#বৃষ্টিভেজা_আলাপন (৪০)
সেদিনের পর তিনদিন বৃষ্টি হয়েছে। তবে উষশী’র সাথে দেখা হলো না। অভিরাজের ভেতরের অবস্থা খুব করে অনুভব করছিল লাবণ্য। সেই জন্যেই মেয়েটির খোঁজে বের হয়েছে। বেশি দূরে নয় উষশী’র বাসাটা। সেখানকার খোঁজ পেতে খুব সময় লাগল না ওর। উষশী গার্ডেনেই ছিল। খুব সহজেই ভেতরে প্রবেশ করল লাবণ্য। সেদিনের মতো অহংকার দেখা গেল না যুবতীর মাঝে। এ যে সেই কিশোরী। তবে লজ্জিতবোধটুকুও নেই। আগের মতোই জেদি আর একরোখা স্বভাবের।
“এলাম দেখে কিছু মনে কর নি তো?”
“কি মনে করব? বসো ওখানটায়।”
চেয়ারের অপর পাশে বসেছে উষশী। মেয়েটি হাতের জাদু তৈরিতে ব্যস্ত। পাশে বসে আছে কোকো। প্রাণীটা সার্বক্ষণিক ওর সাথেই থাকে বুঝি। লাবণ্যকে চিনতে অসুবিধা হয় নি কোকোর। প্রাণীটা কেমন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। কি যে মায়া হলো লাবণ্য’র। সে উঠে এসে কোলে তুলে নিল।
“তুই তো বুড়ো হয়ে গেছিস রে কোকো।”
“বুড়ো হয় নি আপু। শুধু ওর বয়স বৃদ্ধি পেয়েছে।”
উষশী’র মুখে আপু ডাকটা সুন্দর লাগছে। লাবণ্য উষ্ণ শ্বাস ফেলল। কোকোর শরীরে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,”সেটা তো দেখতেই পাচ্ছি। শুধু কোকো নয় তুমিও বেশ বড়ো হয়ে গিয়েছ উষশী।”
“অথচ তুমি বদলাও নি। বরং আরও বেশি সুন্দরী হয়ে গিয়েছ। বয়স যেন থমকে গেছে।”
কথাতে বিদ্রূপ ছিল না কি লাবণ্য জানে না। তবে উষশী’র দিকে তাকিয়ে ওর মুখটা মলিন হয়ে এল। উষশী একটিবার ও তার দিকে নজর দিচ্ছে না।
“একটু সময় হবে?”
“হুম। শুনছি তো।”
“একটু আলাদা সময় কাটাতে চাচ্ছি। এখানে নয়।”
“ঠিক আছে। ঐদিকটায় চলো।”
উষশী নীরবতার সহিত হেঁটে চলেছে। লাবণ্য ও তাই। দুজনের এই নীরবতা ভাঙল কোকো। প্রাণীটার ক্ষিধে পেয়েছে।
“তুমি একটু থাকো। আমি আসছি।”
কথা ফুরোতেই মিলিয়ে গেল উষশী। লাবণ্য ঘুরে দেখল চারপাশ। বেশ সুন্দর বাড়িটা। উষশী যতক্ষণে ফিরল ততক্ষণে সময় ফুরিয়ে গিয়েছে। লাবণ্য ভুলে বসেছিল মিটিং এর কথা। উষশী’র হাতে কফি কাপ।
“অন্য একদিন আসব। আজ সময় নেই উষশী।”
“ঠিক আছে।”
লাবণ্য চলে গেলে আগের জায়গায় এসে দাঁড়াল উষশী। সেদিন লাবণ্য’র সাথে ওমন আচরণ করার পেছনে একটাই রহস্য। সেটা হচ্ছে অভিরাজ। মেয়েটি খুব করে ভেবেছিল তার সেই আচরণ দেখে অভি বুঝি তাকে ঘৃণা করবে। কিন্তু তেমন কিছুই ঘটে নি। উল্টো কতটা যত্ন নিয়ে এসেছিল। সেদিন বৃষ্টির মাঝে অভি’র শরীরের উষ্ণতা গুলো খুব করে মনে হতে লাগল। খানিক বাদেই সেই ভালো লাগাটা মিলিয়ে গিয়ে ছড়িয়ে পড়ল এক নীল ব্যথা।
