আরশির_প্রতিমুখে #পর্ব_২ (প্রেমদণ্ড) —নবনীতা শেখ

0
260

#আরশির_প্রতিমুখে
#পর্ব_২ (প্রেমদণ্ড)
—নবনীতা শেখ

“আজ যে ক্যাম্পাসে সিনিয়রদের রিইউনিয়ন—তা আমাকে বলিসনি কেন?”

কুন্দনের কথায় পাশ থেকে জয়া বলে উঠল, “হ্যাঁ, সেই! তুমি যে শুক্রবারে গ্রাম থেকে বাসায় ফিরেই কলেজের লাইব্রেরিতে চলে আসতে চাইবে—আমার জানা ছিল?”

কুন্দন সরু চোখে তাকিয়ে বলল, “কেন জানা থাকবে না? অবশ্যই জানা উচিত ছিল। বান্ধবীর মনের কথা বুঝতে পারো না—সেই তুমি কচুর সখী আমার!”

মুখ ভেঙাল জয়া। কুন্দন স্কুল মাঠের ভেতরের জমজমাট পরিবেশটাকে পাশকাটিয়ে কলেজের ভেতরে ঢুকে গেল। মেঘ ডাকছে। বৃষ্টি নামবে বলে!

জয়া বিরক্তি নিয়ে বলল, “বৃষ্টি পড়বে! আজ আসার কি খুব দরকার ছিল?”

লম্বা বিনুনি পাকানো চুলগুলো নাড়াতে নাড়াতে কুন্দন ছোটো করে কেবল বলল, “খু-ব!”

করিডোরের মাঝদিকেই লাইব্রেরি। জয়া হাঁটতে হাঁটতে ভেতরে ঢুকে গেল। ঠিক দরজার চৌকাঠেই দাঁড়িয়ে পড়ল কুন্দন। মাথা হালকা ঘুরিয়ে পেছনে তাকিয়ে দেখল এক ভদ্রলোককে, উলটো ঘুরে দাঁড়িয়ে আছে। পেছন থেকে বেশ পরিপাটি দেখতে! এক দৃষ্টে চেয়ে আছে ক্যাম্পাসের ওই কদম ফুল গাছের ওদিকে। কে জানে—কেন!

কাঁধ ঝাঁকিয়ে কুন্দন ভেতরে প্রবেশ করল। কিছু বই জমা দিয়ে জয়াকে নিয়ে দোতলায় চলে গেল। কোনো উদ্দেশ্য নেই। মজাটা এখানেই। যখন আমরা আমাদের পরবর্তী পদক্ষেপ সম্পর্কে জ্ঞাত হব, তখন থেকেই একঘেয়েমির জীবন কাটাব আমরা.. নিজেদের অজান্তেই; সে-সবে নিরাশ হব, ব্যথিত হব। এক্ষেত্রে পরিকল্পনাহীন জীবন সর্বসুন্দর। যেখানে কোনো আশাই থাকবে না, সেখানে হতাশার স্কোপ তো আরও দূরের কথা।

জয়া হাঁটতে হাঁটতে বলল, “তো, মিস কুন্দনিকা! আপনার মতে প্রেম কী?”

জবাবে কুন্দন হাসল। জয়া তাড়া দিলো, “বলো বলো বলো! হোয়াট ইজ দ্য ডেফিনেশন অব্ লাভ?”

কুন্দন প্রসস্ত হেসে বলল, “প্রেম পৃথিবীর একমাত্র ওয়ার্ড, যার কোনো ডেফিনেশন হয় না। এটা যার কাছে যেমন, তার কাছে তেমনই। কারো কাছে ফ্রেন্ডশিপ, কারো কাছে লং টাইম অ্যাটাচমেন্ট আর কারো কাছে ইনফ্যাচ্যুয়েশন।
বিজ্ঞদের মতে, প্রেম বলতে দুনিয়াতে কোনো শব্দই নেই। একটা অদ্ভুত ফিলিংস আছে! বোঝানোর প্রেক্ষিতে বলা হয়, আই অ্যাম ইন লাভ!”

জয়া হাতে তালি দিয়ে বলল, “তোর কাছে পৃথিবীর সব প্রশ্নের উত্তর আছে, না?”

