#বিবর্ণ_বসন্ত
২৩তম_পর্ব
~মিহি
‘সুমির বিয়েটা দিয়ে দিতে আপনার কী সমস্যা সোহরাব?’ খানিকটা উচ্চস্বরেই বললো অনামিকা। ভাইয়ের সাথে কথা বলতে তখনি কেডল দরজার কাছে এসেছে সুমি। ভাবীর উচ্চস্বরে বলা কথাটুকু তার কানে এলো। নিঃশব্দে প্রস্থান করলো সে। এতটাই বোঝা হতে শুরু করেছে সে পরিবারে? ইমাদের পাগলামি নাহয় কমেছে তার কিন্তু একটু সময় তো দরকার নিজেকে সামলাতে। অনামিকা সব জেনেবুঝে কিভাবে পারলো এমন করতে? সুমির রাগ হচ্ছে না, নিজেকে বড্ড অসহায় মনে হচ্ছে। মায়ের অভাবটা খুব করে অনুভব করছে সে। মানসিক যন্ত্রণাগুলোও মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। একবার ডাক্তার আফ্রিনের সাথে কথা বললে ভালো হতো। সুমি এখনো জানেনা আফ্রিন ইমাদের বোন নয়। আফ্রিনের নম্বর তার কাছে নেই। নিতে হলে ইমাদের শরণাপন্ন হতে হবে। সুমির এখন কিছু ভাবতে ইচ্ছে করছে না। সপ্তাহ দুয়েক আগে ইমাদের বলা কথাগুলোর পর সুমি আর যোগাযোগ করেনি তার সাথে কিন্তু এখন মনটা আবার বিক্ষিপ্ত হচ্ছে দিনকে দিন। আফ্রিনের সাথে কথা না বলা অবধি এ অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে না। ক্লান্ত শ্রান্ত সুমি জানালার কাছে হেলান দিয়ে দাঁড়ায়। আনমনে বিড়বিড় করে,’এতটাই বুঝি বোঝা হয়ে পড়েছিলাম? যে ভাবীকে সবসময় সম্মান, শ্রদ্ধা করে বড়বোনের আসনে বসিয়েছি, সেই ভাবীই আমাকে সহ্য করতে পারে না। নিয়তি নিষ্ঠুর-নির্মম হয় জানতাম তাই বলে এতটা? আমার আগের পাপগুলোর শাস্তি বুঝি সুদসমেত এখন ফেরত পাচ্ছি? হতেও পারে। চারিদিকে ঝড় যখন একসাথে উঠেছে তখন বোধহয় পাপেরই ফল এটা।’
____________________
সোহরাব চুপ করে আছে। অনামিকাও বেশ অনেকক্ষণ ধরে চুপচাপ। সুমির জন্য একটা ডাক্তারের সম্বন্ধ এসেছে। অনামিকা চাচ্ছে বিয়েটা ঠিক করতে, সুমি একটা ভালো পরিবারে যাবে এটাই তার ইচ্ছা। সোহরাব ইমাদের কথা বলতে পারছে না। অনামিকা সুমির মতামত নিতে চাচ্ছে কিন্তু সোহরাব জানে সুমি রাজি হবে না। এতে যদি সুমির আবার মন খারাপ হয় এ ভয়ে সোহরাব তাকে অনামিকার সাথে কথা বলাতেই চায় না। অনামিকার খানিকটা রাগ লাগছে। সুমির বিয়ে তো সে একা দিয়ে দিচ্ছে না, সে শুধু সুমির মতামত জানতে চায়। সোহরাব বড় ভাই হিসেবে মতামত দিতেই পারে তবে সুমির মতামতটাই তো মুখ্য।
-‘সোহরাব, ছেলেটা ডাক্তার এটা বড় কথা নয়। কিন্তু ও প্রথম দেখাতেই সুমিকে পছন্দ করে ফেলেছে, অনেক পাগলামি করে ঠিকানা জোগাড় করেছে। আমাদের কি একবার উচিত না বিষয়টা নিয়ে ভাবা?’
