#আরশির_প্রতিমুখে
#পর্ব_৪ (অন্ত)
—নবনীতা শেখ
“দ্বিতীয়বার কাউকে মনে ধরার অনুভূতি বোঝো, মেয়ে?”
সদ্য বিয়ে করা বরের মুখে এমন কথা শুনে ভ্রুকুটি করে তার দিকে তাকাল কুন্দন। কুন্দনকে নিজের দিকে তাকাতে দেখে দিব্য হেসে ফেলল। মাথা দু-ধারে দুলিয়ে বলল, “আমার সাথে তা-ই হয়েছে!”
কুন্দন এবার শুধাল, “ওহ্ আচ্ছা! এরপর?”
দিব্য আবারও হেসে ফেলল। বলল, “সেই স্কুল লাইফে একটা মেয়েকে মনে ধরেছিল। খানিকটা চঞ্চল, অগোছালো, ঠোঁট কাটা, যা-তা করার মানসিকতা সম্পন্ন এক মেয়েকে! তারপর এলো বাঁধা।”
“স্কুল-কলেজের প্রেম টেকানোর জন্য অনেক সাধনা করে যেতে হয়, মশাই!”
“সেই সাধনাই আমি করিনি। মনে ধরাটা পুরোটাই আমার ভুলবশত ছিল। উঠতি বয়সের বাচ্চা ছিলাম। সামনে যে-কোনো কিছু এনে দিলে কৌতূহল চলে আসত। আর আমার সামনে রাখা হলো আমার বেস্ট ফ্রেন্ডকে। বারো বছরের ফ্রেন্ডশিপ ছিল, বুঝলে? তাকে কাছ থেকে দেখতে দেখতে কবে যে ডুব দিলাম, বুঝতেই পারলাম না! সাঁতরাতে সাঁতরাতে দেখি, আমার কোনো কূল নেই। ওভাবেই ভেসে বেড়াতে রইলাম।”
চাপা স্বরে কুন্দন শুধাল, “মেয়েটিতে কী সমস্যা ছিল?”
“ও সনাতনী ধর্মাবলম্বী ছিল।”
চকিতে চাইল কুন্দন। শুকনো ঢোক গিলে বলল, “নিষিদ্ধ প্রেম! নিষিদ্ধ পরিণতি!”
“হ্যাঁ, তা-ই!”
“এরপর?”
“প্রেমে পড়া থেকে তো নিজেকে আটকাতে পারিনি, তবে এগোনো থেকে আটকেছি। আজ সে অন্য কারও বউ, বাচ্চাও আছে।”
মুখ ফসকে কুন্দন বলে ফেলল, “আলহামদুলিল্লাহ্!”
সরু চোখে তাকাল দিব্য। তারপর সে নিজেও হেসে দিয়ে বলল, “আলহামদুলিল্লাহ্!”
হাসি কমিয়ে দিব্য আবার বলল, “আর এরপর ঘটল এর চেয়েও বেশি ইন্ট্রেস্টিং ঘটনা।”
“কী ঘটল?”
“দ্বিতীয়বার একটা মেয়েকে মনে ধরে গেল। আশ্চর্যের বিষয় এটাও না। অবাক করা ব্যাপার হলো—দুজনের মাঝেই অদ্ভুত মিল লক্ষ করলাম আমি। দুজনের প্রতি অনুরোক্তি আসে এক বৃষ্টির বিকেলে, স্কুল ক্যাম্পাসে, সেম সিচ্যুয়েশনে, সেম টাইমিংয়ে, সেম মোমেন্টে, সেম স্টাইলে!”
“একই রকম দুজন?”
“আরশি চেন, মেয়ে? আরশির প্রতিমুখে অবস্থানরত দুজন একে অন্যের সদৃশ্য হয়, অথচ কাজ-কর্ম সব বিপরীতে। আমার প্রথম ভালোবাসা আর দ্বিতীয় ভালোলাগা দুটো ছিল আরশির প্রতিমুখী।”
কুন্দন বোকা বোকা চোখে তাকিয়ে রইল। দিব্য বলল,
“বোঝোই তো, ছেলেবেলার পছন্দ আর এই সময়ের পছন্দে থাকে বিস্তর ফারাক। সেই দুটো মেয়ের মাঝে এমনই কিছু ছিল। তবে ছিল একই টান। প্রথমজন আমাকে ১৮টা বছর ভালো থাকতে দেয়নি। দ্বিতীয়জন আমাকে টানা তিন মাস একটানা ভাবিয়েছে। এবারের জন দ্বিধায় ফেলতে পারেনি! কারণ বাঁধা নেই যে! তারপর পুরো ক্যাম্পাসে অনেক খুঁজে তাকে আবারও পেলাম। আর সব ব্যবস্থা করে তাকে নিজের করে নিয়ে এলাম। ম্যাডাম, এইটুকুও তর সইছিল না আর!”
