#শতদলের_ভীরে
#পর্ব_৬
#মুসফিরাত_জান্নাত
অম্বরে রবি উঁকি দিতেই একটু একটু করে গুঞ্জন ছড়ায় সরকার পল্লীতে।বড় ছেলের বউভাতের আয়োজন করা হয় ঘরোয়া পরিবেশে।সকাল সকাল হাতে হাত রেখে কাজ করেন মহিলাগন।বিয়ে ঠিক হওয়ার সাথেই দাওয়াত করা হয়েছিলো নিকট আত্মীয় স্বজনকে।কাল রাতেই তারা এ বাড়িতে উপস্থিত হয়েছে।সারা বাড়ি বাচ্চাদের ছোটাছুটি মিছিল।সেই শব্দে ঘুম ছুটে যায় ঐশীর।
আধো ঘুমে জাগ্রত হয়ে নিজেকে কারো শক্ত বাহুডোরে আবিষ্কার করে মেয়েটি।বিরক্ত হয়ে বলে,
“উফ! আম্মু,তোমাকে না কতোবার বলেছি আমার গায়ে হাত পা রাখবে না।এমন করে জাইত্তা ধরছো, আমি চ্যাপ্টা হয়ে যাব না?সরো ওইদিকে।”
নিজের মায়ের সাথে এক বিছানায় ঘুমানোর অভ্যাস তার।মস্ত বড় খাট হলেও শোয়ার জায়গা নিয়ে মায়ের সাথে ভাগ চলে প্রতিদিন।আবার মাকে ছাড়া একা থাকতে ভয় পায়।অভ্যাসবসত ঘুমজড়ানো গলায় ধমকের সুরে উক্ত কথাগুলো বলে একটু নড়ার চেষ্টা করে সে।ঘুম ছুটে যায় সাদাতের।চোখ মেলে ঐশীকে নিজের বাহুডোরে দেখতে পায়।আকষ্মিক ছিটকে ওঠে।হালকা ঝাঁকি অনুভব করে মেয়েটি।বিরক্ত হয়ে তড়িৎ চোখ মেলে তাকায়।কয়টা কড়া কথা বলতে গিয়ে সাদাতকে লক্ষ্য করে সে।মস্তিষ্কে একটু চাপ দিতেই সব ঘটনা পরিষ্কার হয়ে যায়।এক লাফে বিছানা ছেড়ে ওঠে।এমন বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ে হাঁসফাঁস করে সাদাত।সুযোগ পেয়ে ঐশীও ছাড়ার পাত্রী নয়।কোমড়ে ওড়না গুঁজে লেগে পড়ে সে।হায় হায় করে বলে,
“ছিঃ ছিহ!এই আপনার চরিত্র?আমি ভাবতেও পারছি না আমার ঘুমের সুযোগ নিয়ে আপনি এমন কিছু করবেন।এখন এমন ভাণ ধরেছেন যেন ঘুমের ঘোরে এমনটা হয়েছে।আপনি কিছুই জানেন না।”
তটস্থ গলায় জবাব দেয় সাদাত,
“আমি ভান ধরছি না,এটাই সত্যি।”
কথাটা উপহাসে উড়িয়ে দেয় ঐশী।বিচক্ষণের ন্যায় মুখ বাঁকিয়ে হাসে।
“ব্যপারটা একদম ভালো হয় নি।পুরো কাঁচা।যে কেও ধরে ফেলবে।”
জিজ্ঞাসু নয়নে তাকায় সাদাত।
“কি বিড়বিড় করছেন?কি ভালো হয়নি?”
“আরে আপনার অভিনয়ের কথা বলছি।একটা ছোট বাচ্চাও এর চেয়ে ভালো অভিনয় পারে।আর আপনি পারেন না।”
ঐশীর হেলাফেলা উত্তরের বিপরীতে চেইন টেনে জবাব দেয় সে,
“এক্সাক্টলি।আমি মোটেও অভিনয় পারি না।কিন্তু আমার মনে হয় এইদিকে মাশাআল্লাহ আপনি ভালোই এক্সপার্ট।আর এই ঘটনায় কোথাও আপনারই হাত রয়েছে।আমাকে ফাঁসানোর জন্য এমনটা করে এখন পাক্কা অভিনয় করছেন।”
“নাউজুবিল্লাহ তওবা আস্তাগফিরুল্লাহ।এট আপনি কি বললেন স্যার!কোনো মেয়েকে দেখেছেন যেচে নিজের অস্তিত্ব কোনো পুরুষের কাছে বিলিয়ে দিতে?শাক দিয়ে মাছ ঢাকা যায় না স্যার।নিজের দোষ আড়াল করতে যতই এসব বলেন কোনো লাভ হবে না।”
“আপনি কি আদৌ মেয়ে?আমার তো মনে হয় না আপনি মেয়ে, যে নিজের অস্তিত্ব রক্ষা করবেন।”
“তো কি আমি ছেলে?আমি ছেলে হলে তো লোকে আপনাকে লেসবিয়ান ডাকবে।”
“হোয়াট?”
