#স্মৃতির_শেষ_অধ্যায়ে_তুমি
#পর্ব_১৯
#লেখিকা_Fabiha_bushra_nimu
হাসোজ্জল বাড়িটা মুহুর্তের মাঝেই নিস্তব্ধ হয়ে গেল। প্রতিটি মানুষের মধ্যে নিস্তব্ধতা রাজত্ব করছে। স্মৃতির কর্ণকুহরে একটা কথাই বারবার এসে বাজছে। আমাকে এমন ভাবে শাস্তি দিবি। সেদিনই হয় যেন আমার শেষ দিন। নিজে বেঁচে থাকতে প্রিয়া মানুষটির মৃ’ত্যু’র কথা শোনার মতো ভয়ংকর অনুভূতি দ্বিতীয়টি নেই। স্মৃতির শরীরটা কেমন নিস্তেজ হয়ে পড়ছে। অভ্র রক্তিম চোখে আকাশীর দিকে দৃষ্টিপাত করে আছে। আরাভ খুব সহজে রেগে যাবার মতো ছেলে নয়৷ তাহলে আকাশী কি কোনো বড় অন্যায় করে ফেলেছে? যা আরাভ আমাদের বলতে চাইছে না। ছোট একটা কারণে নিজের প্রাণ প্রিয় বোনের সাথে সারাজীবনের জন্য কথা বলতে চাইছে না। এতটা ঘৃণা জমার কারণ কি? উত্তর মেলে না অভ্রের। জীবন বড়ই রহস্যময়। এর ভেতরে যত যাওয়া যাবে। ক্ষনে ক্ষনে রহস্য বের হবে। কিন্তু সমাধান বের হবে না।
আমাশের চারিদিকে কালো মেঘ ছেয়ে গিয়েছে। চারিদিকে শীতল হওয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে। আকাশীর কেশগুলো এলোমেলো ভাবে উড়ছে। কেশগুলোর এমন পাগলামি দেখে, মোটেও বাঁধা প্রদান করছে না আকাশী। অভ্রের সামনে নিজের মাথা নুইয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অভ্র আকাশীকে বেলকনিতে নিয়ে এসেছে। আকাশীর সাথে সে আলাদা কথা বলতে চায়। আকাশী ভাইয়ের থেকে রক্ষা পাবার জন্য কাচুমাচু করছে। অভ্র বজ্রকণ্ঠ বলে উঠলো,
–সত্যি করে বল? তুই কি এমন করেছিস? যার কারনে আরাভ এতটা রেগে গেল? আরাভ খুব সহজে রেগে যাবার মতো ছেলে নয়? তাহলে কি এমন করেছিস, যার কারণে ছেলেটার পুরোনো ক্ষত জেগে উঠলো । কেনো এত আহাত হলো? উত্তর মিলছে না। অভ্রের কথায় আকাশী তাচ্ছিল্য করে বলে উঠলো,
–ঐ খু’নি টার জন্য এত দরদ কোথায় থেকে আসছে? ওকে নিজের ভাই বলতে আমার লজ্জা লাগে। কবে জানি আবার আমাকে…পুরো কথা শেষ হবার আগেই অভ্র সজোড়ে কষে আকাশীর গালে প্রহার করল। আকাশী তাল সামলাতে বেলকনির গ্রীল ধরে দাঁড়ায়। অশ্রুসিক্ত নয়নে ভাইয়ের দিকে দৃষ্টিপাত করে রয়েছে। একটা নিকৃষ্ট মানুষের জন্য বোনের শরীরে প্রহর করল। ভাবতেই অভিমানের পাল্লা ভারি হয়ে উঠলো। অদ্ভুত ভাবে আকাশী আরো জেদি হয়ে উঠলো। উচ্চ স্বরে বলতে শুরু করল,
–আমি আরাভ মুনতাসীরকে ঘৃণা করি। আরাভ মুনতাসীরদের মতো ছেলেদের ভরসা নয়। ভয় পেতে হয়। এরা নিজের স্বার্থের জন্য সবকিছু করতে পারে। তোমাদের জন্য এতদিন আরাভ মুনতাসীরকে সন্মান করেছি। আমিও রিফার মতো ধ’র্ষ’ণ হতে চাই না। আমাকে ও যেন কলা বাগানে ছ’য় পিছ অবস্থা পড়ে থাকতে না হয়। আমি এমন ভয়ংকর মৃ’ত্যু চাই না। আমি একটা সুস্থ মৃ’ত্যু চাই। যথেষ্ট বড় হয়েছি। নিজের সন্মান হারাতে পারবো না। আমি আরাভ মুনতাসীরকে ভাই হিসেবে অস্বীকার করি। কথা গুলো শেষ হবার সাথে সাথে আকাশীর গালে আবার প্রহার পড়লো। এবার প্রহার অভ্র করেনি। করেছে স্বয়ং রহমান শেখ। মুখশ্রীতে তার রক্তিম আভা ছড়িয়ে পড়েছে। মস্তিষ্কের রক্ত টগবগ করে উঠেছে। রহমান শেখ আকাশীকে প্রহার করার জন্য শক্ত কিছু খুঁজছে। এই সুযোগে রোকেয়া বেগম। মেয়েকে দ্রুত সরিয়ে দিলেন। তিনি রহমান শেখের ক্রোধ সম্পর্কে অবগত আছেন। আজকে মেয়েকে ধরলে, জীবন বের করে তবেই ছাড়বে। আকাশীকে সরিয়ে দিয়ে, অভ্রের কাছে আসলেন রোকেয়া বেগম। বাবাকে শান্ত করার জন্য অনুরোধ করতে লাগলো। অভ্র মায়ের কথা বুঝলো। বাবাকে ডেকে নিরালায়ে চলে গেল। বাবার সাথে একান্তে কিছু কথা বলা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আকাশীকে মেরে লাভ নেই। কান টানলে মাথা আসবে। আকাশী কোথায় থেকে কি জেনে এসে, আরাভের ওপরে ক্ষিপ্ত হয়েছে। আগে সেটা জানতে হবে।
ছন্নছাড়া মন নিয়ে দীর্ঘের পাড়ে বসে আছে আরাভ। আজকে বুকটা ভিষণ ভাবে ভারি হয়ে আসছে। নিজের বোন হয়ে তাকে এভাবে আহত করতে পারলো। আজকে আরাভের কেনো জানি মনে হচ্ছে, আল্লাহ ছাড়া কেউ আপন নয়। আল্লাহ ছাড়া সত্যিকার অর্থে কেউ তাকে ভালোবাসে না। শুধু আল্লাহ-ই তাকে ভালোবাসে। যতদিন যাচ্ছে। ততই কথাটা উপলব্ধি করতে পারছে। মেঘাছন্ন আকাশের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস উড়িয়ে দিল।
“ছেড়ে যাওয়া মানুষ গুলো জানে কি? তাদের রেখে যাওয়া স্মৃতি গুলো কতটা ভয়ংকর। যদি জানতো। তাহলে কখনো ছেড়ে যেতো না। ঠিক আমার বুকে থাকতো। তবে কেনো ছেড়ে গিয়ে, আমাকে এভাবে দোষী বানালি? আমি যে, আর এই অপরাধের বোঝা সইতে পারছি না। যে অন্যায় টা আমি করি নাই। সেই অন্যায়ের চাপ আমার ওপরে এসে, কেন পড়ছে বারবার। ও আকাশ। ও বাসাস। শুনো আমার দুঃখের কথা। আমি খু’নি নই। আমি অপরাধী নই। কেউ আমায় বিশ্বাস করে না। কেউ আমায় ভালোবাসে না। কেউ আমার ভরসা করে না৷ শুনো গো পৃথিবীর মানুষ। আমায় কি একটু ভালোবাসা যায় না। আমি যে বড়ই কাঙ্গাল। ভালোবাসার কাঙ্গাল। আমার দুঃখ ফুরাবার আগে, আমি নিজেই ফুরিয়ে যাব। সেদিন আমার ভালোবাসার মানুষের অভাব হবে না। মানুষ মৃ’ত্যু বরণ করলে। সবাই