#মুঠোভরা_চোরাবালি
#আলিশা_আঞ্জুম
#পর্ব_১১
তথাকথিত পাত্রীর বাড়িতে পৌছাতে সময় ব্যায় হলো তিনঘন্টা। ঘুরিয়ে পেচিয়ে এ রাস্তা থেকে ফাইজাদের বাড়িতে রওনা হলে দূরত্ব হবে এক ঘন্টার। আর তাসরিফের বাড়ি হতে তিন ঘন্টার দূরত্ব। হঠাৎ তাসরিফের মনে এক সুপ্ত বাসনা খচ করে বিধলো। একবার যাওয়ার ইচ্ছে হলো ফাইজাদের বাড়িতে। তৃষ্ণার্ত চোখ জোরা শীতল হতো।
— আপনি কি জামাই? অনেক সুন্দর তো!
হেঁটে সদর ঘরে প্রবেশ কালেই কানে পৌঁছালো কথাটা। তাসরিফ কৃপণ হাসিতে ঠোঁট প্রসারিত করে রাখলো। মেয়েটার পানে একবার তাকিয়ে পরখ করলো। অতঃপর সোফায় বসতে গললেই আবারও শোনা হলো আরেকটা উক্তি
— আমার বোন কিন্তু প্রচুর অভিমানী। মানিয়ে নিতে পারবেন? আবার আমার বোনের কিন্তু মাথায় সমস্যা আছে। মাঝে মাঝেই এলোমেলো আচরণ করে। এই ধরুন ভীষণ রাতে হঠাৎ তা তা থৈ থৈ নাচ শুরু করে।
বুক কেঁপে কাশি উঠলো তাসরিফের। অবাক নয়নে পাশ ফিরে চাইতে চাইতে দু’টো ছোট অবাধ্য কাশি মুখ থেকে মুক্তিও দিয়ে বসলো। কিশোরী এক মেয়ে। বড় জোর কলেজ পড়ুয়া হবে। তাসরিফ ঘরময় একবার চোখ বুলিয়ে দিয়ে দ্বিতীয় বার চাইলো মেয়েটার দিকে। অসম্ভব মায়াবী এক কণ্যা। তবে হবু জামাইয়ের কাছে হবু বউয়ের এহেন কান্ড ফিসফিস করে ফাঁস করার রহস্য কি? যদিও তাসরিফ বিয়ে করার জন্য আসেনি। বর হওয়ার জন্য পাত্রী দেখতে আসেনি। এসেছে খুঁত খুঁজে মায়ের কানে বাজিয়ে তুলে ধরার উদ্দেশ্যে। যে ক’দিন বাঁচবে সে ক’দিন মায়ের মন ভাঙার চাইতে বুদ্ধি মানের কাজ হবে মায়ের তালে তাল মেলানো। অতঃপর সেই তাল বেতাল করে অন্য তালে লয়, সুর দেওয়া। আবার সেই লয়, সুর মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে নতুন তাল, লয়, সুরে যোগ দেওয়া।
— দেখি সরুন ওদিকে। বসি একটু। এমন অভদ্র কেন আপনি? দাড়িয়ে আছি তবুও বসতে বলছেন না।
যেন আকাশ থেকে কথা ছেড়ে দিলো মেয়েটি। ঠাস করে এসে মাটিতে পরে শব্দ হলো তার। তাসরিফ কিছুটা চমকে বেশ দূরে সরলো। অনেকটা জায়গা করে দিলো সে চঞ্চল মেয়েটিকে। অতঃপর ধাতস্থ হলো। ঈষৎ ভাজ ফেলল ভ্রু যুগলে। ভীষণ সুন্দর করে শুধালো
— তোমার নাম?
— আয়রা।
— তোমার বোন তা তা থৈ থৈ করে রাত বিরাতে নাচে? রিয়েলি?
আয়রা ঝটপট তাসরিফের কথার জবাব দিলো। দেওয়ার আগে একটু ঝুঁকে গেলো তাসরিফের কান বরাবর। তাসরিফ মনোযোগী হলো।
— আস্তে বলুন। আমার আপনার ওপর মায়া হলো বলে আমি আপনালে জানালাম।
তাসরিফও ফিসফিস করে বলল
— তা এই মায়া করা মেয়েটা স্নেহার কে?
