যে_বর্ষণে_প্রেমের_ছোঁয়া #আনিশা_সাবিহা পর্ব ৩৯

0
511

#যে_বর্ষণে_প্রেমের_ছোঁয়া
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৩৯

শৌভিকের বাড়ি থেকে তড়িঘড়ি করে বের হলো মোহ। রাস্তার এপাশ-ওপাশ তাকিয়ে দেখতে থাকল কোনো ফাঁকা অটো পাওয়া যায় কিনা। বাড়ি থেকে কল এসেছে। আজহার সাহেব, মিসেস সুফিয়া এবং ইথান ফিরে এসেছে। এখনি বাড়ি ফিরতে হবে। তবে এই সময়টা সকলের জন্য ব্যস্ততার। ফলে ফাঁকা অটো পাওয়া মুশকিল বটে। রাস্তার একপাশে দাঁড়িয়ে ভাবুক হয়ে পড়ল মোহ। মস্তিষ্ক জুড়ে ঘুরপাক খাচ্ছে স্বচ্ছের কথা। তার জানা নেই মোহের এবং শৌভিকের নেওয়া পদক্ষেপের পর স্বচ্ছের প্রতিক্রিয়া কী হবে! যত কিছুই হয়ে যাক সবশেষে সরোয়ার সাহের তারই বাবা৷ স্বচ্ছ কি কষ্ট পাবে? স্বচ্ছের খারাপ লাগার কথা ভেবেই শৌভিকের কাছে আসার কারণ জানায় নি মোহ। নাহলে সে স্বচ্ছের সাথেই বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করতে পারত। কিন্তু স্বচ্ছের বিন্দুমাত্র খারাপ লাগার কারণ মোহ হতে চায় না। তার ভাবনায় বাঁধা পড়ল গাড়ির ব্রেক কষার শব্দে। মোহ উপলব্ধি করল তার একেবারে সামনে দাঁড়িয়েছে গাড়ি। মোহ মাথা উঠিয়ে তাকাল। জানালার গ্লাস খুলতেই দেখল একটি যুবক। প্রাণোচ্ছল চেহারা। গাঢ় নীল শার্টের সাথে সানগ্লাস ঝোলানো। চেহারায় স্বচ্ছের সঙ্গে অনেকটা মিল খুঁজে পাওয়া যায়। মোহ মনোযোগ দিয়েও চিন্তা করে এই যুবকটিকে চিনতে না পারলে যুবকটি হাসি দিয়ে বলে,
“আপনার সাথে আমার দেখা শুধু একবারই হয়েছিল। তাও আবার আমার ভাইকে প্রথমদিন যখন চ/ড় মে/রেছিলেন। সেদিন বুঝিনি সেই থা/প্পড় এক ঝটকায় আপনাকে আমার ভাবী বানিয়ে দেবে। তাহলে আগের থেকেই খাতিরদারি করতাম।”

শেষ কথাগুলো শুনে মোহের কপাল কুঁচকে গেল। নজর হলো তীক্ষ্ণ। গমগমে সুরে জিজ্ঞেস করল,
“কিছু বললেন? শেষে কী বললেন বুঝলাম না!”

” না, না কিছু না। আমি আহিয়ান স্বচ্ছের সরল সিকা ছোটো ভাই সৌমিত্র।”

মোহ ছোটো করে উত্তর করল,
“ওহ। আমায় কিছু বলতে চান? মানে আমার সামনে এসে গাড়ি ব্রেক করলেন যে!”

সৌমিত্র গলা খাঁকারি দিয়ে আমতা আমতা করে বলল,
“দরকার তো ছিল। আচ্ছা, আপনি নিশ্চয় কোথাও যাওয়ার জন্য গাড়ির অপেক্ষা করছেন? আমি পৌঁছে দিই?”

মোহ সরাসরি মানা করে দিলো,
“তার কোনো দরকার নেই। আমি অচেনা মানুষের সঙ্গে যাই না।”

“আমি তো পরিচয় দিলাম নিজের। তবুও অচেনা হয়ে গেলাম? এটা কোনো কথা বললেন আপনি?”

“হ্যাঁ এটাই কথা। আপনার কি কোনো গুরুত্বপূর্ণ কথা বলার আছে? আচ্ছা, আপনি কি নিজে থেকে এদিকে এসেছেন নাকি আপনার ভাই পাঠিয়েছে আপনাকে?”

মোহের কড়া প্রশ্নে সৌমিত্র নিজের জিহ্বাতে কা/মড় দিয়ে বলে,
“ছি, ছি। না একদম না। ভাইয়া আমাকে পাঠায় নি। কসম করে বলছি।”

মোহ কিছুটা সময় নীরব থেকে গম্ভীর গলায় বলল,
“আচ্ছা তাহলে আপনি আপনার রাস্তায় যান। আমি আমার রাস্তায়।”

মোহ এবার সৌমিত্রের উত্তরের আশা না করে হাঁটা দিলো সোজা। তৎক্ষনাৎ সৌমিত্র তড়িঘড়ি করে নিজের সিটবেল্ট খুলতে খুলতে বিড়বিড়িয়ে বলল,
“এবার বুঝেছি! কী কারণে আমার ভাই এনার প্রতি আসক্ত হলো। দুজনের মাঝেই ঘাড়ত্যাড়ামির রোগ আছে কিনা!”

সৌমিত্র এবার মাথা জানালা দিয়ে বের করে চিল্লিয়ে মোহকে ডাক দিলো,
“ও ভাবী! সরি! ও হবু ভাবী একটু শুনে যান। সত্যি গুরুত্বপূর্ণ কথা ছিল।”

বারংবার ভাবী ডাক শুনে ঘাড় ফিরিয়ে চোখ রাঙিয়ে তাকাল মোহ। পিছু ফিরে এসে কঠিন সুরে সৌমিত্রের উদ্দেশ্যে বলল,
“কী বলে ডাকলেন আপনি আমাকে?”

সৌমিত্র থতমত খেয়ে আকস্মিক হেসে বলল,
“আপনাকে ডাকিনি তো। আমি বলেছি ভারী! আপনি ভাবী শুনতে পেয়েছেন তাই না? আমি তো বলেছি আজকের আকাশটা ভারী হয়ে আছে। যখন তখন বৃষ্টি আসবে। আপনি ভিজে গেলে আমার খারাপ লাগবে। আমাকে ভাই ভেবে তার গাড়িতে লিফট নিলে ক্ষতি কী?”

সৌমিত্র শেষ কথাটা বেশ নমনীয় ভাবে। যেন মোহ কথাটা ফেলতে না পারে। তবে মোহ এবার উত্তর দিলো না। চুপ করে রইল এবং সৌমিত্রের পানে সরু দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। সৌমিত্র ফের অনুরোধ করল,
“আপনার সাথে সত্যি জরুরি কথা ছিল। তাও স্বচ্ছের ভাইয়ের ব্যাপারেই।”

মোহ আগের মতোই নিশ্চুপ রইল। স্বচ্ছের বিষয় ওঠায় এখন মন টানছে তার। দোটানায় পড়ে গিয়ে বলল,
“গাড়ির দরজা খুলুন।”

সৌমিত্র খুশিতে লাফিয়ে উঠে দরজা খুলে দিলো। মোহ উঠে বসল। সৌমিত্র গাড়ি স্টার্ট দিলো। মোড় নিলো মোহের বাড়ির রাস্তায়। মোহ সোজাসাপটা জিজ্ঞেস করে বসল,
“কী বলতে চান বলুন।”

“আমার আপনার কাছে একটা আবদার আছে। ভাইয়ার ব্যাপারেই। যদি পূরণ করে দিতেন!”

মোহের ভ্রু দুটো আপনাআপনি কুঁচকে যায়। কী এমন আবদার? যার কারণে এত হুটোপুটি? মোহ বেশ উৎসুক হয়ে বলল,
“কী আবদার?”

“ভাইকে বাড়ি যাওয়ার জন্য রাজি করাতে হবে। আমার মনে হলো এটা শুধু আপনি পারবেন।”

মোহের উদ্ভট লাগল সৌমিত্রের কথা। বুঝে উঠতে পারল না কিছুই। আগ্রহের সহিত জানতে চায়,
“মানে? বাড়ি যাওয়ার জন্য রাজি করানোর ব্যাপারটার মানে কী?”

“ওহ তাহলে আপনাকে এখনো ভাই বলেনি। আসলে সে গত রাতে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে আসে। বাবার সাথে ভীষণ কথা কাটাকাটি হয় তার! সেটা ধরেই সে শূন্য হাতে বেরিয়ে পড়ে। টাকাপয়সা, গাড়ি কিছু নেয়নি। গরমে, মশার কামড়ে আমাদের ক্লাবে রাত কাটাচ্ছে। আমি অনেকবার চেষ্টা করে বোঝাতে কিন্তু মহাশয় রাজি নয়। আর বাবা ও তার মাঝে তর্কের বিষয়বস্তু ছিলেন আপনি।”

বিস্ময়ে চক্ষু দুটো যেন কপালে উঠে গেল মোহের। মুখশ্রী ভরা কৌতূহল! অস্ফুটস্বরে বলল,
“আমি?”