“আমি?”
“আচ্ছা, ধাক্কা লাগলে কি প্রেম হয়?”
চকিতে তাকাল কুন্দন। শুধাল, “কী?”
হেসে ফেলল দিব্য, “প্রেম হয়েছে কি না, জানি না! তবে ইনফ্যাচুয়েশন অবশ্য হয়েছিল। ঘুম হারাম হয়ে গেছিল, নাওয়া-খাওয়া মুশকিল হয়ে পড়েছিল।”
লাজ গোপন করে বলল, “চিজি ফিলমি ডায়লগ!”
দিব্য হো হো করে হেসে উঠল। আজ হঠাৎ কুন্দনের খুব লজ্জা লাগছে। মুখ সরিয়ে গাড়ির জানালার বাইরে তাকাল। আস্তে করে বলল, “আর কতক্ষণ লাগবে?”
জবাবে দিব্য বলল, “বাড়ি ক্রস করে এসেছি। আমরা এখন সাভার যাব।”
“সেখানে কেন?”
“মায়ের কবর। মা তো বিয়েতে থাকতে পারল না, না-হয় আমিই গিয়ে বউ দেখিয়ে নিয়ে আসি।”
কুন্দন মলিন হেসে বলল, “আচ্ছা।”
দিব্য তখন উদ্বীগ্ন ভঙ্গিতে ফোন বের করল। দ্রুত গতিতে একজনকে কল লাগাতে গেল। তার আগেই কুন্দনের চোখ গেল কন্ট্যাক্টে সেভ করা সেই নম্বরটির নামে; সেখানে লেখা ‘চাঁদ’। ব্যাপারটা দিব্য খেয়াল করল না। অথচ সে এডিট করে নামটা চেঞ্জ করে ফেলল। তারপর চাঁদের পরবর্তী নাম হলো, ‘দূরের মানুষ’!
দিব্য ভিডিয়ো কল লাগাল সেই দূরের মানুষকে। সেকেন্ডের ব্যবধানে কল রিসিভ হলো। ওপাশ থেকে ইন্দুপ্রভা বলল, “কী রে! হঠাৎ কল দিলি যে!”
দিব্য ছেলেমানুষি করা শুরু করল। কুন্দনের একটু কাছ ঘেঁষে এলো। ক্যামেরাতে দিব্যর পাশে অদ্ভুত সুন্দর একটা মেয়েকে বসে থাকতে দেখে ইন্দুপ্রভা চোখ বড়ো বড়ো করে তাকাল। মুখের সামনে হাত নিয়ে কেশে উঠল। তারপর বলল, “বিয়ে ডান?”
দিব্য মাথা উপর-নিচ নেড়ে বলল, “ইয়েস!”
“ভেরি গুড। এবার তোর বউকে দে, কথা বলব।”
দিব্য ফোনটা কুন্দনকে দিলো। ইন্দু কুন্দনকে বলল, “শোনো! খুব জ্বালাবে ও, একদম সব মেনে নেবে না। কিছু বলবেও না, কেবল খাবারের ঝালটা বাড়িয়ে দেবে। ও একদম ঝাল খেতে পারে না। আর খুব সমস্যা হলে আঙ্কেলকে বলে দেবে। কখনও কম্প্রোমাইজ করবে না। আর চুপিচুপি একটা কথা বলি শোনো, আমার পুরো বিশ্বাস—তুমি পৃথিবীর সবচেয়ে চমৎকার মানুষকে পেয়েছ। ভালো থাকবে ভীষণ, বিনিময়ে ভালো রাখার দায়িত্বও নিতে হবে। পারবে না নিতে?”
