বৃষ্টিভেজা_আলাপন (৪১)

0
333

#বৃষ্টিভেজা_আলাপন (৪১)

“অভি কোথায় আছিস তুই?”

“শহর থেকে একটু দূরে আছি। কেন?”

“দ্রুত আয় প্লিজ।”

“কি হয়েছে লাবণ্য?”

“তুই প্লিজ আয়।”

“লাবণ্য আমাকে ফাইল গুলো সাইন করাতে হবে। আজকের পর আর সুযোগ পাব না।”

“অভি,উষশী।”

উষশী’র নাম শুনেই ধক করে উঠল বুক। অভি ঝটপট শুধাল,”উষশী’র কি হয়েছে? লাবণ্য কথা বলছিস না কেন? এই লাবণ্য।”

“তুই দ্রুত আয় প্লিজ।”

কল রেখে একটা বেঞ্চে এসে বসল লাবণ্য। তার শরীর আন্দোলিত হচ্ছে। মনে হচ্ছে সব কেমন ঘোলাটে। উষশী যে ড্রা গ নেওয়া শুরু করেছে এ বিষয়ে বিন্দুমাত্র ধারণা ছিল না। মেয়েটার শারীরিক অবস্থা দেখেও তেমন কিছুই বোঝা যায় না। মাঝে মধ্যে মদ্যপান করে এর রেশটুকু ও নেই। সব কেমন লাগছে। অভি আসতেই ছুটে এল লাবণ্য। ছেলেটার শরীর কাঁপছে। মনে হচ্ছে একটা ভয় ওকে পাগল করে তুলেছে।
“উষশী কোথায় লাবণ্য?”

“বাসায়।”

“কিন্তু কি হয়েছে?”

“তুই একটু শান্ত হয়ে বোস অভি।”

“শান্ত হতে পারছি না লাবণ্য। উষশী’র বাসায় যেতে হবে।”

কথা শেষেই ছুটতে লাগল অভিরাজ। পিছু নিল লাবণ্যও। কিন্তু সেখানকার চিত্র ভিন্ন। সেখানে বড়ো করে তালা ঝোলানো। গার্ড ও চলে যাচ্ছেন। ছুটে গিয়ে অভি পথ আটকালো।
“বাড়িটা তালা কেন দিলেন?”

“ম্যাম তো বাসায় নেই।”

“কোথায় গেছে?”

“জানা নেই। যাওয়ার আগে আমায় কিছু টাকা দিয়ে বলল এর পর থেকে আর কাজ করতে হবে না।”

“হুট করেই কোথায় চলে যাবে!”

অভি উন্মাদের মতো হয়ে গেল। কন্ট্রাক নাম্বার ও নেই। লাবণ্য’র শরীর কাঁপছে। চোখ দুটো প্রাণহীন।
“অভি।”

জবাব আসল না। এমনকি ঘুরেও দেখল না। রাজ্যের চিন্তা তার মস্তিষ্কে। মেয়েটা কি আবার পালিয়ে গেল?
“অভি আমার কথাটা শোন।”

“সময় নেই লাবণ্য। উষশীকে খুঁজতে হবে।”

“অভি শোন।”

শুনছে না অভিরাজ। তার ভেতরটা উত্তপ্ত হয়ে আছে। মনে হচ্ছে যত্ন নিয়ে খুড়ছে কেউ। দু চোখ ভেঙে কান্না আসছে। তবে পুরুষ মানুষের কাঁদতে নেই। ওদের হতে হয় পা ষা ণ।
“উষশী ড্রা গ নেয়।”

কণ্ঠটা কয়েকবার কানের এসে বাজতে লাগল। অভি’র পা থমকে গিয়েছে। লাবণ্য ফের চেচাল।
“ড্রাগ নেয় উষশী। ওর বাসা থেকে এগুলো পেয়েছি।”

কত গুলো প্যাকেট দেখাল লাবণ্য। অভি যেন স্তব্ধ হয়ে গেল। দু চোখের পাপড়ি গুলো অবধি নড়ছে না।
“এটা কি করে সম্ভব লাবণ্য? ওর আচরণে তো এমন কিছু নেই।”

“কারণ হতে পারে স্বল্পমাত্রায় নিয়মিত ব্যবহার করে থাকে। জানি না মেয়েটা এখন কোথায় চলে গেল। আমার খুব ভয় হচ্ছে।”

উষশী’র চিন্তাটা অভিরাজকে শক্ত করে তুলল। দেহ যেন প্রাণহীন হয়ে পড়েছে। মেয়েটার বাদামি রঙা চুলের কথা স্মরণ হলো। যেই চুলের মাদকে নিজের সবটা হারিয়ে বসেছে অভিরাজ।

