#শেষ_বিকেলে_তুমি_আমি
#আলিশা
#পর্ব_৮
— রাতে কি ছোঁয়ার জ্বর খুব বেশি ছিল?
— আমি বুঝতে পারিনি। ও আমার কাছেই ঘুমিয়েছিল কিন্তু…। পরে ওর বাবা বলল জ্বর। গায়ের তাপমাত্রা স্বাভাবিকই ছিলো।
— কারো কারো এমন হয়। তাপমাত্রার তেমন তারতম্য না হলেও শরীরে জ্বর থাকে। ছোঁয়া কি স্মরণের কাছে?
— হ্যা। কিন্তু আমার ঘরে।
সিঁড়ি ডিঙিয়ে ঘরে প্রবেশ পথে হন্টন দশায় কিছু তথ্য আদান প্রদান হলো। অতঃপর অঙ্কনকে সাথে নিয়ে আমার রুমের দরজার নিকট পৌঁছে বললাম
— আপনি ভেতরে যান। আমি আপনার নাস্তার ব্যাবস্থা করি।
— ওকে।
এবার যেন অঙ্কন ডাক্তার সত্তা ধারণ করলো। গাম্ভীর্যে ভরপুর মুখ নিয়ে দরজা ঠেলে প্রবেশ করলো ঘরে। আমি চলে গেলাম গেস্ট রুমে। হাতের পার্স রেখে চোখে মুখে একটু ঠান্ডা পানির ঝাঁপটা দিলাম। মাথা ঝিমঝিম ভাব। সকাল, দুপুর পেরিয়ে এখন বেলা তিনটার নাগাদ হলেও এক গ্লাস পানিও মুখে নেওয়া হয়নি। মনের চাওয়া পাওয়া এই মুহূর্তে একটু শয়ন করা। কিন্তু তা হবার নয়। একটা অতিথি এলো। তার সম্মুখে খুব সামান্য হলেও এক কাপ চা দেওয়া উচিত। নইলে বড্ড বেমানান হবে। জয়নব খালা নিশ্চয়ই নেই এই মুহূর্তে। তিনি দুপুরের পর বিরতি নেন। বাড়িতে চলে যান। আসেন বেলা আছরের ওয়াক্ত গড়িয়ে গেলে।
ঢিমা তালে রান্নাঘরে পৌঁছে চায়ের কেতলিতে পানি দিয়ে অবসন্ন, অলস দেহ নিয়ে তাকিয়ে রইলাম কেতলির পানির দিকে। এখনই তারা টকবক করে ফুটবে। কিছু পানি বাষ্পে রূপ নিয়ে যেন হৈ হৈ করে রওনা হয়েছে আকাশ পথে। তারা কি সুখে আছে? তাদের কোনো দুঃখ নেই, দুশ্চিন্তা নেই, ক্লেশ নেই। আমার মতো মাথাভর্তি দুশ্চিন্তার ছিটেফোঁটাও হয়তো নেই। এই যেমন আমি ওয়ারেসিয়ার কাছ থেকে ফিরতি পথে একটা ভাবনাতেই আটকে আছি। এবাড়ি ছাড়ার পর আমার ঠিকানা হবে কোথায়? আচ্ছা চাকরির ব্যাবস্থা হবে তো? পাঁচ হাজার যদি সেলারি হয় তা দিয়ে বাড়ি ভারা, খাওয়া, ভার্সিটির খরচ আর চলা ফেরা হয়ে যাবে কি? বাজারে দ্রব্য মূল্য উর্ধ্বে। দু একটা টিউশনি জোগাড় করতে হবে। একটা কম ভাড়ার বাসাও জোগাড় করতে হবে।
— এই, সমস্যা কি আপনার?
ভাবনার মাঝে কর্ণপাত হলো এমন একটা উক্তি। মৃদু কেঁপে উঠলাম আমি। বুকে থু থু ছিটিয়ে তক্ষুনি পাশ ফিরে তাকালাম শঙ্কিত দৃষ্টিতে। চোখে ধরা দিলো স্মরণের শক্ত চোখ মুখ। আমি তার উদ্দেশ্য ধরতে না পেরে অবলা দৃষ্টি তাক করে নিষ্পলক তাকিয়ে রইলাম। সে আমার কাছে জানতে চাইল
— মাথায় কি সমস্যা আছে?