-‘ঘুমোও অনামিকা। কাল কথা বলবো এসব নিয়ে।’
-‘আপনার সময় কখন আসলে? আমাকে সময় দেওয়ার সময়টুকুও তো নেই! অফিসে থাকলেই পারেন, আপনার নতুন কলিগ তো ভালোই খেয়াল রাখে।’
-‘কার কথা বলছো?’
-‘তানি।’
-‘ওহ!’
-‘এখনি ব্লক করেন। কলিগ মানে যা তা পোস্টে মেনশন দেওয়ার অধিকার আছে নাকি? আমি সিওর এই মেয়ে আপনাকে লাইন মারার চক্করে আছে।’
-‘কোথাকার কথা কোথায় নিয়ে যাও তুমি!’
-‘অনীলের পরিবারকে সামনের শুক্রবার আসতে বলি? আপনি ওদের সাথে কথা বলে নিয়েন। আমি সুমির সাথে কথা বলে দেখবো।’
-‘ধ্যাত! অনামিকা সবসময় বেশি বোঝো কেন? সুমির বিয়ে দেওয়ার জন্য মরে যাচ্ছো? ধৈর্য ধরো একটু। সবে মাকে হারিয়েছি। সুমি কি অত সহজে মানবে? ও তো চায় এই বাড়িটাতে থেকে একটা কিছু করতে। ওর ইচ্ছের দাম নাই?’
অনামিকা চুপ হয়ে গেল। সুমির ভালো করতে গিয়ে আসলে সে সুমির স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করছে। আসলেই তো সুমির সাথে কথা না বলেই এত তাড়াহুড়ো করা উচিত না কিন্তু সোহরাব সুমির সাথে কথা বলতে চাইছে না কেন? সোহরাব কি কিছু লুকোচ্ছে অনামিকার থেকে? সোহরাব বোধহয় অনামিকার সন্দেহ ধরতে পারলো।
-‘আমি কাল সুমির সাথে কথা বলবো। তুমি এর আগে কিছু বোলো না কাউকে।’
-‘বেশ।’
অনামিকার সংকোচ খানিকটা দূর হয়। নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ে সে। অন্যদিকে সোহরাবও ঠিক করে সুমির সাথে কথা বলতে হবে। ইমাদের সাথে সুমির সম্পর্কের গভীরতা এখন জানাটা আবশ্যক হয়ে পড়েছে। ঘুম আসেনা তার চোখে।
________________________
আজ শুক্রবার। সুমি নয়টার দিকে ইমাদের নম্বরে কল দেয় আফ্রিনের সাথে কথা বলার জন্য। ইমাদ সুমির নম্বর দেখে বিরক্ত হয়। সে এসেছে তার প্রেমিকার সাথে দেখা করতে অথচ সেখানেও এই মেয়েটা কল করে বিরক্ত করছে। ইমাদ ঠিক করলো আজ কড়া কিছু কথা শোনাতেই হবে। ইমাদের প্রেমিকাও জানে সুমির কথা। সে জানে সুমি ইমাদকে বিরক্ত করে সবসময়। ইমাদ ফোন রিসিভ করে সুমিকে কিছু বলার সুযোগই দিল না,’তোমার মধ্যে ন্যূনতম লজ্জা নাই? আরে ভাই তুমি তো সুস্থ হইছো, আর কত? আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল তোমারে পড়াইতে যাওয়া। আমার প্রেমিকা আছে জানার পরও ছ্যাঁচড়ার মতো পেছনে পড়ে আছো কেন? শরম লেহাজ কি এক ফোঁটাও নাই?’
সুমির চোখ বেয়ে গড়ালো নোনা জল। এই মানুষটাই কি তার অসুস্থ সময়ে জীবনের মানে বুঝিয়েছিল? এত রঙ কেন মানুষের? এর চেয়ে তো আল্লাহ সাদা কালো মানুষ বানালেই পারতো! সুমির গলায় কথা আটকে আসে। সাহস করে শব্দগুলো বের করতে পারে না সে। এরই মধ্যে আরেকটা রুক্ষ মেয়েলি গলার কর্কশ কণ্ঠ তার কর্ণকুহরে প্রবেশ করে,’এই মেয়ে! আর কত নিচে নামবে হ্যাঁ? কেন কল দিছো ইমাদরে?’