অভি’র সাথে উষশী’র দূরত্ব যেন কিছুতেই যাচ্ছে না। সারাদিন কাজ করে অভি যখন ফিরে তখন খুব রাত। তবু সে মেয়েটির বাড়ির আশেপাশে ঘুরঘুর করে। অথচ এ বাড়িতে কে কে আছে সে জানে না। কখনো ইচ্ছেও করে না। অনেকটা অদ্ভুত হয়ে গিয়েছে সে। বলা চলে ভালোবাসায় অন্ধ। উষশী’র প্রতি যে গভীর টান রয়েছে সেই টানের বিপরীতে কোনো বাজে কল্পণা মাথায় আসে না। এমন কি মেয়েটির সব ধরণের আচরণ খুব সহজে মেনে নেয়। এসব কতটা ঠিক সেটা প্রেমিক অভিরাজের মস্তিষ্ক মিলাতে পারে না। প্রতি রাতের মতো আজও এসেছে অভিরাজ। উষশী’র বাড়ির কাছে বিশাল এক সিলভাটিকা গাছ। সেই গাছে নীল রঙের ফুল ফুটে আছে। সেখান থেকে কিছু ফুল তুলে নিয়েছে অভি। কল্পণায় গিয়ে মেয়েটির পিনাট বাটারের মতো চুলে সেই ফুল গুজে দিয়েছে। উষশী তখন লাজুক হেসে বলছে,’এত ভালোবাসেন কেন বলেন তো।’
ভাবনার অন্তিমক্ষণে এসে বৃষ্টির জল অনুভব করল অভিরাজ। হুট করেই ভীষণ বৃষ্টি হতে শুরু করেছে। সেই বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছে সমস্ত শরীর। উষশী’র বাড়ির দিকে তাকাতেই মেয়েটির দেখা মিলল। যে মেয়েটি বৃষ্টি দেখলেই ভেজার জন্য পাগল হয়ে যেত সেই মেয়েটা আজ নিরস ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে। বৃষ্টির জল গুনছে যেন। অভিরাজ ধীর স্থির ভাবে বাড়ির ভেতর প্রবেশ করল। উষশী ব্যলকনিতে দাঁড়িয়ে। তার দৃষ্টি প্রাণহীন। হাত নাড়িয়ে ডাকল অভিরাজ। তাতে সাড়া দিয়ে উষশী বলল,”আপনি এখানে কি করছেন?”
“তোমার জন্য এসেছি।”
“ভিজে যাচ্ছেন তো।”
“তুমিও আসো। একসাথে ভিজব।”
“চলে যান অভিরাজ।”
“তোমার সাথে কথা না বলে যাব না রেইন।”
এই নামে ডাকতেই উষশী’র শরীর কম্পিত হলো। মেয়েটি চট জলদি নেমে এল। তার বুকের ভেতরে ধীম ধীম আওয়াজ হচ্ছে।
“কি যে করেন আপনি।”
“কি করলাম।”
“এই রাতের আঁধারে ভরা বৃষ্টিতে চলে এসেছেন।”
“এটা নিশ্চয়ই নতুন নয়।”
“নতুন না হলেও সময় তো পেরিয়েছে।”
“তাতে কি যায় আসে?”
“অনেক কিছু যায় আছে।”
“কেমন?”
“তখন আমরা সম্পর্কে ছিলাম।”
“আর এখন?”
এ প্রশ্নের উত্তর মিলল না। উষশী কিছুটা এগিয়ে এসে অভিরাজের গালে স্পর্শ করল। মেয়েটির খুব কান্না পাচ্ছে।
“এভাবে দ্বিতীয় বার ভালোবাসায় আটকে ফেলবেন না অভিরাজ। সহ্য করার মতো শক্তি আমার নেই।”
“আমার ভালোবাসার সবটুকু উত্তাপ তোমার জন্য উষশী। বত্রিশ বছর বয়সেও একই ভাবে পাগলামি করতে পারি।”
“তবে আমি পারি না।”
“কেন পারো না?”
“কিশোরী নই এখন। যুবতী হয়ে গেছি।”
“সমস্যা কি তাতে?”
