#শেষটা_সুন্দর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
২৮।
‘না, আমি চাই না আপনি কোনোভাবে ওর সংস্পর্শে থাকুন। ওর ব্যাপারটা আমি দেখে নিব। এসবের মধ্যে এখন আর আমি আপনাকে জড়াতে চাইছি না।’
মেহুল রাবীরকে বোঝানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু, রাবীরের এই ব্যাপারটা ভালো লাগছে না। নিজের জন্য বা ঐ সাদরাজকে হারানোর জন্য সে মেহুলকে কোনোভাবেই ব্যবহার করতে চায় না। মেহুল বলল,
‘আরে বাবা, আমি উনার সাথে নিজ থেকে কোনো যোগাযোগ করব না। আমি শুধু দেখব, উনি ভবিষ্যতে আর কী কী করেন। এখন তো আমরা সবকিছু জানিই, তাই না? ঐ লোকটার পরবর্তী চালটা কী এখন আমাদের সেটাই বুঝতে হবে। আর তার জন্য আপাতত আমাদের চুপ থাকতে হবে। আপনি যে ঐ লোকটার ব্যাপারে সব জেনে গিয়েছেন সেটা কোনোভাবেই বুঝতে দেওয়া যাবে না।’
রাবীর ভাবছে; আদৌ এটা ঠিক হবে কিনা। মেহুলের সাথে সাদরাজের এইটুকু কথোপকথনও সে সহ্য করতে পারবে না। সেখানে সাদরাজের সাথে তার এই নরম ব্যবহার সে তো আরো আগেই মেনে নিতে পারছে না। সে অনেকক্ষণ চিন্তা করে বলে,
‘দেখুন, আপনার সাথে যখনই ওর দেখা হবে বা কথা হবে আমাকে সাথে সাথে বলবেন। আর আমাকে না জানিয়ে নিজ থেকে আগ বাড়িয়ে কিছু বলতে বা করতে যাবেন না। সাদরাজ প্রচন্ড চতুর। ওর সাথে আপনি একা পাল্লা দিয়ে পারবেন না, মেহুল।’
‘একা কোথায়? আপনি আছেন না?’
‘হ্যাঁ আছি। এক মিনিটের জন্যও আমি আপনাকে এখন চোখের আড়াল করব না। ভাবছি মা’কে বলব, যেন আমাদের বিয়ের প্রোগ্রামটা ঈদের পর পরই করে ফেলেন।’
মেহুল অবাক হয়ে বলে,
‘ওমা কেন? আমি তো বলেছি আমার অনার্সের পর।’
‘মেহুল দেখুন, আপনি এখানে থাকলে আমার দুশ্চিন্তার ভার বাড়বে। আপনি যদি আমার বাড়িতে থাকেন, তাহলে আমি তুলনামূলকভাবে একটু নিশ্চিন্ত হতে পারব। কারণ, সেখানে আমার পরিপূর্ণ সিকিউরিটির ব্যবস্থা আছে। আপনাকে এখানে রেখে আমাকে সারাক্ষণ একটা দুশ্চিন্তায় থাকতে হবে। তাই আপাতত আপনাকে আমার এই সিদ্ধান্ত মেনে নিতেই হবে। আপনাকে ঐ বাড়িতে নিতে পারলেই আমার শান্তি।’
মেহুলের মুখ কালো হয়ে গেল। রাবীরের এই প্রস্তাব তার মোটেও পছন্দ হয়নি। সে তো ভেবেছিল অনার্স শেষ করতে করতে তার গানের ক্যারিয়ারটাও পাঁকা করে ফেলবে। তারপর রাবীরের বাড়িতে চলে গেলেও কিছু যায় আসে না। ততদিনে রাবীরও তার মা’কে রাজি করিয়ে ফেলতে পারবে। কিন্তু, এখন এত তাড়াতাড়ি বিয়ে হয়ে গেলে তো সবকিছু উলোট পালট হয়ে যাবে।
মেহুলকে উদ্বিগ্ন দেখে রাবীর বলল,
‘চিন্তা করবেন না, ঐ বাড়িতে গেলেও আপনার পড়াশোনার কোনো ক্ষতি হবে না।’
‘আর গানের?’
