#তোমার_আমার_চিরকাল🌸
|| পর্ব – ৫১ ||
#লেখনীতে_বিবি_জোহরা_ঊর্মি
আহানদের বাসার সদর দরজায় দাঁড়িয়ে আছে আহান ও মীরা। দরজার সামনেই গাঁধা ফুল ও গোলাপের পাঁপড়ি ছড়িয়ে সুন্দর একটা রাস্তা তৈরি করানো আছে। মীরা দেখে অবাক হয়ে যায়। আহান মীরাকে বলল, “ফুলের পাঁপড়ির উপর পা রেখে ভিতরে প্রবেশ করো মীরা।”
মীরা তার ডান পা টি রাখল। এরপর আস্তে করে পাঁপড়িগুলোর উপর হেটে আসতে থাকে। মীরা ভেতরে ঢোকার সাথে সাথেই সবাই তাকে স্বাগত জানায়। মীরার একটা অন্যরকম ভালো লাগে। যেন সে প্রথমবার বউ হয়ে এই বাসায় এসেছে। ফুলের পাঁপড়ি সিঁড়ির উপরেও ছড়ানো আছে। মীরাদের রুম পর্যন্ত এই ব্যবস্থা করে রেখেছে আয়ান। আহানের প্ল্যান ছিল এটা। আয়ান শুধু আহানের কথা অনুযায়ী কাজ করেছে। আয়ান একটা কেক নিয়ে আসে ট্রি টেবিলসহ। সে-ই কেকে লেখা আছে, “ওয়েলকাম ব্যাক।” মীরার শ্বশুর শাশুড়ী সবাই এগিয়ে এলেন। আহান মীরার হাত ধরে কেকটা কাটলো। মীরা চোখের পানি ফেলতে শুরু করেছে। সবাই তাকে এভাবে আবার বরণ করে নিবে কখনো ভাবেনি সে। মীরা কেক কেটে প্রথমে আহানকে খাওয়ায়।।তারপর তার শ্বশুর শাশুড়ীকে, এরপর আয়ানকে। মীরাদের আসার কথা ছিল কাল। কিন্তু মিরাজ তাদের আসতে দেয়নি। তাই আজ সকালেই তারা এসেছে। মীরাকে নিয়ে আহান সিঁড়ি ভেঙে উপরে চলে যায়। মীরা ফুলের পাঁপড়ির উপর পা ফেলতে ফেলতে উপরে যায়। রুমে এসে দেখে মীরাদের রুমটা অনেক সুন্দর করে গোছানো হয়েছে। যেখানে রান্নাঘর ছিল, এখন ওটা বারান্দার মতো করে দেওয়া হয়েছে। এ কয়দিনে এতো কিছু পাল্টালো কি করে? দেয়ালে মীরার একটা বড়ো ছবি টাঙ্গানো। তার পাশে আহান আর।মীরার বিয়ের কিছু ছবি ফ্রেম বন্দি করে টাঙ্গিয়ে রাখা হয়েছে। মীরা ওগুলো দেখছে, কত সুন্দর সব। নিজের ঘরকে আবারও নতুন রুপে ফিরে পেয়েছে সে। প্রচন্ড আনন্দিত হয়ে যায় মীরা। আহানকে জড়িয়ে ধরে বলে, “আমার জন্য এতোকিছু কেন করলেন আপনি?”
“ভালোবাসি যাকে, তার জন্য সব করা যায়। সব!”
