অমানিশায়_সেই_তুমিই #লেখায়_তেজস্মিতা_মর্তুজা ২২.

0
366

#অমানিশায়_সেই_তুমিই
#লেখায়_তেজস্মিতা_মর্তুজা

২২.

বেলা নয়টার এলার্ম সেট করেছিল ইরাজ। এলার্ম বাজতেই মুখটা বিকৃত করে বাজে ভাষায় বকে উঠল। দ্রুত এলার্ম অফ করে দিল। তখনই নজরে এলো তার বুকের কাছে মাথা রেখে বাচ্ছা মেয়ের মতো ঘুমিয়ে আছে মেঘালয়া। অপলক চেয়ে রইল কিছুক্ষণ মেঘালয়ার ঘুমন্ত চেহারার দিকে। রাতে কেঁদেছিল মেয়েটা। জিদ, অভিমান, ছটফটানি; কোনকিছুতেই বাঁধা দিতে পারেনি ইরাজকে। ওভাবেই কাঁদতে কাঁদতে শেষ রাতের দিকে ইরাজের ধমকে ঘুমিয়ে পড়েছে।

গতকাল রাতের ঘটনা ভেবে মিশ্র এক অনুভূতি ভিড় করল ইরাজের মাঝে। হঠাৎ মাথায় এলো, সে বোধহয় আবারও এই মেয়েটির ওপর পিছলে যাচ্ছে। যাচ্ছে বলতে গেছে! মেঘালয়ার দিকে তাকিয়ে ভিতরে এক অদম্য টান অনুভব করল। এই মেয়েতে সে তার জীবন-যৌবনের শুরুতে মজেছে। আর কোনদিন অন্য পথে চলতে সাহস পায়নি। যে অমানিশার এক রাতে মেয়েটিকে ত্যাগ করেছিল সে, সেই মেয়েটির সঙ্গেই হালাল সম্পর্কে কয়েক অমানিশা কেটে গেল। কাল কিনা আসলেই নিজের করে পেয়েছে! আন্দোলিত হয়ে উঠল ইরাজ। তার হাতটা এখনও মেঘালয়ার ছোট্ট শরীরটা জড়িয়ে ধরে আছে। চেয়ে থাকতে থাকতে আচমকাই মেঘালয়ার ঠোঁটের কিনারায় আলতো এক চুমু খেল।

আস্তে করে চাদর সরিয়ে উঠে যেতে চাইলেও পারল না। মেঘালয়া নড়েচড়ে উঠল, শেষমেষ চোখ খুলে তাকাল। ইরাজকে ওমন লোভী নজরে তাকিয়ে থাকতে দেখে দ্রুত মুখ ঘুরিয়ে নিল অভিমানে। ইরাজ তা দেখে সামান্য হাসল। মেঘালয়ার মুখে স্পষ্ট অভিমান। সেদিকে তাকিয়ে উঠে বাথরুমের দিকে চলে গেল ইরাজ।

মেঘালয়া উঠে আধশোয়া হয়ে বসল। চুপ করে বসে রইল মুখটা কঠিন করে। তার মনে বহু প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে। ইরাজের আচরণ অদ্ভুত, বরাবরই অদ্ভুত! এই ভালো তো, আবার খারাপ!

কিছুক্ষণ পর ইরাজ বের হলো একেবারে গোসল করে। সে এত সকালে সচরাচর ঘুম থেকে জাগে না, তবে আজ জরুরী কাজে অগত্যা জাগতে হয়েছে। ভেজা চুলে এসে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়াল। আয়নাতে দেখা যাচ্ছে মেঘালয়ার গোমরা মুখটা। তোয়ালেটা ঘাঁড়ে ঝুলিয়ে মেঘালয়ার পাশে এসে বসল। মুখটা শুকনো লাগছে মেয়েটার। ইরাজের ভেতরে কোথাও একটা অনুতাপ কাজ করল যেন। সামনে বসে কয়েক সেকেন্ড চেয়ে রইল মেঘালয়ার নত মুখের দিকে।

নত করে রাখা মাথাটা দু আঙুলে উঁচু করে উপরে তুলে ধরল। আস্তে করে জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে?ʼʼ

উত্তর দিল না মেঘালয়া। গা’টা শিউরে উঠল মেঘালয়ার। হয়ত মেঘালয়া ইরাজের স্পর্শকে ভয় পাচ্ছে! মেঘালয়া হয়ত ইরাজের সংস্পর্শে আতঙ্কিত! তা ভাবতেই ইরাজ নিজের হাতটা সঙ্গে সঙ্গে সরিয়ে নিল। একটু সরে বসল সন্তর্পণে। নিজের ওপর রাগ হচ্ছে ভীষন। এভাবে যখন এতদিন নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রেখেছিল, তাহলে কাল রাতে ওভাবে অধিকার আদায় করতে যাওয়াটা বড্ড ঘৃন্য লাগল ইরাজের আছে। তার মাঝে শতভাগ নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা আর ত্যাগী মানসিকতা রয়েছে। তবে আজ এমন কাজ করে ফেলার মানে কী? নিজেকে কষে কয়েকটা বিশ্রী গালি দিল মনে মনে। সে কোনদিন নিজের জন্য মেঘালয়ার চোখে এমন আড়ষ্টতা আর ভীতি দেখতে চায়নি। বিধায়, মেঘালয়াকে কোনদিন বুঝতে দিয়েছিল না নিজের সেই গাঢ় অনুভূতির কথা। লজ্জিত লাগল নিজেকে বড্ড! মুখটা ভারী করে জিজ্ঞেস করল,

“কী হয়েছে বলবি তো?ʼʼ

জোরে শ্বাস নিয়ে আবার শান্তভাবে বলল, “কাল খুব খারাপ কিছু করে ফেলেছি? মেঘ! আব.. আমি সরি। দেখ কাল একটু রেগে গিয়েছিলাম, হয়ত একটু রুড আচরণ করে ফেলেছি..ʼʼ

মেঘালয়া মাথা তুলে তাকাল। তার চোখে ছলছল পানি। ইরাজ অস্থির হয়ে উঠল এবার, “বাড়ি যেতে চাস? আচ্ছা, আচ্ছা আমি দিয়ে আসব। তোর থাকতে হবে না আমার সঙ্গে। কান্না থামা, ফ্রেস হ। তুই যা চাস তাই হবে। প্লিজ কাদিস না.. শোন.. দেখ..

