#প্রেম_প্রেম_পায়
#স্বর্ণালী_সন্ধ্যা
পর্ব ঊনচল্লিশ
৩৯.
আজ তারা ঢাকা ফিরে যাবে।একে একে বাসে উঠছে সকলে।বাস চলা শুরু করলো৷ এই ৫ টা দিন সকলের দারুন কেটেছে। বাস চলছে ঢাকার পথে।
চলতি বাসে ফারাজ সবাইকে সেই কার্ডটা আবার দিল৷তার কাছেই জমা ছিল সবার কার্ড৷ ফারাজ সবাইকে কার্ড দিয়ে নীতির পাশে বসতেই অপরাজিতা দাড়িয়ে বলল,
‘সবাই এখন নিজের অনুভূতি লিখেন।’
আসিফ ইসলাম প্রশ্ন করলেন,
‘চলতি বাসে? হাতের লেখা তো বাজে আসবে।’
রামিসা বেগম বলল,
‘ভালো কবে ছিল?’
হেসে উঠলো সবাই। আবির মাঝখান দিয়ে বলল,
‘বাসে কেন লিখবো আপু৷’
আবির বেচারা এই কয়দিন শুধু বাবা মায়ের পিছনে
পিছনে ঘুরেছে।
অপরাজিতা বলল,
‘বাসায় পৌছে গেলে এখন এর ফিলিংস টা থাকবে না৷ তাই এখনি যেতে যেতে অনুভূতিকে টা আরেকবার অনুভব করে লিখে ফেলেন সবাই।’
সবাই লিখা শুরু করলো। সবার লিখা শেষ হতেই। রাফিয়া বলল,
‘এখন কি এটা কাউকে দিতে পারব আপি?’
ফায়াদ অপরাজিতার পক্ষ থেকে বলে দিল,
‘প্রিয় কাউকে দিতে পারিস বা নিজের কাছেও রাখতে পারিস।’
রাফিয়া খুশি হয়ে তার ভাই রিজুকে কার্ডটা দিল।রিজু অবাক। রাফিয়া তাকে কার্ড দিচ্ছে!সে কার্ডটা নিয়ে পড়লো। পড়ে তার মনে প্রশান্তি বয়ে গেল৷ রিজুকে চুপচাপ দেখে ফারাজ জিজ্ঞেস করলো,
‘কি লিখেছে রিজু?’
রিজু মুচকি হেসে বলা শুরু করলো,
‘আমার একমাত্র বড় ভাই৷ কখনো কি বলা হয়েছে তুমি আমার সবচেয়ে ভালো বন্ধু? তুমি আমার কম্ফোর্ট জোন! বলা হয় নি বোধহয়। আজ বলছি। তুমি আমার সেরা ভাইয়া। আমাকে কখনো একা ফিল হতে দাও নি। আমি যতই বোরিং কথা পকপক করি বা যতই উল্টো পালটা কাজ করি তুমি আমাকে কখনো কোনো বাজে কথা বলো নি। হ্যা ঝগড়া আমরা করি। তবে তোমার পক্ষ থেকে সেটা নিতান্তই আমাকে সঙ্গ দেওয়ার জন্য।আর আমি করি সিরিয়াস ঝগড়া। এই ট্রিপেও তুমি আমাকে আগলে রেখেছো। বেস্ট ফ্রেন্ড এত মতো আচরণ করেছো।তোমার ইচ্ছে না থাকা স্বত্তেও আমার সাথে দৌড়াদৌড়ি খেলেছো। আই লাভ ইউ ভাইয়া।’
রিজু পড়া শেষ করতেই দেখলো সবার মুখে হাসি। রাফিয়ার দিকে তাকাতেই দেখলো রাফিয়ার চোখ চিকচিক করছে।রাফিয়াকে হেসে বলল,
‘ধুরু ইমোশনাল করে দিলি!’
