#মুঠোভরা_চোরাবালি
#আলিশা_আঞ্জুম
#পর্ব_১২
শরবত সমেত মিষ্টি, পায়েস, জায়গা করে নিলো মাঝারি কিসিমের এক ট্রেতে। ফাইজাকে বলা হলো স্নিগ্ধাকে নিয়ে বসার ঘরে মেহমানদের সম্মুখে যেতে। আড়ষ্ট মন নিয়ে ফাইজা বলে দিলো, সে বরং ট্রে নেবে। আয়রা বরং আরুকে ধরে নিয়ে যাক। বয়সে বড় হবে আরু। ফাইজার সাথে সৌহার্দ্য নেই। অস্বস্তি হবে ফাইজার তাকে ধরে পাত্র পক্ষের সামনে যেতে। আয়রা বোন কে ধরে যাওয়ার জন্য রাজি হলো ওঘরে। পূর্ব প্রস্তুতি নিলো কখন শরবত বিলিয়ে দেবে আর কখন দেবে পায়েস, মিষ্টি।
গুটি গুটি পায়ে ফাইজা ও আয়রা চলল ড্রয়িং রুমের দিকে। ফাইজা নিশচিন্তে যাচ্ছিলো। ঢিপঢিপ করছিলো ফাইজার শাশুড়ি মায়ের পছন্দ করা মেয়েটার বক্ষদেশ। তার প্রার্থনা একটাই। যে কোনো মূল্যে এবারের বিয়েটাও ভেস্তে যাক। শান ব্যাতিত অন্য কারো জন্য মুখে তিনবার কবুল কেন বকুলও বলা সম্ভব হবে না তার দ্বারা। ভাবনা আরো একটু এগিয়ে যেতো, তবে হোঁচট খেলো তা অনাকাঙ্ক্ষিত ভাংচুর হওয়ার মতো ধ্বনির কারণে। দুবোন চমকে পাশ ফিরে চাইলো। ফাইজা চেয়ে রইলো আহত, শূন্য দৃষ্টিতে আরু নাম জানা ফুফুর ননাসের বড় মেয়ের পানে। তার হাতের ট্রে মসৃণ টাইলসের মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছে ভেঙে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে। আয়রা ঘাবড়ে গেলো। আরু ঠাঁই দাড়িয়ে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো ফাইজার দিকে।
— ফাইজাপু….? তোমার লাগেনি কোথাও? তোমার কি শরীর খারাপ? তুমি কাপছো কেন আপু?
ফাইজা নিরুত্তর হয়ে এবার দ্বিতীয় বারের মতো চাইলো দরজার ঝুলন্ত পর্দার এক ফালি ফাঁকা স্থান দিয়ে ড্রইংরুমে। তাসরিফ বসে আছে। তার পাশে বসে আছে তাসরিফের মা। ছলছল করে উঠলো ফাইজার দুচোখ। বুকের পাথর নামানোর ভুল প্রচেষ্টা করে ফুফু পাহাড় চাপিয়ে দিয়েছে। প্রশান্তি কুড়িয়ে আচলে দিলেও তা বেদনায় রূপ নিয়েছে। কন্ঠ নালি এঁটে এলো ফাইজার। তাসরিফ থেকে অতি কষ্টে দৃষ্টি সরিয়ে সে আয়রার মুখপানে স্থির করে বলতে চাইলো কিছু। কিন্তু তৎক্ষনাৎ পেরে উঠা হলো না। আয়রা ইতিমধ্যে ফাইজাকে আরো চমকে দিতেই যেন অজান্তে বলে উঠলো
— স্নিগ্ধাপু, দেখনা একটু ফাইজাপুর কি হলো?
কেঁপে উঠলো ফাইজা স্নিগ্ধা নাম শুনে। অসহায়ত্ব চোখে মুখে গাঢ় হয়ে ফুটে উঠলো। তবে এই সেই স্নিগ্ধা? আরু ওরফে স্নিগ্ধা? ফাইজার নিজের প্রতি রাগ হলো, মাত্রাতিরিক্ত ক্ষোভ হলো। আগে যদি সে ঘুণাক্ষরেও জানতো আরুর অপর নাম স্নিগ্ধা। স্নিগ্ধাকে পরিবারের সদস্যরা আরু বলে ডাকে তবে সে ফুফুর সাথে এ বাড়িতে আসার কথা কল্পনাতেও রাখতো না।
— সরি, পরে গেলো….. আমি….. সরি
মনের দুঃখের দুয়ারে সাময়িক কালের জন্য তালাবদ্ধ করে ফাইজা তড়িঘড়ি করে বলে উঠলো। হুঁশ হারিয়ে ছুঁতে গেলো কাঁচের ধারালো টুকরো গুলো। স্নিগ্ধা এসময় খপ করে ধরে ফেলল ফাইজার হাত। উদ্বিগ্ন হয়ে বলে উঠলো
— কি করছো? হাত কেটে যাবে তো!
