে যাওয়ার। ওকে আমি কি বলে বিদায় নেবো তা ভাবতে ভাবতে আমি ক্লান্ত হয়ে গেছি। তবুও বলার মতো কিছু খুঁজে পাইনি।
আমার অপেক্ষার অবসান হলো ন’টা বাজার দশ মিনিট পূর্বে। ছোঁয়া চলে গেলো স্কুলে। সে স্কুলের জন্য বিদায় নিতে এসেছিল আমার কাছে। আমি মনে মনে তাকে তার অজান্তে বিদায় দিলাম আমার জীবন থেকে।
পাঁচটা শাড়ি দিয়ে পূর্ণ করা ব্যাগটা টানতে টানতে ড্রয়িং রুমে হাজির হলাম। জয়নব খালা আমার পাশে দাড়িয়ে ছিলো। আমি মিহি সুরে খালাকে বললাম
— বাবাকে একটু ডেকে দেবেন খালা?
খালা আপত্তি করলো না। ছুটে চলে গেলেন বাবার নিকট। যাওয়ার আগে জানতে চাইলেন দুঃখী কন্ঠে
— না গেলে হয় না বউ?
আমি মুচকি একটা হাসি দিয়ে বললাম
— একদমই হয় না খালা। জোর করে সংসার হয় না। দু’টো মানুষের মনে শান্তি থাকে না। সুখ পাওয়া যায়। শুধু বিসুখের অস্তিত্ব থাকে। তার চেয়ে ঢের ভালো কেউ থাকতে না চাইলে তাকে ছেড়ে দেওয়া।
চলবে….
( ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন)