#অনুরাগের_প্রহর
#মৌপ্রিয়া_ইসলাম_মিহি
#পর্ব_১৪
_________________
মুনিয়া অবাক হয়ে বললো,
-“আপু তুই সত্যিই সবটা বলতে চাস?”
-“হুম।কারণ এখানে যতজন উপস্থিত আছেন উনারা সবাই আমার আপনজন।উনাদের এই সত্যিটা জানার অধিকার আছে।”
শেহমীর মির্জা নিশ্বাস ফেলে বললেন,
-“বউমা তোমার যখন ইচ্ছা হয়েছে তাহলে আমরা সবটা শুনবো।বলতে শুরু করো তুমি!”
মেহরিন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলতে শুরু করলো,
-“রায়ান আমার নিজের ছেলে না।ও কে!ওর কি পরিচয় তাও আমি জানি না।পাঁচ বছর আগের কথা।ভার্সিটিতে অনুষ্ঠান থাকায় বাড়ি ফিরতে অনেকটাই রাত হয়ে যায়।আমাদের বাড়ির মোড়ের রাস্তাটা নিরিবিলিই থাকে।তাই কোনো আওয়াজ সহজেই কানে আসে।রিক্সায় করে বাড়ি ফেরার পথে হঠাৎ করে কানে বাচ্চার কান্নার আওয়াজ আসে।আমি সেখানেই রিক্সা থামাই।আশেপাশে খুঁজে দেখতেই ডাস্টবিনের পাশে একটা পলিথিনের প্যাকেট পাই।প্যাকেটের মুখ খোলা থাকায় দেখতে পাই সেখানে ছোট্ট একটা বাচ্চা!দেখে বোঝা যাচ্ছিল বাচ্চাটা সেদিনই জন্মগ্রহণ করেছে।ওই বাচ্চাটা আর কেউ না।আমার গুড্ডু!”
মেহরিনের চোখে পানি চলে আসে।বাড়ির সবার চোখ ছলছল করছে।একমাত্র হেনা সাহেবার চোখে ভয় বিদ্যমান!শেহরেয়ার গিয়ে মেহরিনের কাঁধে হাত রাখলো।মেহরিন শেহরেয়ারের হাতের উপর হাত রেখে বললো,
-“এরপরে থেকেই আমি রায়ানকে নিজের সন্তানের পরিচয়ে মানুষ করেছি।রাস্তা-ঘাটে এমন অনেক শিশুর প্রাণ চলে যায়।কিছু কিছু ভাগ্যক্রমে বেঁচে যায়।আমি চেয়েছিলাম রায়ান যেন একটা সুন্দর জীবন পায়।তাই আমার এমন সিদ্ধান্ত!আমার একটা ছেলে আছে জানার পরে অনেকেই আমাকে বিয়ে করতে রাজি হয়নি।একমাত্র শেহরেয়ার!যে আমার ছেলে এবং আমাকে গ্রহণ করেছে সবটা না জেনেই।এমন একজনকে আমার লাইফ পার্টনার হিসেবে পেয়ে আমি অনেক গর্বিত।”
মেহরিন শেহরেয়ারের দিকে তাকিয়ে উজ্জ্বল হাসি দিল।শেহরেয়ার খুব যত্নের সাথে মেহরিনের চোখের পানি মুছে দিল।
হামিদ নিশ্বাস ফেলে বললো,
-“ভাবি তোমাকে তো স্যালুট করা উচিত।এতোটা ত্যাগ কতজন করে!”
শেহমীর মির্জা এসে মেহরিনের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
-“তোর এই কাজের জন্য তোর প্রতি আমার সম্মান দশ গুণ বেড়ে গেল।”
মেহরিন মৃদু হেসে বললো,
-“কি যে বলো বাবা!”
মাসুমা বেগম বললেন,
-“একদম লক্ষী মেয়ে একখানা!”
শাহিন মির্জা একগাল হেসে বললেন,
-“তুমি ঠিকই বলেছো মাসুমা।”
হেনা সাহেবা কিছু না বলে সেখান থেকে রুমের দিকে চলে গেলেন।বিষয়টা মেহরিনের চোখ এড়ালো না।হেনা সাহেবা রুমে গিয়ে জোরে জোরে নিশ্বাস ফেলছেন।টেবিলে থাকা গ্লাস থেকে পানি খেয়ে নিজেকে কিছুটা স্বাভাবিক করলেন।
-“সেই পাঁচ বছর আগে আমার করা পাপ এভাবে ধরা দিল!যাকে সেদিন ফেলে দিয়ে এসেছিলাম সেই আজ আমার বাড়িতে!সবাই সবটা জেনে যাবে না তো?”
-“কি জেনে যাবে সবাই মা?”