ফাইজা স্নিগ্ধার টানে দাড়িয়ে গেলো। হঠাৎই গহীন, অন্তহীন দুঃখ নিয়ে দৃষ্টি ফেলল স্নিগ্ধার চোখে। ফাইজার ভেতর হতে অন্তরাত্মা চিৎকার করে বলে উঠলো যেন
” হাতের কথা রাখো স্নিগ্ধা মেয়ে। আমার হৃদয় কেটে টুকরো টুকরো করে দিচ্ছো তুমি। পারলে আমার হৃদয়টার প্রতি মায়া করো।”
ফাইজার এই ভেতর চিৎকার স্নিগ্ধার কান অব্দি পৌঁছালো না। সে আয়রার পানে তাকিয়ে বলছে
— একটু পরেই যাই ড্রয়িং রুমে। এগুলো পরিষ্কার কর জলদি। কেউ দেখে ফেলার আগেই।
আয়রা মাথা নাড়িয়ে সাই জানালো। ফাইজা হতভাগ্য হয়ে শেষ বারের মতো চাইলো তাসরিফের পানে। ঠিক তখনই আকস্মিক ভাবে তাসরিফ ঘাড় ঘুরিয়ে চাইলো ফাইজার পানে। বুকটা ধ্বক করে উঠলো। ফাইজা থমকে গেলো। তাসরিফ বিষ্ময়ে নিষ্পলক হয়ে তাকিয়ে রইলাম দরজার ওপাশে তার ফাইজার পানে। ভ্রম নয়তো? ভাবনার মাঝেই ফাইজা ঘুরে দাড়িয়ে গেছে। হুলস্থুল পায়ে হাঁটতে শুরু করেছে। হাঁটতে গিয়ে পা ফেলেছে মেঝেতে গড়াগড়ি খাওয়া কোনো এক কাচের টুকরোতে। চমকে উঠে ডাকতে গিয়ে থমকে গেলো তাসরিফ। যখন ফাইজার পা পরলো কাচের টুকরোয় তখন ঝট করে বন্ধ করে নিলো তাসরিফ নিজের দুচোখ। একই ভাবে তার বুকেও যেন বিঁধেলো ভাঙা কাঁচের টুকরো। ইশ! কবে সে শিখবে একটু যত্ন করে চলতে? কবে রেহাই পাবে তাসরিফ এই মেয়ের এহেন কান্ডের কারণে হওয়া বুক ব্যাথা থেকে?
.
স্নিগ্ধা ঘরে ফিরলো। আয়রা ব্যাস্ত হাতে ভাঙা ট্রে, প্লেট, গ্লাসের টুকরো সরিয়ে রেখে পরিষ্কার করে ফেলল মেঝে। অতঃপর ছুটলো ঘরের পানে। ফাইজার কেটে যাওয়া পায়ে ওষুধ লাগানোর কথা মনে স্থির রেখে মা কে বলতে গেলো স্নিগ্ধাকে মেহমানদের সামনে নিয়ে যেতে।
.
ফাইজা ঘরে ফিরে সোহানার নিকট হতে অশ্রুসিক্ত আঁখি ও কাটা পায়ের রক্ত আড়াল করার লক্ষে তড়িঘড়ি করে ঢুকে পরেছে ওয়াশরুমে। পানির কল ছেড়ে দিয়ে পা রাখলো তার নিচে। চোখ বারংবার উপচে দিচ্ছে জল। তবে পায়ের ক্ষতের দরুন না। এই ক্ষতর ব্যাথার খোঁজ যেন মস্তিষ্ক নিতে নারাজ। সে পরে আছে বুকের ব্যাথা নিয়ে। আজ চিৎকার করে কান্না না আসলেও শরীর অবশ হয়ে আসছে ফাইজার। এতো কেন কষ্ট? এতো কেন যন্ত্রণা হয় তাসরিফ কে অন্য কারো হতে দেখলে? উফ! অসহ্য ধাঁচের পীড়া। ফাইজা ভাবনার মাঝে চোখে মুখে পানির ছেটা দিলো। শাড়ির আঁচলে মুছে নিলো মুখমন্ডল। আর এক মুহূর্ত এখানে থাকা যাবে না। নিষিদ্ধ হয়ে গেছে তাসরিফময় মুহূর্ত, তাসরিফময় সব কিছু। সে বিয়ে করে সুখী হবে, সন্তানের বাবা হবে। দাদা, নানা যা খুশি তাই হয়ে যেতে পারবে একদিন। সুখ ডিগবাজি দেবে তার পায়ের নিচে। তবে ফাইজা কেন কষ্ট পাবে? কেন চোখের পানি তাসরিফ কে দেখাবে? কেন তার অসহায়ত্ব তাসরিফের সামনে মেলে ধরবে? ফাইজা ভাবনা শেষে ওয়াশরুম হতে বেরোনোর কালে সোহানার উদ্দেশ্যে বলে উঠলো
