#অমানিশায়_সেই_তুমিই
#লেখায়_তেজস্মিতা_মর্তুজা
২০.
শুক্রবার দিন। বাড়িতে ইমতিয়াজ সাহেবের এক ব্যাবসায়ীক ক্ষেত্রের পরিচিত লোকের পরিবার আসছে। এরকম মাঝেমধ্যেই অনেকেই আসে। আনতারা খানম বহু দ্বিধা-সংকোচ কাটিয়ে শেষমেষ উপস্থিত হলেন মেঘালয়ার রুমের সম্মুখে। মেঘালয়া আনতারা খানমকে দেখে বিশেষ কোন খারাপ ভালো কিছুই প্রতিক্রিয়া দেখাল না। আজকাল ভয় হয় খুব, সেই সঙ্গে পুরোনো ব্যথা! না জানি কি কথা শুনাতে এসেছে! আনতারা খানম নিরস, গোমরা মুখেই কোন শিরনাম ছাড়াই বললেন,
“গোসল করে একটা শাড়ি পরে নিও। মেহমান আসছে।ʼʼ
মেঘালয়া কিছু বলল না। আনতারা খানম চলে গেলেন। যেহেতু ইরাজের বিয়েতে ঘটা করে অনুষ্ঠান করা হয়নি। আর তাছাড়াও মেঘালয়া বাড়ির বউ। এ এক ঐতিহ্যও বটে, বাড়ির বউ শাড়ি পরবে।
মেঘালয়া অনিচ্ছা সত্তেও শাড়ি বের করতে আলমারী খুলল। শাড়ি আছেই মোটে তিনটা। একটা বিয়ের শাড়ি, সেটা অবশ্য খুব বেশি ভারী সাজের নয়। ইচ্ছে করলে এমনিতেও পড়া যায়। তবুও মেঘালয়া বাকি দুটোর মাঝে দেখল। একটা সেদিন পড়ে গিয়েছিল। এই দুটো শাড়ি মেঘালয়ার আগে কেনা। সে ফুফাতো বোনের বিয়েতে এবং কলেজের বিদায় অনুষ্ঠানে কিনেছিল। সেটাকে নেড়েচেড়ে দেখতে থাকল।
ইরাজ হন্তদন্ত হয়ে রুমে প্রবেশ করল। সে আজ সকাল সকাল বেরিয়েছিল কোথাও। মেঘালয়া একবার তাকাল। বড়ো অস্থির আর অগোছালো লাগছে দেখতে ইরাজকে। ঘর্মাক্ত শরীর, এলোমেলো চুল। চমকপ্রদ ভাবে নজরে এলো, ইরাজের হাতের সদ্য হওয়া ক্ষতটি। মেঘালয়া উঠে দাঁড়াল। ইরাজ ব্যস্ত হয়ে কিছু খুঁজছে। মেঘালয়া জিজ্ঞেস করল, “কী খুঁজছেন? হাত কাটল কী করে?ʼʼ
ইরাজ কেবল প্রথম প্রশ্নেরই জবাব দিল, “স্যাভলন কোথায় রেখেছিস?ʼʼ
“আপনি বসুন, আমি দিচ্ছি।ʼʼ
“ঘরের জিনিস উল্টোপাল্টা করতে বলে কে তোকে?ʼʼ
মেঘালয়া ড্রেসিং টেবিলের কাঁচ খুলে উপরের তাক থেকে স্যাভলন বের করতে করতে বলল, “ঘর উল্টোপাল্টা করার দায়টা একচ্যুয়ালি আপনার। হাতের ব্যাথায় মাথা ঠিক নেই, আমার কথা বলে ফেলেছেন। আমি তো কেবল ঘরের পরিচর্যা করি। সবকিছু তার সঠিক জায়গায় গুছিয়ে রাখি।ʼʼ
মেঘালয়ার শীতল জবাবে ইরাজ মুখ ভার করে আড়চোখে তাকিয়ে রইল। তুলো নেই ঘরে, মেঘালয়া টিস্যুবক্স থেকে কয়েক টুকরো টিস্যু নিয়ে এসে ইরাজের পাশে বসল। ইরাজ খপ করে কেঁড়ে নিল এন্টিসেপটিক এর বোতলটা। বলল, “বহু জ্ঞানের বাণী শুনিয়েছিস। এবার গিয়ে আমার খাবারের ব্যবস্থা কর।ʼʼ
“প্রাথমিক চিকিৎসা আগে দিই। তারপর খাবার।ʼʼ
“না, তোর চিকিৎসা লাগবে না। দেখা যাচ্ছে তোর হাত পড়ে এখানে জীবাণু ইনফ্র্যকশন হয়ে গেল।ʼʼ