মেহরিনের কথায় চমকে উঠলেন হেনা সাহেবা।দরজার দিকে তাকিয়ে দেখলেন মেহরিন অবাক হয়ে সেখানে দাঁড়িয়ে আছে।হেনা সাহেবা জোর করে হাসার চেষ্টা করে বললেন,
-“কিসের কথা বলছো বউমা তুমি?”
-“আপনি যা বলেছেন তাই তো জিজ্ঞেস করলাম মা!”
-“কিছুই না বউমা।আমি তো এমনিই বলছিলাম।”
মেহরিন এসে হেনা সাহেবার পাশে বসে বললো,
-“কি হয়েছে মা?আমাকে সবটা বলুন মা!”
হেনা সাহেবা কিছু না বলে চুপ করে বসে আছেন।মেহরিন’ হেনা সাহেবার হাত ধরে বললো,
-“বলুন মা।”
হেনা সাহেবা বলতে শুরু করলেন,
-“আমার জীবনে পাপের শেষ নেই মা।তোমার বলা সব কথা শুনে পাঁচ বছর আগের ঘটনা আমার চোখে ভাসছে।”
মেহরিন অবাক হয়ে বললো,
-“মানে?”
-“আমি একটা শিশু বাচ্চাকে পাঁচ বছর আগে তোমাদের বাড়ির মোড়ে পলিথিনের প্যাকেটে করে ফেলে এসেছিলাম।যা ছিল আমার মেয়ের পাপের ফসল।অনেক ভয় পেয়ে গেছিলাম জানো!অল্প বয়সী মেয়ে!কে বিয়ে করবে?এইসব ভেবে ওই বাচ্চাকে আমি ফেলে আসি।হাফসা পালিয়ে যাওয়ার কিছুদিন পরে ও আমাকে জানায় ওই বাচ্চা আর কারো না রাজ এর ছিল।আমি তারপরে ওই বাচ্চাকে অনেক খোঁজার চেষ্টা করি কিন্তু পাইনি।তারপরে ধরে নিয়েছিলাম হয়তো মারা গেছে।কিন্তু আজ আমি তাকে ফিরে পেয়েছি!তবে ওরা কেউ এইসব জানলে আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দিবে।আর শেহরেয়ার তো এইবার আর ক্ষমা করবে না আমাকে।”
মেহরিন বাকরুদ্ধ হয়ে বসে আছে।কিছুক্ষণ হেনা সাহেবার দিকে তাকিয়ে থেকে বললো,
-“এমন একটা কাজ করার পরে ক্ষমা পাওয়া কি খুব সোজা হবে মা?এটুকু একটা বাচ্চাকে আপনি ওভাবে ফেলে আসলেন কি করে?একবারও আপনার আত্মা কেঁপে উঠলো না?”
হেনা সাহেবা শাড়ির আঁচলে মুখ গুঁজে কাঁদছেন।মেহরিন উঠে দাঁড়িয়ে কঠিন স্বরে বললো,
-“মা আপনি সবাইকে সবটা বলবেন নাকি আমি বলবো?”
-“কি বলছো তুমি বৌমা?”
-“মা প্লিজ!সবটা সবাইকে বলে দেন।আর পাপ বাড়িয়েন না।”
হেনা সাহেবা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে মেহরিনের সাথে ড্রয়িংরুমে গেলেন।তারপরে সব কথা সবার সামনে বলবেন।সবাই আশ্চর্যের চরম পর্যায়ে চলে গেছে।
শেহরেয়ার চোয়াল শক্ত করে বললো,
-“হাফসা অন্যায় করেছিল!আর তুমি সেই অন্যায়কে প্রশয় দিয়েছিলে মা?এই তোমার নীতি?মা রা নাকি সবসময় ভালো কাজ করে!আর তুমি এমন পাপ কাজ করলে কি করে?তোমার মেয়ের কেলেঙ্কারি লুকাতে এমনটা করতে পারলে?ছিঃ!তোমার সাথে কথা বলারই ইচ্ছা নেই আমার।”
শেহরেয়ার কথাগুলো বলে রুমের দিকে চলে গেল।শেহমীর মির্জা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ হেনা সাহেবার দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন,
-“এইসব করলে কি করে তুমি হেনা?বাড়িতে ফিরলে তুমি তোমার রাস্তা দেখবে!”
হেনা সাহেবা চুপ করে দাঁড়িয়ে আছেন।মেহরিন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
-“বাবা’ মা তো সবটা বলেছেন।এখন না হয় উনাকে মাফ করে দেন।যা হওয়ার ভালোই হয়েছে।উনি এমনটা করায় আমি রায়ানকে আমার ছেলে হিসেবে পেয়েছি।”
মাসুমা বেগম বললেন,
-“হ্যাঁ দাদা,ক্ষমা করে দেন ভাবিকে।উনি নিজের সন্তানের ভালোর জন্যই এমনটা করে ফেলেছেন।”
শেহমীর মির্জা গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
-“আমার যা সিদ্ধান্ত নেওয়ার তা নিয়ে নিয়েছি।”
মেহরিন গিয়ে সেতারা বেগমকে আস্তে আস্তে বললো,
-“দিদু তুমি কিছু করো!তুমি বললে বাবা শুনবেন।”
সেতারা বেগম কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন,
-“শেহমীর,বৌমা যখন সবটা স্বীকার করেছে ও-কে ক্ষমা করে দে।”
শেহমীর মির্জা কিছু বলতে যাবেন উনাকে বাঁধা দিয়ে সেতারা বেগম বললেন,
-“আমি এই বিষয় নিয়ে আর কোনো আলোচনা শুনতে চাই না।”
শেহমীর মির্জা সেখানে না দাঁড়িয়ে রুমের দিকে চলে গেলেন।
মেহরিন রুমে গিয়ে দেখলো শেহরেয়ার পকেটে হাত ঢুকিয়ে বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আছে।তার দৃষ্টি আকাশের দিকে।মেহরিন গিয়ে শেহরেয়ারের পাশে দাঁড়ালো।শেহরেয়ার মেহরিনের দিকে এক পলক তাকিয়ে আবার আকাশের দিকে তাকালো।মেহরিন নিশ্বাস ফেলে বললো,
-“শেহরেয়ার’ মা তো সবটা স্বীকার করেছেন।তুমি উনার উপর আর রাগ করে থেকো না!”
শেহরেয়ার মেহরিনের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললো,
-“মেহরিন তুমি মায়ের এমন অন্যায় কাজ সাপোর্ট করতেছো?”
-“আমি মায়ের এমন কাজ সাপোর্ট করতেছি না।দেখো মা তো সবটা হাফসার ভালোর কথা ভেবে করেছিল!”
-“ভালোর কথা ভেবে এমনটা করবে?এমন অন্যায় কাজ!মেহরিন আমি এইসব নিয়ে আর কিছু শুনতে চাই না।এখানে আমরা এসেছি আনন্দ করতে।এইসব নিয়ে আর কথা বলো না।”
শেহরেয়ার কথাগুলো বলে রুম থেকে বের হয়ে চলে গেল।
_______________________
-“কি থেকে কি হয়ে গেল আপু!কোথায় বেড়াতে এসে মজা করবো,আর কি ঝামেলা হয়ে গেল!”
মুনিয়ার কথায় মেহরিন নিশ্বাস ফেলে বললো,
-“আমার জন্যই তো এতোকিছু ঘটলো।আমি যদি আজকে এইসব না বলতাম!”
হামিদ সেখানে এসে মেহরিনের কথা শুনে বললো,
-“ভাবি আপনি সবটা জানিয়েছেন ভালো করেছেন।সবকিছু ক্লিয়ার হয়ে গেছে।”
শুভ এসে হামিদের পাশে দাঁড়িয়ে বললো,
-“হ্যাঁ ভাবি।হামিদ ভাইয়া ঠিকই বলেছে।”
তারা টুকটাক কিছু কথা বলছে।এমন সময় সেখানে শেহরেয়ার আসলো।শেহরেয়ার মৃদু হেসে বললো,
-“এতো সুন্দর বিকেল!আর আমরা বাড়িতে বসে আছি?চলো সবাই মিলে ঘুরতে যাই।”
মেহরিন অবাক হয়ে বললো,
-“শেহরেয়ার……..”
শেহরেয়ার মেহরিনের গাল ধরে বললো,
-“আমি ঠিক আছি।রেডি হয়ে নেও।”
সবাই রেডি হয়ে বাড়ি থেকে বের হলো গ্রাম ঘুরে দেখার উদ্দেশ্যে!শেহরেয়ার রায়ানকে কোলে নিয়ে মেহরিনের হাত ধরে হাঁটছে।মেহরিন নিচুস্বরে বললো,
-“সবার সাথে এভাবে হাত ধরে হাঁটার মানে আছে?”
শেহরেয়ার ভ্রু কুঁচকে বললো,
-“আমার বউ!আমি তার হাত ধরে হাঁটবো,তাতে কার কি!”
শুভ মুনিয়ার দিকে একটা গোলাপ এগিয়ে দিয়ে বললো,
-“মুনিয়া পাখি এটা আপনার জন্য!”
মুনিয়া কপাল কুঁচকে বললো,
-“আমার দরকার নেই।”
মুনিয়া সামনের দিকে হেঁটে চলে গেল।শুভ বা পাশের বুকে হাত দিয়ে বললো,
-“দিল টু গায়া!”
-“জানও টুট যাওয়ার দরকার ছিল।”
হামিদের কথায় শুভ তার দিকে তাকালো।শুভকে তাকাতে দেখে হামিদ হাসি দিয়ে বললো,
-“আরে আমি তো মজা করেছি।”
#চলবে____
[ভূল-ভ্রান্তি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।]