— ফুফু চলো বাসায় যাই। আর থকবো না।
সেহানা বিছানাতেই বসে ছিলেন। মাত্র ড্রয়িং রুমে যাবেন বলে প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। পাত্র কেমন, কি করে ইত্যাদি বিষয়গুলোর সাথে সম্পর্ক গড়তে।
— কি বলছিস এসব? রাত ন’টা বাজে ফাইজা। এখন বাসায় যাবো? আজ থেকে যাই।
— তুমি না গেলে আমি একাই যাবো ফুফু। রাত ন’টা খুব বেশি রাত নয়। মাত্র এক ঘন্টার পথ।
— আচ্ছা আগে মেহমান বিদায় দেই। তারপর যাবো। ওরা এখনি চলে যাবে হয়তো। আমি আসছি ওঘর থেকে। দেখা করে আসি।
ফাইজা আটকালো না সোহানা কে। সে তার পার্স গুছিয়ে শাড়ির ওপর হিজাব বাঁধতে আরম্ভ করলো। হয়তোবা সে একাই, এই মুহূর্তে চলে যাবে। ফুফু থাকুক এখানে। সে তাসরিফ কে চেনে না। ফাইজার বাল্যবিবাহ হয়েছে বলে উনি রাগ থেকে বা ক্ষোভ থেকে ফাইজার বিয়েতে অভিযুক্ত ছিলেন না। তারপর দূরত্ব থেকে সম্পর্কে ধুলোবালি জমে। দেখা করার সুযোগ মেলেনি তাসরিফের সঙ্গে। আসমার দরুণ ভাইয়ের বাড়ি মুখোও হতে চান না সোহানা।
.
স্নিগ্ধা কে সম্মুখের এক সোফায় বসিয়ে রাখা হলো। তাসরিফ লুকিয়ে লুকিয়ে ছটফট করে গেলো পুরোটা সময় তার বউপ্রিয়ার কথা ভেবে। স্নিগ্ধার পানে দৃষ্টি স্থানান্তর করেছিল সে যেন মাত্র তিন সেকেন্ডের জন্য। তাসলিমার মুখে হাসি ঝড়ছে। তিনি উঠে দাঁড়ালেন। স্নিগ্ধার মা, মামিকে নিয়ে চলে গেলেন ভেতর ঘরে। আজকালকার যুগ, সময় বলে কথা। কিছুটা সময় ছেলে মেয়েদের হাতে দান করা আবশ্যক। স্নিগ্ধা খুঁটিয়ে খুটিয়ে দেখলো তাসরিফ কে। বেশ সুন্দর, শানের চাইতে হাজার ডজন বেশি সুন্দর। এক দেখায় প্রেমে পরে যাওয়ার মতো সুন্দর লোকটা।
— আপনার সাথে কি আমি বেলকনিতে গিয়ে একটু কথা বলতে পারি? আসলে কিছু সিক্রেট কথা।
তাসরিফ এবার পূর্ণ দৃষ্টিতে চাইলো স্নিগ্ধার পানে। আয়রা মেয়েটার মতোই এই মেয়েটাও স্যাম বর্ণের। মায়াবতী।
.
সুযোগ পেয়ে বসলো ফাইজা। দরজার ওপ্রান্ত হতে যখন দেখলো ড্রয়িং রুম পুরোটাই নির্জন, জনমানবশূন্য তখনই সে ঝটপট পা বাড়ালো। দম আঁটকে প্রায় বন্ধ চোখে বেরিয়ে গেলো ফ্ল্যাট থেকে। ঘন আঁধারের বুক চিড়ে বৈদ্যুতিক আলোর অস্তিত্ব সঙ্গে নিয়ে ফাইজা সিঁড়ি ডিঙিয়ে নিচে নামলো। অপেক্ষা মাত্র রিকশার। অবশেষে সে সোহানা কে রেখেই রওনা হচ্ছে বাড়ির পথে।
প্রায় মিনিট দশ পেরিয়ে গেলে একটা রিকশা এসে সামনে দাঁড়ালো ফাইজার। ফাইজা উঠে পরলো রিকশায়। চালক তার রিকশা টান দেবে দেবে ভাব। ঠিক এমন সময়ই হঠাৎ কেউ উচ্চবাচ্যে বলে উঠলো
— এই মামা দাড়ান, আমি শশুর বাড়ি যাবো।
চলবে…..