এমন প্রশ্ন শুনে আমি হতবুদ্ধি হয়ে গেলাম। পূর্বের সব ভাবনা বিলীন হয়ে এবার নতুন ভাবনার জাল বুনতে আরম্ভ করলো মস্তিষ্ক। এমন প্রশ্নের উৎস কি? আকাশ পাতাল এক করে ভাবতে যাওয়ার পথে স্মরণ বাঁধা হয়ে দাড়িয়ে বলল
— কাকে কি বলি? আপনি তো বোবা। কথা বলতে পারেন না।….. ননসেন্স, কেতলি পুড়ে যাচ্ছিল দেখেন না?
শেষের কথাটা উচ্চ বাক্যের ছিলো। আমি চমকে চুলার পানে তাকালাম। একি? পানি শুকিয়ে কেতলি তাপে তাপে লাল বর্ণে ছেয়ে গেছে। আমি তড়িঘড়ি করে নামিয়ে রাখলাম ওটা। নামাতে গিয়ে ঘটালাম আরেক বিপত্তি। কড়া উত্তাপের কেতলি খালি হাতে ধরতে গিয়েই বড়সড় একটা ছেঁকা লাগলো হাতে। চিৎকার করে হাত সরিয়ে আনতেই কেতলি যেন ভীষণ রেগে আবার পরলো আমার পায়ে। পরপর দু’টো অঘটনের শিকার হয়ে আমি তব্দা লেগে গেলাম। অনুভূতি প্রকাশ করার কথা যেন বোকা মস্তিষ্ক ভুলে গেলো। চোখে জলেরা ভীর করলো সেকেন্ডের ব্যাবধানে। স্মরণ প্রথমে ক্ষিপ্ত হয়ে তাকালেও পরে তার চোখের দৃষ্টি অসহায় হয়ে পরলো। যেন সে শব্দহীন ভাবে বলে গেলো
” উদ্ভট গাধা প্রাণী। ”
ইতিমধ্যে কেতলির ঝনঝন আওয়াজ পরখ করে অঙ্কন রান্নাঘরের দরজায় উপস্থিত। তার যেন একটু দয়া হলো। সে আগে পরে না ভেবে আমার হাত টেনে দাড় করিয়ে দিলো বেসিনের কাছে। পানির কল ছেড়ে দিয়ে হাতটা তার নিচে রেখে দিলো। স্মরণ তখনও অসহায় হয়ে দাড়িয়ে। দু মিনিটের মাথায় সে ফ্রিজ খুলে বরফের টুকরো বের করলো। অতঃপর আলগোছে বসে তা আমার পায়ের পাতায় রাখতে রাখতে বলল
— আজব!
.
এক প্রকারে দুইবার আহত আমি ড্রয়িং রুমে হাত পা ছড়িয়ে বসে আছি। মাথার ওপর ফ্যান। পাশের দেয়ালে দু’টো এসি। তবুও আমি কুলকুল করে ঘেমে যাচ্ছি। মনের মধ্যে ছটফট ভাব। হাতের পোড়া ভাব ছাপাছাপি হয়ে অন্য কিছুর সুর হৃদয়ের। জানা ছিলো না প্রিয় মানুষ হাত ধরলে এতোটা বুক কাপে। আমার ভেতর ঘরে যেন ভাংচুর শুরু হয়েছে।
— হাত কাঁপলে পেস্টটা লাগাবো কিভাবে?
আমি চমকে উঠলাম। স্মরণ মুখে রাজ্যের বিরক্তি নিয়ে কথাটা বলল। মুখ তার শুকনো। সে শুকনো মুখে আমার বিপরীতে বসে আমার হাতে পেস্ট লাগিয়ে দিচ্ছে। অঙ্কন অজান্তে জোর করে তার হাতে পেস্ট ধরিয়ে দিয়েছে। তারপর সে গেছে ছাঁদে অ্যালোভেরার পাতা আনতে।
— পানি খাবেন?
— উঁহু।
জবাব পেয়ে স্মরণ হঠাৎ আমার পানে একবার দৃষ্টি রাখলো। আমাকে পরখ করে নিয়ে নিজের জায়গা ছেড়ে সে উঠে পরলো। গ্লাস ভার্তি পানি এনে আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল
— নিন।
আমি নিলাম। হাতে নিয়ে ঢকঢক করে পুরো পানি শেষ করলাম। স্মরণ আমার পায়ের দিকে ঝুঁকে পরলো পেস্ট লাগানোর উদ্দেশ্যে। আমি অস্বস্তি থেকে বললাম
— থাক লাগবে না। পরে আমি লাগিয়ে নেবো।
সে নিরুত্তর। যেন আমার কথা সে শুনতে পেলো না। গোমড়া মুখে পায়ে পেস্ট লাগিয়ে দিলো। আমি তব্দা লেগে বসে রইলাম। ভয়ংকর অস্বস্তি আর বিব্রতবোধ হচ্ছে। মনে মনে কেতলিকে গালি দিলাম। দু’টো হাতেই ছেঁকা দিয়ে দিলো। একটা হাত অন্তত ভালো থাকলেও পারতো।
.
