শেষটা_সুন্দর #জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা ৩৯।

0
730

#শেষটা_সুন্দর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৩৯।

রুমে এসে মেহুল প্রথমবারের মতো রাবীরকে টি শার্ট আর ট্রাউজার গায়ে দেখে। রাবীরকে এভাবে দেখে ভীষণ অন্যরকম লাগে। সবসময়ই একভাবে দেখে আসতে আসতে আজ যেন চোখে তাকে নতুন লাগছে। রাবীর তার দিকে চেয়ে বলে,

‘দাঁড়িয়ে আছেন কেন? আসুন।’

মেহুল ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে রাবীরের পাশে বসে। রাবীর জিজ্ঞেস করে,

‘মন খারাপ?’

মেহুল মাথা ঝাঁকিয়ে না করে। রাবীর পুনরায় বলে,

‘রিতার হচ্ছে দুশ্চিন্তা হচ্ছে তাই না?’

মেহুল মৃদু সুরে বলে,

‘ওর সাথে অন্যায় হয়েছে। ও তো সিয়ামকে পছন্দ করতো। ও কখনোই নিজের ইচ্ছাতে সাদরাজ আহমেদকে বিয়ে করবে না। নিশ্চয়ই ঐ লোকটা ওকে ভয় দেখিয়েছে।’

‘রিতার সবথেকে দূর্বলতম জায়গা কোনটা? উনার মা বাবা, তাই না। কিন্তু উনারা তো আজ পুরোটা দিন আমাদের চোখের সামনেই ছিলেন। তবে সাদরাজ রিতাকে অন্য আর কার ভয় দেখিয়েছে?’

‘সেটা তো আমিও বুঝতে পারছি না। আর ওর সাথে কথা না বলে কিছু বুঝতেও পারব না।’

‘হু। আচ্ছা, আপনি এখন শুয়ে পড়ুন। আজ অনেক ধকল গিয়েছে। ঘুমানো প্রয়োজন। নয়তো অসুস্থ হয়ে পড়বেন।’

এই বলে রাবীর উঠতেই মেহুল বলল,

‘আপনি শুবেন না?’

‘হ্যাঁ, আসছি। একটা জরুরি কল করতে হবে।’

‘আচ্ছা।’

রাবীর বারান্দায় যায়। মেহুল একপাশে গিয়ে শুয়ে পড়ে। রিতা এখন কোথায় আছে, কেমন আছে কে জানে? রিতার জন্য খুব দুশ্চিন্তা হচ্ছে তার। সাদরাজ খারাপ লোক। সে রিতাকে যদি ভালোবেসে বিয়ে করতো তাহলেও কোনো আপত্তি ছিল না। কিন্তু, সে তো রিতাকে বিয়ে করেছে খারাপ উদ্দেশ্য নিয়ে; ভালোবেসে না। মেহুল শুয়ে শুয়ে দু হাত কচলাচ্ছে আর ভাবছে যেভাবেই হোক খুব দ্রুত তাকে রিতার সাথে যোগাযোগ করতে হবে।

বারান্দা থেকে কথা শেষ করে রাবীর রুমে এসে দেখে মেহুল ঘুমিয়ে পড়েছে। তাই সে রুমের দরজা আটকে লাইট অফ করে তার পাশে এসে বসে। মেহুলের মাথার উপর হাত রাখতেই হুট করে তার মনে পড়ে, সে মেহুলের জন্য কিছু একটা এনেছিল। কিন্তু, সেটা তো আর দেওয়াই হলো না। সে আবার উঠে গিয়ে আলমারি খুলে একটা ছোট্ট বক্স বের করে। তারপর আবার গিয়ে মেহুলের পাশে বসে। সারাদিনের ক্লান্তি শেষে মেহুল এখন বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। রাবীর সেই বক্স থেকে একটা চেইনসহ পেনড্যান্ট বের করে আস্তে করে মেহুলের গলায় পরিয়ে দেয়। ঘুমের ঘোরে মেহুল কিছু টেরও পায়নি। পরানো শেষে রাবীর মুচকি হাসে। মেহুলের কপালে ঠোঁট ছুঁয়ে দিয়ে সেও পাশে শুয়ে পড়ে।

_______

ঘুমের মাঝেই ভীষণ আলোর ঝাপটা টের পাচ্ছে মেহুল। আরামের ঘুমটা তখন সঙ্গে সঙ্গেই ছুটে যায়। সে তাকিয়ে দেখে চারদিকে রোদে ঝলমল করছে। এত রোদ! রুমের দরজা জানলার সব পর্দা কেউ খুলে দিয়েছে। মেহুল বিরক্ত হয়ে উঠে বসে। ঘড়িতে চেয়ে দেখে কেবল আটটা বাজতে চলল। আর এর মাঝেই সূর্যের আলো যেন পুরো রুমকে গিলে খাচ্ছে। মেহুল পাশে তাকিয়ে দেখে রাবীর নেই। রাবীর যে সকাল সকাল উঠে সে জানে। তাই সেও তখন ওয়াশরুমে চলে যায় ফ্রেশ হতে।

বেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে দাঁত মাজতে মাজতেই হঠাৎ তার গলার দিকে চোখ যায়। চেইনের মতো কিছু একটা দেখে টান দিতেই একটা পেনড্যান্ট সামনের দিকে আসে। যেটা দেখে মেহুল খুব অবাক হয়। আয়নায় যেভাবে এটা চিকচিক করছে মনে হচ্ছে ডায়মন্ড। সে তখন বুঝতে পারে, এটা রাবীর নিশ্চয়ই কাল রাতে ঘুমের মধ্যে তাকে পরিয়ে দিয়েছিল। সে মুচকি হাসে। মুখ ধুয়ে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে ড্রেসিং টেবিলের আয়নার সামনে দাঁড়ায়। শাড়িটা এলোমেলো হয়ে আছে। সেটা ঠিক করে। চুল বাঁধে। গলার পেনড্যান্ট’টা যেন বারবার তার নজর কাড়ছে। সুন্দর লাগছে জিনিসটা। মেহুল তারপর নিচে যায়। তখনও বাসার কেউ উঠেনি। খালি কাজের খালারা ছাড়া। মেহুল ড্রয়িং রুমে যেতেই রাবীর তখন মেইন দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে। রাবীরকে দেখে মেহুল দাঁড়ায়। রাবীর ঘেমে গেয়ে একাকার হয়ে আছে। গলায় ঝুলানোর মাঝারি সাইজের টাওয়ালটা দিয়ে ঘাম মুছছে। মেহুলকে দেখে সে মুচকি হেসে বলে,

‘গুড মর্নিং।’

মেহুলও হেসে বলে,

‘গুড মর্নিং।’

রাবীর এগিয়ে আসে। জিজ্ঞেস করে,

‘এত তাড়াতাড়ি উঠে পড়লেন যে।’

‘যাওয়ার সময় এভাবে উঠার ব্যবস্থা করে দিয়ে গেলে কি আর ঘুমানো যায়? আপনার রুমে অনেক রোদ আসে।’

রাবীর হাসে। বলে,

‘যাক তাহলে, আমাকে আর কষ্ট করে ডাকতে হয়নি। আচ্ছা, আপনি আসুন। আমি গিয়ে ফ্রেশ হচ্ছি।’

রাবীর যাওয়ার সময় মেহুল জিজ্ঞেস করে,

‘চা খাবেন নাকি কফি?’

‘কফি।’

‘আচ্ছা।’

মেহুল রান্নাঘরে গিয়ে দেখে খালা কাজ করছেন। মেহুল উনার দিকে চেয়ে বলে,

‘খালা, আমাকে একটু কফি পাউডার, দুধ আর চিনির বৈয়ামটা বের করে দাও। আমি কফি বানাব।’

খালা উঠে দাঁড়ালেন। বললেন,

‘না না ছোট খালা, আপনার বানাইতে হইতো না। আপনি কন আমি করে দিতেছি।’

‘না খালা, তুমি তোমার কাজ করো। আমি রাবীরের জন্য নিজের হাতে কফি বানাব।’

খালা তখন হেসে বললেন,

‘ওহহ, আইচ্ছা। ভালোবাইসা বানাইবেন। দাঁড়ান, আমি সব বের করে দিই।’

________

মেহুল কফির মগগুলো হাতে নিয়ে বারান্দায় যায়। রাবীর গোসল করে বেরিয়েছে মাত্র। বারান্দায় দাঁড়িয়ে মাথা মুছছিল। মেহুল তার দিকে একটা কফির মগ এগিয়ে দিয়ে বলল,

‘আপনার কফি।’

রাবীর টাওয়ালটা নেড়ে দিয়ে কফির মগটা হাতে নেয়। তারপর সে এক সিপ খেয়ে বলে,

‘মেবি চিনিটা একটু কম হয়েছে। আমি আরেকটু চিনি দিয়ে খাই।’

মেহুল তখন রাবীরের দিকে কপাল কুঁচকে তাকাল। সে মনে মনে অন্যকিছু ভাবল। তারপর রাবীরকে বলল,

‘দেখি।’

রাবীরের হাত থেকে কফির মগ নিয়ে সেও এক সিপ খেল। বলল,

‘ঠিকই তো আছে।’

রাবীর তখন বলল,

‘আপনি হয়তো কম চিনি খান। তাই আপনার জন্য এটা ঠিক আছে। তবে আমার কফিতে একটু বেশি চিনি লাগে।’

মেহুল জিজ্ঞেস করল,

‘এখন দিয়ে আনব?’

