শেষ_বিকেলে_তুমি_আমি #আলিশা #পর্ব_৩

0
430

#শেষ_বিকেলে_তুমি_আমি
#আলিশা
#পর্ব_৩

বাড়ির কাজকর্ম আজ সানন্দে করে গেলাম। হৃদ কোঠার মাঝে কোথাও নব সুরের উৎপত্তি হয়েছিল। মন বলে গেলো, ‘খেয়া, এই মিষ্টি সংসারটা তোর। এই মিষ্টি মেয়েটা তোর। এ ঘরের বড্ড ভালো বাবাটাও তোর। এই সব তোর।’ সে থেকেই মহা ব্যাস্ততা নিয়ে কাজ করে গেলেও রাশি রাশি আনন্দ মন হতে বিচ্যুত হয়নি ক্ষণিকের জন্যও। ছোঁয়ার জন্য আজ পিঠাপুলিও বানাতে বসেছিলাম। পাটিসাপটা পিঠার পর বাবাকে বলে দারোয়ান চাচাকে বাজারে পাঠিয়ে নারিকেল এনেছিলাম। বাচ্চারা নারিকেল পিঠা ভীষণ পছন্দ করে। ছোঁয়া স্মরণের অনুপস্থিতিতে একদিনের মাথাতেই মিশে গেলো আমার সাথে। মা মেয়ে মিলে অনেক হাসি তামাশায় কিচেনে যুদ্ধ করেছি। ছোঁয়া বড্ড খুশি আজ। তবে সে আমার প্রথম দিকে কেন ওমন বাজে আচরণ করেছিলো? মনে এ প্রশ্ন উদয় হতেই অজানা থেকে উত্তর এলো, তার জীবন মা’কে ছাড়া। কখনো হয়তো এমন উন্মুক্ত করে হাসেনি মায়ের মতো কারো সাথে। কখনো কেউ হয়তো আদর করে কাছে ডাকেনি তাকে।

.
— আন্টি, আমাকে একটু সাজিয়ে দেবে?

দুপুর গড়িয়ে বিকেলের সীমান্তে পদার্পণ দিনের। ছোয়াকে নিয়ে আমার ঘরে শুয়ে ছিলাম। এমন সময়ই তার কোমল কন্ঠের উচ্ছল খেয়ালি সুর। আমারও মনে পরলো আজ ঘুরতে যাওয়ার কথা ছিলো। শোয়া থেকে উঠে ছোঁয়াকে বললাম

— আজ আমাদের ঘুরতে যাওয়ার কথা ছিলো না? যাবে?

— হ্যা, যাবো যাবো।

খুশিতে গদগদে হয়ে ছোঁয়া করতালি দিয়ে উঠলো। তার সেকেন্ড তিনেক পরই হঠাৎ বলল

— আন্টি? তুমি থাকো আমি আসছি।

বলেই সে ছুটে আমার ঘরের চৌকাঠ অতিক্রম করে যে কোথায় গেলো তা আমার জানার বাইরে। আমি ফ্রেশ হতে এই ফাঁকে চলে গেলাম ওয়াশরুমে। মিনিট পাচেক পর যখন ওয়াশরুম হতে বেরোলাম তখন দৃষ্টিতে ধরা দিলো দু’টো শাড়ি। আমি কায়দা করে যেন অবাকই হলাম। কাঁচা হলুদ রঙের শাড়ি। একটা ছোট আরেকটা বড় শাড়ি।

— এগুলো দিয়ে কি হবে?

— আমাকে একটা পরিয়ে দেবে। আর.. আর যে একটা থাকবে ওটা তুমি পরবে। বাবা আমাকে এটা কিনে দিয়েছে। দেখো আন্টি সুন্দর না?

ভীষণ সুন্দর! দু’টো শাড়ি একই রকম। শুধু আকারের তফাৎ মাত্র। আমি মলিন হয়ে গেলাম হঠাৎ এই শাড়িগুলো দেখে। মনে পরে গেলো আমার অবস্থান। আমি কি এই শাড়িটা পরতে পারবো? বুকটা কেঁপে উঠলো আমার। ছোঁয়ার মায়ের শাড়ি। আমার কি অধিকার আছে?

