শেষটা_সুন্দর #জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা ৪৬।

0
694

#শেষটা_সুন্দর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৪৬।

এক সপ্তাহ চলে গেল। রাবীর আজকাল ভীষণ ব্যস্ত। সামনে আবার তাদের ইলেকশন। মেহুল আবার তার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে গিয়েছে। কাল থেকে সে ভার্সিটিতে যাচ্ছে। তবে সবকিছু ঠিক থাকলেও স্বাভাবিক নেই কেবল রিতার জীবন। সে এখনো সাদরাজের বাড়ি থেকে বের হতে পারেনি। গত পাঁচদিন যাবত সাদরাজ বাসায়ও আসছে না। এই সুযোগে সে অনেকবার চেয়েছিল, একাবার বেরুবে। মা বাবার সাথে দেখা করে আসবে। কিন্তু, সাদরাজের বাড়ির কাজের লোক আর দারোয়ানরা তাকে বের হতে দেয়নি।

__________

মেহুল আজ ক্লাস শেষ করে তার ড্রাইভারকে বলল,

‘আমি এখন বাসায় যাব না। অন্য একটা জায়গায় যাব। নিয়ে যেতে পারবেন?’

ড্রাইভার জিজ্ঞেস করল,

‘কোথায় যাবেন?’

‘বলছি। তবে আপনাকে ওয়াদা দিতে হবে যে, আমি কোথায় যাচ্ছি সেটা আপনি এখন রাবীরকে বলতে পারবেন না।’

ড্রাইভার এবার চিন্তায় পড়ে গেল। বলল,

‘কিন্তু ম্যাডাম, স্যারকে না জানিয়ে আমি কিছু করলে, স্যার রেগে যাবেন।’

‘কিচ্ছু হবে না। আমি সামলে নিব সবকিছু। আপনি শুধু প্লিজ কাউকে কিছু বলবেন না। পরে সময় মতো আমিই সবাইকে সবকিছু বলব।’

ড্রাইভার অনিচ্ছা সত্ত্বেও বলল,

‘আচ্ছা। কোথায় যাবেন?’

‘রাজাপাড়া রোড হয়ে ডানে একটা গলি আছে। সেই গলির ভেতরে বারো নাম্বার রাস্তায় একজনের বাসা। আমি সেখানেই যাব।’

‘আচ্ছা, ঠিক আছে। আমি নিয়ে যাচ্ছি।’

__________

মেহুলের কথা মতো ড্রাইভার সেদিকেই গেল। তবে অনেকটা সময় লাগল তাদের সেখানে পৌঁছাতে। মেহুল বাসার আরো আগেই গাড়ি সাইড করতে বলে, সে গাড়ি থেকে নেমে পড়ে। ড্রাইভারকে বলে,

‘আপনি এখানেই অপেক্ষা করুন। আমি আসছি।’

‘ম্যাডাম, আমাকে সাথে নিন। পরে কোনো বিপদ হলে..’

‘আরে, কিছু হবে না। আপনি এখানেই বসে অপেক্ষা করুন, আমার বেশি সময় লাগবে না।’

মেহুল দ্রুত এগিয়ে যায়। একটু এগিয়েই মুখে একটা মাস্ক পড়ে নেয়। পরে সে হাঁটতে হাঁটতে একটা বাসার সামনে যায়। গিয়ে দাঁড়ায় সে। বিশাল বড়ো বাড়ি দেখে সে বুঝতে পারে, ঠিক জায়গায় এসেছে। এবার সে মাথায় একটা ঘোমটা দেয়। গেইটের কাছে এগিয়ে গিয়ে দারোয়ানকে জিজ্ঞেস করে,

‘এটা কি সাদরাজ স্যারের বাসা?’

দারোয়ান তার আপাদমস্তক পরখ করে ভ্রু কুঁচকে বলে,

‘জি। কিন্তু, আপনি কে?’

‘আসলে, আমি স্যারের একজন নতুন সহকারী। স্যার আমাকে বাসায় আসতে বলেছিলেন। উনার ওয়াইফের জন্য। স্যার কি বাসায় আছেন?’

‘না, স্যার পাঁচদিন যাবত এই বাসায় আসেন না। ‘

‘ওহহ, আমাকে তো কল দিয়ে আজকেই আসতে বললেন। উনার ওয়াইফের দেখভালের জন্য। ম্যাডাম আছেন বাসায়?’

‘জি।’

‘তাহলে ম্যাডামের সাথেই গিয়ে কথা বলি।’

এই বলে মেহুল ভেতরে ঢুকতেই দারোয়ান তাকে আবার পেছন থেকে ডেকে উঠে,

‘দাঁড়ান।’

মেহুল তপ্ত শ্বাস ফেলে পেছনে চেয়ে বলে,

‘কী?’

‘আপনাকে স্যার বলেছেন আসতে?’

‘জি। স্যার’ই তো বলেছেন, আজকে সকালেই।’

‘ঠিক আছে দাঁড়ান, আমি স্যারের সাথে কথা বলে জিজ্ঞেস করে নিই।’

মেহুল ভয় পায়। সাদরাজকে কল করলে তো সে ধরা পড়ে যাবে। সে ভয়ে ভয়ে ভাবতে থাকে এবার কী করবে। তখনই সে উপরের বারান্দায় রিতাকে দেখে। তাকে দেখেই সে ইশারা দেয়। রিতা প্রথমে তাকে চিনতে পারে না। পরে মেহুল একটু মাস্ক নামাতেই রিতা চমকে যায়। দৌড়ে নিচে নেমে আসে। সে মেহুলের কাছে আসতেই মেহুল বড়ো করে সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করে,

‘কেমন আছেন, ম্যাডাম? আমাকে আসলে স্যার পাঠিয়েছেন, আপনার দেখভালের জন্য। আপনাকে নিশ্চয়ই স্যার বলে গিয়েছেন।’

রিতা বুঝতে পারল ব্যাপারটা। সে হেসে বলল,

‘হ্যাঁ হ্যাঁ, সাদরাজ আমাকে বলেছিল। আপনিই সেই, তাই না?’

‘জি, ম্যাডাম।’

‘তাহলে বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? ভেতরে চলুন।’

‘কী করো যাব, ম্যাডাম? আপনার দারোয়ান তো দিচ্ছেন না।’

রিতা চোখে মুখে মেকি রাগ ফুটিয়ে তুলে বলল,

‘কী দিচ্ছে না? এই যে, আপনি উনাকে ভেতরে আসতে দিচ্ছেন না কেন? আপনার নামে সাদরাজের কাছে কমপ্লেন করব?’

দারোয়ান ভয় পেয়ে বলল,

‘না না, ম্যাডাম। আসলে চিনতে পারছিলাম না তো তাই। আপনারা যান যান, ভেতরে যান।’

রিতা মেহুলের দিকে চেয়ে বলল,

‘চলুন।’

দুজনেই তাড়াতাড়ি করে বাসার ভেতরে চলে গেল। তারা ভেতরে ঢুকতেই খালা রান্নাঘর থেকে এসে জিজ্ঞেস করলেন,

‘উনি কেডা, মা?’

‘খালা, আমার বান্ধবী।’

খালা চকিত হয়ে বলেন,

‘রাবীর খানের বউ?’

‘জি, খালা।’

খালা প্রচন্ড ভয় পেয়ে যান। তিনি ভীত সুরে বলেন,

‘উনারে এহানে আনছেন কেন?’

মেহুল বলে,

‘ও আনেনি। আমি নিজে থেকেই এসেছি।’

‘খালা, আপনি বুঝতাছেন না। সাহেব জানতে পারলে কেয়ামত কইরা ফেলব। তার উপর বাইরে সি সি ক্যামেরা আছে। সাহেব ক্যামেরা দিয়া সব দেহে।’

‘সমস্যা নেই, খালা। আমার মুখে মাস্ক আছে।’

‘আহারে, আপনার মুখ না দেখলে কী হইব। সাহেব যদি বুঝে তার বাড়িতে অপরিচিত মানুষ আইছে তাইলেই স্যার দারোয়ানরে ফোন দিব। তহন দারোয়ান সব কইয়া দিব। আপনারা কী বিপদ ডাইকা আনতেছেন কন তো? হেই দিক দিয়া যদি রাবীর খান এসব জানে। তাইলে উনিও রাইগা যাব। খালা, আপনি যান। আপনি এহানে থাকলে বিপদ।’

‘খালা, আমি চলে যাব। শুধু আপনি আমাকে সব সত্যি বলে দিন। তাহলেই আমি এখান থেকে চলে যাব।’

‘কিসের সত্যি?’

