#শেষটা_সুন্দর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৩৩।
‘একি, আপনি কোথায় যাচ্ছেন?’
সাদরাজ মাত্রই বসা থেকে উঠেছে। মেহুল তখনই তাকে প্রশ্নটা করে। সে হাস্যজ্জ্বল মুখে জবাবে বলে,
‘আপনি তো আর সামনেই এলেন না। তবে আন্টি আংকেলের সাথে কথা বলে বেশ ভালো লেগেছে। এখন একটা কাজ পড়ে গিয়েছে, তাই চলে যাচ্ছি। আবার অন্য কোনোদিন আসব।’
‘ওমা, চলে গেলে কী করে হবে?’
সাদরাজ খানিকটা অবাক হয়ে বলল,
‘কেন? যাওয়া যাবে না?’
মেহুল অস্থির হলো কিছুটা। বলল,
‘না না। বলছিলাম কিছুই তো খেলেন না। আর দুপুরের টাইমে কেউ খাবার না খেয়ে চলে যায়? জানেন তো, আমার মায়ের হাতের রান্না কিন্তু দারুণ মজা। আপনি না খেলে চরম মিস করবেন। তাই খেয়ে যান।’
মেয়ের কথা শুনে রামিনা বেগম হকচকিয়ে তার দিকে চাইলেন। মানে এমন হুটহাট কাউকে খাবারের দাওয়াত দেওয়া যায় নাকি? রান্নাবান্নার একটা ব্যাপার আছে না। কিন্তু, তিনিও পড়লেন বিপদে। মেয়ে বলে ফেলেছে, এখন তিনি তো আর নাকচ করতে পারছেন না। তাই তিনিও মৃদু হেসে বললেন,
‘হ্যাঁ হ্যাঁ, বাবা; দুপুর টাইমে এসেছ খেয়ে যাও।’
সাদরাজ মনে মনে ভাবল, “এই সুযোগ। যত বেশি সময় সে এখানে থাকতে পারবে ততই ওদের কাছাকাছি যেতে পারবে।” তাই সেও বিনাবাক্যে রাজি হয়ে গেল। মেহুল খুশি হলো খুব। এবার রাবীর তাড়াতাড়ি এলেই সে বাঁচে।
খাবার টেবিলে সাদরাজ বেশ মজা করেই খাচ্ছে। তার মা বাবা লোকটাকে বেশ যত্ন করে খাওয়াচ্ছেন। মেহুল এক কোণে মুখ লটকে দাঁড়িয়ে আছে। বারবার দরজার দিকে তাকাচ্ছে। রাবীর এখনো কেন আসছে না কে জানে। সাদরাজ বলল,
‘মেহুল, আংকেলের না হয় খাবারের রুটিন আলাদা তাই বসতে পারছেন না। কিন্তু, আপনি আর আন্টি তো আমার সাথেই বসতে পারেন।’
মেহুল জোরপূর্বক হেসে বলে,
‘না, আপনি খান। আমরা পরে খেয়ে নিব।’
সাদরাজ হেসে বলে,
‘খাবারটা কিন্তু দারুণ হয়েছে, আন্টি।’
রামিনা বেগম বললেন,
‘আরেক পিস মাছ নাও। ভালো হয়েছে বলেও তো খাচ্ছো না কিছু।’
হঠাৎ কলিং বেল বাজল। মেহুল অস্থির হয়ে বলল,
‘আমি দরজা খুলছি।’
সাদরাজ খাওয়া বন্ধ করে সোজা হয়ে বসল। কলিং বেলের শব্দে কিছুটা অস্বস্তি হলো তার।
মেহুল এক দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দিল। রাবীর এসেছে। তবে একা নয়। সাথে অনেক পুলিশও আছে। পুলিশ দেখে মেহুল অবাক হয়। জিজ্ঞেস করে,
‘পুলিশ কেন?’
রাবীর তার দিকে চেয়ে শুধায়,
‘কোথায় সাদরাজ আহমেদ?’
‘ভেতরে।’
সে অফিসারের দিকে চেয়ে বলে,
‘চলুন, অফিসার।’
রাবীর অফিসারদের সাথে নিয়ে ডিরেক্ট ভেতরে চলে গেল। রামিনা বেগম তাকে দেখেই হেসে বললেন,
‘জামাই, আপনি?’
