#তোমার_আমার_চিরকাল🌸
|| পর্ব – ৫৩ ||
#লেখনীতে_বিবি_জোহরা_ঊর্মি
গোঁধুলি লগ্ন। দিঘির পানির কলধ্বনি ভেসে আসছে কানে। চারপাশে মানুষের কোলাহল। পানিগুলো ঢেউ খেলে যাচ্ছে৷ সূর্য অস্ত যাওয়ার সময় হয়েছে। আকাশে ভাসতে থাকা আবিরগুলো পানিতে কি সুন্দর দেখাচ্ছে। মনে হচ্ছে রক্ত ভাসছে পানির মধ্যে। চার যুবক যুবতী একটা বেঞ্চিতে বসে গোঁধুলি লগ্ন উপভোগ করছে। কেটে গিয়েছে বেশ কিছু দিন। শরীর একটু ভালো থাকায় মীরা দিবাকে নিয়ে ঘুরতে এলো। একা আসেনি, আহান ও আয়ানকেও নিয়ে এসেছে সাথে করে। দিবাকে হসপিটাল থেকে রিলিজ করে দেওয়ার পর মীরাদের বাসায় রাখা হয়েছিল। পুরোপুরি সুস্থ হলেই তাকে নিয়ে যাবে তার বাবা। মীরা খুব খুশি হয়েছিল মামার এই ডিসিশনে। তাছাড়া মনে মনে আরো একজনও খুশি হয়েছিল। বাসায় শুয়ে বসে থাকতে দিবার অস্বস্তি লাগছিল। মীরাকে বলায় সে তাকে বলে ঘুরতে নিয়ে যাবে। বিকেলের দিকে বিজয়সিংহ দিঘির ঘুরে তার সংলগ্ন গোল্ডেন শিশু পার্কটি দেখে এলো তারা। মুক্ত পরিবেশে দিবাকে নিজেকে পাখির মতো মেলে ধরেছে। এদিক ওদিক ঘুরে আনন্দ পেয়েছে। দিবাকে দেখে আয়ানের ভালো লাগলো। মেয়েটার চেহারা যেন তার সাথে নেই। শুকিয়ে কাট হয়ে গেছে। পার্কে বেশিক্ষণ থাকলো না তারা। চলে এলো রাজাঝির দিঘির ওখানে। আগে ফুসকার স্টলে বসে ফুসকা খেলো তারা। আহান ছাড়া বাকি সবাই খেয়েছে। আহান একটা দোকান থেকে সিংগাড়া সমুসা এনে খেয়েছে। যে দিবা এতো ঝাল খেত, সে এখন ঝাল কম দিয়েই ফুসকা খেয়েছে। পেটের সমস্যার কারণে। অতিরিক্ত ঝাল ফুসকা খেয়েছে আয়ান ও মীরা। যেন প্রতিযোগিতা চলছিল ওদের মাঝে। খাওয়া দাওয়া শেষ করে দিঘির ওখানে গিয়ে বসে আছে তারা।
সন্ধ্যা নামার আগ মুহুর্ত অনেক সুন্দর হয়। এই পরিবেশটা দিবা এ মীরা দুজনেরই পছন্দের। সূর্য অস্ত যাওয়ার পর মীরা আর আহান দিবাদের বসিয়ে রেখে এক জায়গায় গেল। আয়ান ও দিবা পাশাপাশি বসে আছে। দিবার শরীরটা হঠাৎ খারাপ হতে শুরু করে। কিন্তু দিবা নিশ্চুপ হয়ে বসে আছে। সে।এখন কাউকেই বুঝতে দিবে না। হুট করেই আয়ানের পাশে বসে পড়লো একজন। আয়ান হকচকিয়ে উঠে। দিবাও সেদিকে তাকায়। একটা মেয়ে এসেছে। আয়ানকে বলে, “কিরে গুরু! তুই এখানে?”
আয়ান প্রতি উত্তরে বলল, “এভাবে কেউ আসে? আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম জাস্ট। কি করছিস এখানে?”
মেয়েটা একটু ভঙ্গি করে বলল, “এলাম কাজিনদের সাথে ঘুরতে। তোকে দেখতে পেলাম, তাই চলে এলাম। এখন চল, আমার সাথে যাবি তুই।”
“কোথায় যাব? আমি এখন যাব না কোথাও।”
“তোর কথা আমি শুনব নাকি? চল, চল।”
মেয়েটা আয়ানের হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল। এদিকে দিবা এতক্ষণ চুপ করে ওদের কথাবার্তা শুনছিল। আয়ান এভাবে চলে যাওয়ায় খুব কষ্ট পেল দিবা। একেই অন্ধকার, তারউপর ও একা। ভয়ে হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে তার। আয়ানের কি ঠিক হলো এটা করার? দিবা ভাবলো, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এখান থেকে উঠে চলে যাওয়াই ভালো। দরকার পড়লে ফুসকার স্টলে গিয়ে বসে থাকবে ফুসকা খাওয়ার বাহানায়। তবুও তো ওখানে একটু হলেও নিরাপদ আছে। দিবা উঠে গেল। ভয়ে ভয়ে কয়েক কদম এগিয়ে গেল সে। আচমকাই পিছন থেকে কেউ তার হাত ধরলো। দিবা পিছনে ফিরে তাকিয়ে ভয়ে আতঙ্কে ছিটকে পড়ে যেতে নিল। আগন্তুক তার হাতটি ধরে ফেলল। তাকে বাঁচিয়ে দিল পড়ে যাওয়ার হাত থেকে। চোখের সামনে আয়ানকে দেখে দিবা অপ্রস্তুত হয়ে যায়। চেহারায় ভয় ওর চোখের কার্ণিশে টলমল করছে জল। যা চোখ এড়ায়নি আয়ানের। আয়ান তাকে সোজা করে দাঁড় করায়। দিবার হৃদস্পন্দন খুব দ্রুত বিট করতে থাকে। আয়ান বলে, “পাগল হয়েছ তুমি? একা একা কোথায় যাচ্ছ?”
দিবা আয়ানের দিকে চোখ তুলে তাকিয়ে বলে, “আমাকে একা রেখে গেলেন তো আপনি। আবার উলটে আমাকেই শাসাতে এসেছেন?”
দিবা রাগ দেখিয়ে চলে যেতে নিলে আয়ান আবারও তার হাত ধরে তাকে দাঁড় করিয়ে দেয়। “আমাকে ছাড়ুন।”
“তুমি একটু বাড়াবাড়ি করছ না? আমি তো যাইনি। চলে এসেছি আবার।”
“আমার হাত ছাড়ুন, আমি বাসায় যাব।”
“হ্যাঁ যাবে তো। চলো আমরা ভাইয়াদের খুঁজি।”
“আমি আপনার সাথে কোথাও যাব না। যেখানে গিয়েছিলেন, সেখানেই যান। আমার কথা আপনাকে চিন্তা করতে হবে না।”
দিবার মাথাটা ঘুরছে। এক্ষুনি যেন পড়ে যাবে। “তোমার সমস্যাটা কি দিবা? ভয় পেয়েছিলে?”
“ছাড়ুন আমার হাত। প্লিজ ছাড়ুন।”
আয়ানের উঠে যায় রাগ। সে রাগের বসে দিবাকে একটা থাপ্পড় বসায়। এমনিতেও দিবার দূর্বল শরীর। তার উপর এই থাপ্পড়ের আঘাতে দিবাকে আর সোজা থাকতে দিল না। দিবা অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায় ধপ করে নিচে। আয়ান এটা দেখে ভিষণ ভয় পেয়ে যায়। রাগের মাথায় কি করে ফেলল! সেই মুহুর্তে মীরা ও আহান আসে। দিবাকে দেখে ওরা ছুটে এলো আয়ানের কাছে। মীরা জিগ্যেস করলো, “কি হয়েছে দিবার?”
“অজ্ঞান হয়ে গেছে ও।”
“তুমি কি কিছু বলেছ ওকে?”
আয়ান চুপ করে থাকে। দিবাকে কোলে নিয়ে সে এগিয়ে যায় সামনের দিকে। একটা দোকান থেকে পানি নিয়ে দিবার চোখে ছিটিয়ে দেয়। পিটপিট করে চোখ মেলে তাকায় সে। আয়ান দিবাকে এক জায়গায় বসিয়ে সোজা দিবার সামনে হাটু ভাজ করে বসে পড়ে। দিবার হাত ধরে বলে, “স্যরি দিবা। আমি কাজটা ঠিক করিনি। স্যরি প্লিজ। আমায় তুমি ক্ষমা করে দাও।”
তখন আহান এসে জিগ্যেস করে, “কি করেছিস তুই ওর সাথে?”
“ভাইয়া আমি রাগের বসে ওকে থাপ্পড় দিয়েছিলাম। আর তাতেই ও অজ্ঞান হয়ে গেছে।”
“থাপ্পড় দিয়েছিস! কেন আয়ান?”
আয়ান ওদের দুজনকে সবটা খুলে বলে। সব শুনে আহানই আয়ানকে একটা থাপ্পড় বসায়। আয়ান রেগেমেগে বলে, “লজ্জা করল না তোর? অসুস্থ একটা মেয়েকে এভাবে একা ছেড়ে চলে যেতে? আবার ওকে থাপ্পড়ও দিয়েছিস?”