মেহুল উৎসুক চোখে চেয়ে আছে রাবীরের দিকে। রাবীর কী উত্তর দিবে সেই প্রতিক্ষায়। রাবীর চাপা নিশ্বাস ফেলে বলে,
‘এই ব্যাপারে মা’র সাথে আমার এখনো কথা হয়নি।’
মেহুল মাথা নিচু করে নরম গলায় বলল,
‘আমার এক স্যারের বন্ধু বেশ বড়ো গায়ক। উনি আবার নতুন সব গায়ক গায়িকাদের নিয়ে কাজ করেন। উনি নাকি স্যারকে আমার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেছেন। অফার করেছেন উনার স্টুডিও তে গিয়ে গান করার জন্য। স্যার বলেছেন উনার সাথে কাজ করলে নাকি আমার গানের ক্যারিয়ার এমনিই তৈরী হয়ে যাবে। আমাকে আর বেশি খাটতে হবে না। কিন্তু, আমি তখন সিদ্ধান্ত নিতে পারিনি। আপনার সাথে কথা না বলে কী করে সিদ্ধান্ত নিব? তাই এখন আপনিই বলুন, কী করব? এত বড়ো একটা সুযোগ হাতছাড়া করে দিব? নাকি একবার চেষ্টা করে দেখব?’
রাবীর মেহুলের মুখের দিকে তাকায়। মেয়েটার চোখে মুখে এত উৎসাহ দেখে তার খুব খারাপ লাগছে। সে মেয়েটাকে কষ্ট দিতে চায় না। আবার মা’কে ও সে নারাজ করতে পারছে না।
সে ম্লান সুরে বলল,
‘মেহুল, আপনি তো দেখছেনই মা গানের কথা শুনলেই রেগে যাচ্ছেন। এই অবস্থায় আমি এখন মা’কে গিয়ে এই কথা কী করে বলব? তার উপর আমার ঝামেলারও শেষ নেই। একটার পর একটা লেগেই যাচ্ছে। এসবের মাঝে আপনার এই গানের ব্যাপারটা আমাকে আরো বেশি দুশ্চিন্তায় ফেলছে। আচ্ছা, যদি এখন আমি বলি গানটাকে ছেড়ে দিন, অন্য কিছু নিয়ে ক্যারিয়ার গড়ার স্বপ্ন দেখুন, তখন আপনি পারবেন? জানি পারবেন না। কষ্ট হবে। তেমনি এখন যদি আপনি বলেন, আপনি আপনার মায়ের কথাকে দাম না দিয়ে আমাকেই সাপোর্ট করুন, তাহলে বলব সেটা আমিও পারব না। আপনি বা মা কাউকেই আমি কষ্ট দিতে পারব না। এখন দুজনকেই ভালো রাখতে এইটুকু কঠোর আমাকে হতেই হবে, মেহুল।’
মেহুল অন্যদিকে মুখ করে বসে। ফিচের গলায় বলে,
‘গান গাইতে দিবেন না, সেটা সরাসরিই বলতে পারেন। এত ভণিতা করার দরকার নেই।’
‘আপনি রাগ করলেও এই মুহুর্তে আমার আর কিছু করার নেই। মা রাজি হবেন না আমি জানি। তাও আমি আবার কথা বলব। তবে আগের বারের মতো এখনো বলছি, মা রাজি না হলে আমি মায়ের বিরুদ্ধে যেতে পারব না।’
‘সেটা তো আমিও করতে বলছি না। যেখানে আমার মা বাবাই আমাকে সাপোর্ট করছেন না, সেখানে আপনি তো আরো দূরের মানুষ।’
এই বলে মেহুল উঠে নিজের রুমে চলে যায়। তবে এই কথাটা রাবীরের প্রচন্ড ভাবে মনে লাগে। সে মেহুলের “দূরের মানুষ”? এতকিছু করেও সে মেহুলের “কাছের মানুষ ” হতে পারল না? এর থেকে ব্যর্থতার আর কী হতে পারে?
________
মেহুরের বাবা রাবীরের সাথে ড্রয়িং রুমে বসে কিছুক্ষণ কথা বলেন। তিনি এখন অনেকটাই সুস্থ। রাবীর উনার সমস্ত চিকিৎসার দায় ভার নিয়েছে। যদিও এই কথা এখন অবধি উনি জানেন না। জানলে হয়তো আত্মসম্মানে লাগতো। যতই হোক মেয়ের জামাই তো। আর সেইজন্যই মেহুলও আর উনাকে কিছু বলেনি।
_______
ড্রয়িং রুমে রাবীর তখন একাই ছিল। কারোর সাথে ফোনে কথা বলছিল। রামিনা বেগম ব্যাপারটা খেয়াল করেন। তিনি মেহুলের রুমে গিয়ে দেখেন মেহুল কেউ একজনের সাথে ফোনে খুব ঝগড়া করছে। তার কথার ধরনে তিনি সেই ব্যক্তিকে চিনতে পারছেন না। তাই তিনি দাঁড়িয়ে ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করেন। এর কিছুক্ষণের মাঝেই মেহুল কল কেটে দিয়ে ফোনটা বিছানার উপর ছুঁড়ে মারে। পরে দরজায় মা’কে দেখেই ব্যাখ্যা করতে থাকে কী হয়েছে না হয়েছে।
‘মা, এই খবরের কাগজে এসব কে লিখিয়েছে জানো? আমাদের ক্লাসের সিয়াম। কিন্তু, সে এখন কোনোভাবেই ব্যাপারটা স্বীকার করছে না। তাই এখন ওকে কল দিয়ে খুব ঝেড়েছি। ওর জন্যই তো আমাকে এত কথা শুনতে হয়েছিল।’
‘জামাই ঐ রুমে একা। আর তুই এই রুমে বসে বসে ঝগড়া করছিস?’
