#বৃষ্টিভেজা_আলাপন (৩৫)
জেগে উঠেছে অভিরাজ। এসি চলা সত্ত্বেও ঘেমে গিয়েছে সে। একটা বাজে অনুভূতি হচ্ছে। মনে হচ্ছে চারপাশ থেকে সব কিছু ভীষণ ভাবে চেপে ধরছে। এতটাই অসহ্য লাগছে যে শার্টের বোতাম খুলে ফেলতে হলো। লাবণ্য ব্যলকনিতে ছিল। অভিকে জেগে উঠতে দেখে চট জলদি ভেতরে এসেছে। তার কণ্ঠে ব্যগ্রতা।
“কেমন লাগছে?”
“ঠিক ঠাক।”
“হঠাৎ করে ওমন করছিলি কেন?”
“এমনি।”
লাবণ্য বুঝল কথাটা। অভি কোনো বিষয় লুকাতে চাইছে। তাই সে ঘাটাল না। বরং খাবার অর্ডারের কথা বলে বেরিয়ে পড়ল। লাবণ্য যেতেই অভিরাজ উঠে পড়ল। তার দু চোখে তীব্র তৃষ্ণা। এই তৃষ্ণা বাদামি রঙের চুলের মেয়ের জন্য। রাতের শেষ ভাগে ঈশান এল। ছেলেটা বড়ো ক্লান্ত। পুরো সন্ধ্যা বেশ পরিশ্রম গিয়েছে। অভিরাজ ল্যাপটপ নিয়ে কাজ করছে। দরজায় নক পড়ল।
“ডিস্টার্ব করতে চাইছিলাম না ব্রো।”
“সমস্যা নেই। বোস এখানে।”
ঈশান গরম পানির মধ্যে কফি মিশিয়ে নিল। এটার প্রয়োজন ছিল খুব। অভিরাজ এখন স্বাভাবিক। খুব অল্পতেই যেন সেড়ে গিয়েছে।
“ডিল ফাইনাল হয়ে গেছে। ওরা আমাদের সাথে কাজ করবে।”
“গুড। কন্ট্রার্কের ব্যাপারে কি বলেছে?”
“ছয় মাসের জন্য কন্ট্রাক করবে বলেছে।”
“অফার তো দুই বছরের জন্য করেছিলাম।”
“ব্রো,আমরা বিশাল একটা লস করেছি। ওরা যে এতটা ভরসা করেছে এটাই অনেক বেশি।”
“হুম। তবে আমি কন্ট্রাক করছি না।”
অভি’র কথাতে প্রচন্ড অবাক হলো ঈশান। যেই কন্ট্রাকের জন্য এত কিছু সেই কন্ট্রাক পেয়েও নাকি নাকোচ করে দিবে!
“ভাই এটা কি বললে?”
“ছয় মাসের কন্ট্রাকে আমার লসের সম্ভবনা রয়েছে। আমরা যেই অফার করেছি যে কোনো কোম্পানি আমাদের সাথে ডিল করে নিবে। ওরা শুধু আমাদের চাপে ফেলার পরিকল্পনা করেছে। যাতে করে আরো বেশি লাভবান হওয়া যায়। কিন্তু আমরাও এর কম প্রফিটে কাজ করব না। বিজনেস বিষয়টা অত সহজ না। সবটাই মাথা খেলিয়ে করতে হয়।”
“তাহলে কি করবে?”
“সোজা হিসাব। ডিল ক্যানসেল। চট করে মেইল পাঠিয়ে দে।”
“ভাই, শোনো কথা।”
“এ ব্যপারে দ্বিতীয় কথা হবে না ঈশান। দ্রুত মেইল পাঠানোর ব্যবস্থা কর।”
বেরিয়ে গেল অভিরাজ। ঈশান হতাশ হয়ে পড়ল। কতটা চেষ্টার পর এই কন্ট্রাক পেয়েছে আর অভি কি না পায়ে ঠেলছে!
ভোরের মিষ্টি আলো অভি’র পুরো শরীর কে ভালো লাগায় ভরিয়ে দিচ্ছে। এখানকার রাস্তা ঘাট খুবই পরিষ্কার। লম্বা লম্বা গাছ গুলো কেমন মাথা তুলে দাঁড়িয়ে। বিদেশীরাও শরীর চর্চা করছে। অভি পায়ের গতি বাড়াল। এদিকে ফোন বেজে চলেছে। লাবণ্য’র কল। মেয়েটা নিশ্চয়ই ঈশানের থেকে ঘটনা শুনেছে।
“হ্যাঁ লাবণ্য বল।”
“অভি,তুই এটা কি বলেছিস?”