আমিনা ভাত বসিয়েন। তরকারি রান্না করছেন মালতি। লতিফা বিরস হয়ে বসে আছেন। ছোঁয়া আর ঈশানের ব্যাপারটা জেনেছে সবাই। মালতি এই বিষয়ে টু শব্দটি করেন নি। বরাবরই চুপ তিনি। লতিফা’র দু চোখে কালি জমে গিয়েছে। ছেলেটা বাড়ি ফিরছে না কতদিন হলো। একটা মাত্র ভুলের জন্য ছেলে হারালেন তিনি। অনেক সময় ধরে চুপ ছিলেন আমিনা। এবার তিনি বলে উঠলেন।
“এখন তো কেঁদে লাভ নেই। আগে বোঝা দরকার ছিল। তাছাড়া ছেলের জন্য ছোঁয়া’র থেকে ভালো কাউকে পেতি? পেতি না। মানছি মেয়েটার কিছু সমস্যা আছে। তবে আল্লাহ চাইলে সব ঠিক হয়ে যায়। দেখলি তো ছোঁয়া ঠিকই সন্তানের মা হতে চলেছে।”

এত গুলো কথা বলেও তিনি আরও কিছু বলতে চাইলেন। মালতি হাত ধরে ইশারায় না করলেন। লতিফার থেকে একটি শব্দও শোনা গেল না। খানিক বাদে আমানের দেখা মিলল। ভদ্রলোক কয়েকদিন হলো দেশে ফিরেছেন। আজীবন টাকার পেছনে ছুটে গিয়েছেন। মেয়ের অসুস্থতার কথা শুনে না এসে পারেন নি। মালতি স্বামীকে চা এনে দিল। ভদ্রলোক চা কাপ রেখে বললেন,”সব গুছিয়ে নেও মালতি।”

“কোথাও যাবে তোমরা?”

চুলার পাওয়ার কমিয়ে দিয়ে ড্রয়িং এ এসে দাঁড়ালেন আমিনা। আমানের মুখে কালো মেঘের ছায়া। হুট করেই আমিনা’র মন কু গাইছে।
“আমরা চলে যাব বড়ো ভাবি।”

“চলে যাবে মানে?”

“অন্য বাসায় চলে যাব।”

“কি বলছো এসব?”

“যে বাড়িতে আমার মেয়ের জায়গাটা হয় নি সে বাড়িতে থাকতে পারব না বড়ো ভাবি। সবাই অনেক করেছেন আমাদের জন্য। আজীবন টাকার পেছনে ছুটেছি আমি। স্ত্রী সন্তানের প্রতি ঠিক ঠাক দায়িত্ব পালন করতে পারি নি। সবটা আপনারা দেখেছেন। এই ঋণ শোধ সম্ভব না। তবে ঋণ বাড়াতে চাচ্ছি না।”

মালতির দু চোখ ভরে উঠেছে। কয়েক বছর পূর্বে ছোঁয়ার কারণে পরিবারটা ভেঙে বসেছিল। ছোঁয়া বেশ কান্নাকাটি করেছিল। একটা সময় ছোঁয়া’র অনুভূতি সম্পর্কে জানতে পারেন মালতি। মেয়ের প্রতি বিতৃষ্ণা হয়েছিল। সেদিন মেয়ের গায়ে আ ঘা ত ও করেন। প্রথমত অলকের সাথে ওর প্রেমের বিয়ে। দ্বিতীয়ত বিয়ের পর অন্যের উপর অনুভূতি থাকাটা মহাপাপ। লতিফা আর আতিফ ও বিষয়টা জানতে পারেন। তাদের কাছে চক্ষু লজ্জায় পড়তে হয় মালতিকে। সেদিনই একটা সিদ্ধান্ত নেন তিনি। বাড়ি ছেড়ে চলে যান। ঈশান তখন বেপরোয়া ভাবে চলাফেরা করছে। এদিকে লাবণ্য’র অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। একটা রাগ ক্ষোভ থেকেই লতিফা আর আতিফও বাড়ি ছাড়া হয়। কেমন করে যেন পরিবার টা ভেঙে গিয়েছিল। আর তারপর যখন সবটা ঠিক হলো তখন এই সত্যটা উঠে এল। এরপর এ বাড়িতে থাকা আসলেই সম্ভব না। ছোঁয়া’র সাথে যে অন্যায়টা হয়েছে তার কোনো ব্যাখা হয় না।

তিনটা রাত অভি’র চোখে ঘুম নেই। ঘুম নেই লাবণ্য’র চোখেও। মেয়েটিকে বদ্ধ পাগলের মতো খুঁজে চলেছ ওরা। আশে পাশের সব জায়গায় খোঁজ করা হয়েছে। এর মধ্যে একটা খবর এল। খবরটা বার দূর্ঘটনার। বেশ বড়ো সড়ো ক্ষতি হয়েছে। অনেক গুলো মানুষের জান গিয়েছে। সেই থেকে অভি’র হৃদয়টা ঠিক নেই। কারণ কয়েক ঘন্টা আগের সেই বার ফুটেজে উষশী’র দেখা মিলেছে। লাবণ্য থেকে থেকে কেঁপে উঠছে। ওর উপর যে কি চাপ যাচ্ছে। একদিকে ছোট ভাইয়ের খোঁজ নেই। অন্যদিকে পরিবারের সমস্যা গুলো। এখন আবার অভিরাজ। সব মিলিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে সে। তবু অভিকে একা ছাড়ছে না। কয়েক ঘন্টার ড্রাইভিং শেষে ঘটনাস্থলে পৌছাল ওরা। অভি’র শরীর কাঁপছে। চোখ দুটো ঘোলাটে হয়ে গিয়েছে। ফ্যাকাশে হয়েছে মুখশ্রী।
“উষশী ঠিক আছে অভি।”

লাবণ্য’র ভরসাটুকু কাজে দিচ্ছে না। মস্তিষ্ক পজেটিভ চিন্তা ধরে রাখতে পারছে না। অন্তর ‘কু’ গাইছে। মনে হচ্ছে সবটা শেষ হতে চলেছে। পেয়ে হারানোর ব্যাথা অভিরাজকে দগ্ধ করে যাচ্ছে। সামনে থেকে ভেসে আসছে কান্নার আওয়াজ। চারপাশ মাতম তুলেছে যেন। ঝাপসা হয়ে আসে চক্ষু দৃষ্টি। লাবণ্য অভি’র হাতটা শক্ত করে ধরে রেখেছে।
“আমাদের ভেতরে যেতে হবে।”

ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও ভেতরে যেতে পারল না ওরা। পুলিশ জনগনকে সামলাতে পারছে না। এত ভীড় জমায়েত হয়েছে চারপাশে! এদিকে উত্তপ্ত অভিরাজের দেহ। সে স্থির থাকতে পারছে না। লাবণ্য বার বার ভরসা দিচ্ছে। অথচ সেসব কিছুই কাজে লাগছে না। একটু ফাঁক পেতেই জায়গাটায় ঢুকে গেল অভিরাজ। ওর পিছু ছুটছে লাবণ্যও। বি স্ফো রণে চারপাশ ধসে গিয়েছে। চারপাশে ইট কংক্রিটের স্তুপ। পো ড়া গন্ধে বমি আসার মতো অবস্থা। থেকে থেকে অভি’র ভেতরটা আতকে উঠছে। সে খুব করে চাইছে এখানে উষশী না থাকুক। মেয়েটা ওর থেকে বহু দূরে চলে যাক তবু ঠিক থাকুক। বেঁচে থাকুক। বারের ভেতরে এখনো আগুন মাথা তুলে দাঁড়িয়ে। দুটো ছেলেমেয়েকে ভেতরে চলে যেতে দেখে মানুষ চেচাচ্ছে। লাবণ্য দেখল অভি তার থেকে বেশ এগিয়ে আছে। আর যে দিকে যাচ্ছে সেদিকের অবস্থা বিশেষ ভালো নয়। যেকোনো সময় ধস নামবে।
“আর যাস না অভি।”

কণ্ঠটা কানে পৌছালেও খেয়াল নেই অভিরাজের। সে শুধু উষশীকে খুঁজে চলেছে। একটু পর পর আগুনের বড়ো বড়ো স্তুপ জ্বলছে। লাবণ্য’র বুকের ভেতর ছ্যত করে উঠল। সে বার বার চেচাচ্ছে। তবে শুনছে না অভিরাজ। ওর ধ্যান জ্ঞান সব হারিয়ে গেছে। ভেতরে চলে এসেছে অভিরাজ। চারপাশ থেকে ধোঁয়া আসছে। কাশি উঠে গেল ওর। কাশতে কাশতে নজরে এল কোকোকে। প্রাণীটা মেঝেতে পড়ে আছে। শরীরে র ক্তে র দাগ। অভি ছুটে গিয়ে ধরল ওকে।
“কোকো, কোকো কি হয়ে গেল তোর।”

প্রাণীটার খুব কষ্ট হচ্ছে। সে তবু মিউ শব্দটা উচ্চারণ করল। অভি’র পুরো শরীরে শোক লেগে গিয়েছে। কোকো কে বুকে জড়িয়ে আছে সে। উষশীকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। সে কি করবে বুঝতে পারছে না। পা চলছে না। দু চোখে টলমল করছে অশ্রু। কোকোর আর্তনাদ কানে পৌছাচ্ছে। বাঁচবে কি না জানা নেই। এক আকাশ সম কষ্ট নিয়ে কোকো কে নিয়ে বের হবে ওমন সময় মেঝেতে অবিন্যস্ত ভাবে ছড়িয়ে থাকা বাদামি চুল গুলো নজরে এল।

চলবে…
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি

| গল্পটা আর মাত্র কিছু পর্ব হবে। অভিশী জুটিটা নিয়ে কিছু অনুভূতি জানিয়ে যাবেন। |

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here