রাফিয়া মিটমিট হেসে বলল,
‘কাদো এখন!’
ফারাজ হেসে বলল,
‘কাদতে হবে না৷ আমি এন্টারটেইনমেন্ট দিচ্ছি। দাড়া।’
ফারাজ উঠে তার মায়ের কাছে গেল। মাকে কার্ড টা দিয়ে বলল,
‘সারপ্রাইজ!’
আখি বেগম হেসে কার্ডটা খুলে প্রথমে নিজে কার্ডটা পড়লেন।তারপর খুশিতে চিল্লানি দিয়ে উঠলেন! ফারদিন আহমেদ উনার চিল্লানি শুনে কানে হাত দিয়ে বললেন,
‘আহা চিল্লাও কেন?’
আখি বেগম কার্ডটি ফারদিন আহমেদের কাছে দিলেন। ফারদিন আহমেদ জোরে পড়তে শুরু করলেন,
‘মা! তোমার দোয়া কাজে লেগেছে।তোমাকে মণি ডাকা মেয়েটাকে হুট করে মনে ধরে ফেলেছে। এখন বিয়ে দাও।’
পুরোটা পড়া শেষ হলেই অপরাজিতা সিটি বাজিয়ে উঠলো।সিট থেকে দাঁড়িয়ে বলল,
‘আরে বাহ ভাইয়া আপনি তো ফাটিয়ে দিয়েছেন!সময় বুঝে ছক্কা করে দিলেন!’
আর সবাই চিল্লিয়ে উঠলো।ফায়াদ হাত ধরে অপরাজিতাকে আবার বসিয়ে দিল।
নীতি লজ্জা পেল। ভীষণ লজ্জা পেল। এভাবে সবার সামনে বোম ফাটালো। বাসায় গিয়ে ধীরে সুস্থে বলা যেত না!
ফারদিন আহমেদ বললেন বাসায় গিয়ে এ ব্যাপারে কথা হবে।
———————
ঢাকায় ফিরে সকলে ব্যস্ত হয়ে গেল নিত্য দিনে। রাফিয়া, রিজু নিজেদের বাসায় চলে গিয়েছে। অপরাজিতা অ্যাডমিশন এর জন্য পড়াশোনায় ব্যস্ত। ফায়াদ হাসপাতালে ব্যস্ত। তবে আগের মতো এক্সট্রা টাইমে হাসপাতালে থাকে না সে। এতো ব্যস্ততার মাঝেও তাদের প্রেম কমে নি। অপরাজিতা হুটহাট চলে আসে ফায়াদকে দেখতে। ফায়াদও কিছুটা দুষ্ট মিষ্টি প্রেমে অপরাজিতাকে লজ্জায় ফেলে।
অন্যদিকে ফারাজ নীতিও প্রেমে ডুবে আছে। নীতি নিজেকে সামলে চললেও ফারাজ যেন বেপরোয়া।
ফারাজ নীতির বিয়েটা পেন্ডিং। কারন ফারদিন আহমেদ চাচ্ছিলেন যেন দুই ছেলের বিয়ে একসাথে ধুমধাম করে করবেন। কিন্তু ফারাজ কোনো বিশাল আয়োজন চাচ্ছে না। সে ঘরোয়াভাবে চাচ্ছিল। কিন্তু আখি বেগম আর ফারদিন আহমেদ তাকে অনেক কসরত করে মানিয়েছে।
কিন্তু আজ ফারাজের কি হলো কি জানি! অফিস থেকে বাসায় এসেই ঠাস করে দরজা লাগিয়ে দিয়েছে। বুঝাই যাচ্ছে খুব রেগে আছে। নীতি বসার রুমে দাঁড়িয়ে ঢোক গিলল।এতো জোরে আওয়াজ শুনে আখি বেগম নীতিকে জিজ্ঞেস করলেন,
‘এটার আবার কি হলো?’
নীতি আমতা আমতা করে বলল,
‘আসলে মণি!’
বলতে বলতে ফারাজ আবার বসার রুমে আসলো।নীতির দিকে না তাকিয়ে তার মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘আমি বিয়ে করবো।তাও আজকেই। আমার কোনো আয়োজন লাগবে না। বউ লাগবে!’
ফারদিন আহমেদ সোফায় বসে ছিলেন। ছেলের কথা শুনে বললেন,
‘ওয়াও!’
আখি বেগম চোখ গরম করে তাকালেন স্বামীর দিকে। তারপর ফারাজের দিকে তাকিয়ে চিন্তিত সুরে বললেন,
‘কি হয়েছে বাবা?এতো রেগে আছিস কেন?’
ফারাজ বলল,
‘চলো আমার সাথে। আমি কাজী অফিস গিয়ে বিয়ে করবো।’
ফারাজ কারো কোনো কথা শুনলো না। সবাইকে গাড়িতে বসিয়ে কাজী অফিসের উদ্দেশ্যে রওনা হলো৷ নীতি ভয়ে কিছু বলছে না। ফারাজ ভীষণ রেগেছে আজ।
পথিমধ্যে ফারদিন আহমেদ কল দিল ফায়াদকে। ফায়াদ অপরাজিতাকে নিয়ে সন্ধ্যার ডেট করছিল৷ আজ অনেকদিন পর দুজনে একসাথে বেরিয়েছে। তাছাড়াও ২ দিন পর অপরাজিতার অ্যাডমিশন পরীক্ষা তাই আজ মাইন্ড ফ্রেশের জন্য বের হওয়া।
অপরাজিতা আর ফায়াদ ফুচকার দোকানে ছিল তখন। অপরাজিতা ফুচকা খাচ্ছিল। ফায়াদ ফুচকা খায় না। সে দাঁড়িয়ে ছিল। কল আসায় রিসিভ করলো,
‘হ্যা বলো।’
‘কাজী অফিস যাচ্ছি। অপরাজিতা মামুনিকে নিয়ে আসো।’
ফায়াদ ভ্রু কুচকে বলল,
‘তুমি আবার বিয়ে করছো নাকি?কাজী অফিস কেন?’
অপরাজিতা বোঝার চেষ্টা করছে ফায়াদ কার সাথে কথা বলে। তার গালে এখনো ফুচকা।
ফায়াদের কথা শুনে ফারদিন আহমেদ ধমকে উঠলেন,
‘অসভ্য! বাপের সাথে এভাবে কথা বলে? আমি আবার বিয়ে করবো কেন?’
ফারদিন আহমেদের কথা শুনে নীতি সামনের সিট থেকে হেসে দিল। ফারাজ চোখ গরম করে তাকাতেই আবার চুপ হয়ে গেল।
ফায়াদ বলল,
‘ওহ আচ্ছা তাই বলো। কার বিয়ে?’
‘ফারাজের!’
ফায়াদ খুব স্বাভাবিক ভাবে বলল,
‘অহ আসছি।’
বলে ফোন কেটে দিল। ফোন রাখতেই দেখলো অপরাজিতা উৎসুক চোখে তাকিয়ে আছে।
ফায়াদ ফোন পকেটে রাখতে রাখতে বলল,
‘চলো কাজী অফিস’
অপরাজিতা ফুচকা চিবাতে চিবাতে বলল,
‘ উই আর অলরেডি ম্যারিড!’
ফায়াদ ফুচকার বিল দিতে দিতে বলল,
‘আমার টুইন এর বিয়ে’
‘অহ আচ্ছা—ওয়াট??’
দাঁড়িয়ে গেল অপরাজিতা।ফায়াদ হেসে বলল,
‘ইয়েস!’
‘ফারাজ ভাইয়ার বিয়ে। এভাবে? হুট করে? আমি ভেবেছিলাম নাচবো!’
ফায়াদ অপরাজিতার হাত ধরে হাটতে শুরু করে বলল,
‘এখনও নাচতে পারো তবে তার আগে কাজী অফিস যেতে হবে।কুইক!’
তারা কাজী অফিসে পৌছাতেই দেখলো বাকিরা তাদের জন্য সব রেডি করে বসে আছে। তারা আসবে আর ফারাজ কবুল টা বলে ফেলবে এই অপেক্ষা করছিল যেন।
অপরাজিতা সবার দিকে তাকিয়ে বলল,
‘এভাবে বিয়ে? নরমাল পোশাকে?’
ফারাজ বলল,
‘কবুল বলে নেই তারপর ঝিকঝিক সাঝবো নে’
অপরাজিতা ফিক করে হেসে দিল।আখি বেগমের কাছে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
‘কি ব্যাপার মামনি? ভাইয়া এমন রেগে আছে কেন?’
আখি বেগম বললেন সে জানে না৷ কাজী বিয়ে পড়ানো শুরু করলো। ফারাজকে কবুল বলতে বললে সে এক সেকেন্ডও দেড়ি করলো না। তা দেখে অপরাজিতা বলল,
‘ আপনি তো কাজীর থেকেও ফাস্ট’
নীতি একটু টাইম নিচ্ছিল কবুল বলতে। ফারাজ এমনভাবে তাকালো যে নীতি সাথে সাথে বলে দিল৷ বিয়ে টা হয়ে গেল কোনো আয়োজন ছাড়া। নীতি হয়তো ভাবেও নি তার বিয়ে এভাবে হবে। সে নিজেও জানলো না আজ তার বিয়ে!
বিয়ে শেষ হতেই ফারাজের মুখে হাসি ফুটলো। সে আড়মোড়া দিয়ে দাঁড়িয়ে বলল,
‘যাক খাতাম!’
তারপর মা বাবার দিকে তাকিয়ে বলল,
‘রাগ করেছো তোমরা?’
আখি বেগম ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
‘না।কিন্তু বাবা এভাবে হুট করে?’
‘স্যরি মা’
আখি বেগম বললেন,
‘আচ্ছা এখন আগে বাসায় চল।’
ফারাজ বলল,
‘না। এখন যাবো না আমি।’
অপরাজিতাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
‘পুচকি ভাবি ক্ষুধা লেগেছে আপনার? চলেন আপনাকে খাওয়াবো।’
তারপর ফায়াদকে উদ্দেশ্য করে বলল,
‘ভাই! তুই আমার বউ আর মা বাবা কে নিয়ে বাসায় যা।তোর পুচকি ফুলের সাথে ডিনার করা লাগবে আজ আমার। তাকে আমি পৌঁছে দিব।সমস্যা আছে?’
ফায়াদ নীতিকে উদ্দেশ্য করে বলল,
‘চলো নীতি তোমাকে আমি আমার হাতের স্পেশাল কফি খাওয়াবো’
অপরাজিতা ভেঙচি কাটলো ফায়াদকে। ফারাজ অপরাজিতাকে বলল,
‘ডিয়ার লিটল ভাবি। আগে হাটুন!’
অপরাজিতা হাসতে হাসতে হাটা স্টার্ট করলো।
ফায়াদ নীতি আর মাবাবা কে নিয়ে বাসায় এসে পড়লো। আখি বেগম গিয়েছেন রাতের খাবারের আয়োজন করতে। যতই হোক বিয়ে হয়েছে একটু আয়োজন তো লাগবেই। ফারদিন আহমেদ তার রুমে গেলেন।
ফায়াদ নীতি সোফায় বসে ছিল। ফায়াদ জিজ্ঞেস করলো,
‘এবার বলো তো নীতি ফারাজকে রাগিয়েছে কে?’
নীতি মাথা চুলকে বলল,
‘আমি’
‘কি করেছো?’