“হোয়াট না ইয়েস।এটাই বাস্তব।বেডা হয়ে আরেক বেডাক বিয়ে করলে কি মানুষ স্বাভাবিক পুরুষ বলবে?”
থতমত খেয়ে যায় সাদাত।
“আপনি ছেলেদের চেয়েও ভয়ংকর মাইরি।আপনার মতো ভয়ংকর চিজ এর কাছে নিজেকে কেমনে হেফাজত করব আল্লাহ মালুম।”
কাভার্ড থেকে টাওয়েল নিয়ে ওয়াশরুমে ঢোকে সে।সেদিকে তাকিয়ে মুখ ভেংচি কাটে ঐশী।আফসোসের সুরে জোরে জোরে শুনিয়ে বলে,
“দোষ তো আপনার না।এতো সুন্দরী মেয়ে দেখলে নিজেকে হেফাজত করতে যে কেও হিমশিম খাবে।দোষ আসলে আপনার জাতের।বেডা মানুষ।মেয়ে দেখে নিজেকে সংযত করবে কেমনে?
পরক্ষণেই হেসে বলে,
“কি যুগ আসলো মাইরি।আগেকার যুগে ছাত্রীরা সন্তানতুল্য ছিলো।আর এখন ছাত্রীরা বউ সমতুল্য হয়ে গেছে।”
কোনো উত্তর দেয় না সাদাত।নিজের প্রয়োজনীর জিনিস ও টাওয়াল নিয়ে পাশের রুমে যায় ঐশী।তাকে ভিতরে প্রবেশ করতে দেখে ব্যস্ত হয় সিন্থিয়া।সাদাতের ছোট বোন সে।সিন্থিয়ার উদ্দেশ্যে সে বলে,
“তোমার ওয়াশরুম কি একটু ইউজ করা যাবে ছোট ননদিনী?”
“হ্যাঁ অবশ্যই।অনুমতির কি আছে বলো?এটা তো তোমারও বাড়ি।”
এক পশলা হাসে সে।ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে একটা শাড়ী পড়ে আসে।ঐশীকে দেখে বিষ্মিত সিন্থিয়া।অদ্ভুত নয়নে তাকিয়ে থাকে।অবাক হয় ঐশী।
“কি হয়েছে ননদিনী?কোনো সমস্যা?”
“না মানে হ্যাঁ।তুমি গোছল দিলে না?”
এক গাল হাসে ঐশী।
“আসলে তেমন কিছু হয়নি।আর ভুলেও এসব বলো না।পাশের ঘর থেকে তোমার বিটকেল ভাই শুনলে তোমার পাতলা পায়খানা বানিয়ে ছাড়বে।”
“মানে?”
“মানে হলো..।
কাল রাতে সাথীর সাথে করা ঘটনাটা শোনায় ঐশী।সাথীর অবস্থা চিন্তা করে এক প্রস্তর হাসে দুজনে।একটু পরে ঐশীর হাত ধরে কিচেনের দিকে নিয়ে যায় সে।
কাল রাতেই সাদাতের মামী,খালা,ফুপুরা এসেছে।সকালের নাস্তা রেডি করে বৌভাতের রান্নার আয়োজন করা হবে।এ কারণে এখন সব কিছুর ব্যবস্থা করা হচ্ছে।সকালের নাস্তা বানানোর সময় সাদাতের মামী রাবেয়া বলেন,
“এ কি বৌ নিয়ে আসলে সাহের বানু?এতো বেলা হয়ে গিয়েছে তাও ঘরের দরজা দিয়ে রাখছে।লজ্জা শরম কি কিছু নাই নাকি?”