ভাবনা নিয়ে একবার ছোঁয়ার মুখপানে দৃষ্টি রাখতেই হঠাৎ গলে যেন ঢলে পরলো আমার মন। খুব সাহস সঞ্চয় করে নিয়ে একবার মনে মনে জপলাম

— ছোঁয়ার মা, আমাকে ক্ষমা করে দিয়েন৷ আমি আপনার জিনিসে ভাগ বসাতে চাই না। আপনি নেই তো কি হয়েছে। আপনার জিনিসগুলো আপনারই থাকবে। যদি স্মরণ কখনো আমাকে মেনে নেয়৷ মন থেকে স্ত্রীর অধিকার দেয় তবুও আমি আপনার জিনিসগুলোতে জিনিসগুলোতে নজর দেবো না। খুব সযত্নে তুলে রাখবো। কিন্তু আজ শুধু আমি ছোট মেয়েটার মন ভাঙতে চাই না।

.
কুঁচি করে মা মেয়ে শাড়ি পরে বেরিয়ে পরলাম। ছোঁয়ার সঙ্গে যেন আমিও এক বন্দিনী উন্মুক্ত হলাম আজ। বাবা গাড়ি নিতে বললেও আমি নাকচ করলাম। রিকশায় ঘুরবো আমরা। যেমন ভাবনা তেমন কাজ। বাড়ির গেইট থেকে রিকশা নিয়ে উঠে পরলাম। রিকশা ছুট লাগালো অজানা গন্তব্যে। চালককে বলে দিলাম, আমাদের আজ মাগরিবের আগ পর্যন্ত শুধু রিকশায় নিয়ে ঘুরাবেন। মোট কথা চট্টগ্রাম শহর ঘুরে দেখান। রিকশা চালক আমার কথামতো ঘুরতে লাগলেন। ছোঁয়া বড্ড খুশি হলো। মনে হলো যেন এমন খুশি সে ইতিপূর্বে হয়নি। আমি তার খুশির মাত্রা আরো একটু টানতেই তাকে নিয়ে গেলাম তার নানির বাসাতে। পৃথিবীর সমস্ত খুশি যেন এবার ছোঁয়ার ছোট মনে জেঁকে বসলো। ছোঁয়ার নানা নানি আমাকে বেশ সমীহ করলো। এক ফাঁকে ছোঁয়ার নানী জিজ্ঞেস করে বসলেন

— স্মরণ কি তোমাকে মেনে নিয়েছে?

আমি এমন প্রশ্নে বেশ অপ্রস্তুত হলাম। কোনো জবাব গুছিয়ে নিয়ে এসে ব্যাক্ত করতে পারলাম না। আমার দশা বুঝি উনি পর্যবেক্ষণ করে অবগত হলেন আমার কাল পরিস্থিতি সম্পর্কে। বললেন

— অথৈ আমাদের খুব আদরের মেয়ে ছিলো বুঝলে? তোমার মতো এতো সুন্দর ছিলো না। ও শ্যামলা ছিলো। আমার আদরের মেয়েটা দু’বার আমাকে ফাঁকি দিলো। একবার স্মরণের সাথে পালিয়ে গেলো। আবার স্মরণের থেকে আমাদের থেকে একেবারে পালিয়ে গেলো।

বলতে গিয়ে তিনি হুহু করে কেঁদে উঠলেন। আমি বেজায় অস্বস্তিতে পরে গেলাম।

— তুমি অনেক সুন্দর। স্মরণ তোমাকে এক সময় না এক সময় মেনে নেবেই। পুরুষ মানুষ বউ ভুলে যায় তাড়াতাড়ি। মা তোমার কাছে একটা অনুরোধ। তুমি আমার নাতনিকে মায়ের মতো আদর দিও। ওকে ফেলে দিও না। আর যদি পরে ফেলেই দেওয়ার ইচ্ছে থাকে তাহলে এখন ওকে আদর দিও না।

এহেন কথার নিমিত্তে আমি শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম সম্মুখের মা বয়সী মানুষটার দিকে।