অঙ্কন কিছু ওষুধ লিখে দিয়ে বিদায় হলো। বিকেলে জয়নব খালা এসে আমার এমন অবস্থা মানতে পারলেন না। আফসোসের বণ্যায় হাবুডুবু খেতে খেতে বললেন
— কেমনডা হইছে কও? কি সুন্দর পুতুলের মতো হাতটা পুড়ে ফেললা? সুন্দর মাইয়ারা এমন গাধা যে হয় ক্যা? দুপুরে কিছু খাইতে পারছো? দুই হাতই না পোড়া। তোমার শশুর আব্বা জানে?
— জনে। আমি দুপুরে কিছু খাই নাই খালা। একটু ভাত দিবেন?
খালা কথা না বাড়িয়ে জলদি ভাত আনলেন। দুই হাতের দু’টো দু’টো করে আঙ্গুল পুড়ে ফুলে ফোসকা পরে গেছে। খালা তুলে খাওয়াতে দ্বিধা করলেন না। আমিও খেয়ে নিলাম। ছোঁয়া আমার পাশেই বসে ছিলো। মা মেয়ে দুজনেই সমান তালে অসুস্থ। আমার খাওয়ার সাথে ছোঁয়াও খেয়ে নিলো। গল্প হলো তিনজনের। খালা খাওয়ানো শেষ করেই গেলেন রান্নাঘরে। তখন মাগরিবের আজান পরে গেছে। ছোঁয়া শুয়ে পরলো। আমারও চোখ লেগে কাল হয়ে এলো। বিড়ম্বনা না করে ছোঁয়ার পাশে শুয়ে পরলাম। চোখটা লেগে এসেছিল। এমন সময়ই দরজার ক্যাটক্যাট আওয়াজ। তাকিয়ে দেখি স্মরণ।
— এখানে একটা টিউব আছে। হাতে লাগিয়ে নিবেন। নাহলে ফোসকা বেশি পরবে।
— আচ্ছা।
— ছোঁয়া ঘুমিয়ে গেছে?
— হুম।
— ওষুধ খায়নি ও?
আমি ভয়ে জ্বিভ কাটলাম। খায়নি। আমার মনেই ছিলো না। ক্রমাগত প্রহর গুণতে লাগলাম। এখনই বুঝি আবার বলবে আমি ছোঁয়ার মা হওয়ার যোগ্য নয়। একে একে দু মিনিট পেরিয়ে গেল। আমাকে অবাক করে দিয়ে স্মরণ কিছু বলল না। সে শুধু একবার ছোঁয়ার কপাল ছুয়ে তাপমাত্রা অনুভব করলো। অতঃপর বলল
— মলম লাগিয়ে নিন।
বলেই সে আমার দিকে ছুড়ে দিলো একটা মলমের টিউব। অতঃপর ঘরের বন্ধ ফ্যানটা চালু করে বসে পরলো এঘরেই। ছোঁয়ার ওপাশে একটা চেয়ার এনে। আমি মলমটা হাতে নিয়ে ফোসকা পরা হতে চেষ্টা চালিয়ে গেলাম মুখটা খোলার। কিন্তু হাতের জোর একেবারেই যেন নেই। হাল ছেড়ে মলম রেখে দেবো দেবো ভাবনা, এমন সময় হঠাৎ স্মরণ উঠে এসে হাতে নিলো। মুখটা খুলে দিয়ে আপন ইচ্ছে তেই একটু খালি ওষুধ আমার হাতের পোড়া জায়গায় লাগিয়ে দিয়ে নীরবে ইশারা করলো তা হাত দিয়ে ছড়িয়ে দিতে। আমি তাই করলাম। দ্বিতীয় বারের মতো বুকে ঝড় উঠলো ভালোবাসার মানুষটা এতো নিকটে থাকায়।
— আজ দুপুরে কোথাও গিয়েছিলেন?
হঠাৎ তার প্রশ্ন। আমি একপলক তাকে দেখে বললাম
— হুম।
— কোথায়?
— ওয়ারেশিয়ার সাথে দেখা করতে।
— ওয়ারেশিয়া কে?
— আমার চাচাতো বোন।
— ওহ। অঙ্কন কিভাবে জানলো ছোঁয়র কথা?
— পথে দেখা হয়েছিল।
স্মরণ আমার অপর হাতের ওপর ওষুধ দিতে দিতে বলল
— ওহ।
চলবে…