বৃষ্টিভেজা_আলাপন (২৯)

0
347

#বৃষ্টিভেজা_আলাপন (২৯)

উষশী আর অভিরাজের সম্পর্কটায় খুব বেশি লুকোচুরি নেই। তারা অবাধে চলাফেরা করে। ইদানীং যে খুব বেড়েছে তা নয়। আগেও এমনি ছিল। তবে আমিনা বিষয়টি নিয়ে এবার চিন্তিত বোধ করছেন। তিনি ছেলের মা। চোখ দেখেই কিছুটা আন্দাজ করতে পেরেছেন। স্বামীর সাথে এই নিয়ে বেশ আলোচনাও হলো। ভদ্রলোক নীরব মুখে শুনেছেন। কিছুই বলেন নি। মন মস্তিষ্কের দন্ডে আমিনা প্রায় অসুস্থ বোধ করছেন। তিনি ছেলেকে ডেকে বিষয়টা বলতেই অকোপটে সম্পর্কের কথা স্বীকার করে নিয়েছে অভিরাজ। সেই থেকেই ভদ্রমহিলার চোখে ঘুমে নেই। তিনি যেন সত্যটা মানতেই পারছেন না। লাবণ্যকে ছেলের বউ হিসেবে খুব পছন্দ। দুজনেই সম্পর্কটা তৈরি করতে নারাজ। তবে উষশীকে বাড়ির বউ কল্পণা কিছুতেই হচ্ছে না। মনে হচ্ছে অনেক বড়ো ভুল হতে চলেছে। এর রেশ রইল বিকেল অবধি। তিনি সন্ধ্যার আগ মুহূর্তে ঘর থেকে বের হলেন। উঠানে এক দল পায়রা। তারপাশেই বসে উষশী। খাবার খাওয়া দেখছে। আমিনার চোখ জুড়িয়ে আসল। কি সুন্দর মেয়েটি। তার বাদামি রঙা চুল যেন পিনাট বাটার। আর শরীর যেন মাখন। ওনার ভাবনায় হুট করেই বাঁধ সাজল হাঁটুসম ফ্রক। উষশী আজ একটা ফ্রক পড়েছে। ভীষণ গরম পরেছে বিধায় পোশাকটি পরতে দিয়েছে রত্না। বহু বছর পূর্বে সে খুব শখ করে পোশাক টি কিনেছিল। তবে নানান বাঁধার কারণে আর পরা হয় নি। উষশী বেশ মনোযোগ দিয়ে বসেছে। সাদা এক যুগল পায়রা তার নজর কেড়েছে। সরু ঠোঁট গলিয়ে কি সুন্দর করে খাবার খাচ্ছে তারা। আমিনার নিকট মেয়েটির বাহ্যিক রূপ দৃষ্টিকটু হয়ে রইল। নামাজের সময় হওয়ায় তিনি চলে গেলেন। রাতের খাবারে সকলেই উপস্থিত। অভিরাজ উষশীর প্লেটে মাছের কাঁটা ছাড়িয়ে দিচ্ছে। লাবণ্য অধির আগ্রহে বসে ছিল। তবে সেদিকে আজ খেয়াল নেই অভিরাজের। বিষয়টা ওকে বেশ কষ্ট দিল। খানিক বাদে খাবার খেয়ে উঠে গেল লাবণ্য। ওর মন খারাপ বেশ বুঝতে পারলেন আমিনা। লাবণ্য’র চোখে অভির জন্য তৈরি হওয়া মায়া তিনি ধরতে পারলেন। লাবণ্য যদিও বিষয়টা ঘাটাতে চাইল না তবে আমিনা ছাড়লেন না। আড়ালে ডেকে এনে সরাসরি প্রশ্ন করলেন।
“অভি কে ভালোবাসিস?”

বরাবরের মতো প্রশ্নটা এড়িয়ে যেতে পারছিল না লাবণ্য। তবুও বহু কষ্টে না বোধক উত্তর দিল। আমিনা তার মমতার হাত মেয়েটির চুলে স্পর্শ করালেন।
“আগে যদি সম্পর্কটা মেনে নিতি তা হলে এই জটিলতা আসত না মা।”

“এসব নিয়ে আর ভাবতে চাই না বড়ো মা। তোমরাও ভেবো না। অভি আমার বন্ধু, সব সুখ দুঃখের সাথী। কখনো ভাবি নি এভাবে ভালোবাসাটা হয়ে যাবে। এখন আর সময় নেই বড়ো মা।”

“কেন সময় নেই লাবণ্য? তুই চাইলেই সবটা সম্ভব।”

