#আরশির_প্রতিমুখে
#পর্ব_৩ (বিয়ে)
—নবনীতা শেখ
বৃষ্টি কমতে কমতে বিকেল হলো! সন্ধ্যার আগ দিয়েই সবাই বিদায়ের জন্য তৈরি হয়ে গেল। ইন্দুপ্রভার সাথে এমন সময় দিব্যর আবারও দেখা হলো। চন্দ্রা তখন সিঁথির কাছে।
ইন্দু অকারণেই আজ খুব হাসছে। সে জানে—তাকে হাসলে খুব সুন্দর লাগে। গালের টোলটা দারুণ ভাবে মনোযোগ আকর্ষণ করে। ঠিক এই কারণেই সে সর্বদা হাসতে থাকে। তবে আজ তুলনামূলকভাবে একটু বেশিই হাসছে। হাসতে হাসতে দিব্যর দিকে এগিয়ে গেল।
দিব্য মুখ কুঁচকে ফেলল, “আমাকে কি জোকার লাগছে?”
হাসি না থামিয়ে দু-ধারে মাথা নাড়ল ইন্দুপ্রভা। দিব্য আবার শুধাল, “ননস্টপ জোক বলে যাচ্ছি আমি?”
ঠোঁট চেপে হাসি থামিয়ে বলল, “না!”
এই ‘না’ বলার ধরণটা বেশ নাটকীয় ছিল। বলা শেষ হতে না হতেই, আবারও ফিক করে হেসে দিলো। চেতে উঠল দিব্য, “তো এভাবে মরার মতো হাসছিস কেন তুই? তোকে কাতুকুতু দিচ্ছি আমি?”
ইন্দুপ্রভা আরও শব্দ করে হেসে উঠল। হাসতে হাসতে বলল, “তোর কনফিউজিং ফেইসটা যা জোস! দেখলেই হাসি পাচ্ছে!”
দিব্যর রাগ লাগল। শক্ত গলায় বলল, “আমি মোটেও কনফিউজড না।”
“তো? চেহারায় কী দেখা যায়?”
“সেসব তোর না ভাবলেও চলবে। ফোন হাতে নে, তারপর বরকে কল দে। রসিয়ে রসিয়ে জিজ্ঞেস কর—বাবুর আব্বু, কী করতেছ তুমি? আইম্মিইসিউউ!”
ইন্দুপ্রভা অনেক কষ্টে হাসি আটকাল, থেমে থেমে বলল, “সেসব আমি বলবই! তুই না বললেও বলব।”
“তা বল! আমার কাছে কী? দূর হ এখান থেকে।”
“যাব না, কী করবি?”
“ক্লাস টেনে থাকতে কী করেছিলাম—মনে নেই? তোকে ওদিক থেকে সরে আমার পাশে আসতে বলাতে, আসিসনি তুই। তাই হাতের কাছের ঘড়িটা ছুঁড়ে মেরেছিলাম। আয়নায় গিয়ে দেখ, কপালে এখনও দাগ আছে।”
“সে অনেক আগের এক কাহিনি। এখন তুইও আর বাচ্চাটি নেই, আমিও অন্য ছেলের পাশ-ঘেঁষে দাঁড়িয়ে নেই।”
থমথমে মুখে তাকাল দিব্য। আবারও হেসে ফেলল ইন্দুপ্রভা। গুনগুন করে গাইতে লাগল,
“প্রেমে পড়েছে মন! প্রেমে পড়েছে!
অচেনা এক মানুষ আমার বন্ধুকে পাগল করেছে!”
কড়া দৃষ্টিতে তাকাল দিব্য। ইন্দু ভাবলেশহীনভাবে বলল, “আমি কিছু দেখিনি। কেউ যে ওই বিল্ডিংয়ের নিচতলায় দাঁড়িয়ে কদম গাছের নিচে একটা মেয়েকে লাফাতে দেখে দুনিয়া ভুলে গেছিল—আমি দেখিনি। ট্রাস্ট মি! কিচ্ছু দেখিনি।”
“দেখিসনি না?”
“একদম না।”
“আজ তোর হচ্ছে!”