–
ফাগুন উপলক্ষে ফাগুন উৎসব চলছে চারদিকে। কলেজে ফাগুন উৎসব হচ্ছে, তাই দিবা তাদের বাড়িতে চলে এসেছে। ওর পরিক্ষা আরো দুটো রয়েছে। ওর বন্ধবীরা বলল সবাই শাড়ি পড়ে কলেজে ফাগুন উৎসবে আসবে। দিবাও তাদের কথা ফেলতে পারেনি। মীরাদের বাসা থেকে দুইদিন আগেই সে এসে গেছে। ফাগুনের শাড়ি পড়ে সেজেগুজে কলেজে এসেছে ও। প্রথমে বান্ধবীদের সাথে দেখা করে, ছবি তোলে আর মন খুলে আড্ডা দেয়। কলেজে নাছ গান হয়। ওখানে কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে সে বান্ধবীদের সাথে বাহিরে চলে আসে। কলেজের সামনেই ফুসকার স্টল একটা দাঁড় করানো। সবাই মিলে ওখানে চলে গেল। ঝাল ঝাল ফুসকা অর্ডার করল সবাই। বান্ধবীদের সাথে হাসি ঠাট্টা করে ফুসকা খেতে থাকে দিবা। হঠাৎ চোখ পড়লো রাস্তার উত্তর দিকে বটগাছটার দিকে৷ একজনের চোখাচোখি হয়ে যায় সে। খাওয়া বন্ধ করে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। পাশে থাকা তার বান্ধবীরা তাকে ঠেলে জিগ্যেস করে, “ওদিকে কি দেখছিস? বয়ফ্রেন্ড নাকি!”
থমথমে খেয়ে যায় সে। কাশি উঠে যায় তার। তাড়াতাড়ি পানি খেয়ে নেয়। চোখ গরম করে বলে, “যা যানিস না তা নিয়ে কথা বলবি না।”
“কিন্তু তুই ওদিকে কি দেখছিস? ওখানে তো একটা ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। পরিচিত তোর?”
দিবা মিনমিনিয়ে বলে, “হ্যাঁ।”
একজন বান্ধবী উৎসাহ নিয়ে বলল, “এই কে হয় তোর? ছেলেটা কে আমার হেব্বি লেগেছে। প্রথম দেখায় ক্রাশ খেয়ে গেলাম।”
দিবা দাঁতে দাঁত পিষে জবাব দেয়। “সে বিবাহিত, তার দুটো বাচ্চাও আছে।”
এক বন্ধবী অবাক হয়ে বলে, “কিহ! এই বয়সে বিয়ে! আবার দুটো বাচ্চা! এই তুই মজা করছিস?”
“তোদের সাথে এখন মজা করার কোনো মুডই আমার নেই।”
“অবিশ্বাস্য! এই ছেলে দুই বাচ্চার বাপ!”
“শালার কপাল। ভাবলাম একটু লাইন মারব, কিন্তু এ-তো দেখি ডাবল। এই, তোর কে হয় রে।”
“ফুফাতো বোনের দেবর।”
“আজকাল দেবররাও দু বাচ্চার বাপ হয়ে যায়।”
“থামবি তোরা? চুপচাপ খা।”
দিবা তাড়াতাড়ি ফুসকা খেয়ে ফুসকার বিল মিটিয়ে দিল। তার বান্ধবীরা সবাই বাসে উঠে গেল। সে একা তার বাসায় যাবে। তার বাসা কাছেই। সবাই চলে যাওয়ার পর দিবা এগিয়ে এলো বটগাছের দিকে। আয়ান চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। দিবাকে দেখে সে দু কদম পিছিয়ে গেল৷ দিবা জিগ্যেস করল, “আপনি এখানে হঠাৎ?”
আয়ান বলে, “এক ফ্রেন্ড এর সাথে দেখা করতে এসেছিলাম।”
“দেখা হয়ে গেছে?”
“হ্যাঁ।”
“তাহলে দাঁড়িয়ে আছেন যে!”
“কুরিয়ার অফিসে কিছু কাজ ছিল। বন্ধুর কাজ, ও তাড়া দিয়ে চলে গেল। এখন দেখি অফিস বন্ধ। কল দিয়েছি, লোকটি বলল আসছে। তুমি এভাবে শাড়ি পড়ে রাস্তায় ঘুরছ কেন?”
“আজ আমাদের কলেজে ফাগুন উৎসব হয়েছে। আমরা সবাই শাড়ি পড়ে এসেছি। ফুসকার স্টল দেখে ফুসকা খাচ্ছিলাম।”
“বাসায় যাবা না?”