আয়রা ঝটপট কিছু ভাবলো। অতঃপর কঠিন সুরে বলল
— তা জেনে আপনার কি? আমি আপনার গুপ্ত শুভাকাঙ্ক্ষী। গুপ্ত শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে আপনাকে সাহায্য করছি।
তাসরিফ হাসলো। আয়রা প্যাচে পরলো যে! সে নিজেই শুরুতে বলে দিয়েছে স্নিগ্ধা তার বোন। এখন বলছে তার পরিচয় সুপ্ত! তাসরিফ সোফায় বসে সম্মুখের দেয়ালে এঁটে থাকা ছবি একবার পরখ করলো। অতঃপর আয়রায় পানে তাকিয়ে বলল
— তুমি কি এডাপ্ট ডটার?
আয়রা চমকে উঠলো। তাসরিফ কে অনুসরণ করে সে চাইলো সামনের দেয়ালে। একটা ফটো ফ্রেম। মা বাবার কাঁধে হাত রেখে স্নিগ্ধা হাসি মুখে দাড়িয়ে বন্দী হয়েছে ফটোতে। আর আয়রা বন্দী হয়েছে তাদের থেকে দু হাত দূরে ক্যাবলা হাসি ঠোঁটে নিয়ে। বিভ্রান্ত হলো আয়রা। বড় ধুরন্ধর মনে হলো দু হাত দূরে বসা তাসরিফ নামক ছিমছাম সুন্দর লোকটাকে। সে বুঝিয়ে দিলো কথা দিয়ে যে সে বুঝে গেছে আয়রা স্নিগ্ধার বোন?
ছবিতেও তার চোখ পরে গেছে? আয়রা তো কোনো কালেই এমন সন্ধানী চিন্তা নিয়ে কারো মার প্যাচ ধরতে পারতো না। উহু! অসম্ভব। কোনো কালেই না।
— তোমার আমাকে দুলাভাই হিসেবে পছন্দ না এ কথা সোজাসাপটা বলে দিতে পিচ্চি। তোমর যে দুলাভাই ঠিক করা আছে এটা তো বুঝে গেলাম আমি।
চমকে উঠলো আয়রা। একই সাথে কেঁপে উঠলো ভীষণ ভাবে। একি! লোকটা বুঝে গেলো কিভাবে? আয়রা আহত, নিহত, অসুস্থ, অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো তাসরিফের দিকে। তাসরিফ হাসলো। সে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো অন্য খানে। আয়রা আর এক মুহূর্ত বসে রইলো না এ জায়গায়। ভোঁ দৌড়ে ছুটলো স্নিগ্ধার ঘরের পানে। দ্রুত স্নিগ্ধাকে জানাতে হবে এবারের পাত্র আগের পাত্রগুলোর মতো ব*ল*দ নয়। দেখতে অনেকটা ভদ্র কিন্তু আসলে সে অভদ্র। বিয়েটা ভাঙা এতো সহজ হবে না। তবে একটা প্রশ্ন, আয়রা কি সত্যিই দত্তক কণ্যা? ওই ফটোটা নিয়ে বোনের সাথে তার ফাটাফাটি ধাপের ঝগড়া, ঝামেলা হয়ে গেছে। স্নিগ্ধাও বলে, ‘তোকে কুড়িয়ে আনা হয়েছে। গ্রামের পাটের ক্ষেত থেকে।’ ঘটনা কি সত্যি? নাকি ফাজলামি তাসরিফ ও স্নিগ্ধার?
.