“জানি না। আজকের পর আর কখনো আসবেন না মিস্টার রাগি। এবার আমি শেষ হয়ে যাব।”
মেয়েটির চোখের জল বৃষ্টির জলের সাথে মিশে যেতে লাগল। অভি’র যে কি হলো। সে তৎক্ষণাৎ কাছে টেনে নিল ওকে। আলতো হাতে পিঠে হাত বুলিয়ে বলল,”কিচ্ছু হবে না উষশী। সব ঠিক হয়ে যাবে। তুমি ভরসা রাখলে অভিরাজ চাঁদকেও মাটিতে এনে দিবে।”
উষশী একটা শব্দ ও করল না। এমনকি নড়ল ও না। বরং একই ভঙ্গিতে থেকে ছেলেটার শরীরের উষ্ণতা প্রাণ ভরে নিতে লাগল। তার ভেতরটা কেমন সতেজ হচ্ছে ক্রমশ। সুন্দর মুহূর্তটুকুর লোভ সামলাতে পারছে না। এত দুঃখ বেদনার মাঝেও হেসে উঠল মেয়েটি। যেই হাসির সাথে ধুয়ে যেত লাগল বিগত পাঁচ বছরের বেদনা।
তারপরের দিনের ঘটনা। হাতে সময় থাকাতে উষশী’র বাড়িতে এল লাবণ্য। মেয়েটিকে দেখে আগেরদিনের মতো খুশি হলো না উষশী। বরং একটা তাড়াহুড়ো দেখাতে লাগল। লাবণ্য সময় নিয়ে দেখল ওকে। সেই দৃষ্টি লক্ষ্য করেই উষশী প্রশ্ন ছুড়ল।
“কিছু বলবে?”
“একটা কথা তখন থেকে মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে।”
“কি?”
“তোমার বদল।”
“কেমন?”
“গতদিন কতটা সমাদর করেছিলে। আজ ই পাল্টে গিয়েছ। কোথাও যাচ্ছ নাকি?”
“না তো।”
“তোমার মম পাপা এখানেই থাকেন?”
“উহু।”
“তাহলে?”
“একাই থাকি।”
উষশী’র ভেতরটা কেমন আন্দোলন শুরু করেছে। সে যে ব্যস্ততা লুকাল তা বেশ ভালোই বুঝল লাবণ্য।
“ঘরে নিবে না উষশী? নাকি বাইরে থেকেই বিদেয় দিবে।”
“তেমন নয়। চলো,ভেতরে।”
উষশী’র বাড়িটা বেশ ভালোই বড়ো। এখানে একাধিক মানুষের বাস নেই। চারপাশ ঘুরেই সেটা বুঝতে পারল লাবণ্য। উষশী’র রুমের দেয়ালে অভিরাজের ছবি আঁকা। লাবণ্য সেগুলোতে হাত বুলিয়ে বলল,”অনেক দিন ধরে এগুলো করেছ?”
“হুম।”
“এর মানে অভি কে এখনো ভালোবাসো।”
কালো মেঘের ন্যায় বর্ণ ধারণ করল উষশী’র মুখটা। ওর এই রঙ পরিবর্তন দেখে লাবণ্য বলল,”অনেক বড়ো হয়ে গিয়েছ উষশী। তবে অভিজ্ঞতার দিক থেকে তোমার থেকে এগার বছরের বড়ো আমি।”
“এসব শুনতে ভালো লাগছে না আপু।”
লাবণ্য অন্যদিক ফিরে রইল। ঘরটা ভীষণ অগোছালো হয়ে আছে। উষশী’র অসহায় দুটো চোখ। অপরাধবোধ আর খারাপ লাগাটা বেড়েই চলেছে। ওর শারীরিক স্বাস্থ্যও কিছুটা ভালো নয়। সেটা লক্ষ্য করেছে লাবণ্য।
“তুমি কি অসুস্থ?”
“না তো।”
“কেমন মলিন দেখাচ্ছে।”
“ঘুম হয়নি গতরাতে। তাই এমন লাগছে।”
“এক কাপ কফি পেতে পারি?”
“হ্যাঁ নিশ্চয়ই।”
উষশী নিচে যেতেই বেডের উপর বসল লাবণ্য। তারপর কি মনে করে উঠে গেল। চারপাশ ভালো করে পরখ করে নিতেই একটা ভয়ঙ্কর সত্য ওর চোখে ধরা পড়ল। মৃদু আন্দোলিত হলো ওর শরীর। ঘোলাটে হয়ে এল চোখের দৃষ্টি।
চলবে….
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি
|নিশ্চয়ই এখন আমাকে গা লি দিবেন। তবে দুঃখের সাথে জানাই আমি এইচ এস সি পরীক্ষার্থী। আমার মডেল টেস্ট পরীক্ষা রানিং। গল্প বুধবার পাবেন ইনশাআল্লাহ।|