“হ্যাঁ, যাব। আপনি কি আমার সাথে একটু যাত্রী ছাউনি পর্যন্ত যাবেন?”
“যাওয়া যায়, কিন্তু এভাবে শাড়ি পড়ে রাস্তার মধ্যে একটা ছেলের পাশাপাশি হাটলে মানুষের দৃষ্টিতে তা ভালো দেখাবে না।”
দিবা আয়ানের কথা শুনে মাথা নিচু করে রইলো। সে কেনই বা এটা বলল! এখন নিজের কথার জন্য লজ্জা পাচ্ছে। দিবা কিছু না বলেই আয়ানকে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নেয়। আয়ান তাকে পিছন থেকে ডেকে বলে, “দিবা শোন।”
দিবা দাঁড়িয়ে যায়। আয়ান তার সামনে এসে বলে, “ভেবেছিলাম তোমার সাথে আমার আর দেখা হবে না। কিন্তু দেখো, আমাদের দেখা হয়ে গেল ঠিকই।”
দিবা কিছু বলল না। কোনো এক ভাবনায় ডুব দিতে লাগলো সে। আয়ান আবারও বলল, “দিবা! আজ তোমায় খুব সুন্দর লাগছে।”
দিবা আয়ানের চোখে চোখ রাখলো। অনেক ফেলে আসা দিনগুলোর কথা মনে পড়ে গেল তার। দিবা বলল, “মন্তব্য করার জন্য ধন্যবাদ। আমি আসছি।”
আয়ান উত্তেজিত হয়ে জিগ্যেস করে, “আমাদের কি আর দেখা হবে না?”
“জানি না।”
দিবা চলে যায়। চোখের কোণে চিকচিক কিরছে জল। আয়ানের সামনে সে বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না। চলে এলো। আয়ানের সাথে দেখা হওয়া বন্ধ হোক। নাহলে যে নিজেকে সামলে রাখা বড্ড দায় হয়ে পড়বে তার।
আয়ান নিজেকে সামলে নেয়। আর কতদিন এভাবে চলবে কে জানে।
কুরিয়ার অফিসের কাজ সেড়ে যখন বাহিরে এলো, তখন আয়ান দেখল রাস্তার মধ্যে অনেক ভিড় হয়ে আছে। আয়ান ভ্রু কুচকে ভিড়ের কাছে গেল। লোকজনকে সরিয়ে সামনে যেতেই সে থমকে যায়। আয়ান দেখে দিবার অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে! একপাশে একটা অটো ও তার সাথে ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে সিএনজি। অটোর অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। আয়ান দৌড়ে দিবার কাছে গেল। দিবা যন্ত্রণায় ছটপট করছে। আয়ান বলল, “দিবা এসব কি করে হলো?”
তখন কয়েকজন লোক একসাথে বলে উঠল, “এই মেয়েটা অটো করে যাচ্ছিল, হঠাৎ এই সিএনজি এসে অটোকে ধাক্কা দিলে এই মেয়েটি অটো থেকে ছিটকে রাস্তায় পড়ে যায় আর একটা বাইক এর সাথে অ্যাকসিডেন্ট করে।”
আয়ান চিৎকার করে বলে,
“আপনারা দাঁড়িয়ে দেখছিলেন? ওকে কেউ হসপিটালে নিয়ে যাননি কেন?”
“এটা পুলিশ কেইচ। পুলিশ আসছে। খবর দিয়েছি।”
আয়ান দিবাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে, “কিচ্ছু হবে না দিবা। এইতো আমি আছি।”
দিবা কপালে বেশ চোট পেয়েছে। হাতে পায়েও লেগেছে তার। তবে বেশী আঘাত পেয়েছে পেটে। দিবা চিৎকার করে কাঁদছে। ব্যথায় গড়াগড়ি খাচ্ছে। পুলিশ এসে সিএনজি চালকে ধরে। অটো ও বাইক এর মালিকদেরও নিয়ে যায়। তবে তাদের জেলে ঢুকাবে না। আয়ান বলে শুধু সিএনজি চালকে নিয়ে যেতে। অটো চালকের অনেক ক্ষতি হয়েছে। বাইক এর মালিক দিবকে দেখার সাথে সাথেই ব্রেক কষে। পুলিশের সাথে কথা বলে আয়ান দিবাকে নিয়ে আশেপাশের একটা স্থানীয় ক্লিনিকে যায়৷ দিবাকে কোলে নিয়েই সে দৌড়ে যায়। এই মুহুর্তে তার কাছে দিবার চেয়ে প্রয়োজনীয় আর কিছুই নেই। ক্লিনিকে এসে ডাক্তার দেখানোর পর ডাক্তার বলে। “এনার অবস্থা গুরুতর। আপনি ওনাকে ফেনী নিয়ে যান। আমি চোট লাগা জায়গায় ড্রেসিং করে ব্যান্ডেজ লাগিয়ে দিয়েছি। তবে ওনার পেটের আঘাতের জন্য আপনাকে ফেনী যেতে হবে। টেস্ট করাতে হবে।”
আয়ান পড়ল বিপাকে। দিবার বাসায় না জানিয়ে ওকে কোথাও নিয়ে যাওয়া ঠিক হবে? আয়ান ফোন দিল মীরার কাছে। ফোন দিয়ে সব কথা বলল। মীরা আয়ানের কল কেটে তার মামার কাছে কল লাগাল। দিবার বাবা সব শুনে ছুটতে ছুটতে এলেন বাজারে। ক্লিনিকের কাছে এসে ভেতরে ঢুকে গেলেন। আয়ানকে দেখে হন্তদন্ত হয়ে বললেন, “আমায় মেয়ে কোথায়?”
“আংকেল আপনি শান্ত হোন। দিবার হাত পায়ে অনেক চোট লেগেছে। ডাক্তার প্রাথমিক চিকিৎসা করিয়ে তাকে ব্যথার ঔষধ দিয়েছেন।”
“মীরা যে বলল ওর অবস্থা খারাপ।”
“ওকে ফেনী নিয়ে যাওয়ার কথা বলেছে। কিন্তু আমি আপনাকে না বলে ওকে কিভাব্র নিয়ে যাই বলুন। তাই মীরাকে দিয়ে আপনাকে কল করিয়েছি।”
“আমার মেয়েটাকে নিয়ে চলো আয়ান। কি থেকে কি হলো আমার মেয়ের।”
“আমি সিএনজি ডেকে নিয়ে আসছি। আপনি ওকে নিয়ে বের হোন।”
আয়ান একটা সিএনজি নিয়ে আসলো।দিবার বাবা ও আয়ান মিলে দিবাকে সিএনজিতে উঠিয়ে বসালো। এরপর তারা ফেনীর দিকে রওনা হলো। ফেনীতে এসে একটা হসপিটালে ভর্তি করানো হয়েছে দিবাকে। ডাক্তার কিছু টেস্ট দিয়েছেন। ওগুলো করানো হয়েছে। মীরা আর মিরাজও এসেছে হসপিটালে। দিবাকে ডাক্তাররা কিছুদিন হসপিটালে রাখতে বলেছেন। টেস্ট এর রিপোর্ট একটু খারাপ এসেছে। দিবার বাবা কাঁন্নায় ভেঙে পড়লেন। মীরা তাকে গিয়ে সান্ত্বনা দিল। আয়ান খুব দৌড়াদৌড়ি করেছে দিবাকে নিয়ে। ডাক্তারের সাথে কথা বলা থেকে শুরু করে দিবার ঔষধ, টেস্ট সব কিছুর জন্যই আয়ান ছুটেছে। দিবার বাবা আয়ানকে যত দেখে ততই মুগ্ধ হোন। তার মেয়ের জন্য একটা ছেলে স্বার্থ ছাড়াই এমন করবে উনি কখনো ভাবেননি। অথচ উনি এই ছেলেটাকে শুধু ভুলই বুঝে এসেছেন।
চলবে…