“আজ থেকে মাস দুয়েক আগে হলেও হয়ত সম্ভব হতো। তবে এখন আর সম্ভব নয়।”

সকলের আড়ালে চোখের জলটুকু মুছে নিয়ে লাবণ্য বেরিয়ে গেল। আমিনা ক্লান্ত। মেয়েটির জন্য ওনার হৃদয়ে তীব্র ব্যথা হতে লাগল। উষশী যদি না আসত,তবে পরিস্থিতি বদলে যেত।

সারাটা দিন ক্লান্ত ছিল অভিরাজ। জমিজমা নিয়ে ঝামেলা চলছে। সেগুলোর জন্যেই বের হতে হয়েছিল। সত্যি বলতে দখল জিনিসটা না থাকলে কাগজে কলমে খুব বেশি লাভ করা যায় না। অভিরাজের দাদার সম্পত্তি’র সিংহভাগ দখলে থাকলেও কিছু জমি হাতের নাগালে নেই। সেগুলো এখন ফেরাতে হবে। দীর্ঘদিন গ্রামে না আসাতে বেশ রসিয়ে বসেছেন আকমত নিয়াজী। বয়সের ভারে নুয়ে গেলেও বদ মস্তিষ্কটা ঠিকই সচল রয়েছে। উষশী অনেক সময় ধরে অপেক্ষা করছিল। তার সুন্দর দুটি চোখ যেন ভীষণ তৃষ্ণার্ত। অভিকে দেখতে পেয়েই কেমন ঝাঁপিয়ে পড়ল। ক্লান্ত অভিরাজ একটুও শব্দ করল না। নিজের খারাপ লাগাটা দূরে ঠেলে যত্ন নিয়ে মেয়েটির মাথায় হাত বুলাল।
“কি হয়েছে রেইন?”

“সারাদিন অনেক মিস করেছি।”

“আমিও করেছি।”

“কোথায় ছিলেন? এত বোরিং সময় গিয়েছে আমার।”

“খুব খারাপ লাগছিল?”

“একটু।”

মেয়েটি অভিরাজের বাহুতে মাথা ঠেকিয়ে বসল। অভিরাজ ধীর স্থির ভাবে শার্টের উপরের দুটো বোতাম খুলল। এবার কিছুটা আরাম লাগছে।
“খেয়েছ?”

“হুম। একটু আগে রত্না আপু জোর করে খাওয়াল।”

“ভালো করেছে। এখন তাহলে ঘুমাও?”

“না,না। আপনি খাবার খেয়ে নিন। তারপর যাব।”

“অনেক রাত উষশী।”

“এইটুকু রাতে কিছু হবে না। আসেন তো।”

“জেদি মেয়ে।”

উষশী মৃদু হেসে উঠে গেল। লাবণ্য আগে থেকেই ডাইনিং এ সব আয়োজন করে রেখেছে।
“এসেছিস। ফ্রেস হয়ে নে। খাবার তৈরি আছে।”

“হুম।”

অভিরাজ চলে গেলে উষশী একটু চিন্তায় পড়ল। লাবণ্য ওর মুখটা দেখেই সব বুঝতে পারছে।
“উষশী,ঘুমাবে না?”

“আসলে আপু আমার খুব ক্ষিধে পেয়েছে।”

কথাটা বলে বোকা বনে গেল উষশী। কিছু সময় পূর্বেই খাবার খেয়েছে সে। অন্য কেউ হলে নিশ্চয়ই প্রশ্ন করত। তবে একদমই মৌন রইল লাবণ্য। অভিরাজের জন্য খাবার বেড়ে দিয়ে অল্প করে উষশী’র জন্যেও দিল। চলে যাওয়ার পূর্বে নিচু গলায় বলল,”না খেতে পারলে জোর করে খেও না।”

লাবণ্য ইচ্ছে করেই চলে গিয়েছে। অভিরাজ উষশী’র বিষয়টা ধরতে পেরেছে। তাই মুচকি হাসছে।
“হাসেন কেন?”

“কিছু না। খাবার খাও।”

“আসলে আমার না।”

“আসলে কি উষশী?”

“না মানে।”

“হ্যাঁ বলো।”

চরম বিপাকে পড়েছে উষশী। একটুও ক্ষিধে নেই তার। শুধুমাত্র অভিরাজের সঙ্গ পেতে লাবণ্যকে মিথ্যে বলেছে সে। ওর অবস্থা ধরতে পারল অভিরাজ। বিষয়টা আরেকটু মশলাদার করতে সে তাগাদা দিল।
“খাচ্ছ না কেন?”