ওবাড়ি হতে বেরোনোর সময় দিবা লগ্নর ইতি হয়ে এলো দশা। মৃদু মন্দ বাতাস মন খারাপের সুর শুনিয়ে দিয়ে বিদায় হচ্ছে। আকাশটা আজ হঠাৎই মেঘলা। এ যে বসন্তের বিকেল তা বললে এই মুহূর্তে কেউ বিশ্বাস করতে নারাজ হবে। আমি ছোঁয়া নিশ্চুপে হাঁটছিলাম। আমার মনে বহু প্রশ্ন, বহু কৌতুক। অথৈ দেখতে কেমন ছিলো? সে কিভাবেই বা চলে গেলো সবাইকে ছেড়ে? তার কবরটা কোথায়? এসব বাঁধন হারা ভাবনা ভাতে ভাবতেই হঠাৎ ঈষৎ চমকে উঠলাম। এক দু ফোঁটা করে যেন আকাশ বিদীর্ণ হয়ে বৃষ্টি পরছে। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। সত্যিই আরম্ভ হলো ঘনঘন ফোঁটার গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। আমি ছোঁয়াকে কোলে তুলে নিয়ে দ্রুত পায়ে হেঁটে রিকসা ধরলাম একটা। এ মুহূর্তে ভীষণ মিষ্টি এক দৃশ্য সৃষ্টি হলো আমাদের মা মেয়ের। ছোঁয়া ছোট হাত দিয়ে তার আঁচল টেনে তার আর আমার মাথা ঢাকার বৃথা এক চেষ্টা চালিয়ে গেলো।

বাসায় পৌছালাম আধ ভেজা হয়ে। শাড়ি ভিজে একাকার। খোপা খুলে বেহাল দশা। শুধু একরকমে ছোয়াকে বৃষ্টির ফোঁটা হতে আগলে রাখার চেষ্টা করেছিলাম। তবুও ভিজে গেছে। মেইন ডোরে গিয়ে কলিং বাজিয়ে ছোঁয়াকে কোল থেকে নামিয়ে দিলাম। ইতিমধ্যেই দরজা খেলার শব্দে কানে এলো। মুখ তুলে দরজার দিকে দৃষ্টি দিতেই অন্তর আত্মা আমার লাফিয়ে উঠলো। দরজার ওপাশে কে? ঘরের আলোর ছিটেফোঁটায় স্মরণকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে স্মরণ দাড়িয়ে। আমি অবাক, বিষ্ময়, ভয় সব হাতের মুঠোয় নিয়ে স্তব্ধ হয়ে দাড়িয়ে পরলাম। ছোঁয়া বাবা বলে আনন্দের স্বরে চিৎকার দিয়েই লাফিয়ে পরলো স্মরণের ওপর। স্মরণ কোলে তুলে নিলো মেয়েকে। ছোঁয়া শুরু করে দিলো তার ধারাবাহিক বুলি। আমি আলগোছে ওদের অন্তরালে শুকনো এক ঢোগ গিললাম। স্মরণের চোখের দৃষ্টি বলে দিচ্ছে, যেখানে বাঘের ভয়, সেখানে সন্ধ্যে হয় প্রবাদ আজ প্রমাণিত হবে আমার ওপরে। তবে আমি শঙ্কিত। আজ তো তার আসার কথা ছিলো না? আরো দু’দিন বাকি। এই মানুষটা কি মেয়েকে আমার কাছে রেখে কুল পায়নি কানাডায়? ছুটে এসেছে আজই। তা-ও আবার আমি যখন অথৈ এর শাড়ি পরে সটাং দাড়িয়ে আছি তার সামনে।

— শাড়িটা কেন নিয়েছেন? কোন অধিকারে?

মিনিট তিনেক পরই দাঁতে দাঁত চেপে ঝড়ে পরা রাগ নিয়ে উপস্থিত হলো স্মরণ আমার সামনে। আমি ড্রইং রুম অতিক্রম করার পর্যায়ে তখন। বুকের মাঝে ভয় বাসা বাধলো। কি হবে এখন?

— আমি একটা প্রশ্ন করেছি আপনাকে। কথা কানে যাচ্ছে না? এতো বাড়াবাড়ি কেন করছেন?

চলবে…..

( ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here