“আমার কাছে মাথা আছে, যেটা তোর নেই।”

“অপমান!”

“যা ভাবিস!”

“আচ্ছা, শোন! করিডোরে যেই ভাইয়াটা দাঁড়িয়ে ছিল, দেখেছিস না?”

“হুঁ।”

“কেমন লাগে রে? দেখতে মাশাআল্লাহ ভালোই! পার্সোনালিটিও ভালোই লাগছে!”

“মুখে লাগাম দে, ভাই ডেকেছিস তুই।”

“আব্! ভুলে। ভাই-টাই বাদ! ওটাকে পটিয়ে দে।”

কুন্দন কড়া চোখে তাকিয়ে জয়াকে বলল, “লাথি খাবি, সর এখান থেকে।”

মিনমিন করে জয়া বলল, “হ্যাঁ, সেটাই!”

ক্ষণিকের মধ্যেই ভারি বর্ষণ শুরু হয়ে গেল। স্কুল চত্ত্বরে বসা সবাই স্কুলের ভেতরে অবস্থান নিল। কুন্দন স্থির চোখে দেখল। হঠাৎই মস্তিষ্কে অদ্ভুত, ভারি উদ্ভট একটা কথা এলো। মাথা থেকে বের করতে পারল না সে। ভাবতে ভাবতেই বিনুনি গাঁথা চুলগুলো সামনে এনে নিল। মুখে ছেয়ে গেল স্নিগ্ধ হাসি। পরনে পালাজো আর গোল জামা। এক হাতে জামাটা হালকা উঁচিয়ে কুন্দন দৌড়াতে লাগল। পেছন থেকে জয়া বলতে লাগল, “ভাই! থাম! পড়ে যাবি।”

হাসতে হাসতে কুন্দন বলল, “পড়লাম!”

“ব্যাথা পাবি।”

“পেলাম।”

“মরতেও পারিস।”

“মরলাম।”

সিঁড়ির কোণায় এসে দাঁড়িয়ে পড়ল। খেয়ালে এলো কিছুক্ষণ আগে স্বল্পক্ষণের দেখা একটা লোককে আর হঠাৎ মস্তিষ্কে উদিত সেই কথাটিকে! সে পিছে মুড়ল না, অথচ ধীর পায়ে খানিকটা পেছালো। মাথা বিপরীতে ঝুঁকিয়ে বলল, “ধাক্কা লাগলে কি প্রেম হয়, জয়ু?”

জয়া চোখ-মুখ কুঁচকে বলল, “তুই না বললি—প্রেম বলতে কিছুই নেই?”

“হ্যাঁ, নেই-ই তো! তার মানে কি আমি তোকে বার বার বলব—এই জয়ু, আমার না ইয়ে পাচ্ছে! আমার না ইয়ে ইয়ে লাগছে! আমার বোধহয় ইয়ে হয়েছে! এটা বলব?”

বোকার মতো তাকিয়ে রইল জয়া। বড্ড ভাব নিয়ে অভিজ্ঞবার্তা ছুড়ল কুন্দন, “শোন, জয়া! যখন দেখবি—অনুভূতিকে ব্যাখ্যা করার জন্য নির্দিষ্ট কোনো শব্দ পাচ্ছিস না, তখন সেই শব্দকে তুই প্রেম ধরে নিবি। কারণ দুনিয়াতে প্রেমব্যতীত এমন কোনো শব্দ নেই—যার ব্যাখ্যা আছে, অথচ তাকে সংজ্ঞায়িত করা যায় না। একটা ছোট্ট ট্রিকস শিখিয়ে দিলাম।”

“ওহে প্রেমগুরু! এবার বলেন—পাগলের মতো ওভাবে দৌড়াচ্ছিলেন কেন?”

“কারণ আমি ভিজব।”

“বৃষ্টিতে?”

“আপাতত প্রকৃতির বৃষ্টিতে ভেজার ইচ্ছে আছে। কিন্তু ওই-যে, ধাক্কা লেগে যদি প্রেম হয়ে যায়, তবে প্রকৃতির বৃষ্টিতে ভেজার ইচ্ছেটা প্রেমবৃষ্টিতে ট্রান্সফার হতে সময় নেবে না।”

“বুঝিনি ব্যাপারটা!”