-‘আফ..আফ্রিন মানে ওনার বড় আপুর নম্বরটা লা..লাগ…’
-‘ঢঙ করো আমার সাথে? বাহানা খোঁজো না? ওর কোনো বড় আপুই নাই! মিথ্যেবাদী কোথাকার! কল রাখ থার্ড ক্লাস একটা।’
সুমি কল কেটে দিল। চোখের কোণা এখনো সিক্ত। একটা মানুষ কতটা বহুরূপী হতে পারে আজ জানা হলো সুমির। স্বাভাবিক হওয়ার পর থেকে সুমি কোনোদিন ভালোবাসার দাবি নিয়ে ইমাদের সামনে দাঁড়ায়নি, বন্ধু হিসেবে থাকতে চেয়েছিল। প্রতিদানস্বরূপ আজ ভালো বাক্যই শুনতে পেল। সুমির মাথা চিনচিন করছে। আফ্রিন যদি ইমাদের বোন না হয় তবে কে? এখানেও মিথ্যে? এই মিথ্যের শুরুটা কোথায়? সুমি ঠিক করলো ডাক্তার আফ্রিনের সাথে চেম্বারে গিয়ে দেখা করে আসবে। একবার গল্পে গল্পে চেম্বারের ঠিকানা জেনেছিল সে। বাথরুমে গিয়ে হাতমুখ ধুয়ে বেরোতেই সোহরাবের মুখোমুখি হয় সুমি। সোহরাবের মুখ গম্ভীর। এ গম্ভীর মুখে কতখানি রহস্য লুকিয়ে আছে তা সুমির ব্যতিব্যস্ত মাথায় ঢোকে না। সে ম্লান দৃষ্টিতে কেবল ভাইয়ের কথার অপেক্ষা করতে থাকে।
-‘কিছু বলবে ভাইয়া?’
-‘হ্যাঁ বলতাম আর কী…’
সোহরাবের সংকোচ অনুধাবন করে সুমির গতরাতের ঘটনা মনে পড়ে। অনামিকা সুমির বিয়ে দেওয়ার জন্য সোহরাবের সাথে চেঁচামেচি করছিল। বোধহয় সে কারণেই সোহরাব কথা বলতে এসেছে।
-‘সুমি, আমি ভাবছিলাম তোর বিয়ে নিয়ে। তোর পছন্দটা বল তুই। তোর পছন্দের মানুষের সাথেই….’
-‘ইমাদকে আমি পছন্দ করিনা ভাইয়া আর। তোমরা যার সাথে বিয়ে ঠিক করবে আমি তাকেই বিয়ে করবো কিন্তু এখন না। ভাবীর শরীর ভালো নেই এখন, ফুফুও অসুস্থ। সবকিছু আগের মতো ঠিক হোক, তারপর নাহয় বিয়ের কথা ভেবো।’
-‘একটা ছেলে তোকে পছন্দ করেছে। তুই কি দেখা করবি একবার?’
-‘তোমার অনুমতি থাকলে আমার আপত্তি নেই।’
খানিকটা নির্লিপ্ত স্বরে কথাটা বললো সুমি। জীবন নিয়ে তার আর কোনো ইচ্ছে অনিচ্ছে নেই। মানুষ বলে, জীবনে অতৃপ্তি থাকলেই নাকি বেঁচে থাকার ইচ্ছে বহাল থাকে কিন্তু সর্বক্ষেত্রে অপূর্ণতা, অপ্রাপ্তি যে মানুষের বাঁচার ইচ্ছে তিলে তিলে শেষ করে দেয় সে কথা মানুষ কেন বলে না? সুমির মাথায় প্রশ্নরা ঘুরপাক খেতে থাকে। ডাক্তার আফ্রিনের সাথে দেখা করার প্রয়োজনীয়তা তার জন্য আবশ্যক হয়ে পড়ে।
চলবে…
[গল্প শেষের পথে, আপনারা আপনাদের মতামত জানাবেন অবশ্যই।]