সাদরাজ পেছন ফিরে তাকায়। রাবীরকে দেখে বিষম খায় সে। স্তব্ধ হয়ে যায়। কী করবে বুঝতে পারে না। রাবীরকে সে মোটেও এখানে আশা করেনি। এখন এই পরিস্থিতি সে কীভাবে সামলাবে? সবকিছু তো ঘেটে গিয়েছে। সব প্ল্যান শেষ। সে খাবার টেবিল ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। রাবীর দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
‘অফিসার, এরেস্ট হিম।’
সাদরাজ ভ্রু কুঁচকায়। অফিসার তার দিকে এগিয়ে গিয়ে বলেন,
‘মি. সাদরাজ আহমেদ, আপনাকে এক্ষুণি আমাদের সাথে থানায় যেতে হবে। চলুন।’
সাদরাজ রেগে যায়। তীব্র স্বরে বলে,
‘হুয়াট ননসেন্স। আমি কেন থানায় যাব? কী করেছি আমি?’
‘আপনি আমাদের সাথে আগে থানায় চলুন। সেখানে গিয়েই আমরা আপনার সাথে কথা বলব।’
‘এখানেই বলুন। কিসের ভিত্তিতে আপনারা আমাকে থানায় নিতে চাইছেন?’
‘আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে। আপনি মি. রাবীর খানের গোডাউনে আগুন লাগিয়েছেন।’
সাদরাজ শব্দ করে হাসে। বলে,
‘প্রমান দিন। আছে? আছে কোনো প্রমান?’
অফিসার বলেন,
‘আমরা প্রমান ছাড়া কথা বলি না। থানায় চলুন, সব বলছি।’
‘না, যাব না। আমাকে এখানেই সব বলুন।’
রাবীর এবার চেঁচিয়ে বলে,
‘এটা তোমার অফিস বা কোনো সরকারি জায়গা না যে এখানে তুমি যা চাইবে তাই হবে। এটা আমার শ্বশুরবাড়ি। এখানে তোমার মতো নিকৃষ্ট লোকের কোনো কথা চলবে না। অফিসার, ওকে এক্ষুনি নিয়ে যান। আর তা না হলে আমি ওকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিব।’
সাদরাজ যেন রাগে কাঁপছে। রাবীর গর্জে বলল,
‘কী হলো, এখনো যাচ্ছেন না কেন?’
অফিসার সাদরাজকে নিয়ে বাইরে চলে যায়। মেহুলের মা বাবা হতভম্ব। কী হয়ে গেল, কেন হলো, কিছুই উনারা বুঝতে পারছেন না। রাবীর শ্বাস ফেলে বলল,
‘আমি দুঃখিত, বাবা। আপনার বাসায় এভাবে সিনক্রিয়েট করতে চাইনি। কিন্তু, ঐ লোকটাকে শাস্তি না দিয়েও উপায় ছিল না। ও আমার সাথে শত্রুতার নেভাতে গিয়ে কতগুলো অসহায়ের মানুষের ক্ষতি করেছে। আপনারা পুরো ঘটনা মেহুলের কাছ থেকে শুনে নিবেন। আমি এখন যাচ্ছি। আমাকেও থানায় থাকতে হবে। মেহুল, মা বাবাকে সব বুঝিয়ে বলবেন। আসছি।’
রাবীর দরজার কাছে যেতেই মেহুল তার কাছে ছুটে গিয়ে বলল,
‘রাবীর, সাবধানে থাকবেন প্লিজ। ঐ সাদরাজ আহমেদকে আমার খুব ভয় করে।’
রাবীর তার দিকে চেয়ে ম্লান হেসে বলে,
‘চিন্তা করবেন না। আমার কিছু হবে না।’
________
‘শুধুমাত্র ঐ লোকটার মুখের কথার ভিত্তিতে আপনি আমাকে এরেস্ট করতে পারেন না। আপনি জানেন না, আমি কী করতে পারি। আপনার কিন্তু চাকরি রিস্কে..’
