#শেষটা_সুন্দর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৪২।
‘রাবীর, রিতার ফোনটা তো এখনো বন্ধ। আমি ওর সাথে কোনোভাবেই যোগাযোগ করতে পারছি না।’
‘ফোনটা নিশ্চয়ই সাদরাজের কাছে।’
‘তাহলে এখন ওর সাথে কীভাবে যোগাযোগ করব? ওর সাথে কথা বলাটা তো জরুরি।’
‘হ্যাঁ, সেইজন্যই আমি একবার ভেবেছিলাম পুলিশকে জানাব। পরে মনে হলো রিতা যদি সত্যিটা পুলিশের সামনে না বলেন তাহলে এসব করে কোনো লাভ হবে না। উনাকে সাদরাজের ভয় কাটিয়ে নিজেকেই একটা স্টেপ নিতে হবে। নয়তো সাদরাজের কাছ থেকে উনি নিজেকে কখনো মুক্ত করতে পারবে না।’
মেহুল মন খারাপ করে বলে,
‘সাদরাজ যদি ততদিনে ওর কোনো ক্ষতি করে ফেলে?’
রাবীর মাথা নাড়িয়ে বলল,
‘উঁহু, ক্ষতি করার উদ্দেশ্য থাকলে সাদরাজ উনাকে বিয়ে করতো না। ওর অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে।’
‘তাহলে এখন কী করবেন? রিতার সাথে কি কোনোভাবেই যোগাযোগ করা যাবে না?’
‘হ্যাঁ, যাবে। কাল আমাদের রিসিপশনে আমি সাদরাজ আহমেদকে ইনভাইট করব। আর আমি জানি ও আসবে। তার উপর ওর বিয়ের খবরটা আশেপাশের মানুষ জেনে গিয়েছে। ওকে তো ওর ওয়াইফকে সবার সামনে আনতেই হবে। আর তখনই না হয় আপনি রিতার সাথে কথা বলে সব জেনে নিবেন।’
মেহুল যেন একটু স্বস্তি পেল। বলল,
‘আচ্ছা। আপনি নিজে ওদের ইনভাইট করবেন। একবার রিতা আসুক, আমি তখন সব সত্যি ওর থেকে শুনতে পারব।’
_____________
‘খালা, খালা, এক গ্লাস পানি দিয়ে যাও।’
ড্রয়িং রুম থেকে সাদরাজের গলা পেয়ে খালা দ্রুত উপরে উঠে সাদরাজের রুমে যায়। গিয়ে দেখে রিতা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। খালা তাকে গিয়ে বললেন,
‘মা, সাহেব আইছেন।’
রিতা চেয়ে বলল,
‘হ্যাঁ, আমি বারান্দা দিয়ে দেখিছি।’
‘সাহেব পানি চাইতেছেন। আপনি যান, সাহেবের লাইগা এক গেলাস শরবত বানিয়ে নিয়া যান।’
রিতা ভ্র কুঁচকে বলে,
‘আমি? পারব না।’
‘আহা মা, এমন কইরেন না। যান না মা। আপনিই পারবেন সবকিছু আবার ঠিক করতেন। মা, আপনাকে চেষ্টা করতেই হইব। যান মা। সাহেবের মন ভুলান। যান।’
রিতা বিরক্ত হয় খুব। কিন্তু, এছাড়া তো আর কোনো উপায়ও নেই। ঐ লোকটাকে যেভাবেই হোক পটাতে হবে। যদিও সে অনিশ্চিত, আদৌ সে এই কাজটা করতে পারবে কিনা।
.
রিতা এক গ্লাস শরবত বানিয়ে ধীয় পায়ে ড্রয়িং রুমে যায়।সাদরাজ বসে বসে ফোন দেখছিল। রিতা আস্তে করে গিয়ে তার মুখের সামনে শরবতের গ্লাসটা এগিয়ে দেয়। সাদরাজ গ্লাসটার দিকে চেয়ে বলে,
‘খালা, আমি শরবত বলিনি। পানি…’
পানি বলে উপরে তাকাতেই রিতাকে দেখে সে কপাল কুঁচকায়। রিতা ইতস্তত সুরে বলে,
‘সারাদিনের ক্লান্তির পর পানির চেয়ে এক গ্লাস লেবুর শরবত বেশি কার্যকর।’
সাদরাজ তার কথা শুনে বাঁকা হাসে। শরবতের গ্লাসটা হাতে নেয়। ভালোভাবে গ্লাসের শরবতটা পরখ করে বলে,
‘বিষ টিষ দিয়ে মারার প্ল্যান আছে নাকি?’
মনে মনে রিতা তখন ভাবে, পারলে তো তাই করতাম। তবে মুখে বলে,
‘আপনাকে এখন মেরে আমার কোনো লাভ নেই। বরং আপনি মরলে আমাকেই বিধবা হতে হবে। আর আমার এত তাড়াতাড়ি বিধবা হওয়ারও কোনো ইচ্ছে নেই।’
সাদরাজ তখন হেসে বলল,
‘যাক শুনে ভালো লাগল তাহলে।’
পরে সে শরবতটা খায়। রিতা কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ভীত সুরে বলে,
‘আমার ফোনটা কি আপনার কাছে?’
সাদরাজ তার দিকে চেয়ে বলে,
‘না।’
‘তাহলে কোথায়? আমি আমার ফোনটা পাচ্ছি না। কালতো আপনিই নিয়েছিলেন।’
‘তো? আমি নিয়েছিলাম তো কী হয়েছে? ফোন লাগবে তোমার এখন? কেন, যাতে তোমার বন্ধু আর বন্ধুর হাজবেন্ডকে তোমার খোঁজ দিতে পারো; আর সবাইকে বলতে পারো যে আমি তোমাকে ভয় দেখিয়ে বিয়ে করেছি। এই জন্যই ফোন লাগবে তোমার, তাই না?’
রিতা মাথা নুইয়ে বলল,
‘না, মা’র সাথে কথা বলব।’
‘প্রয়োজন নেই। যতদিন না আমি চাইব তুমি কারো সাথে কোনো যোগাযোগ করতে পারবে না। কথাটা মাথায় রেখো।’
এই বলে সাদরাজ সেখান থেকে উঠে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ায়। সে চলে যাওয়ার খালা সেই রুমে আসেন। রিতার চোখে তখন জল টলমল করছে। সে খালাকে দেখে বলে,
‘দেখেছো খালা, উনার সাথে ভালো ব্যবহার করে কোনো লাভ আছে? উনার কাছে কারোর দুঃখ কষ্টের কোনো মূল্য নেই। উনার মতো একটা পাষাণ মনের মানুষের সাথে আমি কীভাবে থাকব, বলো?’
‘পাষাণের মনেই ভালোবাসা জাগাইতে হইব। আর আমি জানি আপনি এইডা পারবেন। যান, রুমে যান। সাহেবের কাছে কাছে থাহেন। মিষ্টি মিষ্টি কথা কওয়ার চেষ্টা করেন। যান মা।’
রিতার এইসব একদমই ভালো লাগছে না। সে বড়ো করে নিশ্বাস ফেলে উপরে সাদরাজের রুমের দিকে গেল।
গিয়ে দেখে সাদরাজ রুমে নেই। ওয়াশরুমে গিয়েছে হয়তো ফ্রেশ হতে। রিতা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছে কী করবে। তখনই সে খেয়াল করে সাদরাজের ফোনটা বিছানার উপর। সে দ্রুত গিয়ে ফোনটা হাতে নেয়। লক করা। এই লক রিতা জীবনেও খুলতে পারবে না। তাই সেই ডিরেক্ট ইমারজেন্সি নাম্বার ডায়েলের চেষ্টা করে। পরে আবার ভাবে সাদরাজের ফোন দিয়ে সে মেহুলকে কল দিলে সে সহজেই বুঝে ফেলবে। কিন্তু হাতটাও ইশপিশ করছে একটা কল দেওয়ার জন্য। কিন্তু নিজেকে অনেক বুঝিয়ে সে আবার ফোনটা জায়গায় রেখে দেয়। বিরক্ত হয়ে বিছানার একপাশে গিয়ে বসে।
সাদরাজ ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে রিতাকে দেখে। রিতা তাকে দেখেই দাঁড়িয়ে বলল,
‘কিছু লাগবে আপনার?’
সাদরাজ জবাব না দিয়ে বারান্দায় চলে যায়। সেখানে দাঁড়িয়ে ভেজা চুল মুছতে আরম্ভ করে। রিতাও তার পেছনে এসে দাঁড়ায়। সাদরাজ তখন পেছনে না ফিরেই ফিচেল স্বরে বলে,
‘কী ব্যাপার, তুমি আমার পেছন পেছন ঘুরছো কেন? মতলব কী তোমার?’
রিতা হাসার চেষ্টা করে বলে,
‘আমার আবার কী মতলব থাকবে? আচ্ছা, আপনি দুপুরে কী খাবেন বলুন। আমি নিজ হাতে আপনার জন্য বানিয়ে দিব।’
সাদরাজ তখন পেছন ফিরে রিতার দিকে তাকায়। রিতার মুখে এখনো মেকি হাসি। সাদরাজ তার দিকে দু’কদম এগিয়ে যায়। তার এগিয়ে আসা দেখে রিতা ভয় পেয়ে যায়। সে ঢোক গিলে। বলে,
‘না, আমি আসলে খুব ভালো রান্না করতে পারি আরকি। তাই বলছিলাম, কী খাবেন বলুন; আমি বানিয়ে দিব।’
সে কথাটা শেষ করতেই হুট করে সাদরাজ তাকে একটানে নিজের কাছে নিয়ে আসে। রিতার বুকে যেন তখন মোচড় দিয়ে উঠল। সাদরাজ তার কোমরে হাত রেখে তাকে নিজের শরীরের সাথে মিশিয়ে বলল,
‘আমার শত্রুদের আমি সহজে বিশ্বাস করি না। তাই এসব অভিনয় আমার সামনে অন্তত করবে না।’
রিতা ভয়ে ভয়ে মাথা উঁচু করে তাকায়। সাদরাজ চোখ মুখ শক্ত করে তার দিকে চেয়ে আছে। রিতা ভীত সুরে বলে,
‘আপনি আমায় কোনো ভালো উদ্দেশ্যে বিয়ে করেননি, সেটা আমি জানি। কিন্তু, আমি বিয়ে নামক পবিত্র সম্পর্কটাকে বিশ্বাস করি, সম্মান করি। আর সেই সম্মানের খাতিরেই আমি নিজেকে স্বাভাবিক রাখছি। আপনার সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে চাইছি। নাহলে, আপনার মতো একটা মানুষকে কোন মেয়েই বা তার স্বামী হিসেবে মেনে নিত?’
কথাটা বলতেই রিতার গাল বেয়ে টুপ করে উষ্ণ জল গড়িয়ি পড়ে। কিন্তু, তার এই কথায় সাদরাজ আরো রেগে যায়। সে রাগে রিতার কোমরে প্রচন্ড চাপ দিয়ে বলে,
‘তোমাকে আমার সাথে মানিয়ে নিতে হবে না। আমি তোমাকে যে কারণে বিয়ে করেছি সেটা পরিপূর্ণ হয়ে গেলেই তোমাকে আমি তোমার জায়গায় রেখে আসব। এইসব বিয়ে টিয়ের আমার কাছে কোনো মূল্য নেই, বুঝতে পেরেছ?’
এই বলেই সে ধাক্কা দিয়ে রিতাকে সরিয়ে দেয়। রিতা মুখ চেপে কাঁদতে আরম্ভ করে। সে কোনদিনই এই মানুষটার মন গলাতে পারবে না। যার মধ্যে মন বলেই কিছু নেই সে মানুষের পেছনে অনুভূতি ব্যয় করাটাই বেকার। তার চেয়ে ভালো সে এখান থেকে পালিয়ে যাবে। যেভাবেই সম্ভব সে পালাবেই।
চলবে….