আমায়_ডেকো_অপরাহ্নে #আকাঙ্ক্ষা_আহনাফ_স্নেহা #পর্ব_০২

0
321

#আমায়_ডেকো_অপরাহ্নে
#আকাঙ্ক্ষা_আহনাফ_স্নেহা
#পর্ব_০২

বাবার দরজায় অনবরত কড়াঘাত করেও লাভ হয়নি। বাবা শেষে মাকে ধমক দিয়ে বললেন ‘ আহ্, বিরক্ত করো না তো মিলি। দেখছো একটা কাজ করছি সেখানে তুমি বিরক্ত করছো।’

মা কান্নাকাটি ভুলে উল্টো আমাকে দিলেন ধমক, ‘ দেখলি,দেখলি তোর বাবার কাহিনী? আমি বিরক্ত করছি তাকে?’

আমি বন্ধু মহলে অত্যন্ত কোমল হৃদয়ের একজন। আমাকে ধমক দিলেই কাঁদো কাঁদো অবস্থা। আমি কাঁদো কাঁদো মুখ নিয়ে বারান্দায় গিয়ে বাহিরে চোখ বুলাতেই অবাক হলাম। সেই ছাই রঙা ঢিলে শার্ট পড়া লম্বাটে লোকটা এখনো বাড়িতে উঁকিঝুঁকি মারছে। ঘরের দেওয়াল ঘড়িতে দেখলাম,এখন বাজে সাড়ে নয়টা। সেই সন্ধ্যা থেকে এখনো দাঁড়িয়ে। বিষয়টা বোধগম্য হতেই আমি বাহিরে গেলাম। রাস্তায় বৃষ্টির কারণে তেমন মানুষ নেই। শুধু রাজু মিয়ার দর্জির দোকান খোলা মেশিনের ঘটাং ঘটাং শব্দ হচ্ছে।

আমি গেইট খুলতেই লোকটা হকচকিয়ে উঠলো। আমি ছাতাটা গলায় চেপে ধরে বুকে হাত ভাজ করে গম্ভীর স্বরে বললাম ‘ কখন থেকে দেখছি বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছেন।’

মাথায় হাতের তালু দিয়ে বৃষ্টির পানি মুছতে মুছতে আবছা অন্ধকারে যথেষ্ট শুদ্ধ ভাষায় আঞ্চলিক টান দিয়ে বললেন,

‘ হ্যাঁ,একটু দরকারে দাঁড়িয়ে আছি।’

‘কী এমন দরকার? যে, বৃষ্টিতে ভিজতে হচ্ছে! ভিজে ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকা ভালো লক্ষণ নয়। আবার নেম প্লেটেও চোখ বুলালেন। কে,কে আপনি?’

উনি কথা বলার শুরুতেই অনবরত হাঁচি দিচ্ছেন। একজন পর পুরুষকে ছাতার নিচে আসতে বলাটা অস্বস্তির ব্যাপার,আমি জেনেশুনেই তাকে ছাতার নিচে আসতে বললাম ‘ ছাতার নিচে আসুন।’

‘ না তার দরকার নেই,আসলে এটা কী কাইয়ুম সাহেবের বাসা? বাড়ির ঠিকানা তো ঠিকঠাক..’

‘ আমার বাবার নামই কাইয়ুম, আপনি এতক্ষণ বাহিরে কেনো ভিতরে আসুন।’

উনি এতক্ষণ যাবত বাহিরে কেনো তা জানা নেই। তবে আমার পিছনে পিছনে উনি বাড়ির ভিতরে আসলেন। ঘরের ভিতরে ডুকতেই মায়ের দেখা পাওয়া গেলো না। মা আমার ঘরে দরজা বন্ধ করে বসে আছেন। বাবা দরজা খুলেই বললেন ‘ অনুভ্র, তোমার তো আসার কথা ছিল সেই সন্ধ্যায়। এত দেরী করে এসেছো?’

আমি বাবাকে বললাম ‘ তুমি চিনো উনাকে?’

‘ হ্যাঁ চিনি, তুই যা চা নিয়ে আয়।’

চা নিয়ে এসে দেখি ছেলেটার গায়ে ছোট মামার ফতুয়া,আর প্যান্ট। নাকের পাটা লাল হয়ে আছে, ঘন চোখের পাপড়ি ভিজে কৃষ্ণবর্ণ রঙে চোখ মোহনীয়। চোখ লালচে। বাবা সম্ভবত তার থেকে টাকা পাওনা ছিল। উনি চা নিলেন না, বাবা বোধহয় আমার উপস্থিতি সহজ ভাবে নিচ্ছেন না। আমি নিজ থেকে চলে যাওয়ার সময় লোকটার গলা শুনলাম। ‘ চাচা টাকাটা দেরিতে ফেরত দেওয়ার জন্য লজ্জিত। আমায় ক্ষমা করবেন’ যত্ন করে হারমোনিয়ামে সুর তোলার মতো কণ্ঠস্বর। আমার ইচ্ছে করছিল কিছুক্ষণ এই চমৎকার কণ্ঠস্বরটা শোনার তবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ছিল না।

অনুভ্র নামের ছেলেটা যাওয়ার সময় চমৎকার করে হাসলো, আমার উচিত ছিল হাসির বিনিময়ে হাসি দেওয়া তা না দিয়ে আমি মাথা নুইয়ে ফেললাম। লক্ষ্য করলাম উনি যাচ্ছে না। বাহিরে আবারো ঝুম বৃষ্টি আরম্ভ হয়েছে। অনুভ্র গলা খাঁকারি দিয়ে বললো ‘ একটা ব্যাগ হবে কাপড় গুলো নিব।’

আমি ব্যাগের সাথে আমার ছাতাটা দিয়ে বললাম ‘ আর ভিজে ভিজে যাওয়ার দরকার নেই। নিশ্চিত জ্বর বাঁধবে। নিন ছাতাটা’

‘ আপনার নাম চিত্রলেখা?’

‘ জি, আমার নাম চিত্রলেখা।’

‘ নামটা ওতোটাও খারাপ নয়। ছাতা কিন্তু আর ফেরত পাবেন না। যাচ্ছি তাহলে’

লোকটা হাসছে আমিও হাসছি। অকারণে লোভ জাগলো তার চলে যাওয়া মুহুর্তটা দেখার। বারান্দার গিয়ে দেখলাম উনি গেইটের বাহিরে আবারো নেম প্লেট ছুঁয়ে দেখছে। আচমকা আমাদের চোখে চোখ পড়ে গেলো। লজ্জায় দৌড়ে রুমে চলে আসলাম। চোখে ভাসছে ঐ সরলতা মিশ্রিত চোখ দুটো,যে চোখে কৃষ্ণ ঘন নেত্রপল্লব, সুনীল আকাশের ন্যায় গভীরতা। কুচকুচে কালো জোড়া ভ্রু, জীবনে প্রথম কেমন একটা অনুভুতি যে হচ্ছে। কখনো তো আগ বাড়িয়ে কথা বলিনি। তাহলে আজ কেনো যেচে কথা বলা? ছোট মামা আসুক বিষয়টা তার সাথে আলোচনা করতে হবে। নামটা বিরবির করে উচ্চারণ করতে গিয়েও লজ্জা লাগছিল অনু..অনুভ্র! অনুভ্র! অনুভ্র!
________________________________________

আমার অভ্যেস ঘুম থেকে উঠেই দিনপঞ্জি লিখা। বালিশের নিচ থেকে মেরুন রঙের চামড়ার মোটা ডায়েরী বের করলাম। পৃষ্ঠা উল্টাতেই বাসী শুকনো বকুল আছড়ে পড়লে কোলে, শুকনো সুরভী নাকে লাগছে। জানালা খুলে দিতেই বাহিরের ছাতিম গাছে দাঁড়কাক এসে বসলো। ভোরের পাখি,আর বকুলের রেখে দেওয়া সুরভী সব মিলিয়ে সকালটা ভালো ভাবেই সূচনা হলো। কলম হাতে নিয়ে লিখতে শুরু করলাম

‘ গতকাল আচমকা অনুভ্র নামের এক সুদর্শন যুবকের দেখা। লোকটার সাথে দেখা হওয়ার পর থেকে মন খারাপ অকারণে টের পাচ্ছি, স্বপ্নে দেখলাম লোকটার জন্য ভেউ ভেউ করে কাঁদছি। কাজেই বোঝা যায়, ঘটনা অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে আমার অবচেতন মন। লোকটা সত্যি মনটা উলট পালট করে দিয়েছে। চোখ দুটো গভীর ভাবে পরোখ করতে গিয়ে দেখলাম এমন চোখ জীবনে কখনো দেখিনি। তার মুখে তেরো বছরের কিশোরের ন্যায় সারল্য ফুটে ছিলো। প্রিয় বান্ধবী তিথির বিয়ে অথচ মন খারাপ হচ্ছে না। অথচ লোকটা যাওয়ার পর বাবাকে মিথ্যে বলেছি যে তিথির জন্য মন খারাপ।’
.

.

.