মেঘালয়ার এ কথায় রেগে যাওয়ার কথা থাকলেও কেন জানি ঠোঁট চেপে হেসে ফেলল। ইরাজের হাত থেকে স্যাভলনের বোতল নিয়ে তাতে টিস্যু ভেজাল। ইরাজের হাত ধরতে কেমন দ্বিধা হচ্ছে। যদি হাত ছিটকে নেয়, বা কটুক্তি করে? মেঘালয়া মিনমিন করে বলল, “হাতটা দিন।ʼʼ
মেঘালয়ার ভাবনাকে মিথ্যা করে ইরাজ বিরক্ত মুখে হাত এগিয়ে দিল। স্যাভলন ক্ষততে লাগাতেই ইরাজের বদলে মেঘালয়া মুখ কুঁচকে নিলো। ইরাজ তা দেখে অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে বলল, “এক প্রাণ-দুই দেহ হয়ে গেল নাকি তোর আমার? আমার বদলে তুই কাঁদছিস কেন?ʼʼ
মেঘালয়া মনে মনে কপাল চাপড়াল। সে নাকি কাঁদছে, আল্লাহ! কী মুসিবত ত্যাড়া লোকের সাথে চলা!
মেঘালয়া এতক্ষণে জিজ্ঞেস করল, “কী করে কাটল হাত?ʼʼ
“তোর পুরোনো আশিককে আজ এ বাজারে পেয়েছিলাম।ʼʼ
মেঘালয়া দ্রুত মাথা উঁচিয়ে তাকাল, “মারপিট করে এসেছেন আপনি?ʼʼ
“মারপিট করব কী উপলক্ষ্যে?ʼʼ
মেঘালয়া চোখের পাতা ঝাপটাল কৌতুহলি দৃষ্টিতে তাকিয়ে। বলল, “তারপর?ʼʼ
“তারপর এগিয়ে গেলাম। কানে কানে একটা তরতাজা খবর দিয়ে এসেছি।ʼʼ
মেঘালয়া প্রশ্নাত্মক নজরে ভ্রু কুঁচকে রইল। ইরাজ কণ্ঠ খাঁদে নামিয়ে মেঘালয়ার দিকে এগিয়ে গিয়ে ফিসফিস কণ্ঠে বলল, “বলেছি, প্রেম তো তুই করেছিস, বাসর রাতের বেনিফিটটুকু কিন্ত আমিই গিলেছি। আমি ব্যাবসায়ী মানুষ তো, লসের পক্ষে নেই।ʼʼ
মেঘালয়া এমন একটা কথা শোনার জন্য প্রস্তুত ছিল না। সে কোনরকম প্রতিক্রিয়া দেখাতে ভুলে গেল। কিছু মুহূর্ত পার হতেই যেন জ্ঞান ফিরল। সঙ্গে সঙ্গে মাথা নত করে নিলো। আচমকা হাসি এসে জড়ো হলো ঠোঁটের কোণে। তবে ভাবনায় কিছু আসতেই কপাল কুঁচকে তাকাল, “আর তারপর মেরেছেন?ʼʼ
“উফফ! তার জন্য তোর এই দরদ! মানুষের পিরিত দেখতেও ভালো লাগে। শালা, আমরাই কী ছিঁড়লাম জীবনে!ʼʼ
মেঘালয়া কটমটিয়ে চেয়ে ক্ষতর স্থানে চেপে ধরল। ইরাজ মৃদূ চিৎকার করে উঠল, “খান্নাস!ʼʼ
“আমি শুধু জানতে চাইছি কাটল কী করে?ʼʼ
“বাড়িতে ঢোকার সময় আম্মা একটা দা আর নারিকেল দিল শরীরচর্চা করার জন্য। শালার, নারকেল এত সফ্ট, আর দা’তে নেই ধার। ছুটে এসে হাতে লেগেছে। দা’য়ে অন্তত তোর মুখের মতো ধার থাকলেও এই ঘটনা ঘটত
না।ʼʼ
মেঘালয়া ভাবল, এলো নিজের ত্যাড়ামির জোরে শক্ত পোক্ত নারকেধকেও সফ্ট বানিয়ে ছেড়েছে। কোনহাতে দা ধরেছিল, ডানহাতে কী করে লাগল। বলল, “তা ভালো। তবে যদি আপনার মুখের মতো ধার থাকতো— না জানি হাতটাই কেটে পড়ে যেত।ʼʼ
ইরাজ হাত ছাড়িয়ে নিলো, গম্ভীর মুখে তাকাল। উঠে চলে যেতে অগ্রসর হলো। মেঘালয়া জিজ্ঞেস করে, “খাবার কী রুমে এনে দেব?ʼʼ
“খাব না। বাইক ধুয়ে আসি, বাপ অপেক্ষা করছে।ʼʼ