কুন্দন জবাবে মুচকি হাসল। ইন্দুপ্রভা বলল, “ব্যাস! এতেই হবে।”
দিব্য কুন্দনের আরও কিছুটা কাছে এসে ইন্দুপ্রভাকে বলল, “জোস না?”
ইঙ্গিতটা ইন্দুপ্রভা বুঝেছে। ইন্দুপ্রভাও বোঝাল, “আসলেই জোস!”
“তোর চেয়েও বেশি জোস!”
ইন্দুপ্রভা হেসে বলল, “হ্যাঁ, আমার চেয়েও বেশি।”
তারপর আরও কিছুক্ষণ এরকম কথাবার্তা বলে কল কেটে দিলো দিব্য। কুন্দন জিজ্ঞেস করল, “আপনার বাসায় কে কে আছে?”
“বাবা আর আমি।”
“আর কেউ নেই?”
“না। বাবা-মার লাভ ম্যারেজ ছিল। বাবা চট্টগ্রামের ছিল, আর মা রংপুরের ছিল। পরিচয়টা হয় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। এরপর যখন তারা পরিবারকে নিজেদের সম্পর্কের বিষয় জানায়, কেউ মেনে নেয়নি। তারা ঢাকায় চলে আসে, এখানে একাকী থাকা শুরু করে। আমার জন্মানোর সময় মা মারা যায়। তারপর থেকে পরিবার বলতে বাবা আর আমিই আছি। আজ থেকে আমাদের দুজনের ছোট্ট পরিবারটি তিনজনের হলো।”
কুন্দন তাকাল দিব্যর দিকে। হেসে দিয়ে দিব্য বলল, “মিসেস কুন্দনিকা, শেখ পরিবারে আপনাকে স্বাগত!”
“শুকরিয়া শুকরিয়া!”
কুন্দন স্বাভাবিক হলো। কিছুক্ষণের মাঝেই তারা পৌঁছে গেল দিব্যর মায়ের কবরের সামনে। দিব্য কুন্দনকে ফেরার পথে কিছু বেলি ফুল কিনে নিয়েছিল। বাবার কাছে যেদিন থেকে জানতে পেরেছিল—তার মা বেলিপ্রিয়া, সেদিন থেকে প্রতিবার এখানে আসার সময় বেলিফুল আনা তার জন্য আবশ্যক হয়ে পড়ে ছিল।
দিব্য সেখানে ছিল মোটে সাতাত্তর মিনিট। এই এতটা সময়ে সে কোনো কথা বলেনি। কেবল কবরের দিকে তাকিয়ে ছিল। কুন্দনও কিছু বলেনি। সে আশে-পাশে তাকায়। সন্ধ্যার সেই সময়ে কেমন যেন স্তব্ধ হয়ে ছিল প্রকৃতি। গাছের পাতাও নড়ছিল না।
একদম শেষ মুহূর্তে দিব্য কুন্দনের হাত ধরল। কবরের দিকে দৃষ্টি স্থির রেখে ওষ্ঠ কোনে চাঁদের ফালির মতো হাসি এঁটে বলল, “মা, আমি সুখ পেয়ে গেছি। এই সুখকে অসুখ হতে দেবো না।”
বাড়িতে ফিরতে ফিরতে বাজল রাত বারোটা। দিব্য তাকে জানাল, “আমি খুব বেশি ভালো না, তবে খারাপ একেবারেই নই। খুব রসিক না, তবে রাগী একেবারেই নই। খুব একটা হাসি না, তবে দুঃখবিলাসী একেবারেই নই। আমার সাথে সংসার করাতে ঝামেলা অবশ্য হওয়ার কথা নয়।”
কুন্দন প্রসস্থ হেসে বলল, “সেম টু ইউ!”
দিব্য বলল, “কিছু সময়ের ব্যবধানে তোমার জীবনকে পালটে দেওয়ার জন্য সরি আমি বলব না। সবকিছু সুষ্ঠুভাবে হলে তো সমস্যা। মাঝে মাঝে হোক না কিছু চমকপ্রদ ব্যাপার-স্যাপার।”
কুন্দন হেসে নিয়ে বলল, “আমি অতটাও সাধারণ কিছু নই।”
“আই নো, ম্যাডাম!”