“হুমম। ভাই জানে আপনার সাথে বাবা কী কী ভুল করেছে। সেটা নিয়েই কথা কাটাকাটি হয়। আর বাবা তো অন্যরকম একটা মানুষ। নিজের ভুল কখনো স্বীকার করতে রাজি হন না। কিন্তু আমার নাছোড়বান্দা ভাই! সে বলেছে নিজের ভুল স্বীকার করতে হবে নয়ত বাড়ি ছাড়বে আর সে তাই করেছে। তার কাছে বেশি টাকাও নেই এটা সিওর। গতরাত থেকে কিছু খায়নি হয়ত। এভাবে কী করে চলবে বুঝতে পারছিলাম না। তাই আপনাকে বলা উচিত মনে হলো।”

মোহ এবার একটু একটু করে বোধ করে অটোতে স্বচ্ছের মাঝে মাঝে পেট চেপে ধরার ব্যাপারটা, দামী গাড়ির বদলে অটোতে যাওয়ার ব্যাপারটা, গতদিন ধরে এক কাপড়ে থাকার ব্যাপারটা। সব কিছু ধরে ফেলে সে। অদৃশ্য অনুতাপ ঘিরে ফেলল তাকে। তারই কারণে একটা মানুষ এত কষ্ট সয়ে রয়েছে ভাবতেই মনে উচাটন শুরু হলো। দরদর করে ঘামতে শুরু করল সেখানেই। সে তো এসব কষ্ট দেবে না বলেই নিজে যা করার করছে! তবুও কেন ঘটল এমন অঘটন! বুক ভার লাগে মোহের এসব চিন্তায়। গভীর ভাবনার অন্ত ঘটে সৌমিত্রের কথায়।
“আপনার না হওয়া ভাই মনে প্লিজ আমার জেদি, রুক্ষ, মেজাজি ভাইটাকে বোঝান। নয়ত কয়দিন পর তার আর পাটকাঠির মাঝে কোনো পার্থক্য থাকবে না। এটা কি চান বলুন?”

মোহ আগের ন্যায় নীরবতা পালন করল। অনেকটা ভেবে বলল,
“আপনি উনার ছোটো ভাই! আপনার কথা উনি শুনল না। আমার কথা উনি কেন শুনবেন তবে?”

সৌমিত্র এবার ফট করে হেসে লাগামহীনের মতো মুখ ফসকে বলে ফেলে,
“আরে ভাইয়ের কথায় কে ওঠে-বসে? বউয়ের কথায় তো মানুষ ওঠে-বসে!”

কথাটা শেষ হতেই নিজেই তব্দা মে/রে রইল সৌমিত্র। চোখ বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে রইল সামনের দিকে। মনোযোগ দেওয়ার চেষ্টা করল ড্রাইভিং-এ। তবে আঁড়চোখে না তাকিয়ে পারল না মোহের পানে। মোহ একপ্রকার ভ্যাবাচেকা খেয়ে মূর্তির ন্যায় বসে আছে। কান গরম হয়ে গিয়েছে তার সৌমিত্রের লাগামছাড়া কথা শুনে। মনে মনে সে বলে ফেলল, ‘দুই ভাই-ই চরম অসভ্য!’

অনেকক্ষণ সময় নিয়ে নিজেকে সামলে তুলে মোহ গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,
“আপনার দুই ভাইয়েরই উচিত পাবনা থেকে একবার ঘুরে আসা।”

সৌমিত্র ফের বেশরমের ন্যায় দাঁত কেলিয়ে বলল,
“তার জন্য একটা অভিভাবক দরকার! আপনি না হয় আমাদের অভিভাবক হয়ে যাবেন।”

মোহ এবার বিষম খেল যেন। এবার যেন সে গাড়ি থেকে কোনোমতে নামতে পারলেই বাঁচে!