“মাথা থাকলে বুঝতিস। যেহেতু নেই, তাই বাদ দে। শুধু বল—ধাক্কা লাগলে প্রেম হয়?”

ভাবতে থাকল জয়া। অনেকটা সময় ভেবে উত্তর দিলো, “ধাক্কা খেয়ে প্রেম তো কেবল সিনেমায় হয়!”

প্রশস্ত হাসল কুন্দন, “এদিকে জীবনটা সিনেমার চেয়েও সিনেম্যাটিক। প্রেম না হয়ে যাবে কই? লেট’স ডু অ্যান এক্সপেরিমেন্ট!”

“কীসের?”

“ধাক্কা লেগে প্রেমের।”

তারপরই সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগল সেই আগের মতো গতিশীল ভঙ্গিতে। লোকটাকে এখনও সেখানটাতেই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল। পেছন থেকে জয়া বিভিন্ন অঙ্গ-ভঙ্গিতে বোঝাতে লাগল, “যাস নে! যাস নে! মুখে যত কিছুই বলি না কেন, সামনাসামনি কিছু করিস নে! বাঁশ তোকে ডাকছে রে! ওদিকে কান দিস নে!”

এমন ইঙ্গিতে কুন্দনের পেট ফেটে বেরিয়ে আসতে চাওয়া হাসিটা কী কষ্টে যে আটকাল! ছুঁটছে এমন গতিতে যেন ট্রেইন মিস যাবে। ওই তো তার গন্তব্য! ঠিক গন্তব্যের কাছাকাছি যত পা যাচ্ছে, তার গতি কমছে খুবই অমায়িকভাবে, চেহারায় অন্যরকমের দ্যুতি খেলছে। লোকটার খুব কাছে এসে একটা অদ্ভুত সুন্দর ঘ্রাণ পেল, কিছুটা মাদকীয়! পুরুষ পুরুষ ঘ্রাণ কি একেই বলে?

সে সব যাক! যে কাজের জন্য এসেছিল, সেটা আপাতত করা যাক! মাথাটা ঝুঁকে নিচের ঠোঁটটা কামড়ে ধরল। আড়চোখে লোকটার পিঠের দিকে তাকিয়ে, কাঁধ এগিয়ে হালকা ধাক্কা লাগাল। অসাবধানতাবশত লোকটা পিছিয়ে গেল, অবাক হলো, চোখ মুখে প্রবল অস্বস্তিভাব উপচে পড়ল যেন! কুন্দন চোখ নামিয়ে ফেলেছে, চেহারা দেখেনি। গতি সেই আগের মতো বাড়িয়ে সেভাবেই দৌড় লাগাল।

ক্ষণিকের মাঝেই কুন্দনের অধর প্রসারিত হলো, তার চোখ হাসতে লাগল। প্রেম হয়নি! তবে কিছু একটা হয়েছে! অন্যরকমের কিছু একটা! অদ্ভুত অদ্ভুত ভাবটা! যার ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে, সংজ্ঞায়িতও করা যাচ্ছে। সে থামল সাইন্সের ভবন থেকে বেরিয়ে কিছুটা পেছোনে। কিছুক্ষণের মাঝেই সেখানে জয়া এলো।

প্রশ্ন করল, “প্রেম হলো?”

স্মিত হেসে কুন্দন বলল, “ইনফ্যাচুয়েশন হলো।”

“এরপর?”

“এরপর আর কী! ওসব প্রেম-টেম বলতে কিচ্ছু হয় না। বোঝা শেষ আমার। চল, ভিজি!”

“প্রেমবৃষ্টিতে?”

“উঁহু! দুঃখ-বৃষ্টিতে।”

“যাহ্! দুঃখ কেন?”

“কারণ আজ আমার মন খারাপ।”

“এই না ভালো ছিল?”

“হ্যাঁ, এখন নেই। মেয়ে-মন হচ্ছে আকাশের মতন; কখন শরতের সুখ-মেঘ হয়ে উড়বে, আর কখন ধূসররঙের দুঃখ-মেঘ হয়ে গুমোট বাঁধবে, বোঝা দায়। ওমন সুদর্শন পুরুষের সাথে ধাক্কা খেয়েও মোহময়ী কুন্দনিকার প্রেম না হওয়ার জন্য তাকে কঠোরভাবে প্রেমদণ্ডে দণ্ডিত করা হোক। এখন আগামী আটচল্লিশ ঘন্টা সে দুঃখ বিলাস করবে। এমন কষ্টের তুমি কী বুঝবে, জয়া বাবু?”