এই বলে দিব্য সিরিয়াসমুখে ইন্দুপ্রভার দিকে এগোল। চাঞ্চল্যময়ীকে আর পায় কে! দৌড়াতে শুরু করল শাড়ির কুঁচি চেপে ধরে। পিছে পিছে দিব্যও দৌড়াতে লাগল। ঠিক সেই মূহুর্তে মানসপটে সকালের একটি দৃশ্য ভেসে উঠল। দিব্যর সাথে তামাশা রটিয়ে এভাবেই ভেগেছিল, এমনই ভাবে হাসতে হাসতে এগোচ্ছিল। সেই চলন, সেই স্বভাব, সেই আহ্লাদ, সেই শখ, সেই সব কিছু! শুধু মানুষ দুটো ভিন্ন। শুধু পার্থক্য এ-ই—একজনের পিছে দিব্য সব ছেড়ে-ছুড়ে ছুটেছে, আর অন্যজনের বেলায় সে কেবল তাকিয়ে থাকতে পেরেছে। একজন অতীতের প্রিয় অধ্যায়। আর অন্যজন! চাইলেই সে ভবিষ্যতের চির সত্যও হতে পারে।
আচ্ছা! দিব্য চায় কি?
এদিকে আশে-পাশের সকল বন্ধুরা মুগ্ধ চোখে ওদের দেখে গেল। কিছু বন্ধুত্ব কখনও শেষ হয় না। হাজার বছর বাদে দেখা হলেও সেই আগের মতোই থাকে।
____
সেই ঘটনার মাস পেরোল। কুন্দন বসে বসে টাইপিং করছে। ফেসবুকে খানিকটা লেখালিখির শখও তার আছে। লিখতে লিখতেই ফোনে ম্যাসেজ এলো একটা। গিয়ে ম্যাসেজটা ওপেন করতেই সে আশ্চর্য হলো। একটা প্রাইভেট নাম্বার থেকে ব্লাংক ম্যাসেজ!
পরপরই মস্তিষ্ক অন্য কাজে বিমুখ হওয়ায় বিষয়টা থেকে পুরোপুরি দূরে চলে এলো। খানিকক্ষণ বাদে রুমে প্রবেশ করলেন সুমনা বেগম। কুন্দনকে দেখে মিষ্টি করে হাসলেন। বিনিময়ে কুন্দনও হাসল। নিত্য নৈমিত্তিক কাজ এটা।
এগিয়ে গিয়ে কুন্দনের পাশে বসে বললেন, “কী করা হচ্ছে?”
কুন্দন বলল, “এমনিই! কিছু না।”
“একটা কথা ছিল!”
“এত হেসিটেট ফিল করছ কেন? যা বলার বলে ফেলো!”
“আব্.. তোর ইয়াসিন চাচা আছে না?”
“কোন চাচা? আমার জানামতে বাপের তো ভাই নেই।”
“তোর বাপের চাচাতো ভাই।”
“ওহ্! তবে চিনলাম না। আচ্ছা, কী হয়েছে?”
“ওনার এক বন্ধুর ছেলে আছে।”
“তো?”
“বাবা-মায়ের একমাত্র ছেলে। বেশ সভ্য-ভদ্র!”
“আচ্ছা! ছেলেটাকে আমার কাছে পাঠাবে, আর এরপর আমি তাকে অসভ্য-অভদ্র বানাব, মানে ট্রেইনিং দেবো আর কী! তাই তো?”
কুন্দনের নির্লিপ্ততায় সুমনা বেগম কপাল চাপড়ালেন। কপালে হাত রেখেই আঁড়চোখে তাকিয়ে অবসন্ন কণ্ঠে বললেন, “তুই কি কিছুই বুঝতেছিস না?”
“না। বুঝতে পারছি না। এজন্য তোমার উচিত আমার সাথে খোলাখুলি ডিসকাস করা। উইল ইউ?”
“পারতেছি না। আর পারতেছি না। তোর ছোটোটাকে পাঠায় দিতেছি। থাক!”
সুমনা বেগম চলে গেলেন। কুন্দন যে একেবারেই কিছু বোঝেনি, ব্যাপারটা তা নয়! তার মতে—সবকিছু এত অস্বাভাবিকভাবে নিয়ে বুঝে ফেললে তো সমস্যা! বুঝেও অবুঝ হওয়ার যেই আনন্দটা, এটাও চমৎকার!
কিছুক্ষণ বাদে কুন্দনের ছোটো বোন কুমুদ রুমে প্রবেশ করল। ভ্রু-কুঁচকে নিয়ে বলল, “কী করছিস?”
কুন্দন একবার ওর দিকে তাকাল, আরেকবার নিজের ফোনে দৃষ্টি স্থির করে বলল, “লিখছি।”
“তৈরি হয়ে নে, তোকে দেখতে আসবে।”
“কখন আসবে?”
“বিকেলে।”
কুন্দন ঘড়ির দিকে তাকাল, দেখতে পেল—তিনটে বাজে। তারপর কুমুদকে বলল, “আম্মু কোন শাড়ি পরতে বলেছে?”
“কী জানি!”