“এই তো খাচ্ছি।”

এক লোকমা ভাত মুখে তুলতেই হাত ধরে ফেলল অভিরাজ। উষশী করুণ চোখে তাকাল। অভি তার প্লেট সরিয়ে দিল। তারপর বলল,”বোকা। আগে তো সরাসরি সব বলতে। এখন এত দ্বিধা কেন?”

“জানি না। তবে আপনার সঙ্গ চাইতে আমার লজ্জা লাগছিল। যদি লাবণ্য আপু কিছু মনে করে।”

“কি মনে করবে?”

“জানি না। কেমন যেন অস্বস্তি লাগছিল।”

“ভালোই করেছ, নতুবা আমার জন্য তোমার এই বেপরোয়া স্বভাবটা দেখতে পেতাম না।”

উষশী আসলেই লজ্জা পেল। অভি চারপাশ লক্ষ্য করে মেয়েটিকে কাছে টেনে নিয়েছে। একদম বুকের সাথে মিশিয়ে বুক ভরে শ্বাস নিচ্ছে। তার ভেতরের সমস্ত উত্তপ্ততা কেমন করে যেন হারিয়ে গেল। উষশী’র শরীর থেকে আসা মেয়েলি সুবাস যেন অনেক কিছু বলতে চায়।

ঈশান একটা লম্বা গাছের উপর উঠে আছে। সে নিজেকে যথাসম্ভব ব্যস্ত রাখতে চাইছে। এদিকে ভিডিও কল করেছে ছোঁয়া। মেয়েটি সবার সাথে কথা বলছে। এক পর্যায়ে ঈশানকে চাইল। হাজার খানেক ব্যথা নিয়ে এগিয়ে এল ছেলেটা। দৃশ্যটা দেখতে পেয়ে উষশী’র হৃদয় ধক করে উঠল। তার অন্তঃকরন থেকে ভেসে এল বিচ্ছেদের ব্যথা। খুবই অল্প বাক্যে কথা শেষ করেছে ঈশান। সে এখন সকলের আড়ালে যেতে চাইছে। ওর পিছু নিল উষশী। মেয়েটির সঙ্গ বুঝতে পেরে ঈশান বলল,”চলে যাও উষশী।”

“ঈশান,তুমি কষ্টে আছ।”

“কষ্টে নেই।”

“প্লিজ এভাবে নিজেকে আড়াল কোরো না। এতে কষ্ট আরো দীঘল হবে।”

“তেমন কিছুই নয় উষশী। তুমি বাড়ি ফিরে যাও।”

“যাব না আমি। তোমার এমন অবস্থা আমার ভালো লাগছে না ফ্রেন্ড।”

মেয়েটি যে কথা শোনার মানুষ না তা জানে ঈশান। ব্যক্তিগত ভাবে কথা বাড়াতে ইচ্ছে হচ্ছে না তার। ভেতরটা কেমন পু ড়ে যাচ্ছে। মৌনতা নিয়েই অনেকটা পথ চলে এসেছে ওরা। বিকেলের এই প্রহরে মানুষ জনের সমাগম একটু বেশিই থাকে। রাস্তা ঘাটে লোকজন কিলবিল করছে। উষশী’র দিকে কেমন চোখে তাকাচ্ছে। এতে বেশ অস্বস্তি হচ্ছে ওর। ঈশানের থেকে বেশ কিছুটা পিছিয়ে ছিল বিধায় ছুটে গিয়ে দূরত্ব লাঘব করে নিল। ঈশান এক পলক তাকিয়ে বলল,”বড়ো জেদি তুমি।”

“মিস্টার রাগীও একই কথা বলে।”

“এখন বলো,আর কত দূর যাবে?”

“আর যাব না। শুধু তোমার মন ভালো করতে চাই।”

“মন ভালো হয়ে গেছে।”

“রিয়েলি?”

“হুম।”

“হাত ছুঁয়ে বলো তো।”

উষশী হাত বাড়ালেও ঈশান হাতে স্পর্শ করল না। বরং গাল টেনে দিয়ে বলল,”গাল টেনে বললাম।”

ওর আচরণে বেশ মজা পেল মেয়েটি। একটা ভালো লাগা কাজ করছে। ঈশানের মন এখন সত্যিই ভালো হয়ে গেছে। তারা একে অপরের দিকে তাকিয়ে হাসছে। আর এই দৃশ্যটা চোখে পড়ল নিয়াজী বাড়ির ছোট ছেলের। তার ঠোঁটের কোণ রাঙিয়ে গেল ফিঁচেল হাসিতে।

চলবে….
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here