স্মিত হাসে সাদাতের মা।কিছু একটা বলতে অধর ফাঁকা করতেই ভেতরে প্রবেশ করে সিন্থিয়া ও ঐশী।এক গাল হাসেন তিনি।ঐশীকে কাছে ডাকেন।চঞ্চল ঐশী মামী শাশুড়ীর বলা কথাটা তখনই শুনতে পেয়েছে।একটু খুঁচিয়ে দেখতে বলে,
“কিছু কি বলছিলেন মামী?”
“বলছিলাম যে বাড়ির নতুন বউ কতো লক্ষী।সকাল সকাল উঠে গিয়েছে।তা মা,এতো সকালে উঠে গেলা কেনো?আর একটু ঘুমাতে পারতে।কাল ঘুমাতে কতো রাত হয়ে গিয়েছিলো কে জানে!”
প্রতিউত্তরে স্মিত হাসে ঐশী।একটা মানুষ মুহুর্তের মাঝে কেমনে রুপ বদলায় ভেবে পায় না সে।মনে মনে মিথ্যুক বলে বকা দিলেও মুখে কোনো রা করে না।রাবেয়া এবার মথে দেওয়া আটা ঐশীর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,
“তা নতুন বউ।কেমন পরোটা বানাতে পারো দেখি।আজকের নাস্তাটা আমাদের বানিয়ে খাওয়াও তো।”
আবারও স্মিত হাসে ঐশী।শাণিত কন্ঠে উত্তরে বলে,
“আজকের নাস্তাটা না হয় আপনিই বানান মামি।আজকে নাস্তা বানিয়ে শিখিয়ে দেন কীভাবে বানাতে হয়।পরে এক সময় ঘুরতে এলে আমি বানিয়ে খাওয়াব।তখন দেখবেন কেমন পারি।”
বাঁকা হাসেন রাবেয়া।
“কেনো তোমার মা কি কিছু শিখাই নি নাকি?বাবার বাড়ি থেকে এসব শিখে আসো নি?”
“ওর বাবার বাড়ি কোনো ট্রেনিং সেন্টার নয় মামী।ওর মাও কোনো ট্রেইনার নয় যে এসব শেখাবে।আর ও কোনো কাজের লোক নয় যে কেমন কাজ পারে তার দক্ষতা দেখাতে হবে।ও এই বাড়ির আরেকটা সদস্য এটা মনে রাখবেন।ওর সাথে তেমনভাবেই এস্টেমেট করবেন।”
কাঠ কাঠ গলায় কথাগুলো বলে সাদাত।সিড়ি বেয়ে উপর থেকে নিচে নামছিলো সে।কিচেনের কথা কানে বাজে।এ বাড়িতে মেয়েটা সম্পূর্ণ নতুন।সম্পর্কটা যেমনই হোক মেয়েটা তার উদ্দেশ্যেই এ বাড়িতে এসেছে।সে না দেখলে অন্য সবাই পিষে মা’রবে মেয়েটিকে।তাই তার ভালো খারাপ দেখা সাদাতের কর্তব্য।দ্বায়িত্ব বোধ থেকে এগিয়ে আসে সে।প্রত্যেকটা মেয়ে বিয়ের পর নতুন পরিবেশে মানিয়ে নিতে হিমশিম খায়।সেখানে আত্মীয় স্বজনেরা বসে নতুন বধুর গুন বিচারে।ব্যাপারটা প্রচুর জঘন্য।এ কারণে উক্ত কথাগুলো বলে বিষধর সাপের দাঁত ভেঙে দেয় সাদাত। উচিৎ জবাব পেয়ে দমে যায় রবেয়া।থতমত মুখ করে থাকে সে।সম্মানে আঘাত হানলে কেমন অনুভুত হয় উপলব্ধি করেন তিনি।হৃদয় জুড়িয়ে যায় ঐশীর।সত্যি কপাল লাগে এমন সাপোর্টিভ মানুষ পেতে।এক ধ্যানে তাকিয়ে থাকে লোকটির পানে।আজ যেন একটু বেশিই সুদর্শন লাগছে লোকটাকে।আচ্ছা সাদাত কি আজ সত্যি সুন্দর হয়ে গিয়েছে?নাকি সুন্দর মনের পরিচয় দেওয়ায় সৌন্দর্য বৃদ্ধি পেয়েছে?
চলবে