“আচ্ছা, পাঠিয়ে দে। আমি তৈরি হয়ে নেব।”
এবার কুমুদ ডানে-বাঁয়ে সচেতন নজরে চোখ বুলিয়ে নিল। এগিয়ে গিয়ে কুন্দনকে চুপিচুপি শুধাল, “তোর বয়ফ্রেন্ড নাকি ওটা?”
কুন্দন শুধাল, “কোনটা?”
“যে দেখতে আসছে!”
“বয়ফ্রেন্ড কি না জানি না! হলেও অন্য মেয়ের হতে পারে, তবে আমার না।”
“বুবু, তাহলে তুই এত ঠিক কীভাবে আছিস?”
“বেঠিক থাকার কথা?”
“অবশ্যই! তোকে একটা অচেনা-অপরিচিত ছেলে পরিবারসহ দেখতে আসবে, তাতে কি তুই খানিকটাও নারভাস হবি না?”
“হওয়ার কথাও তো নয়। মেয়ে দেখতে আসা পরিবার ৭০%-ই মেয়েকে প্রথমবার দেখতে আসে, সেক্ষেত্রে মেয়ের কাছে তারা সম্পূর্ণ অপরিচিত, অচেনাই ধরা যায়।”
“তা-ও!”
কুন্দন কুমুদের গালে হাত বুলিয়ে বলল, “মেয়ে হয়ে জন্মেছি, দেখতে তো আসবেই! এতে অস্বাভাবিকত্বের কিছুই নেই।”
“কিছুই নেই?”
“না, নেই।”
“বুবু, তাহলে কি তোর এই বয়সেই বিয়ে হয়ে যাবে?”
“হলে হবে!”
“আমি তোকে ছাড়া থাকতে পারব না।”
“মেয়েরা সব পারে। সব সুষ্ঠুভাবে গুছিয়ে-সামলিয়ে চলতে পারে, চালাতেও পারে।”
কুমুদ ছলছল চোখে তাকাল। কুন্দন তাতে হেসে বলল, “জলদি আম্মুকে বল শাড়ি-গয়না পাঠাতে। সাজতেও তো হবে নাকি! নয়তো ছেলেবাড়ির লোকেরা বলবে, মেয়েটার বিয়েতে মত নেই! আমার আবার বিয়ের খুব শখ!”
কুমুদ দ্রুত পায়ে চলে গেল, আবার ফিরে এসে প্রয়োজনীয় সামগ্রী দিয়ে প্রস্থান ঘটাল। সবটাই ঘটল অতিদ্রুত! কুন্দন কুমুদের যাওয়ার পানে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তারপর হালকা গোলাপি রঙা কাতান শাড়িটা সুন্দর মতো পরে নিল।
____
সন্ধ্যার আগ দিয়ে কুন্দনকে দেখতে আসা হলো। ছেলে, ছেলের বাবা আর ছেলের বান্ধবী এসেছে। মেয়েকে তাদের ভারি পছন্দ হলো। সবার মিলিত সিদ্ধান্তে ঘন্টা দুয়েক পরে, সে রাতের মাঝেই বিয়ে পড়ানো হলো। রাতারাতি কুন্দনিকা এক বাড়ির মেয়ে থেকে আরেক বাড়ির বউ হয়ে গেল। বিদায় বেলায় আর পাঁচটা মেয়ের মতো সে কাঁদল না, কিংবা কোনোরূপ খুশিও প্রকাশ করল না। নির্লিপ্ত রইল। আর তার কান্নাটা কেঁদে নিল কুমুদ। সে কী কান্না! দু’বার তার সদ্য বিয়ে করা বরকে ধাক্কা অবধি মেরেছে। আর বলেছে, ‘আমার বুবুকে আমি দেবো না।’
কুন্দনের এদিকে খানিকটা হাসি পেল, সে হাসল না। বিদায়ের আগমুহূর্তে একবার শুধু বাবার বাড়ির দেয়ালগুলো ছুঁয়ে গেল। কী আশ্চর্য! ঘন্টা কয়েক আগেও সে কত নিশ্চিন্তে ছিল! হুট করে কী থেকে কী হয়ে গেল!
কুন্দন গাড়িতে উঠতেই, পাশে তার বর বসল। নিজ থেকে জিজ্ঞেস করল, “কোনো সমস্যা হচ্ছে?”
কুন্দন ডানে-বাঁয়ে মাথা নেড়ে বলল, “হচ্ছে না।”
“আচ্ছা!”
লোকটা আর কিছু বলল না। এদিকে কুন্দন চোখও সরাল না। একদৃষ্টে চেয়ে রইল স্বকীয় স্বামীর দিকে। বরটা সুদর্শন বটে!
চলবে?