#শেষ_বিকেলে_তুমি_আমি
#আলিশা
#পর্ব_১৩
মনে পাহাড় সম আনন্দ চেপে বসলো। জীবনের প্রথম চাকরি, প্রথম এক অভিজ্ঞতাকে বরণ করে নেওয়ার জন্য আমি উন্মুখ ছিলাম। দ্বিধায় ভুগেছি প্রায় বিশ মিনিট শুধু মাত্র শাড়ি নির্বাচন করার পর্বে। অতঃপর আরো দশ মিনিট কেটেছে আমার হেয়ার স্টাইল নিয়ে ভাবতে গিয়ে। বেণী নাকি খোঁপা, খোঁপা নাকি বেণী? ভীষণ জ্বালিয়েছে এই দু’টো শব্দ। অবশেষে বেণী করে খ্যান্ত করেছি মনকে। দরজা ছেড়ে বাইরে এসে তৃতীয় বারের মতো ছোট খাটো হোটচ খাই আমি। ড্রইং রুমে স্মরণ বসে ছিলো। পাশে ছিলো ছোঁয়া। মেয়েকে কিছু খাওয়ার কাজে সো ভীষণ ব্যাস্ত। এই ব্যাস্ততার মাঝে হুট করে সে একবার ভুলবশত যেন চেয়ে বসে আমার পানে। আমার বুকে ধুকপুকের ঢেউ খেলে যায় মুহূর্তে। আচমকাই মনে পরে কাল পেরিয়ে আসা অবচেতন মনের স্বপ্ন। তাকে বলেছিলাম চলুন। অতঃপর বালু চড়ে অজ্ঞান হয়ে পরে যাই। স্মরণের ভাষ্য এমনই ছিলো। প্রিয়র পাশ ঘেঁষে হাঁটা, কিছু কথামালা, কিছু অনুভূতির মিলন মেলা সবই ছিলো অবচেতন মনের কল্পনা-প্রতিভা। যদি বাস্তব হতো সে কার্ভগুলো? আমি লজ্জা কিংবা সংকোচে হয়তো ঘরে ফিরতাম না। তার বুকে কিল-ঘুষি মারা অবশ্যই আমাকে দিয়ে স্বপ্নের মাঝেই করা সম্ভব।
— মা? কোথায় যাচ্ছো?
ধীর পায়ে অবসন্ন মন নিয়ে সিঁড়ি ভেঙে নিচে নামছিলাম। ছোঁয়া আকস্মিক ডেকে বসলো আমাকে। সত্যি বলতে তার কোমল সুরোর সম্মোহনী সম্বোধনে আমি মোহিত হয়ে গেলাম চোখের পলকে। মন প্রাণ কেড়ে নেওয়া ডাক। ‘মা’ ডাকটা যে এতো হৃদয় স্পর্শি ডাক তা আজ আমি নিজে অনুভব করে আশ্চর্যান্বিত।
— হ্যা,…. ব..ল..ও
থতমত খেয়ে গেলাম নিজের অজান্তে।
— বিউটিফুল!
ছোট হাত ভাজ করে এক চোখ আধবোজা করে সে মুখে উচ্চারণ করলো উপরোক্ত শব্দটা। আমি মুচকি হাসলাম। না চাইতেও বেপরোয়া, নিষেধ না মানা চোখ একবার পরখ করলো মানুষটাকে। বিণা নিমন্ত্রণে অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে চোখাচোখি হলো। আমার চাইতে বেশ কিছু ধাপ ওপরের অস্বস্তি জাপ্টে ধরলো স্মরণকে। তার চোখ ফিরিয়ে নেওয়ার ভীষণ তাড়া।
— কোথায় যাচ্ছো?
— একটু বাইরে।
— আমিও যবো।
— তোমাকে… তেমাকে… অন্য
সকলের থেকে আজ লুকাতে চাই চাকরির বিষয়। সেই প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে গিয়ে ছোঁয়ার প্রশ্নের জবাব গুছিয়ে ব্যাক্ত করায় ব্যার্থ হচ্ছি আমি৷ এক নিমিষে কপালে জমলো বিন্দু বিন্দু ঘাম। কি বলি এখন?
— তোমার স্কুল আছে৷ তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করো।
স্মরণ কিছুটা শক্ত কন্ঠে বলল ছোঁয়ার উদ্দেশ্যে। আমি বেশ সুকৌশলে ঘাপটি মেরে চুপটি করে দাড়িয়ে রইলাম। সে অজান্তেই আমাকে বাচিয়ে দিলো। ছোঁয়ার খাওয়া শেষ হলো খুব শীঘ্রই। আমি দাড়িয়ে রইলাম এপর্যন্ত। মা বলে ডেকে মন কেড়ে নিয়েছে। এই বাচ্চা মেয়েটাকে আমি মিষ্টি করে বিদায় না দিয়ে বাড়ি থেকে বেরোই কিভাবে?
স্মরণ ছোঁয়া কে রেখে চলে যেতেই আমি ওর পাশে গিয়ে বসলাম। মিষ্টি হেসে কিছু কথা বিনিময় করে বিদায় জানিয়ে বললাম
— আমি একটা নতুন কাজে যাচ্ছি। আজ তাড়াতাড়ি যেতে হবে। আসি?
ফিসফিস ধ্বনি তুলে বললাম। ছোয়া যেন একটু ঘাবড়ে গেলো। চিন্তিত হলো। উদ্বিগ্ন হয়ে সে প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে বলল
— কি কাজ?
গলার স্বর আরো একটু নিচু করে আমি ওর কাছে গিয়ে শর্ত দিলাম
— তোমার বাবাকে বলবে না তো?
মাথা ডানে বাঁয়ে হেলিয়ে দুলিয়ে ছোঁয়া বলল
–না বলবো না।
— আমি একটা স্কুলের মিস। তোমার মতো বাচ্চাদের পড়াবো ওখানে।
ছোঁয়ার মুখ ‘ও’ বর্ণের উচ্চারণ আকৃতির অবয়ব ধারণ করলো। অবাক কন্ঠে বলল
— সত্যি? আমি তাহলে তোমার স্কুলে পড়বো।
— না না। একদম পড়া যাবে না এখন। তোমার খাটাস বাবা জানতে পারলে আমাকে চাকরিই করতে দেবে না। কি বলবে জানো? ” আপনি আমার পরিবারের মান সম্মান নষ্ট করছেন। এতো ঢং কেন করছেন বলুন তো? কোনো ঝামেলা না পাকালে কি হয় না আপনার? আপনি একটা… ”
— মায়াবতী, কুহকিনী।
আমার কথার সমাপ্তি ঘটলো একেবারে বিপরীত শব্দে। চমকে উঠলাম আমি। কন্ঠটা অর্ধ পরিচিত বলে মনে হলো।
— আপনি চাকরি পেয়েছেন অথচ মিষ্টি বিতরণ করলেন না? শুভ কাজে মিষ্টি দিতে হয় জানেন না?
ঘার ঘুরিয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত মানুষটার পানে চাইলাম। সে আর কেউ নয়। ডক্টর অঙ্কন। আমি মুচকি একটা হাসি দিয়ে বললাম
— পারিশ্রমিক পাই আগে। তারপর মিষ্টি খাওয়াবো।
— ওকে। ছোঁয়া তুমি কিন্তু সাক্ষী। মিষ্টি খাওয়াবে তোমার আন্টি।
ছোঁয়া বুঝে বা না বুঝে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো। আমার মুখের হাসি বিলীন হয়ে গাঢ় চিন্তার ছাপ লেপ্টে পরলো বদনে৷ গত কালের স্বপ্ন তাড়া করছে অঙ্কনকে দেখে। অস্বস্তি হচ্ছে মাত্রাতিরিক্ত।
— আমি তবে আসি।
— ক্লাস কয়টা থেকে?
অঙ্কনও ফিসফিস ধ্বনি তুলে জিজ্ঞেস করলো আমায়। আমি স্বাভাবিক কন্ঠে বলার চেষ্টা করলাম
— নয়টা৷
— পৌনে নয়টা বাজে। যেতে পারবেন?
আমি উঠে দাড়িয়ে তড়িঘড়ি করে বললাম
— হ্যা কোন সমস্যা হবে না।
মনে জপে গেলাম জানা মতো সব ছোট দোয়া দরূদ। যেন পিছু না আসে অঙ্কন। যেন স্বপ্নেরর ছিটেফোঁটাও সত্যি না হয় ভবে। এমনিতেই শুধু হঠাৎ মাঝ রাস্তায় নিঃসঙ্গ পথিক হিসেবে পাশে অঙ্কন কে রাখতে আমার আপত্তি নেই। তাকে ভালো বন্ধুর খেতাব দেওয়ার বেলায় একবার বৈ দ্বিতীয় বার ভাবতে হবে না। কিন্তু অন্য কিছু? ইহকাল বা পরকালের কোনো কালেই সম্ভব নয়। স্বপ্নেরও স্বপ্নে ভাবা আমার জন্য অসম্ভব।
.
স্কুলে পৌঁছাতে পৌঁছাতে সত্যিই অনেকটা দেরি হয়েছিল। হেড টিচারের বাঁকা নজরের শিকার হলাম চাকরি শুরুর প্রথম দিনেই। কিছুটা অপরাধ বোধে মন অশান্ত ছিলো। তবে তা বেশি সময় ধরে স্থায়ী হতে পারলো না। ক্লাস টু এর বাচ্চাদের ক্লাস টিচার করে দেওয়া হলো আমাকে। ক্লাসে যেতেই মন ভরে গেলো। ছোট বাচ্চাদের হাসি, মুখের ডাক, ” মিস” বলে সম্বোধন করা, সবেতেই খুঁজে পেলাম এক টুকরো করে শান্তি। অবশেষে স্কুল ছুটি হলো বারোটার নাগাদ। আমার সাথে একান্ত এক মিটিং হয়ে গেলো হেড টিচারের। বেতন নিয়ে কথা হওয়াটাই ছিল মূখ্য বিষয়। পাঁচ হাজার করে নির্ধারণ করলো। আমি মাথা নাড়িয়ে সাই জানিয়েছি। চলে যাবে আমার দিনপাত। মন্দ কাটবে না। পাশাপাশি একটা টিউশনি নিতে হবে। সেখান থেকে যদি আসে পাঁচ এর মতো। মোট দশ হবে। মিলিয়ে মিশ্রণে খাওয়া পরা, হাত খরচ বাদে মনে হয় এক দু হাজার টাকা বাড়তিই রয়ে যাবে। পূর্ব পরিকল্পনা করে বসলাম এ টাকা মা বাবার কবরস্থানের ওখানে জমা দিয়ে আসবো। ভাবতে ভাবতে পায়ে হেঁটে রওনা হলাম ভার্সিটির উদ্দেশ্যে। বন্ধু-বান্ধবদের চেহারা একবার দর্শন করার খুব ইচ্ছে হচ্ছে।
.
ভার্সিটি থেকে বাসায় আসতে আসতে বেলা ফুরিয়ে দুপুর দুইটা। আজ একটু জলদি আসার চেষ্টা করেছি বটে। পারলাম কিনা জানি না। নিজের ঘরে এসে প্রথমেই দর্শন পেলাম ছোঁয়ার। সে আমার বিছানায় ঘুমন্ত। কি নিষ্পাপ চেহারা তার। এই মেয়েটাকে ছেড়ে যেতে আমার বড্ড কষ্ট হবে। ভাবতে গিয়ে দুফোঁটা অশ্রু গাড়িয়ে চোখের কর্ণিশ ছুয়ে গাড়িয়ে গেলো যেন আমার অনুমতি বিহীন। বেশ দীর্ঘ করে দম ফেললাম। হাতের ব্যাগ রেখে ফ্রেশ হওয়ার উদ্দেশ্যে চলে গেলাম ওয়াশরুমে। ভেবে নিলাম দুপুরের নামাজ আদায় করে নিয়ে আমিও ঘুম দেবো ছোঁয়ার পাশে।
ভাবনার এক বিন্দু নড়চড় না করে ঘুমিয়ে পরলাম। এই জীবনে একটা শান্তির ঘুম দরকার আমার। মাঝে মাঝে মনে হয় অচীন পুরে যাই। যেখানে কেউ চিনবে না আমাকে। আমি বিরতিহীন ডুকরে কেঁদে গেলেও কেউ বাঁধা দেবে না। লোক লজ্জার কোনো ভয় থাকবে না। অপমানিত, অবহেলিত হওয়ার কোনো অবকাশ থাকবে না। কিন্তু আমার কি তখন ভালো লাগবে? জীবনে একজন হলেও ভীষণ পরিচিত কারো থাকতে হয়। ভাবনার মাঝে ঘুমে চোখ নিভু নিভু হয়ে আসছে। দেহ মন সব অচেতন হওয়ার শেষ ধাপে যখন তখন একটু হলেও অনুভব করলাম কেউ যেন ওপাশে ছোঁয়ার পাশ ঘেঁসে বসে পরলো। পিনপতন নীরবতার রুমে ছেড়ে গেলো একটা ছোট চুমুর শব্দ। বুঝলাম স্মরণ ছাড়া এই অজানা ব্যাক্তি আর কেউ নয়। আমার ঘুম মুহূর্তেই ছুটে গেলো। হঠাৎ মনে হলো কিছু কাজ বাকি আছে৷ মনে হলো আমার এবাড়িতে থাকার আয়ু ফুরিয়ে এসেছে। একটা চাকরি হয়েছে আমার। এবার নিজের পথ নিজের দেখে নিতে হবে।
চলবে…