দুপুরবেলা বোতলে মুখ লাগিয়ে পানি খেয়ে পেট ভরাচ্ছে স্বচ্ছ। হাতের কাছে না আছে তেমন টাকা আর না আছে খাবার। পানির ঢক গিলতে গিলতে অন্যমনস্ক হয়ে চিন্তা করছে মোহের বিষয়ে। শৌভিকের বাড়ি যাওয়ার ব্যাপারটা নিয়ে এখনো যেন গবেষণা শেষ করতে পারছে না সে। তার সকল মনোযোগ কেঁড়ে নিয়েছে এই নারী। শব্দ করে বোতল রেখে নিজের শার্ট খুলতে লাগল সে। সৌমিত্র কিছু টিশার্ট দিয়ে গেছে জোর করে তাকে। এখন শার্ট পরিবর্তন করতেই হবে। একটা একটা করে বোতাম খুলতে খুলতে সে বিড়বিড়িয়ে বলল,
“আমার চিন্তাভাবনার শক্তি সব শুষে নিলে আমি এখন চলব কী করে মিস মোহময়ী! এমন চলতে লাগলে আমি সত্যি নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ব।”

মেইন গেটে ঠকঠক আওয়াজ হলো। স্বচ্ছ ভাবল হয়ত তার বন্ধুরা এসেছে। টিশার্ট পরিধান করে স্বচ্ছ এগিয়ে গেল। দরজা খুলতেই ফারাহকে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল। তৎক্ষনাৎ ফারাহ নিজের চুল হাত দিয়ে পেছনে ঠেলে দিয়ে ভাব নিয়ে বলল,
“ওয়েলকাম মি! এখনকার বেস্ট ডিজাইনারকে ওয়েলকাম জানাও ব্রো! ফাস্ট, ফাস্ট।”

স্বচ্ছ মোটেও ফারাহর কর্মকাণ্ড কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাল না। কারণ সে এসবে অভ্যস্ত। তবে এই মেয়েকে এমন আত্মবিশ্বাসী দেখতে স্বচ্ছের বেশ ভালো লাগে। ফারাহ স্বচ্ছের সাড়া না পেয়ে স্বচ্ছকে হাত দিয়ে ঠেলে দিয়ে ভেতরে ঢুকে বলল,
“নূন্যতম ডিসিপ্লিন নেই আহিয়ান স্বচ্ছের মাঝে। ফারাহর মতো একটা ডিজাইনার এসেছে তার কাছে সেধে। অথচ সে সামান্য ওয়েলকাম জানাতে পারছে না। নো প্রবলেম! ফারাহ এসবের তোয়াক্কা করে না।”

স্বচ্ছ এসবের কোনো উত্তর না দিয়ে ফারাহর পিছু পিছু এসে বলল,
“কেন এসেছ তুমি আবার? সৌমিত্র কি কম ছিল বোঝানোর জন্য? সে তুমিও এসেছ?”

ফারাহ চোখমুখ জড়িয়ে চেয়ারে পায়ে পা তুলে বসে বলল,
“আমি কেন তোমাকে বোঝাতে আসব? তোমাকে বোঝানো আর একটা গাছকে হাঁটার কথা বলা একই। কোনোটাই কাজ করবে না।”

“তাহলে কেন আসা হয়েছে?”

ফারাহ এবার সামনে থাকা লম্বা টেবিলে তার অন্যহাতের ব্যাগটা রেখে ব্যাগটা থেকে খাবার বের করতে করতে বলল,
“তুমি তো জানোই আমি অন্তত দয়ালু মনের মানুষ। একটি কোমল মনের নারী। তাই আমার মনে হলো বাড়ি ত্যাগ করা ভাইটার জন্য দয়ামায়া করে তার পছন্দের রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার নিয়ে আসা উচিত!”

স্বচ্ছের মুখ ভার হলো। খিদে পেলেও প্রকাশ করল না। বলল,
“আমি তোমাকে বলেছি এসব আনতে? কেন আমায় না বলে এসব আনতে গিয়েছ?”

ফারাহ চুপ করে রইল এবার৷ ভাইয়ের শুকনো মুখের দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বলল,
“আমিও গত রাত থেকে খাইনি, ভাইয়া।”

চলবে…

[বি.দ্র. আপনারা অনেকে শুধু মোহ এবং স্বচ্ছের মাঝকার আলাপ পড়তে চান। কিন্তু এটা ভুললে চলবে না এটা বড়োগল্প। যেখানে শুধু নায়ক নায়িকা ব্যতীত সকল চরিত্র ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা হবে। শুধু নায়ক নায়িকা দিয়ে কখনো কোনো পূর্ণ উপন্যাস বা বড়ো গল্প লেখা যায় না। ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। গল্পটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here