“খাওয়ার চেয়ে জরুরী?ʼʼ
“আপাতত।ʼʼ
নিচে নামতেই আনতারা খানম গালি ঝারলেন কয়েকটা। দামড়া ছেলেকে খাওয়ার জন্য তাড়তে হয়। ইরাজের শরীর অবধিও বোধহয় পৌঁছাল না কথাগুলো। ডেটলের সুরক্ষা আছে তার চারপাশে, মানুষের কথার পরিপেক্ষিতে। নির্লিপ্ত হেঁটে হেলেদুলে বাইরে বেরিয়ে গেল। ইমতিয়াজ সাহেব অপেক্ষারত সেখানে। গাড়ি ধোয়া দিবস আজ বাপ ছেলের। তার হাত কেটেছে তা জানেন না আনতারা। ডানহাতে ক্লান্তি আসায় বামহাতে চেষ্টা করতে গিয়েই এই আকামটা হয়েছে। বামহাতে এমনিতেই স্বাভাবিকই জোর কম। নারকেলে কোঁ প দিতে গিয়ে ব্যালেন্স ছুটে গিয়ে ডানহাতে লেগেছে। তারপর বাঁকি নারকেল গুলো ইমতিয়াজ সাহেব ভেঙেছেন, ইরাজকে পাঠিয়েছেন সেবা নিতে। সেই নারকেল দিয়ে আনতারা বানাবেন মিষ্টি জাতীয় কোন খাবার।
মেঘালয়া শাড়ি নিয়ে বাথরুমে ঢুকল। এ বাড়িতে থাকলে যে-কেউ অলস হয়ে উঠবে। আগে তিনজন, এখন চারজনের পরিবার। সারাদিনে বাড়তি কোন কাজ নেই। এবং যা আছে আনতারা ও আয়েশা করে ফেলে। আনতারা মেঘালয়াকে ডাকেন না কোন কাজে। সে সারাদিন রুমের মাঝে পড়ে থাকে।
গোসল শেষে মেঘালয়া চুল ঝারতে ঝারতে বের হলো। পরনে তার আসমানী ও সাদার মিশ্রনে সজ্জিত একটি শাড়ি। কলেজের পোশাকটাও এ দুই রঙা ছিল বলে, সকলে এই রঙা শাড়ি কিনেছিল বিদায় অনুষ্ঠানে। মেঘালয়া এ সুযোগ পেয়েছিল কারন— তার থেকে ইরাজ তখন বহু দূরে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে।
ইরাজ রুমে ঢুকেই মেঘালয়াকে ওমন অর্ধজড়ানো শাড়িতে ভেজা চুলগুলো আনমনে তোয়ালেতে ঘষতে ঘষতে এগিয়ে আসতে দেখল। তড়াক করে পুরুষ হৃদয় থমকে যায় যেন! পা উঠল না ইরাজের। শাড়ির কুচি অবধি ঠিক থাকলেও ওপরে কোনরকম শাড়ির আচলটা চিকন করে বুকের মাঝ দিয়ে কাঁধে তুলে রাখা। আচমকাই ইরাজের মনে হলো, মেঘের শরীরে মেঘবরণ শাড়ি। না না, ঝড়ো মেঘ নয়; বরং শরতের আকাশে নীল-আসমানী ও সাদার জড়াজড়িতে ভেসে বেড়ানো পেঁজা তুলোর মতো মেঘ! মেঘালয়াকে ইরাজ আজই প্রথম, প্রথমবারের মতো এভাবে দেখল।
ইরাজ ঠিকমতো আগেও কোনদিন মেঘালয়ার দিকে তাকাত না। তার অনুভূতির সঙ্গে তার আচরণ মেলে নি কোনদিন। সে সংকোচই কাটিয়ে উঠতে পারত না। মনে হতো মেঘালয়াতে আটকে সে বড়ো অবাঞ্ছিত কাজ করে বসেছে। মনকে সংযত না করতে পারলেও, নিজের আচরণ ও নজরকে নিয়ন্ত্রণ করেছিল সে কষে। যখন মেয়েটার মায়ায় পড়েছিল ইরাজ, অধিকার হানা দিয়েছিল এই মেয়ের জন্য— তখন মেঘালয়া চৌদ্দ বছরের কিশোরী। খুব ছোটো না হলেও যুবতী ছিল না সে। যাকে ইরাজ সর্বদা রক্ষা করেছে, তার প্রতি অধিকার না জেগে যেত কোথায়?