‘রাবীর আর সাদরাজের সম্পর্কের মধ্যে এত সমস্যা কীভাবে তৈরি হল? কে উনাদের সম্পর্ক নষ্ট করেছে? কী কী হয়েছিল না হয়েছিল সব বলুন। সব শুনে তবেই আমি এখান থেকে যাব। নয়তো এক পাও নড়ব না।’

রিতাও খালাকে চাপ দিয়ে বলল,

‘হ্যাঁ খালা, আপনি আমাকে একা কিছু বলেননি। এবার মেহুলের সামনেই সবকিছু বলুন। আমাদের সব সত্যি জানতে হবে। আর কিছু লুকাবেন না, প্লিজ।’

‘আইচ্ছা, আপনারা বন। আমি কইতাছি সব।’

মেহুল আর রিতা সোফায় বসে। মেহুল বলে,

‘তাড়াতাড়ি বলুন, খালা। আমার আবার বেরুতে হবে।’

‘জি, কইতাছি। আসলে সাহেব আর রাবীর খানের মাঝে যত শত্রুতা, তা সব তৈরি হইছে সাহেবের বাপের কারণে। মানে আমাদের বড়ো সাহেব। যত নষ্টের মূল উনিই।’

রিতা ভ্রু কুঁচকে বলে,

‘কেন, উনি কী করেছেন?’

‘উনিই আমাদের ম্যাডামরে মারছেন।’

মেহুল আর রিতা দুজনেই চমকে যায়। রিতা বলে উঠে,

‘ম্যাডাম মানে? সাদরাজের মা?’

‘হ, উনারে বড়ো সাহেব মারছে। আর দোষ দিছে সব রাবীর খানের উপর। রাবীর খান এর জন্য জেলও খাটছিল। কিন্তু, উপযুক্ত প্রমানের অভাবে উনারে পরে ছাইড়া দেওয়া হইছে। কিন্তু, সাদরাজ আহমেদ বাপের কথারেই বিশ্বাস করছেন। বাপে যা কইছেন তা। বাপের এই মিছা কথারে বিশ্বাস কইরা উনি উনার এত বছরের বন্ধুরে শত্রু বানাইছেন। রাবীর খান অনেক চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু, উনারে বুঝাইতে পারেন না। পরে উনারও মনে খুব কষ্ট লাগে যে, উনার একটা মাত্র প্রাণপ্রিয় বন্ধু কোনো প্রমান ছাড়াই উনার উপর আঙ্গুল তুলছে। সেই কষ্টে উনিও দূরে সইরা গেছেন। পরে উনি রাজনীতিতে আইয়েন। এইদিকে বড়োসাহেবও তার পোলারে রাজনীতিতে আনে। পরে দুজনের মধ্যে আরো প্যাঁচ লাগাইয়া দেন। আর এই প্যাঁচেই দুজনের সম্পর্কের আজ এই অবস্থা। মূলত এই সবকিছু করছেন আমাদের বড়োসাহেব। উনিই সাদরাজের কানে বিষ ঢালতে ঢালতে উনারে আজ এত খারাপ বানাইছেন। নাইলে আমরার এই সাহেব তো ছিল আমাদের ম্যাডামের মতো, ভালা মানুষ। এই লোকটাই তারে খারাপ বানাইছে।’

মেহুল তখন জিজ্ঞেস করে,

‘কিন্তু, এত কথা আপনি কী করে জানলেন?’

‘আমি এই বাড়িতে আছি আজ থেকে ত্রিশ বছর। এই বাড়ির সব খবর আমি রাখি। এই বাড়ির মানুষগুলারে আমি আমার নিজের মানুষ ভাবি। ম্যাডামরে যে বড়োসাহেব মারছে এইডা সাহেব কাউরে ফোনে কইতাছিল। আমি তহনই শুনছি। আর উনি কেমনে কেমনে রাবীর খানরে ফাঁসাইছে সব আমি শুনছি। আমি সব জানি।’

রিতা বলল,

‘তাহলে, তখন আপনি পুলিশের কাছে কেন কিছু বলেননি?’

‘ওমা গো, পুলিশ! আমি পুলিশের কাছে কইলে হেরা আমারে বাঁচায় রাখতো?’

‘তাই বলে আপনি একজন নিরপরাধকে শাস্তি পেতে দেখলেন?’

খালা হেসে বললেন,

‘নিজের জান সবার প্রিয়। আমি কেন মরতে যামু, কন?’

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here