“শুনেছিস যেটা সেটাই।”
“দেখ, আমরা কতটা পরিশ্রম করে ওদের মানিয়েছি। আর তুই কি না ক্যানসেল করে দিবি।”
“কারণ ওদেরকে এত প্রফিট দিয়ে ছয় মাসের জন্য কন্ট্রাক করাটা যুক্তিসম্মত না।”
“তাহলে কি করবি?”
“অন্য কোম্পানি’র সাথে কথা বলব।”
“যেটা ভালো বুঝিস কর।”
“হুম।”
“তুই কোথায় এখন?”
লাবণ্য’র শেষ কথাটা শুনতে পায় নি অভিরাজ। তার দুটি চোখ থেমে আছে একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা পিনাট বাটারের মতো চুলের মেয়েটির দিকে। তার শ্বেত রঙা গাল, সুন্দর দুটি চোখ আর পাতলা শরীর। সব অভিরাজের নিকট ভীষণ চেনা লাগছে। ছেলেটা ঘোর থেকে বেরিয়ে ছুটে গেল সেদিকে। সুন্দর শুভ্র মেয়েটি তখন একটি ছেলের সাথে কথা বলছে। তাদের কথা বলার ধরণ দেখে অনেক কিছুই মাথায় আসে। অভি খুব বেশি আগাতে পারে নি তার পূর্বেই মেয়েটি গাড়িতে উঠে গেল।
সবটাই কি দৃষ্টিভ্রম? নাকি মেয়েটা জীবন্ত সত্য। পাঁচ বছর পূর্বের সেই কিশোরী কি সত্যিই ডেনমার্কে অবস্থান করছে? যদি তেমনি হয় তবে এর পেছনের কারণ কি? এসব প্রশ্ন অভিকে একটু একটু করে যন্ত্রণা দিচ্ছে। ভীষণ চাপে মস্তিষ্ক কাজ করছে না। এত এত ঝামেলার মাঝে সত্যিই ঠিক থাকা যাচ্ছে না। তবু ঠিক রয়েছে অভিরাজ। তার পরের দিন গুলো প্রচন্ড ঝামেলায় পার হলো। টানা একটা সপ্তাহ গোরু খাটুনি গিয়েছে সবার উপর। প্রথম দিকে ক্লাইন্ট খুঁজে পাওয়া একটু মুশকিল হলেও এখন সেই অসুবিধাটা নেই। একে একে ছয়টা কোম্পানি ২ বছরের চুক্তি করেছে। এরই মধ্যে পুরনো কোম্পানি গুলোও যোগাযোগ করেছে। অভিরাজ তাদের ফিরিয়ে দেয় নি। বরং স্বাদরে গ্রহণ করেছে। সব ঝামেলা শেষে আজ হাতে বেশ ভালো সময় পেল অভিরাজ। হাঁটতে হাঁটতে লেকের কাছে এসে দাঁড়াল। মুক্ত বাতাস পেয়ে প্রাণ ভরে উঠছে। তারপর হঠাৎ ই সেদিনের বারের কথা স্মরণ হলো। যেখানে বাদামি রঙের চুলের সেই মেয়েটিকে প্রথম দেখেছিল। হুট করেই সেখানটায় চলে এল সে। কেন এল,কোন আশা নিয়ে এল তার কোনো ব্যাখা নেই। সবটাই খুব দ্রুত চলছে। মৃদু সুরে গান বাজছে। চারপাশে লাস্যময়ী নারী’রা নেচে চলেছে। অভিরাজের পরনে ক্যাজুয়াল জামা কাপড়। সে চারপাশে চোখ বুলিয়ে একটা ডিভানে এসে বসেছে। বার বয় এসে নেশাক্ত পানীয় দিয়ে গেল। অভি সেসব ছুঁয়েও দেখছে না। রকমারি মেয়ের আনা গোনা এখানে। পোশাকের অবস্থা চোখে দেখার মতো না। সবার মাঝেও একটি মেয়েকে খুঁজে চলেছে উতলা নয়ন। অথচ পাচ্ছে না। একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে উঠে যাচ্ছিল ঠিক সেসময় একটা হাসির শব্দ শোনা গেল। যেই হাসিতে অভিরাজের ভেতরকার সবটা তপ্ত হয়ে উঠল। দ্বিধান্বিত হয়ে পড়ল মস্তিষ্ক। যতক্ষণে মস্তিষ্ক স্বাভাবিক হলো ততক্ষণে চারপাশ থেকে লাউড মিউজিক শুরু হয়ে গেছে। এক দল ছেলে মেয়ে ডান্স করছে। আর তাদের মধ্যে সব থেকে আর্কষণীয় মেয়েটা হচ্ছে উষশী! যার পিনাট বাটারের মতো চুল,শ্বেত রঙা গাল আর সুন্দর দুটি চোখের মায়ায় ডুবে নিজের সবটুকু শেষ করেছিল সাতাশ বছর বয়সী অভিরাজ।