আগ্রহ নিয়ে জানতে চায়। সে কিভাবে মৃ’ত্যু বরণ করল। আচ্ছা মানুষ এটা কেনো জানতে চায় না। তুমি কিভাবে বেঁচে আছো? জীবন যুদ্ধে আমি বড্ড ক্লান্ত। মনের কথা গুলো আল্লাহ ছাড়া কেউ জানেন না। তাই তিনি ছাড়া বোঝার মতো কেউ নেই। ইশ মায়ের কোলে মাথা রেখে, যদি বলতে পারতাম। মা গো তোমার ছেলে ভালো নেই। রাতে ঠিকমতো ঘুমোতে পারে না। তার গলা দিয়ে খাবার নামে না। কিন্তু বলতে পারি না মা। আমাকে যে সবার থেকে দূরে থাকতে হবে। ভীষণ দূরে। এতটা দূরে থাকতে হবে। যতটা দূরে থাকলে, আমার জন্য কারো জীবনে দুঃখ নেমে না আসে। আমি যার জীবনে যাই। তার জীবন দুঃখে পরিপূর্ণ হয়ে যায়। আমার জীবনে কেউ না আসুক। পৃথিবীর সবাই ভালো থাকুক। কথা গুলো বলেই বিষন্ন মন নিয়ে ফুটপাতের রাস্তা ধরে ছুটে চলল।
স্মৃতি কেমন জানি স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে। আরাভদের পরিবারকে দেখে যতটা সুখী পরিবার বলে মনে হয়। তারা আসলে এতটাও সুখী না। প্রতিটি জিনিস বাহিরে থেকে বিচার করা উচিৎ নয়। কথায় আছে না। চকচক করলেই সোনা হয় না। স্মৃতির ভাবনার মাঝেই কাঁধে কারো স্পর্শ পেয়ে দৃষ্টি ঘোরালো স্মৃতি। স্রুতির দিকে মলিন মুখে চেয়ে আছে। স্রুতি স্মৃতিকে নিয়ে নিজের কক্ষে চলে গেল। কক্ষে এসে দরজা লাগিয়ে দিয়ে স্মৃতিকে উদ্দেশ্য করে বলল,
–আজকে আমাদের বাসায় যা কিছু হলো। তুই বাসায় গিয়ে কাউকে কিছু বলবি না। এটা আমাদের পরিবারের ব্যক্তিগত বিষয়। আমি চাই না। আমার বাসার কথা বাহিরে যাক। আমি একটা প্রশ্ন করবো। সোজাসাপটা উত্তর দিবি। কোনো কাচুমাচু চলবে না। চুপ থাকতে পারবি না। আরাভকে ভালোবাসিস? বোনের কথায় ভেতরটা ধক করে উঠলো। পুরো শরীর জুড়ে কম্পন সৃষ্টি হলো। শরীরটা কেমন জানি অবশ হয়ে আসছে। মনের গহীনে একদল ভয় এসে হানা দিয়েছে। স্মৃতিকে চুপ থাকতে দেখে, স্রুতি ধমকে উঠলো। স্রুতির ধমকে স্মৃতি চমকে উঠলো। স্রুতির দু-হাত ধরে বলতে শুরু করল,
–তুমি আব্বু আম্মুকে কিছু বলো না প্লিজ। আব্বু জানলে আমাকে মে’রে’ই ফেলবে। স্রুতির বিচক্ষণ আঁখি জোড়া স্মৃতির দিকে চেয়ে রয়েছে। সে রাগান্বিত হয়ে বলল,
–আরাভকে ভালোবাসিস? হ্যাঁ অথবা না। স্মৃতি মাথা নুইয়ে মিনমিনে কণ্ঠে বলল,
–হ্যাঁ।
–আরাভকে তুই ভুলে যা। যেটা কোনোদিন সম্ভব নয়। সেটা নিয়ে আশা করা বোকামি। আজকের পরে থেকে তুই আর আমাদের বাসায় আসবি না। বাবা-মাকে অবশ্যই আমি বিষয়টি জানাবো। স্মৃতি আহত দৃষ্টিতে বোনের দিকে তাকালো। মন গলল না স্রুতির।
চলবে…..