নীতি মেকি হেসে বলা শুরু করলো।
বাড়ি ফেরার আগের কথা। নীতি অফিসের এক এমপ্লয়ির সাথে হেসে হেসে কথা বলছিল। সে নতুন হায়ার হয়েছে।ছেলেটা নীতির থেকে বড়জোর ২/৩ বছরের বড় হবে।নীতির সাথে কথা বলে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে। নীতির সাথে বন্ধু হয়ে গিয়েছে।আর ফারাজকে বিষয় টা অনেক জ্বালায়। সে নীতিকে নিষেধ করেছিল বেশি কথা বলতে। নীতি তার কথা শুনলে তো!
নীতিকে ফারাজ কেবিনে ডাকলো।নীতি কেবিনে প্রবেশ করতেই ফারাজ নীতিকে বলল,
‘খুব কথা হচ্ছিল?’
নীতি হেসে বলল,
‘হ্যা।হি ইজ সো ফানি!’
‘শাট আপ!!’
ধমক খেয়ে নীতি ভ্রু কুচকে বলল,
‘ধমক দেন কেন?’
‘আপনি ওই ছেলের সাথে কথা বলেন কেন?’
‘কথা বললে কি হয়?’
‘বলবেন না’
নীতিরও জিদ চেপে গেল। আজব তো কথা বলা বন্ধ করে দিবে নাকি সে?
সে জিদ দেখিয়ে বলল,
‘আমি বলবোই’
‘আপনাকে আমার কথা শুনতে হবে নীতি’
‘কেন শুনবো?’
‘কারন আমি—‘
‘আমি বয়ফ্রেন্ড এর কথা শুনি না। আগে জামাই হোন তারপর যা বলবেন শুনবো। তার আগে মুড়ি খান।’
ফারাজ বিস্মিত! এই মেয়ে তাকে এভাবে বলল! বিয়ে হয় নি বলে কথা শুনবে না তার?
রাগ চেপে গেল মাথায়।সে রাগ দেখিয়ে বলল,
‘আচ্ছা তো আমার কথা শুনবেন না এখন! শুনবেন না তাই না?কিভাবে না শোনেন আমিও দেখি!’.
বলে নীতিকে হাত ধরে টেনে গাড়িতে উঠালো।নীতি তো হঠাৎ এতো রাগ দেখে ভ্যাবাচেকা খেয়ে গিয়েছে।তারপর তো বাসায় এসে হলো এসব।
ফায়াদ সব টা শুনলো মনোযোগ দিয়ে। তারপর বলল,
‘তুমিও পারো!শুনো এখন তার কথা সব!ওকে তো চিনো না। দেখো কি কি করায়?’
বলে হাসতে লাগলো।
এদিকে অপরাজিতা রেস্টুরেন্টে পেট ভরে খেয়ে আরামসে বসলো। ফারাজও খেলো। ফারাজ অপরাজিতাকে বলল,
‘আপনাকে দেখে বোঝা যায় না আপনি এতো খেতে পছন্দ করেন।’
অপরাজিতা চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে বলল,
‘খাইয়ে খোটা দিচ্ছেন!’
‘নো নো’
‘আচ্ছা এবার বলেন তো কাহিনী কি? এভাবে বিয়ে করলেন কেনো ভাইয়া?’
ফারাজ জোরে শ্বাস নিয়ে সব বলল।সব শুনে অপরাজিতা হাসতে হাসতে শেষ।সে হাসতে হাসতে বলল,
‘এতো জেলাসি ভাইয়া!’
ফারাজ হালকা হেসে মাথা চুলকালো৷
‘আচ্ছা পুচকি ফুল!নীতিকে কি দেওয়া যায় বলেন তো। বিয়ে এভাবে হয়ে গেল তাকে কিছু দেওয়া দরকার’
‘আগে আমার নাম ঠিক করে বলুন। একবার পুচকি ভাবি একবার পুচকি ফুল!’
‘হলো! হলো! একই।’
অপরাজিতা ফারাজকে আইডিয়া দিল৷ ফারাজ শুনে অবাক এবং তার কাছে মজাও লেগেছে।তার ভাই যে এই বুদ্ধি বাক্স কোথায় পেয়েছে কে জানে?
ফারাজ বাসায় ফিরে দেখলো তার জন্য সবাই অপেক্ষা করছে। তাকে দেখেই ফায়াদ জিজ্ঞেস করলো,
‘অপরাজিতাকে পৌছে দিয়েছিস?’
‘ইয়াপ ব্রাদার’
আখি বেগম ফারাজকে নিয়ে নীতির পাশে বসালেন৷ তারপর দুজনকে মন ভরে দোয়া দিলেন৷ তার ছেলেটা জীবনে এগিয়ে গিয়েছে এটাই তার জন্য অনেক।তিনি নীতিকে কিছু জিনিস দিলেন যা ছেলের বউ হিসেবে নীতির পাওনা। ফারদিন আহমেদ নীতিকে বললেন,
‘ওয়েলকাম ব্যাক আমার পারমানেন্ট মেয়ে হিসেবে।’
এতো ভালোবাসা একসাথে পেয়ে নীতি কেঁদে দিয়েছে।আখি বেগম তাকে বুকে জড়িয়ে অনেকক্ষণ ভালোবাসা দিলেন।
বর্তমানে নীতি বসে আছে ফারাজের রুমে। আখি বেগমই পাঠিয়েছেন। ফারাজ আগেই রুমে এসে পড়েছে। শাওয়ার নিচ্ছে। নীতি বিছানায় বসে আছে।
ওয়াশরুম থেকে বের হতেই ফারাজের চোখ গেল নীতির দিকে ৷ দেখেও কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না। সদ্য শাওয়ার নেওয়া ফারাজকে টাউজার আর টিশার্টে খুবই কিউট লাগছে।
‘স্যার!’
ফারাজ কিছু বলল না।সে সোজা বারান্দায় চলে গেল।
নীতি ফারাজের পিছু পিছু গেল। ফারাজ তার সাথে রেগে আছে ভেবেই তার খারাপ লাগছে এখন। নীতি মাথা নিচু করে বলল,
‘স্যরি’
ফারাজ নীতিকে একটা আংটির বক্স এগিয়ে দিল। ঠান্ডা কন্ঠে বলল,
‘নিন আপনার জন্য পাঠিয়েছে’
‘কে?’
‘আপনার আশিক।আর কে? আমি ভাবতে পারি নি নীতি আপনি আমার সাথে এরকম করবেন’
নীতি ফারাজের এভাবে কথা বলা শুনে কেদে দিল।ফারাজ কার কথা বলছে? তার কারো সাথে কিছু নাই। সে শুধু ফারাজকেই ভালোবাসে।
কান্নারত কন্ঠে বলল,
‘আমি জানি না কে? আমি কিছু করি নি।’
নীতির কান্না দেখে ফারাজের ভালো লাগলো না। সে বাক্সটা খুলে নীতিকে আংটি পড়াতে পড়াতে বলল,
‘পুচকি ফুলের আইডিয়া কাজে লাগাতে পারলাম না। আপনি কেদেকেটেই অস্থির।আমি দিয়েছি রিং।আপনার আশিক আমি। আর কে হবে?’
নীতি থম মেরে আছে। এখনো ফোপাচ্ছে সে। ফারাজ তাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
‘কাদবেন না। প্রিয় মানুষগুলো কাদলে ভালো লাগে না আমার।’
নীতি ফারাজের বুকে কিল মেরে বলল,
‘আপনিই কাদান আমাকে’
ফারাজ হালকা হেসে বলল,
‘দুঃখিত!’
নীতি জড়িয়ে রইলো ফারাজের বুকে। ফারাজ ভাবতে লাগলো তার জীবন নিয়ে। খালি বুকটা আবার পূর্ণ হলো। জীবনে দ্বিতীয়বার ভালোবেসে কাউকে জড়িয়ে নিল। প্রথম ভালোবাসা সে কখনো ভুলবে না।তাকে হারিয়ে জীবনটা অর্থহীন হয়ে উঠেছিল তবে শেষ জনকে হারাতে দিবে না।
———————-
দিন গেল দিনের মতো। অপরাজিতার চান্স হয়েছে পাবলিকে। সে তো মহা খুশি। তার পাবলিকে চান্স পাওয়া নিয়ে তার শ্বশুর আর বাবা সারা এলাকা মিষ্টি বিলিয়েছে। সে কি এক কান্ড!
এখন ভার্সিটি যেহেতু চান্স হয়ে গিয়েছে তাই বিদায়ের ঘন্টাও বেজে উঠেছে অপরাজিতার। বাড়িতে লেগে গেল বিয়ের ধুম।সকলে মহা ব্যস্ত। আসিফ ইসলামের একমাত্র মেয়ের বিয়ে তাই কোনো কমতি রাখছেন না তিনি।
ফায়াদের বাড়িতে বিয়ের আয়োজন দ্বিগুন কারন ফায়াদের সাথে ফারাজের বিয়েটাও অনুষ্ঠান হচ্ছে। ফারাজ তো অনেকবার না বলেছে কিন্তু এবার আর ফারদিন আহমেদ শুনলেন না।
আজ গায়ে হলুদ। ছেলে মেয়ে উভয়ের একসাথেই হলুদ হচ্ছে কমিউনিটি সেন্টারে। সবাই এসে একে একে হলুদ লাগাচ্ছে উভয় জোড়াকে। চারজনকেই হলুদে ভুত বানিয়ে দিয়েছে সকলে। এ নিয়ে হাসাহাসির শেষ নেই। রাফিয়া তো বার বার স্টেজে উঠছে আর হলুদ লাগাচ্ছে। অবশেষে ফায়াদ রাফিয়ার স্টেজে উঠা নিষিদ্ধ ঘোষণা করে দিল। রাফিয়া নাকি আবার স্টেজে উঠলে তাকে ফায়াদ তেলাপোকা ওয়ালা রুমে ছেড়ে দিবে।এ নিয়ে রাফিয়ার বকবকানির শেষ নেই। সে ফায়াদ ফারাজের চৌদ্দ গোষ্ঠী ধুয়ে দিচ্ছে মনে মনে।আপন মনের খেয়ালে ব্যস্ত থাকার মাঝে হুট করে কেউ তার সামনে কোক এগিয়ে দিয়েছে। কোক আনা ব্যক্তিটির দিকে তাকাতেই তার মুখে হাসি ফুটলো।
‘সামির ভাই’
সামির কেশে বলল,
‘তুমি ইদানীং একটু বেশিই ভাই ভাইয়া করো’
রাফিয়া পাত্তা না দিয়ে কোক নিয়ে খেতে খেতে বলল,
‘নিজের ভাইরা যেখানে দুশমন আর কি বলব? তাই আপনাকে ভাইয়া বানিয়ে মনকে শান্তনা দিচ্ছি।’
সামির রাফিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,
‘আমি তো ভাইয়া হতে চাই না তোমার।’
‘তো কি হতে চান?’
সামির বাকা হেসে বলল,
‘সেটা না জানার মতো বোকা তুমি নও’
বলে সামির চলে গেল সেখান থেকে। রাফিয়াকে রেখে গেল গোলকধাধায়। রাফিয়া অজানা কিছু অনুভব করলো। সেটা বুঝতে পেরেই কোক খাওয়ার গতি বাড়িয়ে দিল সে।ভাইয়া হতে চায় না তাহলে কি হতে চায়?সাইয়া?