“ভাইয়া আমি বুঝতে পারিনি। আমিতো যাইনি। চলে এসেছিলাম। কিন্তু ও বেশি রিঅ্যাক্ট করে ফেলেছিল।”
“তোকে আর ওর ধারে কাছেই আমি ঘেঁষতে দিব না।”
আহান একটা সিএনজি ডেকে মীরা আর দিবাকে উঠিয়ে ওদের নিয়ে চলে গেল। আর আয়ানকে ফেলে গেল। আয়ান নিজের ভুলের জন্য আফসোস করছে।
–
প্রায় এক মাসের মতো কেটে গেছে। নিজের শরীরে বেশ কিছু পরিবর্তন দেখতে শুরু করে মীরা। এই পরিবর্তনের কারণ জানতে নিকটস্থ হসপিটালে যায় সে। ডাক্তার দেখিয়ে চলে আসে বাসায়।
এখন ঠিক সন্ধ্যা। মীরা বসে বসে পপকর্ণ খাচ্ছিল। তার পরিক্ষা কালই শেষ হয়েছে। পরিক্ষা খুব ভালোই হয়েছে। মীরা ভাবতেও পারেনি তার পরিক্ষা এতো ঝামেলার মধ্যেও ভালো হবে। কাঁধ থেকে যেন একটা বোঝা নামলো। এই খুশিতে পপকর্ণ ভাজা চলতেই পারে। আহান আসলো রুমে। ঘেমে একাকার অবস্থা তার। বিছানায় বসে পা দুলিয়ে মনের আনন্দের পপকর্ণ খাচ্ছে মীরা। আহান ভ্রু কুচকে জিগ্যেস করে, “খুশি লাগছে! ব্যাপার কি?”
“ফ্রেশ হয়ে আসুন। বলছি।”
আহান তোয়ালে নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল। ফ্রেশ হয়ে আসে পাঁচ মিনিটের মধ্যেই। কোমরে তোয়ালে পেঁচিয়ে রেখেছে। উন্মুক্ত গা, ভেজা চুল। মীরা চোখ বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে আছে সে দিকে। আহান হাত দিয়ে নিজের চুলের পানি ঝাড়ছে। মীরাকে এভাবে ক্যাবলার মতো তাকিয়ে থাকতে দেখে সে থেমে গেল। মীরার কাছে এসে পাশে গিয়ে বসলো। জিগ্যেস করলো, “তোমার কি হয়েছে বলবে? যেভাবে আমায় দেখছ যেন এই প্রথম আমাকে দেখলে!”
মীরা লজ্জা পেল। আহান মীরার দিকে ঝুকে জিগ্যেস করলো, “কি হয়েছে হু? আজ একটু বেশিই খুশি লাগছে তোমাকে।”
মীরা কিছু না বলে আহানকে শার্ট পেন্ট দিয়ে বসে রইলো। আহান মীরার কাছ থেকে ওগুলো নিয়ে অন্যদিকে গিয়ে জামা কাপড় বদলে নিল। মীরা মনের আনন্দে পপকর্ণ খাচ্ছে। আহান এসে ধপ করে বসে পড়লো মীরার পাশে। মীরার থেকে পপকর্ণ এর বাটিটা নিয়ে খেতে শুরু করলো। মীরা কোমরে হাত রেখে বলল, “এই! আমি খাচ্ছিনা। আপনি আমার খাওয়ায় ভাগ বসালেন কেন?”
আহান তব্দা হয়ে তাকিয়ে রইলো। “মাত্র কয়েকটা নিয়েছি। তাতেই মেজাজ দেখাচ্ছ?”
“আপনাকে এর ভাগ দিব না। সরুন।”
মীরা আহানের কাছে থেকে বাটিটা নিয়ে সাইডে রেখে দিল। আহান বলল, “কি বলবে যেন। বলো তাড়াতাড়ি।”
মীরা হঠাৎ আহানকে জড়িয়ে ধরে। মীরার কাজের কোনো গতিবিধিই আহান বুঝে উঠতে পারছেনা। মীরা আহানের বুকে মাথা রেখে বলল, “সে আসছে..!”
“কে?” ভ্রু কুচকে জিগ্যেস করে আহান। মীরা আহানের একটা হাত নিয়ে তার পেটের উপরে রাখে। আর বলে, “সে এখানে এসে গেছে।” বলেই লজ্জায় নুইয়ে পড়লো আহানের বুকে। আহানের ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠেছে। সে চট করে মীরাকে কোলে নিয়ে ঘুরতে লাগলো। ঘুরতে ঘুরতে বলল, “থ্যাঙ্কিউ, থ্যাঙ্কিউ, থ্যাঙ্কিউ। “মীরা আহানের শার্ট খাঁমছে ধরে বলে, “পরে যাব। নিচে নামান।”
“আজ আমার চেয়ে খুশি কেউ নয় মীরা।”
“নামান না প্লিজ।”
আহান মীরাকে নামিয়ে বিছানায় বসালো। মীরার কোমর জড়িয়ে ধরে তাতে তার মাথাটা রাখল। মীরা আহানের চুলের ভাজে আঙ্গুল গলিয়ে দিচ্ছে। আহান বলে, “তুমি আমার অন্ধকার জীবনের এক টুকরো চাঁদের আলো। যার আগমনে আলোকিত হয়েছে আমার মনের আকাশ। বিষাদ জীবন কেটে আনন্দময় জীবনের দেখা মিলেছে।”
“আমি কিছু করিনি আহান। আপনি শুধু শুধুই আমাকে এতো সম্মানিত করেন।”
“স্ত্রীকে সম্মান দেওয়াই তো স্বামীর কর্তব্য।”
“আপনি আমার দেখা শ্রেষ্ঠ পুরুষ আহান।”
চলবে…