মেহুল বিরক্ত চোখে তাকায়। সে কী বলল, আর তার মা কী বলছে? মানে সবকিছুর মধ্যেই উনাকে উনার জামাইকে টেনে আনতেই হবে। মেহুল ধপ করে বিজানায় বসে বলে,
‘তো, উনাকে ঐখানে বসে বসে শোক পালন করতে কে বলেছে। এই রুমে আসলেই তো পারেন। নাকি এই রুমে আসতেও উনাকে এখন দাওয়াত দিয়ে আনতে হবে?’
রামিনা বেগম চেতে মেয়ের মাথায় চাটি মেরে বলেন,
‘চেটাং চেটাং কথা না বললে হয় না, না? যা, জামাইকে গিয়ে তুই বলে রুমে আন। কতদিন পরপর ছেলেটা আসে তাও যদি উনি একটু দাম দিত। না চাইতেই এমন হিরা পেয়ে গিয়েছ তো, তাই মূল্য নেই। হিরা যখন হারাবে, তখন বুঝবে তার কী মূল্য।’
মেহুল উঠে দাঁড়িয়ে দু হাত জোড় করে মায়ের সামনে মাথা নুইয়ে বলে,
‘ক্ষ্যামা করো মা, আমাকে ক্ষ্যামা করো। তোমার জামাইকে এখন থেকে আমি মাথায় করে রাখব। তাও দয়া করে এইসব ভয়ানক ইমোশনাল কথাগুলো আমাকে আর বলো না। আমার হার্ট অ্যাটাক চলে আসে।’
রামিনা বেগম চোখ পাকিয়ে তাকাতেই মেহুল এক দৌড়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। তারপর সে ড্রয়িং রুমের দরজার কাছে যায়। রাবীর তখনও ফোনে কথা বলছে আর ব্যস্ত হয়ে রুম জুরে পায়চারি করছে। মেহুল দাঁড়িয়ে এক দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে থাকে। খেয়াল করে তার প্রতিটি অঙ্গভঙ্গি। লোকটার মাঝে আসলেই নেতা নেতা একটা ভাব আছে। সুঠাম দেহের প্রতিটা অংশ যেন জানান দিচ্ছে তিনি কতটা প্ররিশ্রমী। তার এই চোখে মুখের ভীষণ নিখুঁত গাম্ভীর্যতা তাকে যেন আরো বেশি চমৎকার করে তুলছে। যেন কোথাও কোনো ভুল নেই। খুব যত্নে গড়া একজন মানুষ। প্রতিটা নারীর কল্পনার পুরুষ হয়তো এমনিই। যাকে দেখলেই চোখের তৃষ্ণা মিটবে তবে মনের তৃষ্ণা কেবল বেড়েই যাবে। রাবীরকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে দেখতেই আনমনেই তার চোখ রাবীরের ঠোঁটের উপর পড়ে। তার চলমান অস্থির ঠোঁট জোড়া দেখে মেহুলের চোখ যেন তাতেই আটকে যায়। কেমন অদ্ভুত ঘোরে যেন আটকে গেল সে। কোনো পুরুষ মানুষের ঠোঁট এত সুন্দর হয় নাকি? ঠোঁট তো কেবল মেয়েদের সুন্দর। তবে রাবীরের বেলায় এর ব্যতিক্রম কেন হলো?
‘আমি জানি আমার ঠোঁট সুন্দর। তাই বলে এভাবে চেয়ে থেকে সেই সৌন্দর্য উপভোগ করার কোনো মানেই হয়না, মেহুল।’
মেহুল চমকে তাকায়। কী হলো ব্যাপারটা? রাবীরের ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি দেখে তার আর বুঝতে বাকি রইল না। ইশ, কীভাবে হ্যাংলার মতো সে রাবীরের ঠোঁটের দিকে চেয়েছিল! রাবীর কী ভাবছে কে জানে। ভীষণ লজ্জায় পড়ে সে। লজ্জায় কী করবে বুঝতে না পেরে দৌড়ে আবার নিজের রুমে চলে যায়।
চলবে…