দিব্য কুন্দনের দুবাহুতে ধরে পিছে ঘোরাল। ড্রেসিং মিররে কুন্দন নিজের প্রতিবিম্ব দেখতে পেল, ঠিক পাশে স্বকীয় স্বামীকে।
দিব্য বলল, “প্রথমে স্বামী হলাম, এরপর তোমার প্রেমিক হব। প্রেমে পাগলামি করার বয়স আর আমার নেই। তবে তোমার সাথে আমার হবে ম্যাচিউর একটা প্রেম। এই প্রেমগুলো সাংঘাতিক হয়। কারণ সচরাচর প্রেমের মতো এটা নিষিদ্ধ প্রেম নয়। সবচেয়ে শুদ্ধ প্রেম, সবচেয়ে ভয়ঙ্কর প্রেম।”
“প্রেমে উন্মাদ হয়ে যাবেন, মশাই।”
“যাব আর কই? যেখানে লক্ষ্য স্বয়ং আপনি।”
“প্রিয় পুরুষ, আমার বোধহয় নাইওর যাওয়া উচিত। প্রেমে পড়ার পরই ফিরব।”
“কালই ব্যবস্থা করছি।”
আরশির প্রতিমুখে দৃষ্টি স্থির রেখেই কুন্দনিকা হাসল, দিব্য নিজেও হাসল।
_____
পরিশিষ্ট:
দিব্য, কুন্দনিকা!
তাদের প্রেমটা ঘটা করে হয়নি। বিয়ের বছর চারেক গেল, আজও একে-অপরকে ‘ভালোবাসি’ বলা হয়নি। অথচ, জীবনটাও থেমে থাকেনি। ছন্নছাড়া চেতনার কুন্দনিকা সংসারী হয়েছে! একে-অপরকে কখনই তারা নিজেদের প্রয়োজনের বহিঃপ্রকাশ করে না। না বললেও কুন্দন বুঝে যায়—দিব্যর এখন এটা প্রয়োজন। দিব্যর ব্যাপারটাও তাই।
কিছু সম্পর্ক থাকে অদৃশ্য সুতোয় গাঁথা। কেউ কখনই বাইরে থেকে দেখতে পারে না—সুতোটার আকৃতি-প্রকৃতি কেমন, কতটুকু বিস্তার! কেবল সুতোয় গাঁথা দুজন তা অনুভব করতে পারে। দিব্য-কুন্দন সবসময় সেটা অনুভব করছে।
একটা ভালো উদাহরণ দিই। দিব্য এখন ঘরমুখো হয়েছে, যতটুকু সম্ভব ঘরে থাকে। সবাইকে বলে—কাজ জলদি শেষ! ব্যাপারটা তা নয়। কুন্দনকে বেশিক্ষণ না দেখে সে থাকতে পারে না, শান্তি লাগে না। তাই তো বাড়ি ফেরার এত তাড়া, সব ছেড়ে-ছুড়ে জলদি জলদি বাড়ি ফেরা।
সন্ধ্যে বেলা কুন্দন যখন চায়ের কাপ নিয়ে বারান্দায় বসে ছিল, অফিস থেকে ফিরে দ্রুত দিব্য কুন্দনের কাছে গেল। পেছন থেকে জড়িয়ে ধরল। কুন্দন ঘাবড়ে যায়নি। চায়ের কাপটা আলতো করে কর্ণার বক্সের উপর রেখে বলল, “বলো!”
দিব্য হেসে বলল, “খুব জ্বালাচ্ছ!”
“আর?”
“একটুও শান্তি দিচ্ছ না।”
“আর?”
“একদমই স্থির হতে পারছি না।”
“আর?”
“মাথা খারাপ করে দিচ্ছ।”
“আর?”
“সব ক্ষেত্রে পার্ফেক্ট আমিটা তোমার কাছে এলোমেলো হয়ে পড়ি!”
হেসে ফেলল কুন্দন, “আমিও।”
“আমার অপারগতা সব তোমায় ঘিরেই..”
“আমারও।”
“তাই বলে যে—আমি তোমায় খুব ভালোবাসি, ব্যাপারটা তেমনও না। আমি কিন্তু তোমায় সামান্যও ভালোবাসি না।”
“আমিও না।”
~সমাপ্ত~
পাশে থাকার জন্য সকলকে ধন্যবাদ। ভালোবাসা নেবেন❤️