আজ সেই মেঘালয়া তার বউ রূপে, তার ঘরে, এমন নারীবেশে দাঁড়িয়ে। পুরুষ মনে ধাক্কা লাগল কোথাও একটা। তবে কতক্ষণ, তার নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা যে অসীমের মতোই। দ্রুত নজর ফিরিয়ে নিয়ে চারদিকে অপ্রস্তুত দৃষ্টি ফেলল। মেঘালয়া ইরাজকে ওভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকে ফেলল। ইরাজের শরীর ভেজা। হাতে পায়ে ময়লা লেগে আছে। রেগে উঠল মেঘালয়া,
“এভাবে রুমে ঢুকেছেন? সবে সবকিছু পরিষ্কার করে গোসলে ঢুকেছি। বেক্কল ব্যাটাছেলে।ʼʼ
ইরাজ গম্ভীর কণ্ঠে ভার মুখে শুধাল, “শাড়ি কেন পরেছিস?ʼʼ
মেঘালয়া তাকাল ইরাজের এমন রাশভারী গলা শুনে। দৃষ্টি ফিরিয়ে নিজের দিকে খেয়াল দিতেই লজ্জায় ভেঙে পড়ল মেঘালয়া। তড়িৎ গতিতে ঘুরে দাঁড়িয়ে দ্রুত শাড়ির আঁচল জড়িয়ে নিল শরীরে। তারপর আড় আড়ষ্টতায় বুদ হয়ে মৃদূ স্বরে জবাব দিল, “মামনি বলেছে।ʼʼ
ইরাজ কপালে ভাঁজ ফেলে বলল, “কোন দুঃখে?ʼʼ
“বাড়িতে মেহমান আসার দুঃখে।ʼʼ
“মেহমান আসলে শাড়ি পরতে হয়; কোন বলদের হাতে, কোন কিতাবে ছাপা হয়েছে এই বাণী?ʼʼ
মেঘালয়া প্রতিবাদ করে ওঠে, “আপনার মতো পানসে তো আর না লোকে। অন্তত আমি তো মোটেই না। ওয়েট ওয়েট.. নিজে তো বাইরে বের হওয়ার সময় সাহেব সেজে বের হন। ছোটোবেলার থেকে অত্যাচার করে যাচ্ছেন, এটা করতে পারবা, সেটা করা যাবে না..
কথা ফুরোলো না। ইরাজের গম্ভীর মুখের দিকে চোখ যেতেই থেমে গেল মেঘালয়া। ইরাজ তীর্যক দৃষ্টি মেলে চেয়ে আছে মেঘালয়ার চোখের দিকে। মেঘালয়া এলোমেলো হয়ে উঠল। সে ইরাজের সম্মুখে আবারও অভিযোগ করে উঠেছে, যদিও কথাগুলো সে জটিল কিছু ভেবে বলেনি। কিন্ত ইরাজ তো বাঁকা! ইরাজ ভ্রু উঁচিয়ে আগ্রহের সাথে জিজ্ঞেস করল, “এরপর?ʼʼ
মেঘালয়া মাথা নত করে নিলো। ইরাজ আবার বলল, “কন্টিনিউ! আর কী কী করেছি, বল? আমারও মনে নেই অত, বল শুনে মনে করি।ʼʼ
মেঘালয়া মুখ খোলার আগেই ইরাজ হনহন করে বাথরুমের দিকে চলে গেল। মেঘালয়া হতাশ এক শ্বাস ফেলল।
চলবে..