‘না, থাক। এখন আর কষ্ট করে নিচে নামতে হবে না।’

এই বলে সে মেহুলের কাছ থেকে কফির মগটা নিয়ে খেতে আরম্ভ করে। মেহুল তার দিকে কপাল কুঁচকে চেয়েই থাকে। রাবীর চেয়ে বলে,

‘কী হলো, আপনি খাচ্ছেন না কেন? কফি ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে তো।’

মেহুল মুখ কালো করে অন্যদিকে তাকায়। কোথায় সে ভেবেছিল, সে কফিতে চুমুক দেওয়ার পর রাবীর বলবে, “আপনার ঠোঁটের ছোঁয়াতেই আমার কফি মিষ্টি হয়ে গিয়েছে, আমার আর মিষ্টি লাগবে না।” তা না, সে কিছু না বলে এই কফিই গিলে যাচ্ছে। নিরামিষ কোথাকার!

কফি খাওয়া শেষ করে মেহুলে মগটা রাবীরের হাত থেকে নিয়ে চলে যেতে নিলেই রাবীর তাকে আবার ডেকে উঠে,

‘মেহুল।’

মেহুল চেয়ে বলে,

‘কী?’

‘আপনার কাছ থেকে নেওয়ার পর কফিটা মিষ্টি হয়ে গেল কী করে বলুন তো?’

মেহুল ভ্রু কুঁচকায় সঙ্গে সঙ্গে। রাবীর ভ্রু নাচিয়ে বলে,

‘কী হলো, বলুন।’

মেহুল নাক ফুলিয়ে বলে,

‘জানি না।’

এই বলে সে দ্রুত নিচে নেমে যায়। আর রাবীর তখন তার যাওয়া দেখে শব্দ করে হেসে উঠে।

_______

রিতা বিছানা ছেড়ে উঠতে পারছে না। মাথায় প্রচন্ড ব্যথা তার। চোখ মেলে তাকিয়ে যেন সবকিছু ঝাপসা দেখছে। তাও কোনোরকমে চোখ খুলে চাইল। চেয়ে দেখল একটা বয়স্ক মহিলা তার দিকে হা করে চেয়ে আছে। সে বুঝতে পারল না প্রথমে। পরে নিজের দিকে তাকাতেই লজ্জা পেয়ে ওড়না গায়ে জড়িয়ে নিল। কোনোরকমে উঠে বসল। মহিলাটা বলল,

‘ম্যাডাম, আপনার কফি। স্যার কইছে, নিচে গিয়া নাস্তা করতেন। আর আপনার জামা কাপড়সহ যা যা লাগব সব আলমারিতে আছে।’

রিতা ঢোক গিলল। কাঁপাকাঁপা গলায় বলল,

‘একটু পানি দিবেন।’

মহিলাটা একটা পানির গ্লাস তার দিকে এগিয়ে দিল। রিতা ঢকঢক করে পুরো গ্লাসের পানি শেষ করে জোরে জোরে নিশ্বাস ফেলল। মহিলাটাকে বলল,

‘ঐ লোকটা কোথায়?’

মহিলাটা ভ্রু কুঁচকে বলে,

‘কোন লোকডা?’

‘সাদ-সাদরাজ আহমেদ।’

মহিলা হেসে বলে,

‘ওমা, লোকডা কী? উনি তো আপনার স্বামী লাগেন।’

রিতা চেঁচিয়ে বলল,

‘আমি মরে গেলেও ঐ লোকটাকে আমার স্বামী হিসেবে মেনে নিব না। জানোয়ার একটা।’

মহিলাটা ভয়ে তার মুখ চেপে ধরে। বলে,

‘চুপ চুপ। কী কন এডি? এই বাড়ির দেওয়ালেরও কান আছে। স্যারের কানে গেলে স্যার মাইরাই ফেলব।’

রিতা তখন শব্দ করে কেঁদে উঠল। ফুঁপাতে ফুঁপাতে বলল,

‘এই লোকটার সাথে থাকার চেয়ে মরে যাওয়াও ভালো। ঐ লোকটা মানুষ না। মানুষ হলে উনি কখনোই আমার সাথে এমনটা করতেন না।’

মহিলাটা বলল,

‘এডাই তো স্বামীর ভালোবাসা।’

রিতা চেঁচিয়ে বলে,

‘এটা ভালোবাসা? না, এটা ভালোবাসা না। এটা লোভ। নারীর শরীরের প্রতি পুরুষের লোভ। আর এই লোভ আর যাই হোক ভালোবাসার মতো পবিত্র জিনিস হতে পারে না।’

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here