বয়ফ সাদা মেয়েটির সাথে কিশোরী উষশী’র বড়ো অমিল। অবশ্য এতে অবাক হওয়ার মতো কিছু নেই। পাঁচ বছর কম সময় নয়। অভি’র জীবন থেমে থাকলেও বাকি সবই ছিল চলমান। ভীড় ঠেলে অভিরাজ ভেতরে গেল। উষশী তখন গানের তালে তালে অর্ধমাতাল। রোজকার অভ্যাস তার। মেয়েটির উন্মুক্ত বাহু বড়ো চোখে লাগে। এত সৌন্দর্য’র মাঝেও ছড়িয়ে পড়ল তিক্ততা। অভি দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল। কোনো প্রকার ভনিতা ছাড়াই টেনে নিল যুবতীকে। বারে থাকা সব গুলো মানুষ চকিত হলো। উষশী একটা রাগ ক্ষোভ নিয়ে জ্বলন্ত চোখে তাকিয়েছে। তার সাথে থাকা মেয়ে গুলো চেচামেচি করছে। অভিকে রুম ডেটের অফার করছে। এসব শুনে প্রতি দিনকার মতো হাসল না মেয়েটি। বরং অত্যন্ত রাগ নিয়ে বলল,”নট অ্যানাদার ওয়ার্ড। এভরি ওয়ান মুভ। আই সেইড মুভ।”
মেয়ে গুলো সরে গেল ঠিকই তবে যাওয়ার পূর্বে অন্যরকম দৃষ্টি ফেলে গেল। ৩২ বছর বয়সী অভিরাজের সুদর্শন রূপ যে কারো হৃদয় কম্পন করার মতো।
কি আশ্চর্য যে মেয়েটাকে দেখার জন্য হৃদয় আনচান করত। একটু ছোঁয়া’র জন্য আকুলতার শেষ ছিল না সেই মেয়েটার প্রতি অন্য রকম অনুভূতি হচ্ছে। তবে এটাকে ঠিক ঘৃণা বলা যায় না। আবার ভালোবাসাও না। কেমন যেন মাঝামাঝি একটা পরিস্থিতি। উষশী’র দৃষ্টির সাথে অভিরাজের দৃষ্টি একাকার হয়ে গিয়েছে। একটা সময় পর মৌনতা ডিঙিয়ে অভি বলল,”ইউর লাইফ ইজ গোয়িং ভেরি ওয়েল উষশী। দেখে ভালো লাগছে।”
নিরুত্তর উষশী। সে কোনো জবাব দিচ্ছে না। এমনকি নড়চড় ও নেই। অভিরাজ একটা তাচ্ছিল্য ভাব রাখল অধরে।
“স্লোভেনিয়া’র উষশী এখন ডেনমার্কে! পাঁচ বছর পূর্বে স্লোভেনিয়া’র টিকেট রেখে পালিয়ে যাওয়া সেই মেয়েটি আজ আমার চোখের সামনে দাঁড়িয়ে! পৃথিবীটা বড়ো আজব। কেউ পালিয়ে গেলেও কোনো এক কালে দেখা হয়েই যায়। তবে এতটাও আশা করি নি। গ্রেট জেদি মেয়ে। তুমি জিতে গিয়েছ। তোমার জেদ, তোমার কালচার এমনকি তোমার করা সব ছলনা সবটা জিতে গিয়েছে। অন্যদিকে নিজের থেকে এক যুগ ছোট এক মেয়েকে ভালোবেসে নিঃস্ব হয়ে গেছে অভিরাজ। যত আশা নিয়ে বেঁচে ছিলাম সবটা আজ ধ্বংস হয়ে গেল। যার ব্যক্তিত্ব, যার কাজ, যার কঠোরতায় পুরো দুনিয়ায় কম্পন ধরে যেত সেই ছেলেটা এক ভুল মেয়ের ছলনায় পড়ে নিজের জীবন থেকে পাঁচটা বছর সরিয়ে নিল। ওয়াও, ইউ এন্ড ইউর চিট আর বোথ উইনার্স। অভিনন্দন জেদি মেয়ে।”
নিজের সমস্ত ভালোবাসাকে শেষ করে দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে অভিরাজ। আর শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বিশ বছর বয়সী বরফ সাদা রঙের পাঁচ বছর পূর্বের সেই কিশোরী উষশী। যাকে সব টুকু দিয়ে ভালোবেসে সাতাশ বছর বয়সী এক যুবকের পুরো জীবনই বদলে গিয়েছে। নষ্ট হয়ে গেছে পাঁচটা বছর।
চলবে….
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি