#শেষটা_সুন্দর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৪৪।
ঘড়িতে ঠিক বারোটা বাজছে। রিতা তখন থেকে খাবার টেবিলে বসে আছে। যদিও সে যা করছে সব তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে। শুধু খালা তাকে দিয়ে জোর করিয়ে এসব করাচ্ছেন। তবে বসে থাকতে থাকতে বর্তমানে তার ভীষণ খিদে পেয়েছে। কিন্তু, খালা বলেছেন সাদরাজ আসলে তার সঙ্গে একসাথে খাওয়ার জন্য। এইদিকে আবার তার ঘুমও পাচ্ছে খুব। রিতা বারবার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে। বারোটার উপরে বাজে, এখনো লোকটা আসছে না কেন? খালা বলে নিজেও গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছেন। সেও এবার বিরক্ত হয়। আর অপেক্ষা করতে পারবে না। রিতা খাবার বেড়ে খেতে আরম্ভ করে। তার খাবার খাওয়াও শেষ হয়ে যায়। বারোটা ত্রিশ বাজে। সাদরাজের আসার এখনো কোনো নাম গন্ধ নেই। রিতা তখন আর বসে না থেকে সব খাবার ঘুরে রেখে তার শোয়ার রুমে চলে যায়।
ভাবে শুয়ে শুয়ে আরেকটু অপেক্ষা করবে। কিন্তু সে শুতে শুতেই প্রচন্ড ঘুমে চোখ ভরে আসে তার। আর তার কিছুক্ষণের মধ্যে সে ঘুমিয়েও পড়ে।
হঠাৎ টের পায়, সে নিশ্বাস ফেলতে পারছে না। কিছু একটা ঝাপ্টে জড়িয়ে ধরে আছে তাকে। তার অস্বস্তি হচ্ছে। সে চোখ মেলে তাকায়। রুমটা অন্ধকার। সে ভালোভাবে খেয়াল করতেই দেখল সাদরাজ তার বুকের উপর মাথা রেখে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে আছে তাকে। রিতা যে একটু নড়বে সেই সুযোগও নেই। সে সাদরাজকে সরানোর চেষ্টা করে। কিন্তু তাকে এক চুল নড়ানোর শক্তিও তার গায়ে নেই। পরে সে বিরক্ত হয়ে ওভাবেই ঘুমিয়ে পড়ে।
___________
দরজার ঠকঠক শব্দে মেহুলের ঘুম ভাঙ্গে। উঠে বসে ঘড়িতে দেখে সাতটা বাজে। এত সকালে কে এলো। সে বড়ো একটা হাই তুলে চোখ মুখ কঁচলে দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। গিয়ে দেখে দু’টো মেয়ে দাঁড়ান। মেয়ে দুটো তাকে দেখে সালাম দেয়। মেহুল তাদের চিনতে পারে না। তখন পেছন থেকে তার শাশুড়ি এসে বলেন,
‘ওরা পার্লার থেকে এসেছে, তোমাকে সাজাতে।’
মেহুল বলে,
‘ওহ আচ্ছা। আপনারা ভেতরে এসে বসুন। আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।’
দশটা বাজে। মেহুলের সাজ প্রায় শেষের দিকে। মেহুল ভাবছে, এত সকালে সেজে তার কী লাভ। অনুষ্ঠান তো শুরু হবে আরো দু ঘন্টা পর। এই দু ঘন্টা তাকে এভাবেই পুতুল সেজে বসে থাকতে হবে। এইদিকে আবার তার প্রচন্ড খিদেও পেয়েছে। কেউ তাকে একটু খাবারও এনে দিচ্ছে না। রাবীরও যে সকাল থেকে কোথায় কে জানে। একটা পার্লারের মেয়ে তখন বলল,
‘ম্যাম, লিপস্টিকটা দেওয়ার আগে আপনি কিছু খেয়ে নিন। পরে না হয় অসুবিধা হবে।’
মেহুল তখন ভাবছে সে এখন খাবারের জন্য কাকে ডাকবে। পরে ভাবতে ভাবতেই দেখে যে তার শাশুড়ি মা খাবার নিয়ে এসেছেন। তিনি এসে বলেন,
‘নিচে পরিচিত পরিজনরা অনেকেই চলে এসেছেন তো তাই উনাদের নাস্তা পানির ব্যবস্থা করতে গিয়ে তোমার জন্য নাস্তা আনতে লেইট হয়ে গিয়েছে।’
মেহুল মৃদু হেসে বলে,
‘সমস্যা নেই মা।’
মেহুল বিছানায় বসে। শাশুড়ি মা খাবারের প্লেটটা তার সামনে রাখেন। মেহুল হাতটা খাবারের কাছে নিতেই তিনি দেখে বলেন,
‘আরে তোমার হাত নষ্ট হবে। দাঁড়াও, আমি খাইয়ে দিচ্ছি।’
পরে তিনিই খুব যত্ন করে মেহুলকে খাইয়ে দেন। খাওয়ানো শেষ করে পানি খাইয়ে মুখ মুছে দিয়ে তিনি চলে যান। মেহুল মনে মনে খুব শান্তি পায়। মায়ের পর প্রথম উনার হাতে খেয়েই সে এত তৃপ্তি পেয়েছে।
__________
মেহুল সেন্টারে গিয়ে দেখে পুরো সেন্টার মানুষে গিজগিজ করছে। এত মানুষ! মেহুলের যেন ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে। কিন্ত সেই অস্বস্তি মুহুর্তেই ফুস হয়ে যায় যখন সে রাবীরকে তার দিকে এগিয়ে আসতে দেখে। রাবীর তার শাড়ির সাথে ম্যাচিং করে একটা কালো রঙের পাঞ্জাবী পরেছেন। সাদা রঙের পর আবার এই কালো রঙেও মারাত্মক লাগছে তাকে। সে এসে মেহুলের হাত ধরে তাকে নিয়ে স্টেজে যায়।
অনেক মানুষের ভীড়ে মেহুল তার পরিচিত মুখগুলোকে খুঁজছে। তার পরিবারের মানুষরা এখনো আসেনি। আর রিতা সেও কেন এখনো আসছে না কে জানে।
একে একে সব মেহমান চলে আসেন। সবাই মেহুল আর রাবীরের সাথে ছবি তুলছেন। মেহুলের মা বাবা সহ আরো কিছু আত্মীয়স্বজন এসেছেন। কিন্তু রিতা এখনো আসছে না। মেহুল চিন্তায় পড়ে। রিতার সাথে কি আজকেও তার কথা হবে না?
সবাই মেহুল আর রাবীরকে খাবার টেবিলে বসতে বলছে। কিন্তু, মেহুল এখনই বসতে চাইছে না। সে রাবীরের দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করে,
‘সাদরাজ আহমেদ কি রিতাকে নিয়ে আসবেন না?’
‘আসবে। আমি যখন বলেছি তখন ও অবশ্যই আসবে।’
আর সত্যিই তাই হয়। সাদরাজ রিতাকে নিয়ে সেখানে হাজির হয়। রিতাকে দেখে মেহুল উঠে দাঁড়ায়। সাদরাজ তার ওয়াইফকে সবটুকু দিয়ে সাজিয়ে এনেছে। আর সত্যি রিতাকেও কোনো অংশে মেহুলের চেয়ে কম সুন্দর লাগছে না। রিতা এসেই মেহুলকে জড়িয়ে ধরে। মেহুলও জড়িয়ে ধরে তাকে। সাদরাজ এগিয়ে হেসে রাবীরের দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়। রাবীরও তখন বাঁকা হেসে তার সাথে করমর্দন করে। রাবীর বলে,
‘তোমাদের দেখে খুশি হয়েছি।’
‘তুমি বলেছ আর না এসে পারা যায়?’
‘হ্যাঁ জানি, আমার কথা তুমি কোনো সময়ই ফেলতে পারো না।’
‘বুঝতে হবে। আমার একমাত্র প্রিয় শত্রু। তার কথা আমি কীভাবে ফেলি, বলো?’
সাদরাজ তখন রিতার দেখে চেয়ে বলে,
‘রিতা, চলো আমরা ওদের সাথে একটা ছবি তুলে আজকের দিনটাকে স্মরণীয় করে রাখি।’
তারা চার জন ছবি তুলে। সাদরাজকে এখানে দেখে রাবীরের দলের লোকেরা খুব অবাক হয়। অনেকে আবার তার বউকে দেখেও খুব অবাক হচ্ছে। আর সবার আগ্রহ কমাতে রাবীর তখন একটা মাইক নিয়ে সবার সামনে বলে,
‘উপস্থিত সবাইকে আমি আরেকটা সুখবর দিতে চাই। এই যে আমার পাশে দাঁড়ান সাদরাজ আহমেদ, আমার সবথেকে বড়ো কম্পিটেটর। কিন্তু, বর্তমানে সে আমার খুব কাছের একজন আত্মীয় হয়ে উঠেছে। কারণ সে আমার ওয়াইফের একমাত্র বেস্টফ্রেন্ডকে বিয়ে করেছে। আর তাই আপনারা সবাই ওদের নতুন জীবনের জন্য অনেক অনেক ভালোবাসা জানাবেন। যেন আমাদের মতো ওরাও খুব সুখী দম্পতি হয়ে উঠতে পারে। তাই না?(সাদরাজের দিকে চেয়ে)’
সাদরাজ হেসে বলে,
‘অবশ্যই।’
রাবীর পরে মাইকে রেখে বলে,
‘সাংবাদিক এসেছে। যাও, ওদের মুখোমুখি হও।’
সাদরাজ বলে,
‘ওদের মুখোমুখি হওয়ার জন্যই তো আমি এখানে এসেছি। রিতা, চলো।’
সাদরাজ রিতাকে নিয়ে সাংবাদিকদের কাছে যায়। তাদের নানান প্রশ্নের সে এক এক করে জবাব দিতে থাকে। রিতার এসব ভালো লাগছে না। তার তো মেহুলের সাথে কথা বলা জরুরি। সে মেহুলের দিকে তাকায়। মেহুল তাকে ইশারা দিয়ে সেখান থেকে চলে আসতে বলে। কিন্তু রিতা ভাবছে এখান থেকে সে কীভাবে যাবে। সাদরাজ তো তাকে যেতে দিবে না। তাও সে একবার ট্রাই করল। সাদরাজের দিকে চেয়ে হেসে বলল,
‘সাদরাজ, তুমি উনাদের সাথে কথা বলো। আমি একটু মেহুলের সাথে কিছু সিংগেল ছবি তুলে আসি।’
এই বলে সে আর না দাঁড়িয়ে দ্রুত সেখান থেকে সরে আসে। সাদরাজ তাকে তখন আটকাতে পারে না। সাংবাদিকরা তাকে এমন ভাবে ধরে রেখেছে যে চাইলে সেখান থেকে এখন বেরুতে পারবে না। রিতা মেহুলের কাছে ছুটে আসে। মেহুল তার হাত ধরে রাবীরের দিকে চেয়ে বলে,
‘আমরা ঐদিকে যাচ্ছি। আপনি সাদরাজকে সামলে নিয়েন।’
‘আচ্ছা, যান।’
রিতাকে নিয়ে মেহুল দ্রুত একটা ফাঁকা রুমে যায়। রুমে গিয়েই দরজা আটকে দেয় সে। রিতার দিকে চেয়ে বলে,
‘দোস্ত, দ্রুত আমাকে সবকিছু বল। কেন তুই সাদরাজকে বিয়ে করেছিস? উনি তোকে কী জন্য বিয়ে করেছে? সব বল আমায়।’
রিতা ঢোক গিলে বলে,
‘উনি আমায় কেন বিয়ে করেছেন জানি না। তবে আমি উনাকে বিয়ে করেছি সিয়ামকে বাঁচাতে। সেদিন পার্লারে একটা নাম্বার থেকে কল আসে। বলে যে, আমি যদি এক্ষুনি তাদের বলা এড্রেসে না যায় ওরা নাকি সিয়ামকে মেরে ফেলবে। ওরা সিয়ামের হাত পা বাঁধা একটা ভিডিও পাঠায়। আর সেটা দেখে আমি ভয়ে দ্রুত সেখানে চলে যায়। আর তারপর সেখানে গিয়ে সাদরাজ আমাকে জোর করে সিয়ামকে মেরে ফেলার ভয় দেখিয়ে বিয়ে করে। তবে উনি যে আমাকে কোনো খারাপ উদ্দেশ্যে বিয়ে করেছেন সেটা আমি বেশ বুঝতে পারছি।’
মেহুল তখন শক্ত গলায় বলে,
‘তুই এই কথাগুলো পুলিশের সামনে বলবি। আমি রাবীরের সাথে কথা বলছি।’
রিতা তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে,
‘না না, আমি পুলিশের সামনে কিচ্ছু বলব না।’
‘কেন? ভয় পাচ্ছিস? ভয় পাস না দোস্ত। আমরা সবাই আছি তোর সাথে।’
‘না মেহুল, উনাকে পুলিশে ধরিয়ে দিলে কোনো লাভ হবে না। বরং উনার আর রাবীর ভাইয়ার সম্পর্কটা ঠিক করতে হবে।’
‘রাবীর আর উনার সম্পর্ক জীবনেও ঠিক হবে বলে তোর মনে হয়? উনাদের সাপে নেউলে সম্পর্ক। এই সম্পর্ক কখনোই ঠিক হবে না।’
‘হবে। অবশ্যই হবে। তুই হয়তো জানিস না, উনারা দুজন একসময় বেস্ট ফ্রেন্ড ছিল।’
মেহুল চমকে বলে,
‘কী!’
চলবে….