#বৃষ্টিভেজা_আলাপন (৩১)
“এই মেয়ে, ওভাবে বৃষ্টিতে ভিজছো কেন?”
“আপনিও আসেন না।”
“জ্বর বাঁধানোর শখ হয়েছে?”
“একটু আধটু জ্বর হলে কিছু হয় না।”
“উষশী এখনি চলে আসো।”
“না,না আমি আরো থাকব। এই বৃষ্টিটা খুবই দারুণ।”
“তোমার কাছে কোন বৃষ্টিটা দারুণ নয় বলো তো।”
“যে বৃষ্টিতে অভিরাজ থাকবে না।”
বাক্যটি শেষ করে আরেকটু এগিয়ে গেল উষশী। উঠানের সামনের জায়গাটুকু বাঁধাই করা বিধায় বেশ স্বাচ্ছন্দ্যের সাথে ঘুরছে সে। অন্যদিকে অভিরাজ শান্ত সুমদ্রের মতো দাঁড়িয়ে। এক চুলও নড়ছে না ছেলেটা। ওর মস্তিষ্কে উষশী’র বলা শেষ কথাটা ঘুরপাক খাচ্ছে। বুকের ভেতরটা কেমন রিক্ত হতে শুরু করেছে। হুট করেই প্রচন্ড রাগ হলো ওর। ভরা বৃষ্টিতে নেমে গেল সে। উষশী’র বাহু চেপে ধরে একদম কাছে টেনে নিল।
“বাহ আপনিও ভিজতে শুরু করলেন।”
“একটু আগে কি বললে?”
“কি বললাম?”
“মনে করো।”
“আরে বাবা কোনটা?”
“উষশী, তোমার জীবনে এমন কোনো বৃষ্টি আসবে না যে বৃষ্টিতে অভিরাজ থাকবে না।”
উষশী কেমন করে তাকাল যেন। অভিরাজের ভেতরের ব্যথাটা বোধহয় অনুভব করার চেষ্টা চালাল।
“জেদি মেয়ে, জানো আমার বুকের ভেতরে প্রচন্ড যন্ত্রণা হচ্ছে। আর কখনো এভাবে বলবে না। তুমি কখনো হারিয়ে গেলে অভিরাজের জীবন থমকে যাবে।”
ভরা বৃষ্টিতে ছোট্ট মেয়েটিকে দু হাতে আগলে নিল অভিরাজ। বৃষ্টি’র জলে ভিজে একাকার ওরা। অভিরাজের বুকের ভেতর থেকে আসা লাব ডাব শব্দ যেন শোক নামাল। উষশী ধীরে ছেলেটির পিঠে হাত রাখল। তার দু চোখের নোনা জলের সাথে বৃষ্টির জল মিশে যাচ্ছে। সন্ধ্যায় দেওয়া কাজল টুকুও লেপ্টে গিয়েছে। তবু কতটা সুন্দর লাগছে তাকে!
বর্তমান
অতীতের সবটুকু ব্যথা ভুলে গিয়ে অভিরাজ আজ বিমানবন্দরে। তার সাথে রয়েছে লাবণ্য আর ঈশান ও। শুরুতে ঈশানের যাওয়ার কথা ছিল না। তবে কোন মতলবে যেন এল ছেলেটা। এতে অবশ্য সবথেকে খুশি হয়েছে অভিরাজ। ছোঁয়া’র সাথে ঈশানের বিষয়টা শুধুমাত্র সে জানে। এত বছরেও পাঁচ কান হয় নি ঘটনাটা। আসলে ঈশান ই চায় নি এই ঘটনাটা আর কেউ জানুক। নিজের ব্যক্তিগত ঝামেলার কারণে ছোট ভাইকে মানসিক সাপোর্ট দেওয়া হয়ে উঠে নি। একটা বোধ থেকে কেমন কষ্ট হচ্ছে। মাত্র কয়েক ঘন্টার পার্থক্যে ডেনমার্ক চলে এসেছে ওরা। সেখান থেকে সোজা উঠল হোটেলে। তিন মাসের লম্বা সফরের জন্য এসেছে! ঈশান নিজ রুমের চাবি নিয়ে আগেই উঠে গেল। লাবণ্য সেদিকে তাকিয়ে চেচাল। “শ য় তা ন একটা। আমাদের জন্য দাঁড়াল না অবধি!”
“ওকে ওর মতো থাকতে দে লাবণ্য।”
“সারাজীবন কি দেবদাস হয়ে থেকে যাবে? ওর কাহিনীটা রহস্যই রয়ে গেল। এমন ভাবে বদলে গেল!”
এ ব্যপারে মন্তব্য করল না অভিরাজ। ওর থেকে সাড়া না পেয়ে থেমে গেল লাবণ্যও। একটা গভীর শ্বাস ফেলল। সত্যি বলতে ওদের প্রত্যেকের জীবনই ভীষণভাবে অগোছালো। অভি তাকে বার বার নিজের জীবন গুছিয়ে নিতে বললেও সে পারে নি গোছাতে। সর্বদাই মনে হয়েছে শেষ দিন অবধি অভি’র পাশে থাকতে হবে। সেটা হোক স্বার্থপর হয়ে কিংবা স্বার্থহীনভাবে। দিন শেষে একটাই সত্য অভি’র পাশে থাকছে সে। নিজ রুমে এসে লম্বা শাওয়ার নিল অভিরাজ। ঘরের মাঝ বরাবর দেয়াল জোড়া আরশি রাখা। সেখানে নিজের অবয়ব দেখা যাচ্ছে। অদ্ভুত ভাবে কেঁপে উঠল ছেলেটা। অন্তঃকরনে কেমন জ্বালা করছে। একটা ধারালো ব্যথা গলায় এসে উৎপাত চালাচ্ছে। এত বছর পর ও নিজের মাঝে কোনো পরিবর্তন খুঁজে পাচ্ছে না। অথচ এমন হওয়ার কথা ছিল না। যতটা মানসিক অবসাদের মাঝে গিয়েছে এতে করে গঠন ভেঙে যাওয়ার কথা ছিল। অথচ এমনটা হয় নি। পাঁচ বছর কি কম সময়? নাকি লাবণ্য’র করা যত্ন গুলোই এই সৌন্দর্যের একমাত্র রহস্য।
অতীত
উষশী’র চোখের কাজল লেপ্টে গিয়েছে। কিশোরী’র শ্বেত রঙা গালে কালো বর্ণটা একেবারে ফুটে উঠেছে। ওর অবস্থা দেখে হেসে উঠল অভিরাজ। নিজ হাতের কনিষ্ঠা আঙুলের সাহায্যে সেটা মুছে দিয়ে শুধাল, “আরো বৃষ্টিতে ভিজতে চাও?”
“উহু।”
“চলো তাহলে। ঠান্ডা না লেগে যায়। কি যে করো তুমি। একটা কথাও শোনা না।”
কথা শেষে মেয়েটিকে নিয়ে পথ আগাল অভিরাজ। ইরা আর রত্না ড্রয়িং এ বসে গল্প করছিল। দুজনকে কাকভেজা হয়ে ফিরতে দেখে একে অপরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করল।
“এ মা,ভিজলে কেমন করে ভাইয়া?”
“যেভাবে মানুষ ভিজে।”
“ইচ্ছে করে ভিজেছ তোমরা?”
“তেমনি কিছুটা। সব কথা রেখে উষশী’কে দ্রুত ঘরে নিয়ে যা। চেঞ্জ করা হলে হাতের তালুতে তেল মালিশ করে দিবি। ঠান্ডা লাগার চিন্তা আছে।”
ভাইয়ের কথা গুলো মনোযোগ দিয়ে শুনল ইরা। নিজের জন্যে একটুও চিন্তা নেই। অথচ উষশী’র নখের যত্ন নিতেও ভুল করছে না! এর মধ্যেই যা বোঝার বুঝে নিয়েছে রত্না। সে মৃদু হেসে চা বসাতে গেল। অভিরাজ নিজ ঘরে আসতেই লাবণ্যকে দেখতে পেল। লাবণ্য কাজ করছে। মুখের ভঙ্গিমা বিশেষ ভালো নয়।
“একটা ইম্পর্টেন্ট মেইল এসেছে। চেইক করিস তো।”
“কিসের মেইল?”
“হসপিটাল থেকে। ম্যানেজার পাঠিয়েছেন।”
“ঠিক আছে। আমি দেখে নিয়ে তোকে সেন্ড করছি।”
“তার আগে চেঞ্জ করে আয়।”
“ও হ্যাঁ। তুই তাহলে বোস।”
অভিরাজ চলে যেতেই ফের কাজে ব্যস্ত হলো লাবণ্য। বাড়ির বড়ো মেয়ে হওয়াতে তার দায়িত্ব একটু বেশিই যেন। সে কাজ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়লেও কাউকে বলে না। অভিরাজের সাথে এই একটা দিক বড়ো মিল তার। দুজনেই কাজের প্রতি ভীষণভাবে দায়িত্বশীল।
উষশী ড্রেস চেঞ্জ করে অভিরাজের কাছেই এসেছিল। সেখানে লাবণ্যকে দেখে ফিরে গেল। কাজের সময় বিরক্ত করতে চাচ্ছে না। পথে দেখা হলো রত্না’র সাথে। মেয়েটার হাতে চা। সেখান থেকে এক কাপ তুলে নিয়ে কি মনে করে যেন আরেকটা কাপ ও নিল। অভিরাজের রুমের ঠিক বিপরীত পাশের করিডোরের প্রথম ঘরটা ঈশানের। ছেলেটা শুয়ে আছে। ফোনের দিকে তার গভীর দৃষ্টি। বাইরে থেকেই নক করল উষশী। নড়ে উঠল ঈশান। মলিনতা সরিয়ে কণ্ঠে ছন্দ ফিরিয়ে বলল,”আরে উষশী! হোয়াট লাক আই হ্যাভ। বাইরে দাঁড়িয়েছ কেন?”
“এখানটায় ই ঠিক আছি। ঈশান তোমার সাথে আড্ডা দিতে চাচ্ছিলাম। খুব বোরিং ফিল হচ্ছে।”
“জাস্ট আ মিনিট।”
ঘরের স্যান্ডেল পায়ে দিয়ে ঝটপট চলে এল ঈশান। অভিরাজের মতোই লম্বা ছেলেটা। কিশোরী’র নিকটে আসতেই একটা মন ভালো করা সুবাস মিলে। উষশী চায়ের কাপ এগিয়ে দিল। মৃদু হাসল সে। চায়ের কাপ নেওয়ার সময় ঝলমলে বাদামি রঙা চুল গুলোর দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুচকে ফেলল।
“চুল ভেজা কেন?”
“বৃষ্টিতে ভিজেছি।”
“উইথ ব্রো?”
“হুম।”
“ফাইনালি ইউর লাভ হেজ স্টার্টটেড।”
“কাইন্ড অফ। বাট ঈশান, ওয়ান থিংক আই ডোন্ট আন্ডারস্ট্যান্ড।”
“সেটা কেমন?”