— ফাইজা? ভালো লাগছে তোর? মন হালকা তো? আয়রা কিন্তু তুই বলতে পাগল। আরুও ফাইজা ফাইজা লাগিয়ে দিয়েছে।
ফুফুর কথায় ফাইজা মুচকি হাসলো। মন হালকা কিনা তা সম্পর্কে কোনো বার্তা এখন অব্দি ভেতর হতে আসেনি। তবে এ বার্তা স্পষ্ট, ফাইজার বুকের নাম না জানা কিছু আটকে থাকা উধাও হয়েছে। মাথা ফাঁকা হয়েছে। আজ অনেকদিন পর ঘর ছেড়ে বাইরে পা ফেলার সুবাদে বিচিত্র মানুষ, বিচিত্র যানবাহন, বিচিত্র শব্দ অব্দি তার ভালোলাগার খাতায় নাম লিখিয়ে নিয়েছে। ফাইজা ভাবনা ছুটি দিতে চাইলো ফুফুর পানে। হালকা হেঁসে বলল
— ফুফু। মায়ের পর আমার আরেক মা হওয়ার জন্য তোমার কাছে আমি কৃতজ্ঞ। আমাকে বোঝার জন্য আমি তোমার কাছে ঋণী।
সোহানা হাসলেন। ব্যাস্ত ভঙ্গিতে চোখের চশমাটা এক আঙ্গুলে ঠেলে ঠিকঠাক ভাবে বসিয়ে দিয়ে বললেন
— হুম…. এসব বলতে হবে না। তোর মা আমার কতটা আপন ছিলো সে কথা আমি জানি রে। সে আমার পড়ালেখায় যেভাবে সাহায্য করেছে, বিয়ে ভেগে দিয়ে আব্বাকে বুঝিয়ে পড়ালেখা করিয়েছে। তাই তো আজ একজন স্কুল শিক্ষিকা আমি। কত সুখে আছি। আর তোর জন্য যদি মায়ের আদরটুকু আমার কাছে না থাকে তাহলে নিজেকে মানুষ মনে হবে আমার?
ফাইজা শুধু এক টুকরো হাসি ঠোঁটে রেখে দিলো। কিছু বলতে পারলো না। তাকিয়ে রইলো সোহানার হাতের দিকে। তিনি টুকটাক করে ঘর পরিপাটি করছেন। এসেছেন আজ ননাসের বাড়িতে। ননাসের বড় মেয়েকে আজ পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে।
— ফাইজাপু…. ফাইজাপু?
হঠাৎ দরজার ওপাশে দাড়িয়ে থাকা আয়রার চঞ্চল কন্ঠ ছুটে এলো ফাইজার নিকট। ফিরে চাইলো সে। আয়রা চোখ মুখ খিঁচে বলছে
— আপুকে একটু সাজিয়ে দাও তো। আমার সাথে ঝগড়া লেগেছে। আমার কাছে সাজবে না।
ফাইজা কিছুটা থতমত খেয়ে গেলো। সে তো সাজাতে জানে না।মেকআপ এর ম টাও বোঝে না সে।
— আমি তো পারি না।
— আমি বলে দেবো।আসো না। প্লিজ।
ফাইজা বসা থেকে উঠে চলে গেলো আয়রার সাথে। দুপুরে এবাড়িতে ফুফুর সাথে এসেছে ফাইজা। আসার মিনিট দশেকের মাঝেই আয়রা ফাইজাপু ফাইজাপু করে পাগল করে দিচ্ছে তাকে। তবে এই পাগল হওয়ার মধ্যে একটা প্রশান্তি আছে বটে।
ফাইজা আসতে চায়নি এখানে। সোহানার জোরাজোরিতে আসা। ওনার যুক্তি, বাইরে থেকে ঘুরে এলে ভালো লাগবে। সে যেহেতু আজ যাচ্ছে ফাইজাকেও নিয়ে যাবে আয়রাদের বাসায়।
.
বোনকে আয়রাই সাজালো। ফাইজা শুধু দেখে গেলো পাশে বসে। আয়রা সরবতও তৈরি করলো অতি চালাক পাত্রর জন্য। এক গ্লাসে তৈরি করলো তিন চামচ লাল মরিচের গুঁড়ো মিশানো সরবত। আরেক গ্লাসে চার চামচ লবণ মেশানো সরবত। ফাইজা আয়রার এহেন কন্ডে হতভম্ব হয়ে গেলো। হা করে সে কিছুসময় দেখেছে আয়রাকে৷ অতি কষ্টে হা ভাবটা দামিয়ে জিজ্ঞেস করেছে
— এটা কেন করছো আয়রা?
আয়রা সোজাসাপটা জবাব দিয়েছে
— ছেলের মেজাজ পরীক্ষা করবো এজন্য।…. ফাইজাপু… লাল মরিচেরটা আগে খেতে দেবো বুঝলে? তারপর যখন পানির জন্য হাত বাড়াবে তখন লবণ পানি খাইয়ে দেবো। ভালো হবে না?
ফাইজা ড্যাবড্যাব তাকিয়ে প্রত্যুত্তর করেছে
— হুম… হবে।
চলবে…..