মুঠোভরা_চোরাবালি #আলিশা_আঞ্জুম #পর্ব_১০

0
560

#মুঠোভরা_চোরাবালি
#আলিশা_আঞ্জুম
#পর্ব_১০

ফাইজার ঘরের জানালা হাট করে খুলে রাখা। হু হু করে বাতাস এসে পায়চারি করছে ঘরে। দমকা হাওয়ার গোসলের দরুণ সদ্য ভেজা চুলগুলো শুকিয়ে উঠছে। ফাইজা ফোন হাতে লেখালেখিতে মত্ত। কখনো আবার কলমের আচড় কাটতে ব্যাস্ত সম্মুখের নোট খাতায়। আজ আনন্দ ছলকে উঠছে তার। বুকের সব ব্যাথা ছাপাছাপি, চাপাচাপি করে আনন্দ জায়গা করে নিয়েছে। কি আশ্চর্য! সামাজিক যোগাযোগে ফাইজা লেখালেখি শুরু করলো। বহুল ব্যাবহৃত সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে। এক নিঃস্বার্থ ভালোবাসায় তাকে মানুষ ভাসিয়ে দচ্ছে যেন। ইয়া বড় মন্তব্য, সুর তুলে আপু ডাকা, ইনবক্সে গল্প চেয়ে আবেদন করা সবই যেন বুকে এসে ধাক্কা দেয় ফাইজার। সেদিনই একটা পেইজ খোলা হলো। ” মৃন্ময়ী ফাইজা ” নামে। ক’দিন হবে? ফাইজা ভাবনার মাঝে চট করে হিসাব মিলিয়ে নিলো। গুণে গুণে পনেরো দিন। আজ এই পেইজের সদস্য সংখ্যা ছ’হাজার। ভাবতেই এক সমুদ্র খুশি এসে ডুবিয়ে দিচ্ছে ফাইজাকে।

বই পড়ার অসুখে কিভাবে যেন সংক্রমিত হয়েছিল ফাইজা? ফাইজা হাতের ফোনটা ক্ষণিকের জন্য রেখে ভাবলো। মায়ের থেকে শিখেছিল বই পড়া। এ বাড়িতে মায়ের শ খানেক বই রাখা আছে একটা বুক সেলফে। ফাইজার হাসি পায় মায়ের বাসা থেকে পালিয়ে আসার গল্প মনে পরলে। সেদিন নাকি ফাইজার মা কাপড়ের ব্যাগে কাপড় ভর্তি না করে ভর্তি করেছিল পছন্দের বইয়ে। দু’টো ইয়া বড় বড় ব্যাগে নাকি জায়গা পেয়েছিল মাত্র তিনটা শাড়ি। ঠোঁট উল্টানো ছিল ফাইজার বাবার সামনে। অসহায় ফাইজার বাবা দু’হাতে দু’টো ব্যাগ নিয়ে হাঁটতে গিয়ে পা বাড়াতে পারেনি সেদিন। অতঃপর ব্যাগের চেইন খুলে তিনি ভেতরের ইতিহাস জানতেই থ বনে যান। হতভম্ব, আশ্চর্যান্বিত মিরাজ সাহেবকে ফাইজার মা বলেছিল তখন

” পড়া হয়নি এগুলো। মাত্র গতকাল কিনেছি। রেখে আসতে কষ্ট হচ্ছিলো। আর পছন্দের বইগুলো…. ”

— ফাইজা বৃষ্টি আসতেছে বাইরের কাপড়ডি তুইলা আইনা দেও একটু। সারাদিন খালি ঘরের মধ্যে বইসা কি করো?

ভাবনার মাঝে আসমা হাঁক ছেড়ে বলে উঠলো। ফাইজা স্ব চকিত হলো। কান পেতে শুনতে চাইলো বৃষ্টির বার্তা। মিহি শব্দ টিনের চালে। হন্তদন্ত হয়ে ফাইজা ছুটলো ঘর থেকে। বাড়ির সামনের খোলা অংশে কাপড় মেলানো ছিলো। দ্রুত তুলে নিলো ফাইজা। তুলতে গিয়ে হঠাৎ বৃষ্টির ফোঁটা গায়ে পরতেই মন আনচান করে উঠলো। তারপর কি যেন হলো তার। হুটহাট কাপড় গুলো বারান্দায় মেলে রেখে এসে নেমে পরলো বৃষ্টির মাঝে। আকাশের দিকে চাইলো। বেশ লাগছে। আজ বৃষ্টি বিলাশ করলে মনে হয় মন্দ হবে না। যেমন ভাবনা তেমন কাজ। সিক্ত মাটির বিপজ্জনক পথ ফাইজা পা টিপে টিপে পার করে চলে গেলো সেই মাঠে। যেখানে সাদ তার শখের ছাগলের জন্য ঘাস কাটে, বোঝা বাঁধে অপটু হাতে।