ফরহাদ সাহেব এসেছেন এক পলিথিন লটকন নিয়ে। ভদ্রলোককে দেখে অবাক হয়েছি। উনি উনার আনা লটকন খেতে খেতে বিনয়ী হেসে বলছেন ‘ আসলে তিথির বাড়িতে যেতে লজ্জা লাগছিল। একটা চিঠি লিখে পাঠিয়েছিলাম। সেই চিঠি গিয়ে পড়েছে তিথির মায়ের কাছে। সেখানে লিখা ছিল কী সেটা বলতে পারব না কারণ পার্সোনাল একটা কথা ছিল। আপনি কী আমাকে ওদের বাড়ির নাম্বারটা দিবেন?’

‘ ইয়ে তিথি কী এই বিয়েতে রাজি?’

‘ হ্যাঁ, হ্যাঁ। রাজি হয়েছে,এটাও বলেছে আপনাকে যোগ্য জবাব দিতে হলে আমার ভুরি কমাতে হবে!’

আমি হা করে তাকিয়ে আছি, আমার ইচ্ছে করছে তিথিকে কষিয়ে দুইটা চড় লাগাই। তুই বিয়ে করবি আমার কী। দুদিন হতে না হতেই এটা ওটা কথাও হচ্ছে এই ভুরিওয়ালা লোকের সাথে।

‘ নাম্বার টা দিন’

আমি নাম্বার বলতেই উনি কলম বের করে হাতে লিখে ফেলেছেন। খুশির বশেই একটা লটকন খোসা সহকারে গিলে, হেহেহে মার্কা হাসি একে বেরিয়ে গেলেন। আমার ধারণা ভদ্রলোক রাত বিরাতে কল দিয়ে ‘ তিথি ভালো আছো’ এই বলে শুরু এবং ইনিয়ে বিনিয়ে কথার শেষ হবে বাসর ঘর শব্দটার মাঝে গিয়ে। একটা কথা সত্যি,বিয়ের পর বান্ধবীদের কথা বান্ধবীর মনে থাকে না। তিথিরও মনে থাকবে না। একটা সময় হুটহাট হয়তো ছেলে মেয়েদের বলবে ‘ আমি তো নক্ষত্রদের নাম তেমন জানি না। তবে একটা নক্ষত্রের নাম জানি চিত্রলেখা। ওহ হ্যাঁ,এই নামে আমার একটা বান্ধবী ছিল বাংলাদেশে নিকেতনে।’

মা ভুনা খিচুড়ি রান্না করেছেন, এবং মরিচের আচার, খাসির গোশত অতিরিক্ত ঝাল দিয়ে রান্না করেছেন। বাবা খেতে গিয়ে হো হা করছে। মা ফ্রিজ থেকে মিষ্টি বের করে দিতে দিতে বললেন ‘ গতকাল একটা ছেলে এসেছিল বললে। ছেলেটা কে?’

বাবা জল খাওয়া বন্ধ করে বলল ‘ ছেলেটার নাম অনুভ্র, ময়মনসিংহ থেকে এসেছে। একবার একটা চিতল মাছ এনেছিলাম না বড়? ওটা ওদের পুকুরের। ছেলেটা ভালোই, গত মাসে আমার থেকে টাকা ধার নিয়েছিল। শহরে চলে আসার সময় ঠিকানা দিয়ে এসেছিলাম। আজ ফেরত দিতে এসেছে।’

‘ একটু ডাক দিলেই তো পারতে,ছেলেটা কিছু না খেয়ে চলে গেলো।’

‘ তোমার সাথে কথা বলতে ভালো লাগছে না মিলি। এই মুহূর্তে তুমি আমার সামনে থেকে যাও, আর হ্যাঁ এই উদ্ভট মরিচের আচার ফাচার আমাকে খাওয়াবে না।’
_______________________________________

আমাদের দেশের বাড়ির লোক অনুভ্র! লোকটা তাহলে ঢাকাতে থাকে না। দেখা হবে না তাহলে আর, তবে কেনো এক দেখাতেই মন কেঁদে উঠেছিল। চোখ বন্ধ করতেই এ চোখ জোড়া ভেসে উঠলো। বারান্দায় গিয়ে বাহিরে চোখ বুলাতে গিয়ে কিছুই দেখলাম। মানুষটা এখানেই দাঁড়িয়ে ছিল। বাগান বিলাস ফুলের গোলাপি পাপড়ি রাস্তায় পড়ে আছে। গুনগুন করে গান গাওয়া ধরলাম,

“বধূ কোন আলো লাগলো চোখে….!”

#চলবে…?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here