মেঘালয়া এবার ডুকরে কেঁদে উঠল। ইরাজ হতভম্ব হয়ে যায়। গতরাতে বাড়ি যেতে চেয়েছিল মেয়েটা, সে জোর করে ধরে রেখেছে। ইরাজের ধারণা— এ থেকেই অভিমান জমেছে হয়ত। ইরাজের কথা শেষ করতে দিল না, হঠাৎ-ই মেঘালয়া বিক্ষিপ্ত ঢেউয়ের মতো লুটিয়ে পড়ল ইরাজের বুকে। ইরাজ একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল এতে। থমকানো এক ঢোক গিলল। আবেশে চোখটা বুজে ফেলল আস্তে করে। মেঘালয়া ফুঁপিয়ে কাঁদছে ইরাজকে জড়িয়ে ধরে। ওর মাথাটা ইরাজের কাধের কাছে বুকের ওপরে ঠেকে আছে। ইরাজকে অবাক করে দিয়ে আরও ঠেসে জড়িয়ে ধরল এবার। যেন ইরাজের বুকের মাঝে ঢুকে যেতে চায় মেয়েটা। অস্থির চিত্তে ইরাজের পিঠ খামচে ধরল। যতটা পারছে ইরাজকে নিজের সাথে মিশিয়ে নিচ্ছে মেঘালয়া। তার এই অশান্ত আচরণ যেন বলে যায়— কোথায় যাব আমি? আমি তো থাকতে চাই, এই বুকে, এই দেহের সংস্পর্শে, এই দেহের মালিককে কেন্দ্র করে বাঁচতে চাই এক জনম।

হাতদুটো ইরাজের বাহুর নিচ থেকে বের করে এবার ইরাজের গলাটা জড়িয়ে ধরল মেঘালয়া। মাথাটা ইরাজের কাধে চেপে ধরল। বাঁধভাঙা নদীর মতো শান্ত হয়ে উঠেছে মেঘালয়া।

ইরাজ যেন থেমে গেছে মেঘালয়ার আচরণে। তার ভেতরে তোলপাড় চলছে, মেঘালয়ার এই অস্থিরতা তাকেও এলোমেলো করে ফেলল মুহূর্তে। মেঘালয়ার কান্নাজড়িত অভিযোগ ভেসে এলো, “কোথায় যাব আমি? কার কাছে যাব? আব্বু আপনার ভরসায় এখানে পাঠিয়ে দিল। আপনি আব্বুর কাছে রেখে আসতে চাইছেন। আমি খুব ভারী বোঝা হয়ে গেছি সকলের কাছে? কেউ বইতে চাইছে না আমায়! আমার জন্য জায়গা হয়না কারও কাছে? কাল সারারাত রেখে দিতে ইচ্ছে হয়েছিল আমাকে নিজের কাছে? এখন চাহিদা মিটেছে, আমি অপ্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছি? কাল কেন ধরে রাখলেন! বিয়ের পর স্বামীর ঘর নাকি মেয়েদের আপন হয়, আমার তো বিয়ে হয়ে গেছে। তাহলে..

আর বলতে পারল না মেঘালয়া। আবারও ডুকরে উঠল। জন্মের বেপরোয়া আর ছন্নছাড়া ইরাজের আজ হাতটা কেঁপে উঠল মেঘালয়ার মাথায় হাত রাখতে। বুকের মাঝে শীতল ঢেউ তাণ্ডব শুরু করেছে যেন! কাঁপা হাতে আস্তে করে মেঘালয়াকে জড়িয়ে নিলো দু’হাতে। যেন জনমানব শূন্য পানি বাতাসহীন এলাকায় আটকে যাওয়া কোন পথিক তার হাজারো ছটফটানির শেষে এবার পথ খুঁজে পেয়েছে। পিপাসায় মৃতপ্রায় ব্যাক্তি গভীর অরণ্যে এক ছোট্ট ঝিরি ঝরনার সন্ধান পেয়েছে। ইরাজের ভিতরটাও ঠিক এমনই আকুল হয়ে উঠল মেঘালয়ার আচরণ ও স্বীকারক্তিতে।

শক্ত বন্ধনে আবদ্ধ করে ফেলল বুকে লেপ্টে থাকা মেয়েটাকে। জলন্ত ইটের ভাটায় যেন আকাশের বুকে ভেসে বেড়ানো এক টকরো মেঘ ভেঙে বর্ষা নেমে এলো ইরাজের বুকে। ইরাজের এতদিনের খাঁ খাঁ মরুময় তপ্ত বুকটা সজীব হয়ে উঠল মুহুর্তেই। শক্ত করে জড়িয়ে ধরল নিজের বহু সাধনা ও বুকের তিক্ত যন্ত্রণায় কেনা মেঘকে।

চলবে..

[ সময়ের অভাব, সাথে মনোবলেরও। আজ ছোটো হয়েছে জানি। তবে আগামী দিন বড়ো করে দেওয়ার চেষ্টা করব। ভুলভ্রান্তি ক্ষমা করবেন।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here