হলুদ দেওয়া শেষ হতেই অপরাজিতা আগে ছুটলো ওয়াশরুমে।তার ফ্রেশ হওয়া দরকার। ফ্রেশ হয়ে মুখ ধুয়ে বের হতেই ফায়াদ তাকে টেনে নিয়ে গেল সেন্টারের এমন এক কর্নারে যেখানে মানুষের আনাগোনা একদম কম।
‘আরে আরে এখানে এনেছেন কেন?’
ফায়াদ বলল,
‘আমি হলুদ লাগাই নি তো’
‘তো?’
‘তো আমি এখন হলুদ লাগাবো। ‘
‘একদম না আমি মাত্র ধুয়েছি–‘
বলতে না বলতেই ফায়াদ তার হলুদ মাখানো বলিষ্ঠ হাত দিয়ে অপরাজিতার শাড়ি ভেদ করে উন্মুক্ত পেটে ছুয়ে দিল। অপরাজিতা নিঃশ্বাস আটকে দাঁড়িয়ে পড়লো। তা দেখে বাকা হাসলো ফায়াদ। অপরাজিতা কানের লতিতে চুমু খেয়ে কানে ফিসফিস করে বলল,
‘তোমাকে মারাত্নক লাগছে। ইচ্ছে তো করছে–‘
শেষ করতে দিল না অপরাজিতা। ফায়াদের কাধ খামচে ধরে জোড়ে শ্বাস নিতে নিতে বলল
‘ফায়াদ স্টপ!’
ফায়াদ অপরাজিতা কপালে চুমু খেয়ে আদুরে স্বরে বলল,
‘ওকে বাট কাল কোনো স্টপ নেই।’
গলায় চুমু খেয়ে বলল,
‘ঘ্রাণ টা নেশা ধরিয়ে দেয়।’
তারপর অপরাজিতার থেকে একটু দূরে সরে হাত বাড়িয়ে মিটমিট হেসে বলল,
‘চলো এখান থেকে। আমাদের খুজবে দেড়ি করলে’
অপরাজিতা তাকিয়ে রইলো সেই হাসির দিকে৷ বাড়িয়ে রাখা হাতটা ধরে চলতে লাগলো ফায়াদের সাথে। মনে মনে বলল,
‘সারাজীবন চলতে চাই এই হাত ধরে’
আজ নীতি আর অপরাজিতা একসাথে থাকবে অপরাজিতাদের বাসায়। কাল বিয়ের পর একসাথে বাড়িতে প্রবেশ করবে বাড়ির দুই বউ।নীতি আর অপরাজিতা শুয়ে আছে বিছানায়। অনেক রাত হয়েছে।উত্তেজনায় ঘুম আসছে না কারোরই। অপরাজিতা বার বার এপাশ ওপাশ করছে। নীতি তা দেখে মোলায়েম কন্ঠে বলল,
‘কি হয়েছে?’
অপরাজিতা নীতির দিকে পাশ ফিরে বলল,
‘ভয় লাগছে।’
‘কেন?’
‘জানি না। নতুন জীবন শুরু এজন্য বোধহয়।’
নীতি অপরাজিতাকে ভরসা দেওয়ার চেষ্টা করছে। তাদের কথা বলার মাঝে ফোন এলো ফায়াদের। ফোন ধরেই অপরাজিতা বলল,
‘এতো রাতে!’
‘অপরাজিতা ভাবি আমি ফারাজ!’
ফারাজের কন্ঠে অস্থিরতা। যা শুনে মুহুর্তে অস্থির হয়ে গেল অপরাজিতা।সে বিচলিত কন্ঠে শান্ত থাকার চেষ্টা করে বলল,
‘ভাইয়া আপনি? এই নাম্বারে কেন? ডাক্তার সাহেব কোথায়?’
ফারাজ অসহায় কন্ঠে বলল,
‘সবাইকে নিয়ে হাসপাতাল আসুন প্লিজ’
(চলবে)