জয়া মিনমিনে স্বরে বলতে থাকল, “আরও ছাতার মাথা প্রেমের উপন্যাস পড়!”

___
দিব্য অবাক হয়ে তাকিয়ে ভাবল—আজকালকার মেয়ে-ছেলেরা কী উশৃঙ্খল হয়ে গেছে! এভাবে একটা পুরুষকে কোনো মেয়ে কী করে ধাক্কা দিতে পারে! সে খুব করে ধরতে পেরেছে—ব্যাপারটা সম্পূর্ণ ইচ্ছাকৃত! মেয়েটাকে আরেকবার সামনে পেলে কষিয়ে একটা থাপ্পড় লাগাতে ভুলবে না। আলে-গালে থাপড়াতে থাপড়াতে বলবে, “এত ফ্যান্টাসি আসে কোত্থেকে তোর? বল! আজ তোর সব সখ মেটাব। নে, আরেকটা থাপ্পড় খা।”

বলতে বলতেই রাগ তার বাড়তে লাগল। ঠিক তখনই কল এলো সিঁথির। দিব্য রিসিভ করে বলল, “বলো!”

সিঁথি শুধাল, “কই আছ এই বৃষ্টির মাঝে! খুঁজে পাচ্ছি না যে!”

“আমি সাইন্সের বিল্ডিংয়ে আছি।”

“ওখানে?”

“হ্যাঁ, ঘুরে দেখছিলাম!”

“এই বৃষ্টিতে?”

“বৃষ্টির আগেই এসেছিলাম।”

“ওহ্ আচ্ছা!”

“হুম।”
থামল দিব্য। গম্ভীর শ্বাস ফেলে জিজ্ঞেস করল, “ও কী করছে?”

সিঁথি বলল, “তেমন কিছু না। বাকিদের সাথে গল্প জুড়েছে। এখনও কী চঞ্চলই না আছে! একটুও পালটায়নি!”

হেসে কল কেটে দিলো দিব্য। প্রকৃতি জানে—কাকে কীভাবে মানায়! আর তাকে সেভাবেই রাখে। মেয়েটাকে এভাবেই মানায়। দিব্যর মন থেকে বেরিয়ে এলো একটাই দোয়া, ‘ও ভালো থাকুক।’

প্যান্টের পকেটে হাত পুড়ে ওখান থেকে সরতে যাওয়ার আগেই চোখ গেল ফের সেই কদম গাছটির কাছে। অবাক হলো! খুব বেশিই! একটা মেয়ে কী আনন্দে বৃষ্টিবিলাস করছে! কদম গাছের নিচটায় কাঁদাপানিতে লাফাচ্ছে। হালকা রঙা পালাজোর নিচের দিকটা কাঁদায় মেখে গেছে। কাটা চুলগুলো ভিজে মুখের সামনে লেপটে আছে। সে তবুও থামছে না, একটা ফুলের নাগাল পাওয়ার কী চেষ্টাই না করছে! অবশেষে ফুল হাতে পেল! চোখ মুখে কী অজানা সুখ লক্ষণীয় হলো!

দিব্য অনিমেষনেত্রে তাকিয়ে গেল। আশ্চর্যের কথা এ-ই—সে ভুলেই গেছে, খানিকক্ষণ আগে ধাক্কা মারার অপরাধে যেই মেয়েকে গালমন্দ করছিল, কয়েকটা থাপ্পড়ও অবশ্য দিতে চেয়েছিল! সেই মেয়েটিকে দ্বিতীয় দেখায় মনে ধরে গেল। না না! চোখে ধরল কেবল! এরপর মস্তিষ্কে ধরবে, তারপর না মনে! অনেক দেরি! অ-নে-ক!
মনকে কড়া শাসনে এনে দিব্য প্রস্থান ঘটাল।

চলবে..
(সবাইকে রেসপন্স করার অনুরোধ রইল🖤)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here