“আমাদের সম্পর্কের ভবিষ্যৎ কি।”
“চিল ইয়ার। ব্রো তোমাকে কতটা চায় সেটা তো দেখছোই।”
উষশী একদমই চুপ হয়ে রইল। করিডোর দিয়ে চলতে চলতে বারান্দায় এসে দাঁড়াল। বৃষ্টি থেমে গেছে। সাথে আসছে ভেজা মাটির সৌরভ। কিন্তু কেন যেন উষশী’র মন ভালো হচ্ছে না। একটা চাপা দুঃখ ওকে প্রচন্ড বেগে আ ঘা ত করে চলেছে। যেন একটু একটু করে শোকের প্রহর নেমে আসছে।
ঘুমন্ত মেয়েটিকে এভাবে নিয়ে আসতে একদমই ইচ্ছে হচ্ছিল না অভিরাজের। আবার ঘুম ভাঙানোর ও ইচ্ছে হলো না। তাই মেয়েটিকে ঘুমন্ত অবস্থাতেই তুলে নিয়ে এল। হসপিটালে কিছু সমস্যা হয়েছে। সেই জন্যেই রাতারাতি ফিরতে হচ্ছে ওদের। সবাই বলেছিল উষশীকে রেখে যেতে। তবে অভি মানতে নারাজ। মেয়েটিকে এক মুহূর্ত চোখের আড়াল করতে চাচ্ছে না। লাবণ্য’র থেকে থেকে ঝিমুনি আসছে। অর্ধেক রাত অবধি কাজ করেছে। শরীর ক্লান্ত তবু চেয়ে থাকার বৃথা চেষ্টা চালাচ্ছে। সেটা দেখে অভিরাজ বলল,
“ঘুমিয়ে নিতে পারিস। পৌছে গিয়ে উঠিয়ে দিব।”
“না। ঠিক আছি।”
“হুট করেই হসপিটালে এমন একটা কান্ড হয়ে যাবে ধারণা করতে পারছি না। ওরা কি করে বলতে পারে পেসেন্টের মৃ ত্যু টা অস্বাভাবিক।”
“সেটা তো আমিও বুঝতে পারছি না অভি। আমাদের হসপিটালে আগে এমন কখনো কি হয়েছে?”
“এটাই চিন্তার। যদি আমাদের গাফিলতি হয়ে থাকে তাহলে খুব অন্যায় হয়েছে লাবণ্য। আর এর শাস্তি অন্তত এ পৃথিবীতে সম্ভব না।”
“শুধু শুধু নেগেটিভ চিন্তা করছিস। টেনশন করিস না। গিয়ে দেখি কি অবস্থা।”
অভিরাজ দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ফ্রন্টের মিররে উষশীকে দেখা যাচ্ছে। মেয়েটা গভীর ঘুমে তলিয়ে। তার ফর্সা মুখশ্রীতে কিছু বিরক্তিকর চুল এসেছে। যা কিশোরী’র ঘুম নষ্ট করছে। হুট করেই গাড়ি থামানোয় চমকে উঠেছে লাবণ্য। যখন চোখ মেলে তাকিয়েছে তখন অভিরাজ ড্রাইভিং সিটে নেই। সে পেছনের সিটে গিয়ে কিশোরী’র অবিন্যস্ত চুল বিন্যস্ত করতে ব্যস্ত। উষশী ঘুমের ঘোরেই অভিরাজের উষ্ণতা মেখে চলেছে। ছেলেটা’র কাছে যেতে চাইছে। এটা দেখেই নজর ঘুরিয়ে নিল লাবণ্য। দম বন্ধ হয়ে আসছে। ক্রমশ সবটা কেমন জটিল লাগছে।
উষশী’র ঘুম ভাঙল বেশ বেলা করে। মেয়েটি তখনো জানে না কোথায় আছে। খানিক বাদে ঘুম জড়ানো কণ্ঠটা শুনতে পেল। অভিরাজ তার পাশেই আধশোয়া হয়ে বসেছে।
“ঘুম ভেঙেছে?”
“হুম। কিন্তু এটা…।”
“ঢাকায় চলে এসেছি আমরা।”
“কখন!”
“অনেক রাতে।”
“আমি তো বুঝতেও পারলাম না।”
“তখন তুমি গভীর ঘুমে ছিলে। এত মিষ্টি একটা ঘুম নষ্ট করতে চাই নি।”
সরল চোখে তাকাল উষশী। মেয়েটি’র শুভ্র সুন্দর মুখশ্রীর পানে তাকিয়ে আছে অভি। দুজন দুজনাকে দেখে নিচ্ছে মন প্রাণ ভরে। অত্যন্ত এক জনমে তো এ দেখার শেষ হবে না।
চলবে…
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি