#বিবর্ণ_বসন্ত
শেষ_পর্ব
~মিহি
অভিশপ্ত দিনগুলো বেরঙিন কাটলো সুমির। অনীলের বাবা মা তাকে পছন্দ করে মাস ছয়েক পর বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করলেন। সুমি নিশ্চুপ দেখে গেল সবটা। আফ্রিন দরকারি কাজে বিদেশে গেছে। তার সাথেও যোগাযোগ করতে পারেনি সে। সব মিলিয়ে সুমির মন বিক্ষিপ্ত। দেখতে দেখতে তিনটে মাস কেটেছে। রাহেলা বানুর শরীর সুস্থ হলেও তিনি এখানেই থাকছেন। সুমি পড়াশোনার চাপে আর সংসারে তেমন নজর রাখতে পারে না। রাহেলা বানুই সব কাজ সামলান। অনামিকা চাইলেও এখন কোনো কাজ করতে পারে না। ডাক্তার বলেছেন রেস্টে থাকতে, তার প্রেগন্যান্সিতে যথেষ্ট কমপ্লিকেশন রয়েছে। সোহরাবের দুশ্চিন্তা ফুরায় না। একদিকে সুমির জন্য দুশ্চিন্তা অন্যদিকে অনামিকার জন্য প্রতিমুহূর্তে ভয় কাজ করে তার মনে।
অনীল সুমিকে ইদানিং প্রতিদিন ফোন দেয়। সুমি কিছুটা বিরক্ত হলেও মাঝে মাঝে অনেকটা ভালোও লাগে। একরকম অভ্যেস হয়ে গেছে তার । আজ কলেজে একটা পরীক্ষা আছে। সুমি তাড়াহুড়োয় বেরিয়ে গেছে তবুও ঠিকমতো পৌঁছাতে পারেনি। ফলাফল যা হওয়ার তাই। পরীক্ষাটা দিতে পারলো না সে। মন খারাপ করে বাড়িতে আসতেই দেখলো অন্তরা বেগম কোথাও বের হচ্ছেন।
-‘কোথাও যাচ্ছেন খালাম্মা?’
-‘হ্যাঁ সুমি। ব্যাংকে একটু কাজ আছে। তুমি একটু অনামিকার খেয়াল রেখো। রাহেলা ভাবীও তো নাই, একটু দেখে রেখো ওকে।’
-‘আচ্ছা খালাম্মা, সাবধানে যাবেন।’
সুমি বুঝতে পারলো না তার ফুফু এ সময় কোথায় যেতে পারে। অনামিকার অসুস্থতার পর থেকে সে উপর তলায় খুব একটা যায় না। সোহরাব আর সে নিচতলার ঘরেই থাকে। সুমির ঘরটাও নিচতলায়। সে ঘরে ঢুকে ফ্রেশ হলো। অনামিকার কিছু লাগবে কিনা জানার জন্য সে অনামিকার ঘরে গেল। গিয়ে দেখলো অনামিকা সেখানে নেই। নিচতলা তন্ন তন্ন করে খুঁজেও অনামিকাকে না পেয়ে সুমির চিন্তা হলো। অনামিকার নম্বরে কল দিল সে। খানিক সময় বাদে কল রিসিভ হলো।
-‘ভাবী কোথায় তুমি?’
-‘আমি তো ছাদে এসেছি। নিচে একা ভালো লাগছিল না!’
-‘তুমি পাগল ভাবী? একা একা ছাদে উঠছো কেন? আমি আসছি দাঁড়াও।’
-‘আরে একা উঠিনি। ফুফুর সাথে এসেছিলাম, উনি কী একটা কাজে গেলেন। আমার এখানেই ভালো লাগছিল। তাই আর নামিনি।’
-‘তুমি ওখানেই দাঁড়াও। আমি আসছি।’
-‘তোমার আসা লাগবে না। তুমি গোসল করে নাও। আমি একটু এখানে থাকবো। যখন যেতে ইচ্ছে হবে তখন তোমাকে কল দিবনি।’
সুমি ‘আচ্ছা’ বলে কল রেখে দিল। ঘরে ঢুকে গোসল সারতেই সুমির ফোনের মেসেজ টোন বেজে উঠলো। ফোন হাতে নিল সুমি। ইমাদ টেক্সট করেছে মেসেঞ্জারে। অনেকগুলো ছবি পাঠিয়েছে সে। সুমি এক এক করে ছবিগুলো দেখতে লাগলো। ইমাদ বিয়ে করেছে। বিয়ের ছবিগুলোই সুমিকে পাঠিয়েছে সে। নিচে একটা টেক্সট,
‘চরিত্রহীনের মতো অন্যের প্রেমিকের দিকে নজর দেওয়া ছাড়ো!’
সুমি বুঝতে পারলো টেক্সটটা ইমাদের প্রেমিকা করেছে। এক মুহূর্তের জন্য সুমির মনে হলো সে কি আসলেই চরিত্রহীন? কেন এভাবে অকারণে অপমানিত হচ্ছে সে? কী দোষ করেছিল সে? নাহয় একটু ভালোই বেসেছিল তাও তো সেটা একটা মোহ ছিল বুঝতে পেরে সরেও এসেছিল। দীর্ঘশ্বাস ফেলল সুমি। না চাইতেও একটা অস্বাভাবিক রক্তক্ষরণ শুরু হয়েছে মনের মধ্যে। নিস্তব্ধ হয়ে উঠলো সবকিছু। ঝড়ের পূর্বাভাস?
আরেকটা ফোন আসলো সুমির নম্বরে। নম্বরটা অনীলের মায়ের। সুমি রিসিভ করলো।
-‘আসসালামু আলাইকুম আন্টি।’
-‘তোমার মানসিক সমস্যা আছে?’
হঠাৎ এহেন প্রশ্নে বিব্রতবোধ করলো সুমি। এ কেমন প্রশ্ন?
-‘মানে?’
-‘যা বলছি তার উত্তর দাও। তোমার মানসিক সমস্যা আছে?’
-‘ছিল কিছুটা। এখন আমি সুস্থ।’
-‘পাগল কী আর বলবে সে অসুস্থ?’
-‘আন্টি আপনি ভুল বুঝছেন!’
-‘চুপ! তোমার আরেকটা ছেলের সাথে সম্পর্কও ছিল। সব জানতে পেরেছি আমি। এ বিয়ে হচ্ছে না। তোমার ভাইয়ের সাথে আমি কথা বলবো। চরিত্রহীন মেয়ে কোথাকার!’
খট করে কলটা কেটে দিলেন তিনি। সুমি অসহায়ের মতো মেঝেতে পড়ে রইলো। মাথাটা সম্পূর্ণ ফাঁকা হয়ে আসলো তার। অনীল ইতিমধ্যে তার অভ্যেসে পরিণত হয়েছে। খুব কাছে পাওয়ার পর হারিয়ে ফেলাটাও বোধহয় সুমির অভ্যেস হয়ে উঠেছে। কানের কাছে তীব্র শব্দে বারবার বাজছে ‘চরিত্রহীন তুমি!’। সুমি একটা ভয়ঙ্কর সিদ্ধান্ত নিল। এ ভয়ঙ্কর সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সে কোনোকিছুর বিচার করলো না। অনামিকার কথাও সে বেমালুম ভুলে গেল।
ওষুধের বক্সে হাই পাওয়ারের কয়েক পাতা ঘুমের ওষুধ ছিল। রাহেলা বানুর অসুস্থতার জন্য কেনা হয়েছিল। সুমি এক পাতা ট্যাবলেট থেকে বেশ কয়েকটা প্রতিবেদন খেয়ে ফেললো। আত্মহত্যার চিন্তা করলে নাকি মানুষকে শয়তান ধরে। মৃত্যুর আগ অবধি সে শয়তানই মানুষকে আত্মহত্যার দিকে পুরোপুরি ঝুঁকিয়ে ফেলে। সুমি ঘরে এসে দরজা বন্ধ করে দিল। চোখ বেয়ে অশ্রু গড়াচ্ছে ক্রমশ। না চাইতেও সব হারিয়ে ফেলার যন্ত্রণাটা স্পষ্ট অনুভব করতে পারছে।