ফাইজার এহেন কান্ড দেখে পাশের বাড়ির তেরো বছরের মিলি, কিশোরী অণু, ক্লাস সেভেনের শাপলা, বুলবুলি চাচির ছোট মেয়ে মীমও দৌড়ে আসলো বৃষ্টিতে ভিজবে বলে। প্রিয় ফাইজা আপা বৃষ্টি বিলাশ করবে। আর তারা কি বসে বসে দুঃখ বিলাশ করবে? এ কেমন বেমানান কথা, কান্ড?

ফাইজার পরনের শাড়িটা ছিলো দামী, চিকচিক করা এক অপূর্ব সুন্দর শাড়ি। ছোট ছোট দু একটা ছেলে মেয়ে বৃষ্টির ভারি বর্ষণ এক সময় সহ্য করতে না পেরে ফাইজার লম্বা আঁচলের নিচে ঠাঁই নিতে চাইলো। বাচ্চার জন্য হা হা করা বুকের মালকিন ফাইজা আগলে নিলো ওদের। যেন হঠাৎ কাল পরিস্থিতি ভুলে একটু আবোগী হলো। প্রায় এক মাস পর আজ প্রাণখুলে হাসলো। তবে এই হাসিতে আজও গাঢ় ভাবে সর্বনাশ হলো কাব্যর। আচমকা মাথা চুলকে উঠলো সে। আজ হাতে ক্যামেরা নেই। তবে মনে হচ্ছে না হাতের ক্যামেরার চাইতে মনের ক্যামেরা কমজোরি হয়ে কাজ করেছে।

একমাস পর আজও তার আগমন এই গ্রামে। কিন্তু কেন? অকারণে, অহেতুক। একটা অপূর্ব হাতের ছবি তার ক্যামেরায় বন্দী ছিলো। হতে পারে সেই হাতের টানে আবারও এসেছে। আবার শুনেছে তার ফুফু মণির বাড়ি এই গ্রামে। হতে পারে ফুফু মণির খোঁজে পুনরায় অভিষেক হয়েছে তার এখানে। তবে মন্দ কি হয়েছে? কাব্যর মন বলল, একেবারেই না হয়তো। আবার একেবারেই হয়তো মন্দ হলো। মিষ্টি যন্ত্রণা আগ বাড়িয়ে ক্রয় করতে এলো। ক্ষয় করতে এলো একটা আস্ত হৃদয়। সুস্থ মস্তিষ্ককে অসুস্থ করতে এলো। প্রেম তো মস্তিষ্ক কে অসুস্থই করে তাই না? নইলে কাব্য বাসায় গিয়ে তরকারির ছাড়া এক প্লেট ভাত কিভাবে খেয়েছিল? তার মা গোটা পাঁচেক বার ডাকলেও কেন সে শুনতে পায়নি?

.
অফিস থেকে ফেরার পথেই তাসরিফ আজ এক ব্যাগ রক্ত শরীরে প্রবেশ করিয়ে ফিরেছে। শরীরটা দিনকে দিন মন্দ হওয়ার পথে। হুট করে গত রাতে দাঁতের মাড়ি হতে অনেক রক্ত ক্ষরণ হয়েছে। পূর্বের তুলনায় অনেক বেশি। শরীরে ঘাটতি পরে গিয়েছে রক্ত। আজ রক্ত না নিয়ে ডাক্তার খানা হতে ফিরে আসা গেলো না। ক্লান্ত দেহখানা তাসরিফ আজ ঘরে নয়, ড্রয়িং রুমেই মেলে দিলো সোফার ওপর। এসি অন করলো। এসির ওপরের সংখ্যাটা ছাব্বিশ থেকে কমিয়ে করে দিলো বাইশ। সাধ হলো মাথার ওপরের ফ্যানটাও চালিয়ে দিতে কিন্তু সাধ্য হলো না উঠে গিয়ে ফ্যানের সুইচ অন করার। বন্ধ চোখে কিছুসময় ব্যায় করতে গিয়ে তাসরিফের মনে হলো ফাইজার কথা। দেখতে ইচ্ছে করছে খুব ফাইজাকে। কিন্তু ইচ্ছে তো পূরণ হবার নয়। তাসরিফ চোখের পাতা খুলে সোজা হয়ে বসলো। গলা অব্ধি আটকে রাখা শার্টের বোতামের দু’টো বোতাম খুলে দিলো এক হাতে। হঠাৎই বিরবির করে বলে উঠলো এক টুকরো হাসি নিয়ে

” আমার বউপ্রিয়া এতো বোকা না? ও ভাবলো কিভাবে আমি আরেকটা বিয়ে করবো?”

কথাটা বলেই নিঃশব্দে হাসলো তাসরিফ। সেদিন ফাইজা চলে গেলো যোহরের পূর্বে। তাসরিফ বাসায় ফিরলো এশার পর মুহূর্তে। তাসলিমা প্রচন্ড রেগে ছিলেন। ছেলের সাথে তার যাওয়ার কথা ছিলো স্নিগ্ধা নামের পাত্রীর বাসায়। ও বাড়িতে সব আয়োজন করেছিল ওনারা। তাসলিমা তৈরি ছিলেন। শুধু তাসরিফ আসার অপেক্ষা ছিলো। কিন্তু তাসরিফ তো আসেনি। যাওয়া হয়নি স্নিগ্ধা নামের পাত্রীকে দেখতে।

আজ আবার যাওয়ার কথা আছে। মাগরিবের পর। আজ হয়তো তাসরিফ মা’কে কিছু বলে আটকাতে পারবে না। বেশ ক’দিন হলো তাসলিমা কে আজ নয় কাল বলে তাসরিফ ঘুরিয়েছে। এবারে ঘোরালে বাসায় তুলকালাম কান্ড বাঁধবে। তাসরিফ ভাবনার মাঝে ঘড়ি দেখলো, আছরের ওয়াক্ত হয়ে গেছে। আর বসা হলো না তার। বসা থেকে উঠে পা বাড়ালো নিজ রুমের দিকে।

.
মাগরিব পর পরই রওনা হলো তাসরিফ মা-বাবার সঙ্গে পাত্রীর বাড়িতে। খুব একটা দূরে নয় শুনেছিল সে। কিন্তু ড্রাইভ করতে গিয়ে তার মনে হলো এই পথ ফুরাইবার নয় যেন। আজ রাতটা কি গাড়িতেই পেরিয়ে যায় কিনা সন্দেহ। তাসরিফ পেছনে বসা তাসলিমার উদ্দেশ্যে বলল

— মা, মেয়ের বাড়ি এতো কাছে কেন?

তাসলিমা গম্ভীর সুরে ছেলের রসিকতার জবাব দিলেন

— ফাইজাদের বাড়ি কিন্তু খুব কাছে ছিলো না।

তাসরিফ দমে গেলো ফাইজার প্রসঙ্গ আসতেই। ড্রাইভিংএ মনোনিবেশ করলো পুরোপুরি। মনে মনে আওড়ালো, ” বিয়ে করলে দূরে করাই বুদ্ধি মানের কাজ। বউয়ের সাথে ঝগড়া হলে যখন তখন বাপের বাড়ি আসার থ্রেটটা দিতে পারবে না বউ।” কেউ যদি কখনো বিয়ে সম্বন্ধে তাসরিফের নিকট পরামর্শ চায় তবে সে সোজাসাপটা সংকোচহীন আলাপে বলে দেবে

” শশুর বাড়ি দূরে করো। পারলে বউয়ের আত্মীয় স্বজনের বাড়ি তোমার বাড়ি থেকে একশোগজ দূরে এমন ঘরের মেয়েকে বিয়ে করো। না হলে একটা ধকম দিলেই বউ বলবে, আমি থাকবো না, এই যে গেলাম। ”

চলবে…….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here