‘উনার চাকরি নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না, সাদরাজ আহমেদ। তুমি তোমার নিজের কথা ভাবো। অনেক করেছো। তোমার জন্য আজ এতগুলো মানুষ অসহায়ের মতো পড়ে আছে। তুমি কী ভেবেছ, এতকিছু করেও পার পেয়ে যাবে? এত সোজা? উহু, তোমাকে কালকে কোর্টে উঠানো হবে। আমি নিজে তোমার বিরুদ্ধে সাক্ষী দিব। আমিও দেখব, এবার তুমি কী করে বাঁচো।’
সাদরাজ রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলে,
‘আমি কিন্তু তোমাকে ছাড়ব না, রাবীর খান। তুমি আর আর তোমার স্ত্রী মিলে ইচ্ছে করে এসব করেছো তাই না? এসব সাজানো নাটক। আমাকে আটকানোর জন্য। আচ্ছা, আমিও দেখব; ঠিক কতদিন তোমরা আমাকে আটকে রাখতে পারো।’
রাবীর দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
‘তুমি যাতে আজীবন এই জেলেই পঁচে মরো, আমি সেই ব্যবস্থাই করব।’
‘আহ, তোমার এসব হুমকিতে এই সাদরাজ আহমেদ ভয় পায় না। যাও যাও, যা খুশি করো গিয়ে। সাদরাজ আহমেদকে আটকানো এত সহজ না।’
রাবীর বাঁকা হেসে বলে,
‘হুহ, সেটা তো সময়ই বলে দিবে।’
________
‘আপনি আমার কল কেন ধরেন না বলুন তো?’
‘ব্যস্ত ছিলাম।’
‘তাই বলে একটু মেসেজও করা যায় না, নাকি? আমি যে এইদিকে টেনশনে মরে যাই, সেটা কি আপনি বুঝেন না?’
‘আমার আর এত বুঝে কী হবে? আজকাল তো আমার থেকে আপনাকে সাদরাজ আহমেদ’ই একটু বেশি বুঝছেন।’
মেহুল ঠোঁট চেপে হেসে বলে,
‘বাবা, আপনার আবার হিংসেও হয়?’
‘না, আমার কেন হিংসে হবে? আমার তো মন নেই। আমি তো রোবট। আমার ওয়াইফের সাথে আমারই শত্রু এত ভাব বিনিময় করবে আর আমি তা হাসি মনে মেনে নিব, এটাই তো আপনি চান; তাই না?’
মেহুল মৃদু হেসে বলে,
‘আমি এমনটা চাই কখন বললাম? আপনার শত্রু তো আমারও শত্রু। আমি তো আপনার কথা ভেবেই ঐ লোকটার সাথে একটু কথা বলেছিলাম।’
‘হ্যাঁ, বুঝেছি। কিন্তু, ওর এই সাহসের ফল তো ওকে পেতেই হবে। আমার ওয়াইফের দিকে ও নজর তুলে তাকায় কী করে। তাছাড়া ওর অন্যায়ের বোঝা তো কম না। সবকিছু কালকে আমি কোর্টে বলব। তারপর দেখি ওকে কে বাঁচায়।’
মেহুল ভীত সুরে বলে,
‘এতকিছুর পর ঐ লোকটা আপনার কোনো ক্ষতি করে দিবে না তো? যা রাগ উনার আপনার প্রতি।’
‘নিজে বাঁচলেই না আমার ক্ষতি করবে। আগে তো নিজে বাঁচুক। আর এই কয়দিন আপনার বাসা থেকে বের হওয়ার দরকার নেই। ওর এরেস্ট হওয়ার খবর পেয়ে ওর লোকগুলো নিশ্চয়ই আরো তৎপর হয়ে উঠেছে। ওরা এখন যেকোনো মূল্যে ওকে বের করতে চাইবে। তাই আপাতত আপনার বাইরে বের হওয়ার দরকার নেই। আর খুব প্রয়োজন পড়লে আমাকে কল দিবেন। আমি নিজে আপনাকে নিতে আসব।’
মেহুল তৃপ্তির নিশ্বাস ছেড়ে বলে,
‘এত ভালোবাসলে ভালোবাসাতেও নজর লাগে; বুঝলেন নেতা সাহেব।’
‘চিন্তা নেই। ভবিষ্যতে আর কেউ নজর দিতে আসলে তার সেই নজর উপড়ে ফেলা হবে।’
চলবে…