সুমি ফোন রিসিভ না করাতে অনামিকার দুশ্চিন্তা হয়। তাড়াহুড়োয় নামতে নেয় সে। পাঁচটা সিঁড়ি পেরোতেই পা পিছলে নিচে পড়ে সে। ব্যথায় আর্তনাদ করে উঠে। কিছুক্ষণের মাঝে মেঝে রক্তে ভেসে যায়। অনামিকা চিৎকার করে কাঁদতে থাকে। আর্তনাদে গলা বসে আসে তার।
চোখ মেলতে পারছে না সুমি। ক্ষীণ স্বরে অনামিকার আর্তনাদটা কানে এসেছে তার। তড়িঘড়ি করে ওঠার চেষ্টা করতেই তাল সামলাতে না পেরে পড়ে গিয়ে বিছানার সাথে ধাক্কা গেল। মাথা ফেটে রক্ত বের হলো তবুও সুমি নিজের উপর জোর খাটিয়ে উঠে দাঁড়ালো। টালমাটাল পায়ে বাইরে আসতেই দেখল রক্তে ভেজা মেঝেতে অনামিকা পড়ে থেকে আর্তনাদ করছে। সুমির এক মুহূর্তের জন্য মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিল। দ্রুত পায়ে সে বাইরে গিয়ে সাহায্য চাইলো। চোখ খুলে রাখার প্রচণ্ড প্রয়াস করেও সে পড়ে যাচ্ছে বারবার। সুমির চেঁচামেচিতে আশেপাশের সবাই এসে অনামিকাকে ধরে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করলো। সুমি কখন জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে তা কেউ খেয়াল করেনি। হাসপাতালে পৌঁছানোর পর সবাই তাকে দেখল ব্যাকসিটে ফেলান দিয়ে পড়ে থাকতে। সুমিকেও এডমিট করা হলো অতিদ্রুত।
ঘণ্টা দেড়েকের মধ্যে সোহরাব ছুটে এলো। অনামিকা তখন ওটিতে। সুমির পেট থেকে ওষুধ ওয়াশ করা হচ্ছে। সব মিলিয়ে সোহরাবের নিজেকে পাগল পাগল মনে হচ্ছে। অন্তরা বেগম এককোণে বসে আছেন। তার মুখে শব্দ নেই। সুমির কেবিন থেকে একজন ডাক্তার বেরোলেন। সোহরাব তার কাছে গেল।
-‘দেখুন সোহরাব, সুমির অবস্থা খুব ক্রিটিক্যাল। ওর এখনো জ্ঞান ফেলেনি, ওষুধ আমরা বের করেছি। এখন ওর জ্ঞান ফিরলে সব বলতে পারবো।’
-‘ডাক্তার আমার ওয়াইফ?’
-‘ওনার সন্তানকে বাঁচানো যায়নি। অতিরিক্ত ব্লিডিংয়ের জন্য মিসক্যারেজ হয়ে গেছে। ওনার অবস্থাও ভালো না। ব্লাড ডোনার পাওয়া গেছে তবুও কিছু বলা যাচ্ছে না। ওনাকে যে ডাক্তার দেখছেন তিনি যথেষ্ট অভিজ্ঞ। ধৈর্য ধরুন।’
সোহরাব বসে পড়লো। পৃথিবী হঠাৎ থমকে গেছে তার। ফোন বাজছে।সোহরাবের ধরার ইচ্ছে নেই তবুও ফোনটা রিসিভ করলো। রাহেলা বানু ফোন করেছেন।
-‘কেমন আছিস সোহরাব?’
-‘ফুফু, অনামিকা আর …’
-‘আমি জানি তো। আমিই তো করেছি। তোর বউ একটু বুঝুক সন্তান দূরে চলে গেলে কেমন লাগে।’
-‘ফুফু!’
-‘হ্যাঁ আমি। সিঁড়িতে তেল আমিই ফেলেছিলাম। সুমির বিয়েও আমি ভেঙেছি। এখন আমি চলে যাচ্ছি দেশ ছেড়ে। আর আধ ঘণ্টা পর আমার ফ্লাইট।’
-‘এত জঘন্য কাজ কিভাবে করতে পারলে ফুফু? সুমি তো তোমার কত খেয়াল রেখেছিল! অনামিকা আর আমার সন্তান কী দোষ করেছিল?’
-‘তোর বউয়ের জন্য আমার মেয়ে আমাকে ছেড়ে চলে গেছে।তার শাস্তি দিলাম। ভালো থাক।’
খট করে কল কেটে নম্বর বন্ধ করে দিলেন রাহেলা বানু। একটু পরেই তার ফ্লাইট। বাড়িটা বিক্রি করে এখন এই টাকায় একজন এজেন্টের সাহায্যে বিদেশে গিয়ে আরামে থাকবেন। ভাবতেই তার মন পুলকিত হয়ে উঠছে। লোভ, প্রতিহিংসা মানুষকে অন্ধ করে ফেলে, তার নিকৃষ্ট উদাহরণ রাহেলা বানু।
পরিশিষ্টঃ এজেন্টের নাম করে একদল নারী পাচারকারী রাহেলা বানুকে কোনো এক দেশে বিক্রি করে দিয়েছে। পুলিশ সেই পাচারকারীকে ধরলেও পাচারকৃতদের খোঁজ পাননি। এর মধ্যে অনেকের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ অবৈধভাবে পাচার করা হয়েছে। পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সোহরাবের কাছে এসছিল। সোহরাব একবাক্যে বলেছে রাহেলা বানুর সাথে তার কোনো সম্পর্ক অবশিষ্ট নেই। পাপের ঘরা পূর্ণ হলে আল্লাহ বিচার নিজ হাতেই করেন। রাহেলা বানুর লোভ তাকে ধ্বংস করেছে। এ দায় তার নিজের। কোনো এক অপরিচিত দেশে কঠোর পরিশ্রম করেও অপমানিত, লাঞ্ছিত হতে হতে একসময় তার মনে পড়বে নিজের পাপের কথা। অনুতপ্ত হবেন কী? মানুষ হলে বোধহয় হবেন, অমানুষ হলে?
সন্তান হারানোর কথা শোনার পর থেকে অনামিকা একটা শব্দও উচ্চারণ করছে না। সে একেবারে বোবা হয়ে গেছে। অনামিকার এ অবস্থার জন্য সুমি কিছুটা হলেও নিজেকে দায়ী করে। সে দায়ে অনামিকার মুখোমুখি হয়নি সে। সপ্তাহ ঘুরলেও অনামিকার মন ঘোরেনি। সে কিছুতেই স্বাভাবিক হতে পারেনি। এর মধ্যে অনীল বেশ কয়েকবার এসেছিল সুমির সাথে দেখা করতে। বাবা মায়ের বিরুদ্ধে হলেও সে সুমিকে বিয়ে করতে চায়। সুমি রাজি হতে পারেনি। একজন সন্তানকে তার বাবা মা থেকে আলাদা করার যন্ত্রণা নিজ চোখে দেখেও সে আর এ পাপে পা বাড়াতে পারেনি। অপেক্ষমান প্রেমিকের মতো এখনো অনীল দাঁড়িয়ে সুমির বাড়ির চৌকাঠে।
সোহরাব আর অনামিকার সম্পর্ক এখন হিমশীতল। দুজনের মাঝে নীরবতা। এক অন্ধকার রাত্রিতে অনামিকার কান্নায় ঘুম ভাঙে সোহরাবের। সাহস করে অনামিকাকে বুকে জড়িয়ে নিতেই অনামিকার কান্নার মাত্রা বাড়ে। বিড়বিড় করে সে আওড়ায়,’আমাদের বসন্তটা কেন বিবর্ণ হলো বলতে পারেন সোহরাব?’ সোহরাব কিছু বলতে পারে না। এ প্রশ্নের জবাব তার কাছে নেই।
সমাপ্ত
[গল্প সম্পর্কে ভালো লাগা, খারাপ লাগা সবকিছু শেয়ার করতে পারেন। ধন্যবাদ সবাইকে🖤]